মুসলমানদের মাঝে ঈমান ও ইসলামী ভ্রাতৃত্বের ঐক্য সৃষ্টির চেষ্টা করুন : একই দিনে ঈদের বিষয় দায়িত্বশীলদের উপর ছাড়ুন-২
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
এ মাসআলা মুখতালাফ ফীহ
ইতিপূর্বে আরজ করেছি যে, এ বিষয়টি যেমন ‘মুজতাহাদ ফীহ’ (ইজতিহাদী) তেমনি ‘মুখতালাফ ফীহ’ (ইখতিলাফী)ও বটে। এমনকি চার মাযহাবের প্রত্যেকটির ফকীহগণের মাঝেও এ বিষয়ে ইখতিলাফ রয়েছে। প্রত্যেক মাযহাবেই উভয় মতের ফকীহ রয়েছেন। ইমাম ও ফকীহগণের মাযহাবের বিবরণ দেওয়ার আগে দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মনে রাখা দরকার।
এক. আলোচ্য বিষয়ে ইমামগণের ইখতিলাফ মূলত দূর দূরান্তের অঞ্চলসমূহের ক্ষেত্রে। কাছাকাছি দুই স্থান বা শহরের মধ্যে এক জায়গার চাঁদ দেখা যদি অন্য জায়গায় ‘তরীকে মুজিবে’র মাধ্যমে পৌঁছে তাহলে তা ‘ওয়াজিবুল আমল’ (অবশ্যগ্রহণীয়) হওয়ার বিষয়ে ইমামগণ একমত। যদিও কোনো কোনো কিতাবের বর্ণনাভঙ্গি ও বর্ণনার শাব্দিক ব্যাপকতার কারণে অনেকে মনে করেছেন, কোনো কোনো ইমামের মতে প্রত্যেক শহরে তা যতই কাছাকাছি হোক না কেন, নিজেদের চাঁদ দেখাই ধর্তব্য। নিকটবর্তী অন্য কোনো শহরের চাঁদ দেখাও তাদের জন্য অবশ্যগ্রহণীয় নয়। এটা ভুল ধারণা। ইমামগণের মূল ইখতিলাফ দূর-দূরান্তের শহর-নগরের ক্ষেত্রে। কাছাকাছি দুই স্থান বা শহরের ক্ষেত্রে নয়।
একাধিক গবেষক আলিম তা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন। আমি শুধু একটি উদ্ধৃতি উল্লেখ করছি।
আল্লামা আবুল হাসানাত আবদুল হাই লাখনোবী রাহ. (১২৬৪ হি.-১৩০৪ হি.)
তিনি তাঁর ‘মাজমূআতুল ফাতাওয়া’য় খন্ড : ১, পৃষ্ঠা : ২৬৮ (খুলাসাতুল ফাতাওয়ার সাথে মুদ্রিত) এ বিষয়টি আলোচনা করেছেন। ফার্সী ভাষায় কৃত তাঁর আলোচনার একটি অংশ এখানে উদ্ধৃত করছি :
وايں كہ در عوام مشہور است "لكل أهل بلد رويتهم" ازيں ايں مراد نيست كہ مطلقا رويت يكجا در مقام ديگر معتبر نباشد ورنہ لازم خواہد آمد كہ اگر دريك شہر رويت شود ودر ديگر شہر كہ ازاں صرف يكدو منزل يا دو چار ميل دور باشد رويت نشود پس آں رويت در حق مردمان ديگر شہر معتبر بناشد وايں امر ہيچ عاقل كہ اور اورا از كتب حديث ممارست وہفن ہيئت مناسبت است تجويز نخواہد كرد، بل لا يقول به إلا جاهل غبي أو غوي ... .
