কাদিয়ানী সম্প্রদায় কেন মুসলমান নয়-৩
কাদিয়ানীদের পাশে সুশীল সমাজ!
‘রৌশ্নি’ নামক একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশিত হয় কাশ্মীর থেকে। পত্রিকাটির ১৯ অক্টোবর ’৭১ ঈসায়ী সংখ্যা আমার হাতে রয়েছে। উর্দু ডাইজেস্ট ‘শবিস্তানে দিল্লীতে’ প্রকাশিত সাংবাদিক ফারক্লীতের একটি নিবন্ধ পুনর্মুদ্রিত হয়েছে ‘রৌশ্নি’র এ সংখ্যায়।
লেখক সেখানে কাদিয়ানীদেরকে অমুসলিম আখ্যায়িত করা না করার বিষয়ে ‘সুশীল সমাজের’ ভাবনাগুলো তুলে ধরেছেন। নিবন্ধের উদ্দেশ্য সম্পর্কে লিখেছেন, (তাদের মাঝে ‘কাদিয়ানী সম্প্রদায়কে মুসলিম আখ্যায়িত করার ব্যাপারে) ‘বিশিষ্ট নাগরিকদের পরামর্শগুলো’ আমি একত্রিত করে দিয়েছি, যেন আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর অনুসারী আলেমগণ এ বিষয়ে নতুন করে ভাবতে পারেন। আর যদি পরামর্শগুলো ভুল হয়ে থাকে, তাহলে যেন যথাযথভাবে এগুলো খন্ডন করেন এবং তাদের মাঝে যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে তা দূর করতে সচেষ্ট হন।’
অবশ্য লেখক এসমস্ত ধারণাকে তার নিজের বক্তব্য মনে না করার জন্যও পাঠকের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন।
কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, ধারণাগুলির সঙ্গে সাংবাদিক সাহেব যদি একমত না-ই হন, তাহলে তিনি নিজেই কেন তার উত্তর দিলেন না। তাঁর সম্পর্কে দীর্ঘদিনের জানাশোনা অনুযায়ী আমাদের বিশ্বাস, তাঁর মতো বিজ্ঞজনের পক্ষে ঐ অসার বক্তব্যগুলো খন্ডন করা কোনো বিষয়ই ছিলো না। কিন্তু তিনি সুশলীদের ধারণাগুলো প্রচার করলেও তার উত্তর দানে বিরত থাকলেন। ফলে দায়িত্ব পড়লো অন্যদের উপর।
যাইহোক, নিবন্ধটিতে ‘কাদিয়ানী সম্প্রদায় মুসলমান নয় কাফের; আলেমগণের সর্বসম্মত এই ফতোয়াকে গলত ঠাওরানোর চেষ্টা করা হয়েছে এবং এর জন্য আজব আজব ‘দলিল-প্রমাণ’ হাজির করা হয়েছে। যেমন,
প্রথম দলিল : সবচে শক্তিশালী ভেবেই বোধয় এটাকে সবার আগে স্থান দেয়া হয়েছে, (‘বৃটিশ আমলে) যখন খেলাফত আন্দোলন চলছে, তখন প্রশ্ন উঠেছিলো, একজন মুসলমানের সংজ্ঞা-পরিচয় কী হবে? কাকে মুসলমান বলবো আর কখন একজনকে মুসলমান ভাববো? সে সময় দীর্ঘ আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হয় যে, আমরা তাকেই ‘মুসলিম সদস্য-’ বলবো, যে নিজেকে মুসলমান মনে করে এবং মুসলমান বলে পরিচয় দেয়- এই কথার উপর সেসময় অধিকাংশ আলেম একমত হয়েছিলেন।’
সাংবাদিক সাহেব ‘সুধীসমাজের’ এই উদ্ধৃতি উল্লেখের উপযুক্ত ভাবলেন কীভাবে সেটা বড় বিস্ময়ের ব্যাপার। এই উদ্ধৃতির সোজাসাপটা অর্থ তো হলো, আকিদা-বিশ্বাস যাই হোক, মুসলিম হওয়ার জন্য নিজেকে মুসলিম মনে করা বা মুসলিম বলে পরিচয় দেয়াই যথেষ্ট! আর কিছুর দরকার নেই!!
কোনো আকলমন্দ আলেমের পক্ষে এমন মূর্খোচিত কথা বলা সম্ভব?
আবু জাহল আবু লাহাবসহ আরবের কাফের-মুশরিক এবং ইহুদী-খৃস্টানদের প্রতি নবীজীর দাওয়াত কি শুধু এটুকুই ছিল যে, আকিদা যেমনই হোক, তোমরা কেবল নিজেদেরকে মুসলিম বলে পরিচয় দাও! ব্যস, তোমরা মুসলমান! এটুকুই ছিলো নবীজীর দাওয়াত? কোরআনও কি বলে, তোমরা নিজেদেরকে শুধু মুসলিম বলবে, এতেই তোমরা মুসলিম বান্দা এবং জান্নাতী বলে গণ্য হবে?
খেলাফত আন্দোলনে যে সকল ওলামায়ে কেরাম অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন, মুফতী কেফায়েতুল্লাহ, আব্দুল বারী ফিরিঙ্গী মহল্লী, আমীরে শরীয়ত মাওলানা মুহাম্মাদ সাজ্জাদ প্রমুখসহ দেওবন্দ ও বদায়ুনের আলেমগণের কারো ব্যাপারেই কি ধারণা করা যায় যে তিনি বলেছেন, শরঈ অর্থে এবং হাকীকতে মুসলিম হওয়ার জন্য নিজেকে মুসলমান বলাই যথেষ্ট, আকিদা-বিশ্বাসের কোনো বালাই নেই?
