মাদকের ভয়াবহ বিস্তার বাঁচতেই হবে আমাদের, কিন্তু কীভাবে?
নেশা ও মাদক মানব-সভ্যতার চরম শত্রু। এটা জীবন ও সম্ভাবনাকে নষ্ট করে, শান্তির পরিবারে অশান্তির আগুন প্রজ্জ্বলিত করে এবং সমাজে অনাচার ও অস্থিরতা সৃষ্টি করে। নেশা ও মাদক সভ্যতার চাকা পিছনের দিকে ঘুরিয়ে দেয়। তাই কল্যাণের ধর্ম ইসলামে নেশা ও মাদক সম্পূর্ণ হারাম।
কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا إِنَّمَا الْخَمْرُ وَالْمَيْسِرُ وَالْأَنْصَابُ وَالْأَزْلَامُ رِجْسٌ مِنْ عَمَلِ الشَّيْطَانِ فَاجْتَنِبُوهُ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ * إِنَّمَا يُرِيدُ الشَّيْطَانُ أَنْ يُوقِعَ بَيْنَكُمُ الْعَدَاوَةَ وَالْبَغْضَاءَ فِي الْخَمْرِ وَالْمَيْسِرِ وَيَصُدَّكُمْ عَنْ ذِكْرِ اللَّهِ وَعَنِ الصَّلَاةِ فَهَلْ أَنْتُمْ مُنْتَهُونَ
হে মুমিনগণ! মদ, জুয়া, পূজার বেদী ও (ভাগ্য) নির্ণায়ক) শর ঘৃণ্য বস্ত্ত, শয়তানের কাজ। সুতরাং তোমরা তা বর্জন কর। যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার।
শয়তান তো এ-ই চায় যে, মদ ও জুয়ার দ্বারা তোমাদের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি করবে এবং তোমাদেরকে আল্লাহর স্মরণ ও সালাত থেকে বিরত রাখবে। সুতরাং তোমরা কি নিবৃত্ত হচ্ছ?-সূরা মাইদা ৫: ৯০-৯১
এ আয়াতে মাদক সম্পর্কে চূড়ান্ত বিধান দেওয়া হয়েছে এবং একে ঘৃণ্য ও বর্জনীয় ঘোষণা করা হয়েছে। শুধু তাই নয় একে উল্লেখ করা হয়েছে পূজার বেদীর সাথে। আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস রা. বলেন, যখন শরাব হারাম করা হল তখন আল্লাহর রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সাহাবীগণ একে অপরের কাছে গিয়ে বললেন, ‘শরাব হারাম হয়েছে এবং একে শিরকের মতো (মারাত্মক গুনাহ) সাব্যস্ত করা হয়েছে।’
حرمت الخمر وجعلت عدلا للشرك،
قال المنذري : رواه الطبراني، ورجاله رجال الصحيح.
আত তারগীব ওয়াত তারহীব ৩/১৮০ হাদীস (৩৫৭৬)
হাদীস শরীফের ঘোষণায় নেশা ও মাদক সম্পূর্ণরূপে হারাম সে যে নামের হোক, আর যেভাবেই তা গ্রহণ করা হোক। ইরশাদ হয়েছে-
كل مسكر حرام
‘সকল নেশাসৃষ্টিকারী দ্রব্য হারাম’
এটি একটি ‘মুতাওয়াতির’ হাদীস। মুহাদ্দিসগণের পরিভাষায় মুতাওয়াতির ঐ সকল হাদীসকে বলে, যা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত, যা এত সংখ্যক রাবীর সূত্রে বর্ণিত যে, এতে কোনো প্রকারের সন্দেহ-সংশয়ের অবকাশ থাকে না। বিখ্যাত হাদীস বিশারদ আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী রহ. (৮৫২ হি.) বলেন, এ মর্মের হাদীস একত্রিশজন সাহাবী থেকে বর্ণিত হয়েছে। (দ্র. ফতহুল বারী ৩/৭৩)