তো কাছাকাছি দুই শহর বা একটি বড় শহর যদি এমন হয় যে, ইলমুল ফালাকের বর্ণনা অনুসারে এখানে চাঁদের উদয়স্থল কখনো কখনো আলাদাও হয়ে যায় তাহলেও সবাই একমত যে, এক্ষেত্রে উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য নয়। বরং এক্ষেত্রে এক জায়গার চাঁদ দেখা অন্য জায়গার জন্য (তরীকে মুজিবের মাধ্যমে প্রমাণিত হলে) অবশ্যগ্রহণীয়।
কাছাকাছি এলাকার ক্ষেত্রে এক জায়গার চাঁদ দেখার সাক্ষ্য অন্য জায়গার জন্য কবুল করা মারফূ হাদীস দ্বারাও প্রমাণিত, উম্মাহর আমলে মুতাওয়ারাছ (প্রজন্ম পরম্পরায় চলে আসা ব্যাপক কর্মধারা) দ্বারাও প্রমাণিত। বাস্তবে এ বিষয়ে কোনো ইখতিলাফ নেই। শুধু কিছু বাক্যের শাব্দিক ব্যাপকতা থেকে ইখতিলাফ ধারণা করা হয়েছে।
আনাস রা.-এর পুত্র আবু উমাইর বলেন, আমাকে আমার আনসারী চাচাগণ, যারা সাহাবী ছিলেন, হাদীস বর্ণনা করেছেন যে-
قالوا : أغمي علينا هلالُ شوال، فأصبحنا صياما، فجاء ركب آخر النهار، فشهدوا عند رسول الله صلى الله عليه وسلم أنهم رأوا الهلال بالأمس، فأمر رسول الله صلى الله عليه وسلم الناسَ أن يُفْطِروا ويَخْرُجُوا إلى عيدهم من الغد.
একবার মেঘের কারণে শাওয়ালের চাঁদ আমাদের দৃষ্টিগোচর হল না। ফলে পরদিন আমাদের সকাল হল (রমযানের ত্রিশতম) রোযা অবস্থায়। দিনের শেষে এক কাফেলা এল এবং আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে সাক্ষ্য দিল যে, তারা গত রাতে চাঁদ দেখেছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লোকদের আদেশ করলেন, এখন রোযা ভেঙ্গে ফেল আর আগামীকাল ঈদের জন্য বের হও। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস : ৯৫৫৪; মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, হাদীস : ৭৩৩৯; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস : ১৬৫৩; আসসুনানুল কুবরা, বায়হাকী খ. ৩, পৃ. ৩১৬; খ. ৪, পৃষ্ঠা ২৪৯)
ইমাম বায়হাকী রাহ. প্রথম জায়গায় এ হাদীসের সনদকে সহীহ আর দ্বিতীয় জায়গায় ‘হাসান’ বলেছেন। সর্বাবস্থায় তা দলীল হিসেবে গ্রহণযোগ্য। শব্দের কিছু পার্থক্যের সাথে এ হাদীস সুনানে আবু দাউদ (১১৫০), সুনানে নাসায়ী (১৭৫৬), মুসনাদে আহমদ খ. ৫, পৃ. ৫৭, ৫৮) ও সহীহ ইবনে হিববানেও (৩৪৫৬) আছে।
এ হাদীস থেকে সাধারণভাবে এটাই বোঝা যায় যে, এই কাফেলা মদীনা থেকে অন্তত এক দিনের দূরত্বে থাকা অবস্থায় চাঁদ দেখেছে। তারা যদি রাতেও সফররত থেকে থাকেন তাহলে অন্তত দেড় দিনের দূরবর্তী স্থান থেকে মদীনায় পৌঁছেছেন। অর্থাৎ তাঁরা সম্ভবত পঁচিশ-ছাবিবশ মাইল দূরের এলাকায় চাঁদ দেখে থাকবেন। বোঝা গেল, কাছাকাছি এলাকাসমূহে এক জায়গার চাঁদ দেখা অন্য জায়গার জন্য অবশ্যগ্রহণীয়। প্রতি যুগে উম্মাহর সম্মিলিত কর্মও এরূপই ছিল। ইমামগণের মাঝে যে ইখতিলাফ হয়েছে তা দূরবর্তী অঞ্চলসমূহের ক্ষেত্রেই হয়েছে।