এতো আলেমদের ব্যাপারে নিকৃষ্টতম অপবাদ ছাড়া কিছুই নয়। কারণ উপরে যাদের নাম নেয়া হলো, তাঁদের প্রায় সবাই তাদের বিভিন্ন লিখনী ও ফতোয়াতে কাদিয়ানীদেরকে অমুসলিম বলে আখ্যায়িত করে গেছেন। (গ্রামে-গঞ্জে, হাটে-বাজারে তারা কাদিয়ানীদের কুফুরী আকিদার ব্যাপারে জনগণকে সতর্ক করে গেছেন।)
হাঁ, উদ্ধৃতিটুকুর অর্থ এই হতে পারে যে, খেলাফত কমিটি বা মুসলিম লীগের নীতি ছিলো, ‘যেই তাদের নিকট নিজেকে মুসলমান বলে পরিচয় দেবে- (তার আকিদা-বিশ্বাস যাই হোক)- তাকে তারা মুসলিম ধরে নিবে এবং দলের সদস্য বানিয়ে নেবে। (কারণ কে কী আকিদা-বিশ্বাস পোষণ করে, তার খোঁজ-খবর নেয়া তাদের পক্ষে সম্ভব নয়।)’
রাজনৈতিক দলের এই নীতি থেকে কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের ইসলাম ও কুফরের মাসআলা কত ভিন্ন! আমরা পূর্ণ আস্থার সঙ্গে বলছি, উপমহাদেশের সমস্ত হক্কানী আলেম, যারা দ্বীনের বিষয়ে গভীর প্রজ্ঞা রাখেন, মির্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী এবং তাঁর অনুসারীদের আকিদা-বিশ্বাস সম্পর্কে যাদের পূর্ণ অবগতি রয়েছে, তাঁরা খেলাফত আন্দোলনের পূর্বে যেমন কাদিয়ানীদের কাফের হওয়ার ব্যাপারে একমত ছিলেন, খেলাফত আন্দোলনের পরও তারা একমত যে, এ সম্প্রদায় নিজেদেরকে ‘আহমদিয়া মুসলিম’ বললেও নিজেদের কুফরী আকিদা-বিশ্বাসের কারণে শরীয়তের দৃষ্টিতে মুসলমান নয়। তারা ইসলামের গন্ডিবহির্ভূত অপরাপর ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মতো ভিন্ন একটি সম্প্রদায়। উদাহরণস্বরূপ কয়েকজন আলেমে রববানীর নাম লিখছি, যাদের কেউই
এখন আর (ডিসেম্বর ’৭৪ ঈসায়ী) দুনিয়াতে নেই।
* শাইখুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদ হাসান দেওবন্দী রাহ. (মৃ. ১৯২০ ঈ.)
* হাকীমুল উম্মত আশরাফ আলী থানুবী রাহ. (মৃ. ১৯৪৩ ঈ.)
* মাওলানা মুহাম্মদ আলী মুঙ্গেরী রাহ. (মৃ. ১৯২৭ ঈ.)
* মাওলানা মানাযের আহসান
গীলানী রাহ.
* মুফতী কেফায়েত উল্লাহ দেহলবী রাহ. (মৃ. ১৯৫২ ঈ.)
* আমীরে শরীয়ত মাওলানা মুহাম্মাদ সাজ্জাদ রাহ. (মৃ. ১৯৫৬ ঈ.)
এই সকল আলেমে দ্বীনকে যারা চেনেন, তারা কখনো বলতে পারবেন না, এঁরা ‘কাফের’ ফতোয়া দেয়ার ক্ষেত্রে অসতর্ক বা অদূরদর্শী ছিলেন কিংবা তাঁদের খোদাভীতি কম ছিলো।
শেষোক্ত দুইজনকে আলোচ্য নিবন্ধের লেখক তো কাছ থেকেই দেখার সুযোগ পেয়েছেন! তিনিই সাক্ষ্য দিতে পারেন, ‘তাকফীর’ (কাফের ফতোয়া দেয়া) -এর মতো গুরুত্বপূর্ণ এবং ঝুকিপূর্ণ মাসআলা বলার ক্ষেত্রে তাঁদের খোদাভীতি ও সতর্কতা কোন স্তরে উন্নীত ছিল।
আর এ সকল আলেমে দ্বীনের ৫০/৬০ বছর পূর্বে লিখিত কিতাবাদিও বিদ্যমান রয়েছে। তাতে মির্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী ও তাঁর অনুসারীদেরকে কাফের বলা হয়েছে। তখন থেকে উপমহাদেশের সমস্ত হক্কানী আলেম এই মাসআলায় একমত পোষণ করে আসছেন। এবং সেই ভিত্তিতে পাকিস্তানের আলেমগণ সরকারের নিকট কাদিয়ানীদেরকে অমুসলিম ঘোষণার দাবি জানিয়েছেন। পাকিস্তান সরকার যে ফায়সালা করেছে, সেটা সাংবাদিক সাহেব ও তার সহগামী ‘সুশীল সমাজের’ নিকট যেমনই লাগুক, কুরআন-সুন্নাহর সিদ্ধান্ত এবং আলেমগণের ঐকমত্যের সঙ্গে খুবই সঙ্গতিপূর্ণ।