২. দায়লাম হিময়ারী রা. বলেন, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে আরজ করলাম, ‘আল্লাহর রাসূল! আমরা এক ঠান্ডা দেশের অধিবাসী, আমাদেরকে কঠিন পরিশ্রমের কাজ করতে হয়, আমরা গম দ্বারা এক ধরনের পানীয় প্রস্ত্তত করে থাকি, যার দ্বারা আমরা কাজের শক্তি পাই ও শীতের মোকাবিলা করি।’ তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘সেটা কি নেশা সৃষ্টি করে?’ আমি বললাম, জী হাঁ। তিনি বললেন, ‘তাহলে তা বর্জন কর।’ আমি বললাম, ‘লোকেরা তা বর্জন করতে প্রস্ত্তত হবে না।’ তিনি বললেন, ‘ত্যাগ না করলে তাদের সাথে লড়াই কর।’ সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ৩৬৮৩
৩. হযরত সা‘দ ইবনে আবী ওয়াককাস রা. থেকে বর্ণিত, ‘যে বস্ত্ত অধিক পরিমাণে গ্রহণ নেশা সৃষ্টি করে তা সামান্য পরিমাণে গ্রহণও আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিষিদ্ধ করেছেন’।-সুনানে নাসায়ী, হাদীস : ৫৬০৮, ৫৬০৯, সহীহ ইবনে হিববান হাদীস : ৫৩৭০।
এ মর্মের হাদীস হযরত জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ রা. ও উম্মুল মুমিনীন আয়েশা সিদ্দীকা রা. থেকেও বর্ণিত হয়েছে। (দ্র. সুনানে আবু দাউদ, ৩৬৮১; তিরমিযী, ১৮৬৫; ইবনে মাজা, ৩৩৯৩; মুস্তাদরাকে হাকিম ৩/৪১৩ আবু দাউদ ৩৬৮৭)
মাদকদ্রব্যের বেচাকেনা এবং এর সাথে যেকোনো পর্যায়ের সংশ্লিষ্টতা নিষিদ্ধ আর তা আল্লাহর লা’নত ও অভিশাপের কারণ।
১. জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ রা. বলেন, তিনি ফতহে মক্কার বছর যখন আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কায় অবস্থান করছিলেন, তাঁকে বলতে শুনেছেন যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল খাম্র (শরাব) বিক্রয় নিষিদ্ধ করেছেন ...। (সহীহ বুখারী, হাদীস : ২২৩৬, ৪২৯৬; সহীহ মুসলিম ৪১৩২)
২. আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস রা. থেকে এক দীর্ঘ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘খাম্র’ (শরাব) সম্পর্কে বলেছেন, ‘যিনি তা পান করা হারাম করেছেন তা বিক্রি করাও হারাম করেছেন।’ (সহীহ মুসলিম, হাদীস : ৪১২৮)
৩. উম্মুল মুমিনীন আয়েশা সিদ্দীকা রা. বলেন, সূরা বাকারার শেষের দিকের (রিবা সংক্রান্ত) আয়াতসমূহ যখন নাযিল হল তখন আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বের হলেন এবং লোকদের সামনে তা তিলাওয়াত করলেন। এরপর শরাবের ব্যবসাও নিষিদ্ধ করলেন। (সহীহ বুখারী, হাদীস : ৪৫৯,২০৮৪,২২২৬,৪৫৪০-৪১,৪২; সহীহ মুসলিম, হাদীস : ৪১৩০, ৪১৩১)
৪. এক হাদীসে আছে,
لعن الله الخمر وشاربها وساقيها وبائعها ومبتاعها وعاصرها ومعتصرها وحاملها والمحمولة إليهه.