তবে যদি দুই অঞ্চলের মাঝের দূরত্ব এতো বেশি হয় যে, উভয় জায়গার মাঝে সময়ের ব্যবধানও খুব বেশি। যার ফলে সহজ-স্বাভাবিকভাবে এক জায়গার চাঁদ দেখা অনুযায়ী অন্য জায়গায় আমল করা সম্ভব হয় না। এ ধরনের ক্ষেত্রেও কি এক অঞ্চলের চাঁদ দেখা অন্য অঞ্চলের জন্য প্রযোজ্য হওয়ার বিষয়টি ইখতিলাফী? কেউ কেউ এমনটি ধারণা করে থাকলেও একাধিক গবেষক আলিমের মতে, এক্ষেত্রে এক এলাকার চাঁদ দেখা অন্য এলাকার জন্য অবশ্যগ্রহণীয় না হওয়া ইজমায়ী ও সর্বসম্মত। যথাস্থানে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হবে ইনশাআল্লাহ।
দুই. মাযহাবসমূহের বিবরণে যাওয়ার আগে যে দুই বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছি তার দ্বিতীয় বিষয়টি এই যে, যে দূরবর্তী অঞ্চলসমূহের মাঝে এক জায়গার চাঁদ দেখা অন্য জায়গার জন্য ধর্তব্য হওয়ার ক্ষেত্রে ইমামগণের মাঝে ইখতিলাফ আছে এ ধরনের একাধিক অঞ্চল যদি একই প্রশাসক বা বিচারক (কিংবা স্বীকৃত হেলাল কমিটির) অধীনে থাকে এবং সেখানে কোনো এক জায়গায় চাঁদ দৃষ্টিগোচর হওয়ার ভিত্তিতে গোটা অঞ্চলের জন্য চাঁদের ফয়সালা করে দেওয়া হয় তাহলে আলিমগণের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত এই যে, ঐ অঞ্চলগুলোর সকল অধিবাসীর জন্য ঐ চাঁদ দেখা অনুসরণ করা জরুরি।
এ সিদ্ধান্ত ঐ আলিমগণেরও, যারা দূরবর্তী শহরনগরের ক্ষেত্রে ইখতিলাফুল মাতালি (চাঁদের উদয়স্থলের বিভিন্নতা) গ্রাহ্য করেন এবং মনে করেন এক এলাকার চাঁদ দেখা অন্য এলাকার জন্য ধর্তব্য নয়।
আল্লাহ তাআলার তাওফীক হলে এ দিকটি নিয়েও বিস্তারিত ও দালীলিক আলোচনার ইচ্ছা আছে। এখানে শুধু ইঙ্গিত করাই উদ্দেশ্য, যাতে সামনে বিষয়টি বুঝতে অসুবিধা না হয়।
মাযহাবসমূহের বিবরণ
মাযহাবের বিবরণ সাহাবা-যুগ থেকে ধারাবাহিকভাবে উপস্থাপন করা সঙ্গত মনে হচ্ছে।
সাহাবা-যুগ
শতবর্ষব্যাপী সাহাবা-যুগ, যাতে খিলাফতে রাশিদার ত্রিশ বছরের সোনালী আমলও অন্তর্ভুক্ত, (যাকে খিলাফত আলা মিনহাজিন নুবুওয়াহ্র আমল বলে) তাতে এ রীতিই অনুসৃত ছিল যে, প্রত্যেক এলাকার অধিবাসীগণ নিজ নিজ চাঁদ দেখা অনুসরণ করতেন। কাছাকাছি জায়গা থেকে কোনো নির্ভরযোগ্য শাহাদত (সাক্ষ্য) এসে গেলে তা-ও গ্রহণ করা হত, কিন্তু অন্য জায়গা থেকে শাহাদত সংগ্রহ করা কিংবা অন্যান্য জায়গায় শাহাদত পাঠানো বা শাহাদতের ভিত্তিতে দারুল খিলাফায় (রাজধানীতে) যে ফয়সালা হয়েছে তা অন্য অঞ্চলে পাঠানোর কোনো আয়োজন করা হত না। হাদীস-সীরাত ও তারীখের কিতাবে এর একটি নজিরও আমাদের চোখে পড়েনি। কেউ যদি কোনো নির্ভরযোগ্য কিতাব থেকে নির্ভরযোগ্য সনদে নবী-যুগ বা খিলাফতে রাশিদা-যুগের এমন কোনো নজির দেখিয়ে দেন তাহলে আমরা তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকব।
ঐ যুগের সাধারণ অবস্থা অনুসারে দূর-দূরান্তের অঞ্চল থেকে চাঁদের খবর পাওয়ার কথা চিন্তাই করা যেত না। কিন্তু কুদরতের কারিশমা, সাহাবা-যুগে ঘটনাচক্রে সংঘটিত এমন একটি ঘটনা হাদীসের কিতাবে সংরক্ষিত হয়ে গেছে। সহীহ মুসলিম ও মুসনাদে আহমদসহ হাদীসের অনেক কিতাবে তা সহীহ সনদে বর্ণিত হয়েছে। এ ঘটনায় দেখা যাচ্ছে, শামে চাঁদ দেখার সংবাদ মদীনাবাসী জানতে পেরেছেন। শাম (দামেশক) মদীনা থেকে স্থলপথে ১৯২৮ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। আর দামেশক ৩৩̊ উত্তর অক্ষাংশে, ৩৬̊ পূর্ব দ্রাঘিমাংশে এবং মদীনা ২৪̊ উত্তর অক্ষাংশে, ৩৯̊ পূর্ব দ্রাঘিমাংশে অবস্থিত।