সাংবাদিক ফারক্লীত সাহেব তার নিবন্ধের শেষে সুশীল সমাজের একটি লিখিত বক্তব্য হুবহু নকল করেছেন। এতে ইসলাম ও কুফরের পার্থক্যের বিষয়ে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি আরও সুস্পষ্টরূপে ধরা দিয়েছে। ভারতীয় সংবিধানের একটি ধারাকে মুসলিম সরকার ও আলেমগণের জন্য আদর্শ নমুনা হিসাবে তুল ধরে লিখেছেন, ‘ভারতীয় সংবিধানে সমস্ত হিন্দু ধর্মীয় উপগোষ্ঠীকে ‘হিন্দু’ বলে মেনে নেয়া হয়েছে। এর ফলে (‘হিন্দুত্ব’ নিয়ে উপগোষ্ঠীগুলোর) পারস্পরিক বাদবিসম্বাদের অবসাদ ঘটেছে। আইনের দৃষ্টিতে এখন শুধু আর্যসমাজী ও সনাতনীরাই হিন্দু নয়, বরং বৌদ্ধ, জৈন এবং শিখরাও ‘হিন্দুত্ব’ লাভ করেছে! অথচ শিখরা বেদ-উপনিষদে বিশ্বাস করে না। বৌদ্ধ এবং জৈন সম্প্রদায়ও হিন্দুদের কোনো ধর্মগ্রন্থ স্বীকার করে না। ... এতদসত্ত্বেও হিন্দুস্তানের আইন এদের সকলকে ঐক্যের এক সুঁতোয় গেঁথে নিয়েছে।’
অর্থাৎ ‘বিশিষ্ট নাগরিকেরা’ আমাকে আপনাকে, মুসলিম সরকারপ্রধান ও আলেমগণকে পরামর্শ দিচ্ছেন যে, আকিদা-বিশ্বাদের এই সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি তোমরা ত্যাগ কর, কেউ আল্লাহর অস্তিত্ব স্বীকার করুক আর না করুক, আল্লাহর নাযিল করা কিতাব মানুক আর নাই মানুক একই নবীতে বিশ্বাস করুক বা নাই করুক- হিন্দুস্তানের আইনের মতো সবাইকে তোমরা মুসলমান বলে মেনে নাও। সবাইকে ‘মুসলমানিত্বের’ সূত্রে গেঁথে নাও।
এই ‘সুধীবাবুরা’ যদি নবুওতের যামানা পেতেন, তাহলে খুব সম্ভব নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকেও মশওয়ারা দিতেন, এইসব আকিদাগত বিচ্ছিন্নতা রাখুন। এর ফলে অর্থহীন বিভেদ তৈরি হয়। আস্তিক ও নাস্তিক, তাওহীদবাদী আর মুশরিক, নবী ও কিতাবে বিশ্বাসী আর অবিশ্বাসী, কেয়ামত ও আখেরাতের বিষয়ে ঈমানদার ও বেঈমান সবাইকে এক কাতারে নিয়ে আসুন। এক জাতি ও উম্মত হিসাবে মেনে নিন। এ কালের সুধীজনের পরামর্শগুলো সেকালের আবু জাহল আবু লাহাবরাই সবার আগে খুশি মনে লুফে নিতো বলে মনে হয়।
এমনিভাবে এরা যদি হযরত আবু বকর রা.-এর যামানা পেতো, তাহলে মিথ্যা নবুওয়তের দাবীদার মুসাইলামা ও যাকাত অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে সিদ্দীকে আকবরের যুদ্ধকেও অনর্থক সাব্যস্ত করত।
আরবজাতির মাঝে সংঘাত বাঁধিয়ে দিয়েছেন- বলে দোষারোপ করত।
ইতিহাসের পাঠকমাত্রই জানেন, যাকাত অস্বীকারকারী এবং মুসাইলামা ও তার অনুসারীরা নিজেদেরকে মুসলমান বলত এবং কালিমায়ে তাইয়েবাও পাঠ করত। (তা সত্ত্বেও হযরত আবু বকর তাদেরকে মুসলমান বলে মনে করেননি; বরং তিনি তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন।)
(এখানে স্মরণ রাখা উচিত, কখনোই হককে বাতিলের সঙ্গে মিশিয়ে ফেলার কোনো অবকাশ নেই। হককে যে কোনো মূল্যে সুস্পষ্ট ও সুপ্রতিষ্ঠিত রাখতে হবে। তাই হকের প্রতি দাওয়াত দেয়া, হক ও সত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা, সত্যকে মিথ্যার সঙ্গে মিশে গিয়ে অস্পষ্ট হয়ে যেতে না দেয়া বিভেদ নয়। বিভেদ হল হক গ্রহণে বিলম্ব করা, হক প্রতিষ্ঠায় বাধা দেয়া কিংবা হককে বাতিলের সঙ্গে মিশিয়ে ফেলার চেষ্টা করা। বিষয়টা মনে রাখলে অনেক বিভ্রান্তি আপনাআপনিই দূর হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।)
দ্বিতীয় দলিল : কাদিয়ানীদের ব্যাপারে আলেমগণের দেয়া কাফের ফতোয়াটি ভুল প্রমাণের জন্য সুধী সমাজ দলিল দিয়েছেন যে, ‘রায়বেরেলীর মুজাদ্দিদ মৌলবি আহমদ রেজা খান দুনিয়ার কোনো মুসলমানকেই কাফের না বলে ক্ষান্ত হননি!’