وفي رواية للترمذي : وآكل ثمنها
মাদকের উপর অভিশাপ; মাদক পানকারীর উপর অভিশাপ, পরিবেশনকারীর উপর অভিশাপ; বিক্রয়কারীর উপর অভিশাপ, ক্রয়কারীর উপর অভিশাপ; যে মাদক নিংড়ায় তার উপর অভিশাপ, যার আদেশে নিংড়ানো হয় তার উপর অভিশাপ; বহনকারীর উপর অভিশাপ, যার কাছে বহন করে নেওয়া হয় তার উপর অভিশাপ; আর যে মাদক বিক্রয়লব্ধ অর্থ ভোগ করে তার উপর অভিশাপ।-সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ৩৬৭৬; জামে তিরমিযী, হাদীস : ১২৯৫
এককথায়, মাদক এমনই খবীছ বস্ত্ত যে, উৎপাদন, বিপণন, পরিবেশন ও গ্রহণের যেকোনো পর্যায়ে এর সাথে সংশ্লিষ্ট থাকা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অভিশাপের কারণ। আর এ তো বলাই বাহুল্য যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অভিশাপ যার উপর তার জীবন কখনো শান্তির হতে পারে না।
মাদকের সাথে সংশ্লিষ্টতা তো নিষিদ্ধই, যে মজলিসে মদপান করা হয় ঐ মজলিসে উপস্থিত থাকাও নিষিদ্ধ।
জাবির ইবনে আবদুল্লাহ রা. থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘যে আল্লাহ ও শেষ দিবসে ঈমান রাখে সে যেন ঐ দস্তরখানে না বসে যাতে মদ পান করা হয়।’-দারিমী ২/১৫৩, হাদীস ২০৯২; মুসতাদরাকে হাকীম ৪/১৪৩ (৭০৭১)
২. ওমর ইবনে আব্দুল আযীয রহ.-এর কাছে শরাবপানকারী কিছু লোককে হাজির করা হল। তিনি তাদেরকে প্রহারের আদেশ দিলেন। বলা হল এদের মধ্যে একজন আছে, যে ‘সাইম’ (অর্থাৎ মজলিসে উপস্থিত থাকলেও সে মদ পান করেনি)। তিনি বললেন, ওকে দিয়েই শুরু কর। এরপর তার দিকে লক্ষ করে বললেন, তুমি কি কুরআনের এ আয়াত শোননি-
وَقَدْ نَزَّلَ عَلَيْكُمْ فِي الْكِتَابِ أَنْ إِذَا سَمِعْتُمْ آَيَاتِ اللَّهِ يُكْفَرُ بِهَا وَيُسْتَهْزَأُ بِهَا فَلَا تَقْعُدُوا مَعَهُمْ حَتَّى يَخُوضُوا فِي حَدِيثٍ غَيْرِهِ إِنَّكُمْ إِذًا مِثْلُهُمْ إِنَّ اللَّهَ جَامِعُ الْمُنَافِقِينَ وَالْكَافِرِينَ فِي جَهَنَّمَ جَمِيعًا
তিনি তো কিতাবে তোমাদের প্রতি (এ বিধান) নাযিল করেছেন যে, যখন তোমরা শুনবে আল্লাহর আয়াতকে প্রত্যাখ্যান করা হচ্ছে এবং তার সাথে বিদ্রুপ করা হচ্ছে তখন তাদের সাথে বসবে না, যাবৎ না তারা অন্য প্রসঙ্গে লিপ্ত হয়। অন্যথায় তোমরাও তাদের মতো (গণ্য) হবে ...।-নিসা ৪ : ১৪০
মাদক গ্রহণের পার্থিব ক্ষতি তো বলাই বাহুল্য; আমরা তা দেখছি ও শুনছি। আর আখিরাতে এর যে ভয়াবহ শাস্তি ভোগ করতে হবে সে সম্পর্কে আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাবধান করে গেছেন।
জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ রা. থেকে বর্ণিত, এক ব্যাক্তি ‘জাইশান’ থেকে এলেন- জাইশান ইয়ামানের একটি জায়গা- তিনি ‘মিয্র’ নামক একটি পানীয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন যা তাদের অঞ্চলে পান করা হত। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এটা কি নেশা সৃষ্টি করে?’ লোকটি বললেন, ‘জী হাঁ।’ আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘নেশা সৃষ্টিকারী সব কিছু হারাম। আর আল্লাহ নিজের উপর অপরিহার্য করে নিয়েছেন যে, যে ব্যক্তি নেশা সৃষ্টিকারী বস্ত্ত পান করবে তাকে তিনি ‘তীনাতুল খাবাল’ পান করাবেন।’ সাহাবীগণ জিজ্ঞাসা করলেন, আল্লাহর রাসূল! ‘তীনাতুল খাবাল’ কী? তিনি বললেন, জাহান্নামীদের ঘাম অথবা বললেন, জাহান্নামীদের পুঁজ।
كل مسكر حرام، وإن على الله عهدا لمن يشرب المسكر يسقيه من طينة الجنال، قالوا : يا رسول الله! وما طينة الجنال؟ قال : عرق أهل النار أو عصارة أهل النار
মোটকথা, ইসলামে নেশা ও মাদক চরমভাবে ঘৃণিত ও বর্জনীয়। অথচ এ ঘৃণ্য ও বর্জনীয় বস্তরই ব্যাপক বিস্তার ঘটছে ‘সভ্য’যুগের মুসলিম-সমাজে। এর কুরআন-বর্ণিত কুফলও এ সমাজকে ভুগতে হচ্ছে। শত্রুতা হানাহানি, আত্মবিস্মৃতি ও আল্লাহ বিস্মৃতি, সালাত-সিয়াম বিমুখতা, উচ্ছৃঙ্খলা ও উন্মত্ততা এখন এ সমাজের সাধারণ প্রবণতা। কোনো কোনো ঘটনা হয়তো আমাদের কিছুটা চঞ্চল করে, কিন্তু এ ধরনের ঘটনা তো ঘটেই চলেছে। এ অভিশাপ থেকে অনেকেই আমরা মুক্তি পেতে চাই। কিন্তু কী উপায় মুক্তির?