ঘটনাটি এই যে, তাবেয়ী কুরাইব ইবনে আবী মুসলিম (৯৮ হি.)-কে উম্মুল ফযল বিনতুল হারিছ কোনো কাজে মুয়াবিয়া রা.-এর কাছে শামে পাঠিয়েছিলেন। তিনি তাঁর কাজ সমাপ্ত করলেন। ইতিমধ্যে শামে রমযানের চাঁদ দেখা গেল এবং জুমার রাতে (বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে) চাঁদ দেখা গেল এবং জুমাবার থেকে রোযা শুরু হল। কুরাইব মাসের শেষের দিকে মদীনায় পৌঁছলেন। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা., যিনি ছিলেন কুরাইবের মাওলা, কথাপ্রসঙ্গে কুরাইবকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমরা কবে চাঁদ দেখেছ?’ কুরাইব বললেন, ‘জুমা-রাতে।’ ইবনে আববাস রা. জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি নিজে দেখেছ?’ তিনি বললেন, ‘হাঁ, আমিও দেখেছি, অন্যরাও দেখেছেন। সবাই রোযা রেখেছেন। মুয়াবিয়া রা.-ও (ঐ সময়ের আমীরুল মুমিনীন) রোযা রেখেছেন।’ আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা. বললেন,
لكنا رأيناه ليلة السبت، فلا نزال نصوم حتى نكمل ثلاثين، أو نراه
‘কিন্তু আমরা তো শনিবার রাতে (শুক্রবার দিবাগত রাতে) চাঁদ দেখেছি। অতএব আমরা আমাদের হিসাবমত ত্রিশ রোযা পুরা করব, তবে যদি (২৯ তারিখ দিবাগত রাতে) চাঁদ দেখি সেটা আলাদা কথা।’
কুরাইব জিজ্ঞাসা করলেন-
أولا تكتفي برؤية معاوية وصيامه
‘আপনি কি মুয়াবিয়া রা.-এর চাঁদ দেখা ও রোযা রাখাকে যথেষ্ট মনে করবেন না?’
আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা. বললেন-
لا، هكذا أمرنا رسول الله صلى الله عليه وسلم
‘না, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে এ আদেশই করেছেন।’
(সহীহ মুসলিম ১০৮৭; মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ২৭৮৯; জামে তিরমিযী, হাদীস : ২৩৩২; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ৬৯৩; সুনানে নাসায়ী, হাদীস : ২১১১)
এ ঘটনা সম্পূর্ণ পরিষ্কার। কুরাইব একজন তাবেয়ী ও ছিকা (বিশ্বস্ত, নির্ভরযোগ্য) ব্যক্তি এবং আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা.-এর অতি ঘনিষ্ট। আর আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা.-এর কাছে রমযান সম্পর্কে এক ব্যক্তির সংবাদই যথেষ্ট। তিনি নিজেই হাদীস বর্ণনা করেছেন যে, রমযানের চাঁদের বিষয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক বেদুঈনের (আ’রাবীর) সাক্ষ্য গ্রহণ করেছেন (বায়হাকী খ. ৩, পৃ. ২১১-২১২)।
আর কুরাইব শুধু নিজের চাঁদ দেখার সংবাদ দেননি, আমীরুল মুমিনীনের নিকট চাঁদ দেখা প্রমাণিত হওয়া ও তা কার্যকর হওয়ার সংবাদ দিয়েছেন।