কাদিয়ানীদের ‘উকিল-মক্কেল’ সবাই সুযোগ পেলেই কথাটা পেড়ে বসে এবং কাদিয়ানীদের বিষয়ে কাফের ফতোয়াটি অগ্রহণযোগ্য প্রমাণের জন্য এই দলিল হাজির করার ইতিহাস অনেক পুরানো। বিশেষত লাহোরী গ্রুপ নিজেদের লেখালেখি ও প্রচারপত্রে দলিলটি অতি গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করে থাকে। তাদের মতে, মৌলবি আহমদ রেজা প্রদত্ত কাফের ফতোয়া যেমন গ্রহণযোগ্যতা পায়নি, তেমনি কাদিয়ানীদের উপর আরোপিত ফতোয়াও গ্রহণযোগ্যতা পাবে না।
আহমদ রেজা খান শাহ ইসমাঈল শহীদসহ সমস্ত আকাবিরে নদওয়া ও দেওবন্দকে কাফের বলত। আর বৃটিশবিরোধী খেলাফত আন্দোলনে যোগ দেয়ার ‘অপরাধে’ বদায়ূন ও ফিরিঙ্গীমহলের আলেমগণকেও সম্পূর্ণ ভিত্তিহীনভাবে কাফের বলতো।
কাদিয়ানী এবং তাদের কৌঁসুলীদের মতে, যেহেতু আহমদ রেজা খানের কাফের ফতোয়া সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন, ভুল ও অগ্রহণযোগ্য সাব্যস্ত হয়েছে, তাই এখন আর কারো কাফের ফতোয়া গ্রহণযোগ্য হবে না (যদিও তা শরীয়তের স্বীকৃত নীতিমালার আলোকে সতর্ক, প্রাজ্ঞ ও খোদাভীরু আলেমে দ্বীনের তরফ থেকেই হয় না কেন!)
চিন্তা করুন পাঠক! কেমন বেইনসাফি। কতটা লঘু এবং অযৌক্তিক দলিলে ইসলাম ও কুফরের পার্থক্য তারা উড়িয়ে দিতে চাচ্ছে। (ইসলামের সুবিশাল ইতিহাসের মাত্র একজন বিতর্কিত ব্যক্তির ভুলের অজুহাতে শরীয়তের সকল নীতিমালা এবং উম্মতের সমস্ত আলেম-উলামার সিদ্ধান্তকে তারা নস্যি করে
দিতে চাচ্ছে।)
পুলিশ চোর ধরে। ডাকাত ধরে। ভুলও করে। পুলিশের ভুলের কারণে কি বলা হবে, এতদিন যত চোর-ডাকাত ধরা হয়েছে সবাই নিরপরাধ? আর পুলিশরা সামনে যত গ্রেফতার করবে, তাদের গ্রেফতার আর আমলে নেয়া হবে না? ছেড়ে দিতে হবে যত চোর-ডাকাত!
(আমাদের সুশীল সমাজ এবং বিশিষ্ট নাগরিকদের বক্তব্য বিচার করলে এমন ফলাফলই বেরিয়ে আসে। আফসোস, এ- সমস্ত ভাইদের চিন্তাধারার প্রতি!)
নিবন্ধকার সুশীলসমাজের-পক্ষ থেকে এও লিখেছেন যে, ‘স্বীকৃত একটি মূলনীতি হল, যদি বক্তার বক্তব্যে কোনো অস্পষ্টতা থাকে, তবে বক্তার কাছেই তার মতলব জিজ্ঞেস করা হবে। তিনি যদি তার বক্তব্যের এমন কোনো ব্যাখ্যা দেন, যাতে কারো দ্বিমত নেই, তাহলে সেখানেই প্রসঙ্গটির মিমাংসা হয়ে যাবে।’
নীতিগতভাবে উল্লিখিত বক্তব্য সঠিক। কিন্তু মির্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী এবং তার মূলধারার অনুসারীদের যে সকল স্পষ্ট বক্তব্যের আলোকে আলেমগণ তাদেরকে অমুসলিম আখ্যা দিয়েছেন, তাতে কোনো অস্পষ্টতা নেই। মির্জা বশীরুদ্দীন মাহমুদ, যিনি কাদিয়ানী সাহেবের পুত্র এবং খলিফা, তিনি তার কিতাব ‘হাকীকাতুন নুবুওয়াহ’, ‘তাশহীযুল আযহান’, ‘আনওয়ারে খেলাফত’ ইত্যাদি কিতাবে মির্জা সাহেবের নবুওত ও রেসালত অস্বীকারকারী মুসলমানদেরকেই উল্টো কাফের বলেছেন এবং কিতাবগুলিতে স্পষ্ট ভাষায় নিজের, নিজের পিতার এবং কাদিয়ানী ধর্মের আকিদা-বিশ্বাস তুলে ধরেছেন। এরপর কাদিয়ানীদের আকিদা-বিশ্বাসের বিষয়টি কারো কাছে অস্পষ্ট নেই। (আলকাউসারের মে ও আগষ্ট সংখ্যায় ‘কাদিয়ানী সম্প্রদায় কেন মুসলমান নয়’ শিরোনামে লেখকের একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে মির্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী এবং মির্জা বশীরুদ্দীন মাহমুদের স্পষ্ট বক্তব্যসমূহ তুলে ধরে দেখানো হয়েছে যে, কাদিয়ানীদের কুফরি আকিদা একদম স্পষ্ট, তাতে ভিন্ন ব্যাখ্যার কোনো অবকাশ নেই। কাদিয়ানীরা কাফের না মুসলমান-এ বিষয়ে যারা সঠিক উপলব্ধি অর্জন করতে চান, তাদের প্রতি ঐ প্রবন্ধটি পড়ার আন্তরিক অনুরোধ রইল।)