মুক্তির একমাত্র উপায় ইসলাম। যে সমাজে ইসলামের আলো প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল, সে সমাজে মাদক ছিল জীবন ও সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। আরবী সাহিত্যে নেশা ও মাদকের জন্য রয়েছে শতাধিক শব্দ। মাদক ও তার বিভিন্ন অনুষঙ্গের বিবরণ দিয়ে রচিত হয়েছে শত শত পংক্তি। মাদক ছাড়া আরব্য সংস্কৃতি ও আরবীয় অভিজাত্যের কল্পনা করাও সম্ভব ছিল না। অথচ ঐ সমাজ থেকে মাদক শুধু নির্মূলই হল না, চরম ঘৃণিত ও অপবিত্র বস্ত্ত হিসেবে চিহ্নিত হল। আর মাদকাসক্ত ব্যক্তি সমাজের চোখে নেমে এল চরম লাঞ্ছিত, অপমানিত ও দন্ডপ্রাপ্ত আসামীর স্থানে। মাদকের বিষয়ে মদীনা-সমাজের এই আমূল পরিবর্তন ইসলাম ও ইসলামের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এরই অবদান। কিয়ামত পর্যন্ত সকল যুগ ও জাতির জন্য এ এক আলোকিত দৃষ্টান্ত।
এটা ঠিক যে, কুরআন মজীদে মাদকের চূড়ান্ত নিষিদ্ধতা নাযিল হওয়ার আগে একাধিক আয়াত (২:২১৯; ৪:৪৬) নাযিল হয়েছে এবং চূড়ান্ত বিধানের আগে মানসিকভাবে প্রস্ত্ততও করা হয়েছে। (দ্র. আবু সায়ীদ খুদরী রা. এর সূত্রে বর্ণিত হাদীস-সহীহ মুসলিম, হাদীস : ৪০১৪)
কিন্তু চূড়ান্ত বিধান অবতীর্ণ হওয়ার সাথে সাথে সাহাবীগণ যে স্বতঃস্ফূর্ততার সাথে তা বর্জন করলেন এটা নিছক সুব্যস্থাপনার ফল নয়, এটা আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দীর্ঘ মেহনত, সাহাবীদের ঈমানী তরবিয়ত এবং খোদাভীতি ও আখিরাতমুখী চেতনা-বিশ্বাসের ফল। সাহাবীগণ তাদের প্রচন্ড ঈমানী শক্তি এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি পরম আনুগত্যের কারণেই মাদক বর্জন ও মাদক নির্মূলে সক্ষম হয়েছিলেন।
কোনো মানব-গোষ্ঠী যদি ইসলামকে যথার্থ ও আন্তরিকভাবে গ্রহণ করে এবং কুরআন-সুন্নাহর বিধানকে সমর্পিত চিত্তে শিরোধার্য করে তাহলে তা তাদের রুচি ও স্বভাব এবং জীবন ও কর্মে কী বিপ্লব আনতে পারে এ তারই নমুনা।
ঈমানী তরবিয়ত ও আখেরাতমুখী জীবনবোধের পাশাপাশি যে বিষয়টি এ বিপ্লব সাধন ও রক্ষায় কার্যকর ভূমিকা পালন করেছে তা হচ্ছে সমাজের সর্বস্তরে ‘আমর বিল মারুফ ও নাহি আনিল মুনকার’ কার্যকর থাকা এবং অপরাধের শাস্তি-বিধান ও দন্ড প্রয়োগে কোনোরূপ অবিচার কিংবা শিথীলতা না থাকা।
আমাদের কি চিন্তা করা উচিত নয় যে, প্রচার ও প্রযুক্তির এই যুগে, অর্থ ও ব্যবস্থাপনার সব কিছু সত্ত্বেও কেন আমরা অসহায়? কীসের অভাবে বর্তমান সভ্যতা অনাচার নির্মূলে চরম ব্যর্থ? আমার যদি ধর্ম-বিমুখ বুদ্ধিজীবীগনের ‘প্রত্যাদেশে’ সম্পূর্ণ অভিভূত না হয়ে থাকি তাহলে এ সত্য অনুধাবনে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে, অভাব আমাদের কোনো কিছুরই নেই, অভাব শুধু ‘ঈমান’ তথা ভিতরের শক্তির। আর ‘নাহি আনিল মুনকার’ তথা বাইরের শাসনের। এ দুয়ের কারণেই মদীনা-সমাজ ছিল নেশা ও মাদকসহ সকল অনাচার থেকে মুক্ত আর এ দুয়ের অভাবেই প্রযুক্তি ও প্রচারের এই যুগেও আমরা চরম অসহায় ও ব্যর্থ।