যাই হোক, এ সংবাদের উপর নির্ভর করে এই ফয়সালা করা যে, রমযান মূলত জুমাবারেই শুরু হয়েছে। আমরা চাঁদ দেখিনি এবং যথাসময়ে অন্য জায়গার চাঁদ দেখার সংবাদও পাইনি। এ কারণে আমাদের একটি রোযা কাযা হয়ে গেছে। কুরাইবের সংবাদের ভিত্তিতে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার ক্ষেত্রে কোনো বাধা ছিল না। ইবনে আববাস রা.কে যদি দূরবর্তী অঞ্চলের এই চাঁদ দেখা গ্রহণ করতে হত তাহলে মাসআলার দিক থেকে তা গ্রহণের ক্ষেত্রে অন্য কোনো বাধা ছিল না। কিন্তু তিনি তা গ্রহণ করেননি; বরং বলেছেন-
هكذا أمرنا رسول الله صلى الله عليه وسلم
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে এমনই আদেশ করেছেন।
এখন এটা আলাদা বিষয় যে, আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা.-এর কাছে এ বিষয়ে (দূরবর্তী অঞ্চলের চাঁদ দেখা ধর্তব্য হওয়া না হওয়া) আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কোনো সুস্পষ্ট নির্দেশ ও নির্দেশনা ছিল, না তিনি এর দ্বারা আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ঐ বাণীর দিকেই ইঙ্গিত করেছেন, যা তাঁর মতো আরো অনেক সাহাবী বর্ণনা করেছেন। অর্থাৎ যে বাণীতে (তোমরা চাঁদ দেখে রোযা রাখ এবং চাঁদ দেখে রোযা ছাড়) এর নির্দেশ রয়েছে।
আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা. বলেন-
إني لأعجب من هؤلاء الذين يصومون قبل رمضان، إنما قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : إذا رأيتم الهلال فصوموا وإذا رأيتموه فأفطروا، فإن غُمَّ عليكم فعُدُّوا ثلاثين.
ঐ সকল লোকের উপর আমার আশ্চর্য হয়, যারা রমযান আসার আগেই রোযা রাখতে শুরু করে। আল্লাহর রাসূল সাললাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তো বলেছেন, যখন তোমরা চাঁদ দেখবে তখন রোযা রাখবে এবং যখন (দ্বিতীয়) চাঁদ দেখবে তখন রোযা ছাড়বে। চাঁদ যদি আড়ালে থাকে তাহলে ত্রিশ সংখ্যা পূর্ণ করবে। (আসসুনানুল কুবরা, বায়হাকী ৪/২০৭)
আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা. এ-ও বর্ণনা করেছেন-
قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : لا تقدموا الشهر بصيام يوم ولا يومين، إلا أن يكون شيئا يصومه أحدكم، ولا تصوموا حتى تروه، ثم صوموا حتى تروه، فإن حال دونه غمامة فأتموا العدة ثلاثين.
তোমরা একটি বা দুটি রোযার দ্বারা (রমযান) মাসের চেয়ে অগ্রগামী হয়ো না। তবে যদি তোমাদের কারো (অভ্যাসগত নফল) রোযার দিবস হয়, যা সে আগে থেকে রেখে আসছে তাহলে আলাদা কথা। আর তোমরা চাঁদ দেখার আগে রোযা রাখবে না এবং (দ্বিতীয়) চাঁদ দেখা পর্যন্তই রোযা রাখবে। যদি মেঘের কারণে চাঁদ দেখা না যায় তাহলে ত্রিশ সংখ্যা পূর্ণ করবে। (আসসুনানুল কুবরা, বায়হাকী ৪/২০৭)
আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা.-এর কাছে যদি এ বিষয়ে (দূরবর্তী অঞ্চলের চাঁদ দেখা অবশ্যগ্রহণীয় না হওয়ার বিষয়ে) কোনো সুস্পষ্ট বাণী না-ও থেকে থাকে এবং তিনি ‘রাসূলের আদেশ’ বলে উপরোক্ত হাদীসের প্রতিই ইঙ্গিত করে থাকেন, তবুও তো এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, তিনি