তৃতীয় দলিল : কাফের ফতোয়াটির উপর এই বলেও প্রশ্ন তোলা হয়েছে যে, ‘কাদিয়ানীরা ‘আহলে কেবলা’-এর অন্তর্ভুক্ত। আর আহলে কেবলার কাউকে কাফের বলা নিষেধ। ইমাম গাযালী রাহ. ‘আততাফরিকাহ’ নামক কিতাবে লিখেছেন, (অর্থ) ‘আমার অসিয়ত হল, যথাসম্ভব কোনো ‘আহলে কেবলা’কে কাফের বলা থেকে বিরত থাকবে, - যতক্ষণ পর্যন্ত সে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ- এই কালিমার সাক্ষ্য দেবে এবং এই কালিমার বিরুদ্ধাচরণ না করবে। বিরুদ্ধাচরণ হল কোনো কারণবশত কিংবা বিনা কারণে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মিথ্যুক প্রতিপন্ন করার নাম। কারণ এ ধরনের (আহলে কিবলা)র কাউকে কাফের বলার মাঝে ঝুকি রয়েছে। কিন্তু চুপ থাকার মাঝে কোনো ক্ষতি নেই।’
ইমাম গাযালী রাহ. (মৃত্যু ৫০৫ হি.) -এর অনুরূপ কথা আরও বহু আগে বড় বড় ইমামগণ বলেছেন। ইমাম আবু হানিফা রাহ. (মৃত্যু ১৫০ হি.) থেকে বর্ণিত আছে, (অর্থ) ‘কোনো আহলে কেবলাকে আমরা কাফের আখ্যায়িত করি না। অধিকাংশ ফকীহের মত এটাই। শরহুল ফিকহিল আকবর, পৃ. ১৫৫
মুহাদ্দিস মোল্লা আলী কারী ‘শরহুল মাওয়াকিফ’ (৮/৩৭০) থেকে নকল করেছেন যে, (অর্থ) ‘অধিকাংশ ফকীহ ও মুতাকাল্লিম (আকিদাশাস্ত্রবিদ) এ বিষয়ে একমত যে, কোনো আহলে কিবলাকে কাফের বলা যাবে না।’
আফসোস! আমাদের ভায়েরা আলোচনা তুলেছেন কিন্তু আহলে কেবলা’ দ্বারা কী উদ্দেশ্য তা চিন্তা করে দেখেননি! ইমামগণের কিতাবে ‘আহলে কেবলা’ বলে কী বোঝানো হয়েছে তাও ভাবেননি! বলা বাহুল্য, শাব্দিক অর্থে তো প্রত্যেক ঐ ব্যক্তি ‘আহলে কেবলা’র অন্তর্ভুক্ত, যে মক্কা শরীফে অবস্থিত কা’বাঘরকে কেবলা মনে করে। আর এই অর্থ যদি উদ্দেশ্য হল, তাহলে আবু জাহলের মতো আরবের সমস্ত মুশরিকও ‘আহলে কেবলা’ বলে গণ্য হবে। কারণ কা’বাঘরকে তারাও কেবলা মানত। বাইতুল্লাহ শরীফকে সম্মান করত। এই ঘরের তওয়াফ করত। নিজেদের মতো করে হজ্ব-উমরাও করত। সুতরাং আলোচ্য ক্ষেত্রে ‘আহলে কেবলা’র শাব্দিক অর্থ অনুযায়ী আবু জাহল আবু লাহাবকেও কাফের বলার সুযোগ নেই! আমাদের কালের কাদিয়ানী তো দূরের কথা!
বাস্তবতা হল, ‘আহলে কেবলা’ বিশেষ একটি ইলমী ও দ্বীনী পরিভাষা। আকিদা ও ফিকহের কিতাবে ‘তাকফীর’-এর আলোচনায় এ পরিভাষা বারবার আসে এবং সেখানে এর উদ্দেশ্যও বলা থাকে। যে ব্যক্তি তাওহীদ-রেসালাত, কেয়ামত-আখেরাত ইত্যাদি আকিদার উপর ঈমান রাখে এবং নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত দ্বীনি বিষয়সমুহ অর্থাৎ জরুরিয়াতে দ্বীনের কোনো কিছু অস্বীকার না করে সে ‘আহলে কেবলা’র অন্তর্ভুক্ত। অতএব কেউ যদি জরুরিয়াতে দ্বীনের কোনো বিষয় অস্বীকার করে, তবে সে ‘আহলে কেবলা’র অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য হবে না। যেমন পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরজ হওয়াকে অস্বীকার করা, কেয়ামত-আখেরাত, খতমে নবুয়ত ইত্যাদিকে অবিশ্বাস করা। কুরআন মাজীদকে আল্লাহ পাকের কালাম মনে না করা ইত্যাদি।
মোল্লা আলী কারী (মৃত্যু : ১০১৪ হি.) ‘আহলে কেবলা’র কাউকে ‘তাকফীর’ না করার বিষয়ে ইমাম আবু হানিফা রাহ.-এর উল্লিখিত বক্তব্য উদ্ধৃত করেই লিখেছেন, (অর্থ) ‘অর্থাৎ স্মরণ রাখতে হবে, আহলে কেবলা বলতে ঐ সকল লোক উদ্দেশ্য, যারা জরুরিয়াতে দ্বীনের কোনো বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করে না। যেমন বিশ্বজগৎ অনাদি না হওয়া, কেয়ামতের দিন সশরীরে পুনরুত্থিত হওয়া, ছোট-বড় সকল বিষয়ে আল্লাহ পাকের অবগতি থাকা ইত্যাদি। এ জাতীয় বিষয়গুলি জরুরিয়াতে দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং কেউ যদি আজীবন ইবাদত-বন্দেগী ও সৎ কাজে মশগুল থাকে, আবার সে বিশ্বজগৎকে অনাদি মনে করে, সশরীরে পুনরুত্থান হওয়াকে অস্বীকার করে, অথবা ছোট খাট বিষয়ে আল্লাহ পাকের ইলম নেই বলে মনে করে, তাহলে সে ‘আহলে কেবলা’র মধ্যে গণ্য হবে না।’