এখনও যারা ব্যক্তিগত পর্যায়ে ইসলামের বিধি-বিধান মেনে চলেন তারা এ সভ্যতার বড় বড় ব্যাধি থেকে মুক্ত। কিন্তু এ সভ্যতার কেন্দ্রীয় ভূখন্ডগুলোতে
এবং ওদের প্রভাবে আমাদের মুসলিম-দেশগুলোতেও যে ব্যাপক অবক্ষয় তার প্রধান কারণ উপরের দুই বিষয়ের অনুপস্থিতি। শুধু অনুপস্থিতিই নয়, এর বিপরীত প্রবণতার লালন ও বর্ধনই তো বর্তমান যুগের শিক্ষা ও সংস্কৃতির অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। সর্বস্তরের জনগণ, বিশেষত তরুণ ও যুবশ্রেণির মাঝে ঈমানী চেতনার পরিবর্তে কুফরী মানসিকতা, আখিরাতমুখী জীবন-বোধের পরিবর্তে ভোগসর্বস্ব ইহজাগতিকতা, কুরআন-সুন্নাহর প্রতি সমর্পণ ও আনুগত্যের পরিবর্তে বিদ্রোহ ও বিরুদ্ধতা তৈরির চেষ্টাই তো ব্যাপকভাবে কার্যকর। আমাদের শিক্ষা-ব্যবস্থা, প্রচারমাধ্যম ও সামাজিক পরিবেশ সব ক্ষেত্রেই তো এ প্রয়াস আশংকাজনকভাবে লক্ষণীয়। একই সাথে আইন-আদালত ও বিচার বিভাগের অবস্থা তো বলাই বাহুল্য। এরপর যদি এ সমাজের সন্তানেরা বিপথগামী হয়, নেশা ও মাদকে আসক্ত হয়, যিনা ব্যাভিচারে লিপ্ত হয়, দুর্নীতি ও সন্ত্রাসে অভ্যস্ত হয় তাহলে তো আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। এ তো এ সমাজের নীতি ও কর্মপন্থার স্বাভাবিক ফলাফল।
যে শক্তি তাদেরকে এই সকল অনাচার থেকে মুক্ত করতে ও মুক্ত রাখতে পারত সেই শক্তির বিরুদ্ধেই তো সমাজের ‘দায়িত্বশীল’ শ্রেণী যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। এরপর শুধু সচেতনতামূলক সভা-সেমিনার, গোলটেবিল বৈঠক এবং কিছু শপথবাক্য পাঠের অনুশীলন কীভাবে এই ভয়াবহ ব্যাধি থেকে মুক্তি দিবে?
এ কারণে ধর্ম-বিদ্বেষী চক্রকে, বিশেষত মুসলিম জনপদে, আমরা শুধু ধর্মেরই শত্রু মনে করি না, সমাজ ও সভ্যতারও শত্রু মনে করি।
সত্যি সত্যি যদি আমরা মাদক থেকে মুক্তি পেতে চাই তাহলে গোড়া থেকে সংস্কার শুরু করতে হবে। আবার আমাদের ইসলামের দিকে ফিরে আসতে হবে, ঈমানী পরিবেশে ঈমানী তারবিয়াত গ্রহণ করতে হবে। তাহলে ইনশাআল্লাহ শুধু মাদক নয় সকল অনাচার থেকেই আমরা মুক্তি পাব। আর মুক্তি তো আমাদের পেতেই হবে। যেহেতু আখিরাত সত্য, জান্নাত ও জাহান্নাম সত্য তাই সকল অনাচার আমাদের ছাড়তেই হবে। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন। আমীন। ইয়া রাববাল আলামীন।