صوموا لرؤيته وأفطروا لرؤيته
(তোমরা চাঁদ দেখে রোযা রাখ চাঁদ দেখে রোযা ছাড়।) শীর্ষক হাদীসের এই অর্থই বুঝেছেন যে, এ হাদীসে নিজ এলাকা ও নিকটবর্তী এলাকার চাঁদ দেখা উদ্দেশ্য। দূরবর্তী এলাকার চাঁদ দেখা উদ্দেশ্য নয়।
আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা.-এর এ অনুধাবনের সাথে কোনো মুজতাহিদ ইমামের যদি দ্বিমত থাকে তবে থাকতে পারে, কিন্তু এর দ্বারা দুটি বিষয় সুস্পষ্টভাবে সামনে আসে :
এক. صوموا لرؤيته শীর্ষক হাদীসের এ ব্যাখ্যাই নির্ধারিত নয় যে, ‘যেখানেই চাঁদ দেখা যাক তোমরা রোযা শুরু কর, দূরবর্তী অঞ্চলের চাঁদ দেখাও তোমাদের জন্য অবশ্যগ্রহণীয়।’ কারণ আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা. একজন ফকীহ সাহাবী এবং তিনি নিজে ঐ হাদীস আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে শুনেছেন, কিন্তু তিনি এর ঐ অর্থ বোঝেননি।
দুই. আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা.-এর মাযহাব এই ছিল যে, দূরবর্তী এলাকার চাঁদ দেখা অবশ্যগ্রহণীয় নয়; নিজ এলাকার চাঁদ দেখাই আমলযোগ্য।
এখন তো আমি মাযহাবই বর্ণনা করছি। তো সাহাবা-যুগে আমরা সাহাবী আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা.-এর এই মাযহাব পেলাম যে, তিনি দূরবর্তী অঞ্চলের চাঁদ দেখা ধর্তব্য মনে করেননি। আর এ বিষয়ে অন্য কোনো সাহাবী তাঁর সাথে দ্বিমত করেছেন এমন তথ্য আমাদের জানামতে হাদীসের কিতাবসমূহে বর্ণিত হয়নি।
ইমাম ইবনে আবদুল বার রাহ. (৩৬৮-৪৬৩ হি.) মুয়াত্তা মালিকের ভাষ্যগ্রন্থ ‘‘আততামহীদ’’ কিতাবে এ বিষয়ে ইমামগণের মাযহাব বর্ণনা করতে গিয়ে প্রথম মত এই উল্লেখ করেছেন যে, অন্য এলাকার চাঁদ দেখা অবশ্যগ্রহণীয় নয়। তিনি লেখেন, এটাই আবদুল্লাহ ইবনে আববাস (সাহাবী) (৬৮ হি.), ইকরিমা (১০৭ হি.), কাসিম বিন মুহাম্মাদ (১০৭ হি.) ও সালিম বিন আবদুল্লাহ (১০৬ হি.) (এই তিনজন তাবেয়ী)-এর মাযহাব। এবং ইসহাক ইবনে রাহূয়াহও (২৩৮ হি.) এ কথাই বলেছেন। এরপর ইবনে আবদুল বার দ্বিতীয় মাযহাব বর্ণনার পর স্পষ্ট ভাষায় লেখেন,
إلى القول الأول أذهب، لأن فيه أثرا مرفوعا، وهو حديث حسن تلزم به الحجة
আমি প্রথম মতই গ্রহণ করি। কারণ এর সমর্থনে একটি মারফূ হাদীস আছে, যা সনদের বিচারে দলীলযোগ্য। আর তা এক বড় সাহাবীর মাযহাব। সাহাবীদের মধ্যে কেউ এ বিষয়ে তার বিরোধিতা করেননি। পাশাপাশি এটি ফকীহ-তাবেয়ীগণের একটি জামাতেরওসিদ্ধান্ত। (আততামহীদ খ. ১৪, পৃ. ৩৫৬-৩৫৮, নাফে-এর সূত্রে বর্ণিত চল্লিশতম হাদীসের আলোচনায়)
সারকথা এই যে, সাহাবা-যুগে দূরবর্তী অঞ্চলের চাঁদ দেখা ‘অবশ্যগ্রহণীয়’ না হওয়ার বিষয়ে এক বড় ফকীহ সাহাবী আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা.-এর মাযহাব পাওয়া গেল। এর বিপরীতে অন্য কোনো সাহাবীর কোনো কথা পাওয়া যায়নি।
(চলবে ইনশাআল্লাহ)
[আগামী সংখ্যায় পড়ুন : ‘‘তাবেয়ী-যুগ’’ ও ‘‘চার মাযহাবের মুজতাহিদ ইমাম ও অন্যান্য ফকীহগণের সিদ্ধান্ত’’।]