উপরের উদ্ধৃতি থেকে স্পষ্ট বোঝা গেল, জরুরিয়াতে দ্বীনের কোনো বিষয় অস্বীকারকারী ‘আহলে কেবলা’র মধ্যে দাখিল হবে না। সে কাফের-মুরতাদ বলে চিহ্নিত হবে। এজন্যই যে সকল আলেম আহলে কেবলাকে ‘তাকফীর’ করতে নিষেধ করেছেন, তাঁরা এটাও বলেছেন, যদি কেউ নিজেকে মুসলমান দাবী করে এবং বাইতুল্লাহ শরীফকে কেবলা মানে, কিন্তু সে কেয়ামত-আখেরাত, নামায-রোযা, হজ্ব-যাকাত ইত্যাদির কোনোটি অস্বীকার করে, আল্লাহ তাআলা অথবা কোনো নবী-রাসূলের শানে বেয়াদবি করে, কুরআন মাজীদকে আল্লাহ পাকের নাযিলকৃত কালাম মনে না করে (কিংবা দ্বীনের কোনো বিষয় নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে,) তাহলে সে ‘আহলে কেবলা’ নয়; বরং কাফের। অর্থাৎ নিজেকে মুসলমান পরিচয় দিয়ে একই কেবলার অনুসরণ করা সত্ত্বেও সে ইসলাম থেকে খারেজ বলে গণ্য হবে। ইমামগণ আকিদা ও ফিকহের কিতাবে বিষয়গুলো সবিস্তারে আলোচনা করেছেন। আগ্রাহী পাঠক সে সমস্ত কিতাব খুলে দেখতে পারেন।
নিবন্ধকার যে কিতাব থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে ‘আহলে কেবলা’কে কাফের না বলার প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছেন, সেই কিতাবেই উদ্ধৃতিটুকুর আগে পরে স্পষ্ট বলা আছে, যদি কেউ জরুরিয়াতে দ্বীনের কোনো বিষয় অস্বীকার করে, তাহলে তাকে ‘তাকফীর’ করা হবে। এজন্যই ইমাম গাযালী রাহ. ঐ সকল মুসলিম দার্শনিককে কাফের বলতেন, যারা রুহানিভাবে হাশর হবে বলে বিশ্বাস করে এবং সশরীরে পুনরুত্থান হওয়াকে অস্বীকার করে।
‘আত তাফরিকা’ কিতাবে ইমাম গাযালী রাহ. তা’বীল (ভিন্ন ব্যাখ্যা) সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে বলেন, কিছু ভিন্ন তা’বীল এমন আছে, যার কারণে তা’বীলকারীকে কাফের বলা যায় না, তবে তাকে গোমরাহ-বিদআতী বলা যায়। কিন্তু কিছু ‘বিচ্ছিন্ন’ তা’বীল এমন, যার ফলে তা’বীলকারী কাফের হয়ে যায়। তিনি লিখেছেন, (অর্থ) অর্থাৎ ‘ঐ ব্যক্তিকে অবশ্যই কাফের সাব্যস্ত করা হবে, যে গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক আকিদার ক্ষেত্রে ভিন্ন তাবীল করবে এবং অকাট্ট দলিল ব্যতিরেকেই শরীয়তের নস এর স্বাভাবিক অর্থের মাঝে পরিবর্তন সাধনের চেষ্টা করবে। যেমন কিছু অসম্ভাব্যতার নিছক অনুমানের ভিত্তিতে এবং অকাট্ট দলিল ব্যতিতই কেয়ামতের দিন সশরীরে পুনরুত্থান হওয়ার এবং পরকালে শারীরিক শাস্তি হওয়ার বিষয় অস্বীকার করে। (এই ধরনের লোক আহলে কেবলা নয়; এরা অবশ্যই কাফের।) এদেরকে কাফের আখ্যায়িত করা ওয়াজিব। আর এটা অধিকাংশ দার্শনিক আলেমের অভিমত।’
ইমাম গাযালী রাহ. এখানে যাদেরকে কাফের আখ্যা দেয়া ওয়াজিব বলেছেন, তারা কিন্তু নিজেদেরকে মুসলমান বলত এবং কা’বা শরীফকে কেবলা মানত! (তারপরও জরুরিয়াতে দ্বীনের মাঝে হস্তক্ষেপকারীকে তিনি কাফের আখ্যা দিলেন।)
‘আহলে কেবলা’ সম্পর্কিত ইমাম গাযালীর যে বক্তব্য সাংবাদিক ফারক্লীত উদ্ধৃত করেছেন, সেই বক্তব্যের নিকটেই আছে, (অর্থ) অর্থাৎ ‘তাকফীর’-এর শরঈ নীতি এই যে, আকিদা দুই প্রকার। কিছু আকিদা বুনিয়াদি আর কিছু আকিদা শাখাগত। বুনিয়াদি আকিদা তিনটি : তাওহীদ, রেসালাত ও আখেরাত। এই তিনটি ব্যতিত বাদবাকি আকিদা শাখাগত। কেউ শাখাগত বিষয়ে অস্বীকার করলে তাকে ‘তাকফীর’ করা যাবে না, কিন্তু যদি ঐ শাখাগত বিষয়টি নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে যুগপরম্পরায় অকাট্ট দলিলে প্রমাণিত হয়, (অর্থাৎ সেটা জরুরিয়াতে দ্বীনের আওতায় এসে যায়,) তাহলে এমন শাখাগত আকিদা অস্বীকার করলেও তাকফীর
করা হবে।’
একটুপর ইমাম গাযালী রাহ. আরও লিখেছেন, অর্থাৎ যখনি নবীজীকে মিথ্যুক প্রতিপন্ন করার মতো কোনো বিষয় সামনে আসবে, তখনি ‘তাকফীর’ করা হবে। যদিও বিষয়টি শাখাগত হয় না কেন।’
এ বিষয়ে ইমাম গাযালী রাহ. দুটি উদাহরণ দিয়েছেন। দ্বিতীয় উদাহরণটি বুঝতে সহজ হবে বিধায় পাঠকের খেদমতে সেটি পেশ করা হচ্ছে।
কিছু লোক নিজেদেরকে মুসলমান দাবী করে এবং কা’বা শরীফকেও কেবলা মানে, কিন্তু নবীপত্নী হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রা.-এর ব্যাপারে আপত্তিকর বিশ্বাস পোষণ করে। ইমাম গাযালী লিখেছেন, (অর্থ) ‘এমনিভাবে হযরত আয়েশা রা.-এর নিষ্কলুষতার বিষয়ে আয়াত নাযিল হওয়ার পরও যারা তাঁকে ‘অসতী’ মনে করে, তাঁরা নির্ঘাত কাফের। কেননা এ জাতীয় গোমরাহি নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মিথ্যুক প্রতিপন্ন করা এবং নবীজী থেকে তাওয়াতুরের সাথে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত বিষয় অস্বীকার করা ছাড়া
সম্ভব নয়।’
প্রকাশ থাকে যে, ইমাম গাযালী এই উদাহরণ দিয়েছেন শাখাগত আকিদার বিষয়ে, যাতে নবীজীর তাকযীব (মিথ্যুক প্রতিপন্ন করা) কিংবা আবহমান কালের অকাট্ট কোনো দ্বীনী বিষয়ের এনকার (অস্বীকৃতি) রয়েছে। হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রা. এর উপর তোহমত দেয়া অনুরূপ একটি বিষয়। ইমাম গাযালী এরপর লিখেছেন, ‘অর্থাৎ দ্বীনের মৌলিক তিন আকিদা- (তাওহীদ, রেসালাত, আখেরাত)-এর উপর ঈমান এবং ঐ সকল সর্বজনজ্ঞাত দ্বীনী বিষয়, যাতে নতুন করে ভিন্ন ব্যাখ্যা দেয়ার কোনো অবকাশ নেই এবং তা নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে তাওয়াতুরের সাথে যুগপরম্পরায় প্রবাহিত, আর এর বিপরীত কোনো অকাট্ট দলিল বের হওয়ারও কল্পনা করা যায় না, (দ্বীনের মৌলিক আকিদা হোক কিংবা শাখাগত কোনো বিষয়) এমন ক্ষেত্রে ভিন্নমত পোষণ করা কিংবা এজাতীয় বিষয় অস্বীকার করা নবীজীকে তাকযীব করার নামান্তর। যেমন জান্নাত-জাহান্নাম অস্বীকার করা (অথবা এগুলোর ভিন্ন অর্থ দেয়ার চেষ্টা করা।) এমনিভাবে হাশরের মাঠে সশরীরে উপস্থিত হওয়াকে মানতে না চাওয়া ইত্যাদি।
একটু পর লিখেছেন, অর্থাৎ ‘আরেকটি মূলনীতির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা জরুরি। কখনো কখনো বিরোধীভাবাপন্ন ব্যক্তি তাওয়াতুরের সঙ্গে প্রমাণিত শরঈ বিষয়ের মাঝে মতভেদ করে। তার ধারণায় বিষয়টিকে সে অস্বীকার করছে না, বরং নতুন তা’বীল (ভিন্ন ব্যাখ্যা) করছেমাত্র। অথচ এ জাতীয় বিষয়ে ভাষাগতভাবেও কোনো প্রকার ভিন্ন ব্যাখ্যার অবকাশ নেই। সুতরাং এরূপ তাবীল করা কুফর, যদিও সে নিজেকে অস্বীকারকারী নয়, ব্যাখ্যাকারী ভাবছে।’
ইমাম গাযালী রাহ.-এর ঐ পুস্তক থেকেই আমরা ‘তাকফীর’ বিষয়ে উপরোক্ত স্পষ্ট বক্তব্যসমুহ নকল করলাম, যেখান থেকে সাংবাদিক সাহেব ‘আহলে কেবলা’র প্রসঙ্গ উঠিয়েছেন। সুতরাং ‘আহলে কেবলা’র এই উদ্দেশ্য বলার কোনো সুযোগ নেই যে, আকিদা যার যাই হোক, সর্বজনস্বীকৃত শরঈ বিষয়সমূহের মাঝে যে যেমন হস্তক্ষেপই করুক, যদি সে নিজেকে মুসলমান ভাবে আর একই কেবলার অনুসরণ করে তাহলেই সে মুসলমান! তাকে কাফের বলা যাবে না!
ইমাম গাযালী রাহ. একজন স্বীকৃত আলেমে দ্বীন। সাংবাদিক সাহেব ও তার কথিত সুধীসমাজ ‘আহলে কেবলা’র যে অর্থ তাঁর বক্তব্য থেকে ধরে নিয়েছেন, ইমাম গাযালীর মতো বড় মাপের আলেম তো দূরের কথা, দ্বীনের বিষয়ে যার ‘আলিফ-বা’র জ্ঞান আছে, তার পক্ষেও অমন মুর্খোচিত কথা বলা সম্ভব নয়। আর ইমাম গাযালীর উপরোক্ত বক্তব্যসমুহ দেখার পরও ঐ কথা বলা মিথ্যা অপবাদ ছাড়া কিছুই নয়।
নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যামানায় কিছু লোক ঈমান আনল। তারা নামাযও পড়ত। কিন্তু তারা কিছু কুফরি কথা বলে বসল। নবীজী জানতে পেরে তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেন। তখন তারা অনুনয়বিনয় করে বলতে লাগল, কথাগুলো আমরা মন থেকে বলিনি, ভেবেচিন্তে বলিনি। এমনিই হাসি মজাক করতে করতে বলে ফেলেছি। তাদের বিষয়ে আল্লাহ তাআলা আয়াত নাযিল করলেন, (অর্থ) ‘অজুহাত দিতে হবে না। তোমরা ঈমান আনয়নের পর কাফের হয়ে গেছ। (সূরা তাওবা ৯ : ৬৬)
অনুরূপ কিছু লোক ঈমান এনে মুসলমানদের দলভুক্ত হয়েছিল। যারা কেবলামুখী হয়ে নামায আদায় করতো। তারাও কিছু কুফুরী কথা বলল। ফলে আল্লাহ পাক তাদেরকে ইসলাম থেকে খারেজ সাব্যস্ত করলেন। কাফের আখ্যায়িত করে আয়াত নাযিল করলেন, (অর্থ) ‘তারা কুফরী কথা বলেছে এবং ইসলাম অবলম্বনের পর কাফের হয়ে গেছে।’ (সূরা তাওবা ৯/৭৪)
কোরআন মাজীদের এই আয়াতসমূহ থেকে স্পষ্ট যে, কেউ যদি নিজেকে মুসলমান বলে, কালিমা পড়ে, কা’বা শরীফকে কেবলা মানে, আবার কোনো কুফরী কথাও বলে কিংবা এ জাতীয় কোনো আকিদা প্রকাশ করে, তাহলে সে ইসলাম থেকে খারেজ হয়ে যাবে। এটাই উম্মতের ইজমায়ী ফায়সালা; সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত।
হাঁ, এতটুকু ঠিক, যে নিজেকে মুসলমান বলবে, কালিমা পড়বে, তাকে আমরা মুসলমানরূপে মেনে নেব, যতক্ষণ না তার থেকে কোনো কুফুরী কথা বা আচরণ প্রকাশ পাবে। (কিন্তু যখনই তার থেকে কোনো কুফর প্রকাশ পাবে, তৎক্ষণাৎ সে ইসলাম থেকে খারেজ হয়ে যাবে।)
মির্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীকে কাফের ঘোষণা করার সবচে’ বড় বুনিয়াদ হল নবুওত দাবী করে তার দেয়া স্পষ্ট বক্তব্যসমূহ। এগুলোতে ভিন্ন কোনো ব্যাখ্যা চলে না। যারা এই দাবীর অনর্থক ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে চান, মির্জাপুত্র বশীরুদ্দীন মাহমুদ তাদের সেই সুযোগ একেবারেই বন্ধ করে দিয়েছেন। তিনি পিতার স্পষ্ট বক্তব্যসমূহ একের পর এক উদ্ধৃত করে স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, মির্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী স্বতন্ত্র শরয়ী নবুওতের দাবীদার। তিনি ঈসা, মুসা প্রমুখ নবীগণের মতোই নবী। পূর্বেকার কোনো নবীকে অস্বীকার করা যেমন কুফর, মির্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীকে অস্বীকারকারীরাও কাফের। (এ বিষয়ে আলকাউসারের মে ও আগষ্ট সংখ্যায় ‘কাদিয়ানী সম্প্রদায় কেন মুসলমান নয়’ শীর্ষক প্রবন্ধে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে।)
প্রথম যুগে মুসায়লামা এবং আসওয়াদ ‘আনাসী নবুওতের দাবীদার ছিল। এ যুগের মির্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীও নবুওতের দাবীদার। সবাই খতমে নবুওত সম্পর্কিত কুরআন মাজীদের আয়াত এবং তাওয়াতুরের সঙ্গে বর্ণিত অকাট্ট হাদীসসমূহের অর্থহীন ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেছে, যা মৌলিকভাবে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ‘তাকযীব’ করার নামান্তর। এজন্য শরীয়তের দৃষ্টিতে মিথ্যুক মুসায়লামার অবস্থান যা, মির্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী এবং তার অনুসারীদের অবস্থানও তা।