শাওয়াল ১৪৩৪   ||   আগস্ট ২০১৩

বুযুর্গদের ইন্তেকালের ধারাবাহিকতা : আল্লাহ আমাদের উপর দয়া করুন

মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক

একের পর এক আল্লাহওয়ালা ও আহলে ইলম আমাদের মাঝ থেকে বিদায় নিতে চলেছেন। চারদিকে আজ যেন শুধু অন্ধকার আর অন্ধকার। হায়, এখনো যদি আমাদের একটু অনুভূতি হতো! দু একজন বুযুর্গ আল্লাহওয়ালা ও আহলে ইলম, যারা এখনো বেঁচে আছেন আমরা যদি তাঁদের কদর করতাম, তাঁদের থেকে ইস্তিফাদা করতাম! বিশেষ করে তালিবানে ইলমের মধ্যে যদি এই জযবা সৃষ্টি হত যে, সালাফের নমুনা বানানোর জন্য নিজেদেরকে ওয়াকফ করে দিতেন! এখন তো অবস্থা এমন যে, যিনি চলে যাচ্ছেন তার কোনো নমুনা থাকছে না। যিনি যেখান থেকেই যাচ্ছেন সেখানেই শুধু শূন্যতা বিরাজ করছে।

মাওলানা মুবারক কারীম রাহ. (১৩৩৪-১৪৩৪ হি.)

গত ২৯ জুমাদাল উলা ১৪৩৪ হিজরী, মোতাবেক ১১ এপ্রিল ২০১৩ ঈসায়ী, বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত অর্থাৎ জুমারাত দেশের প্রবীণতম বুযুর্গ হযরত মাওলানা মুবারক কারীম (পীর সাহেব উজানী) আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে গেছেন।

কুদরতীভাবে হযরত রাহ. ও তাঁর ভাই হযরত মাওলানা শরাফত কারীম রাহ. (যিনি বয়সে তাঁর ছোট, কিন্তু তাঁর কয়েক বছর আগেই ইন্তেকাল করে গেছেন।)-এর সাথে আমাদের ঘনিষ্ঠতা ছিল। কারণ আমাদের পৈত্রিক নিবাস শরশপুর এবং আমাদের বিদ্যাপীঠ খেড়িহর মাদরাসা ও এর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে ইসলাহ ও ইরশাদ এবং ওয়ায ও নসীহতের উদ্দেশে তাঁর আগমন ঘটত। খেড়িহর থেকে দক্ষিণে কয়েক মাইল দূরে দৌলতপুর (বর্তমান উসমান আবাদ), চাটখিল, নোয়াখালি ছিল হযরতের দাদার বাড়ি। মদীনা মক্কা থেকে দক্ষিণ দিকে- এ বিষয়টি মাথায় রেখে তাঁর পিতামহ হযরত মাওলানা কারী ইবরাহীম সাহেব রাহ. (১৮৬৩-১৯৪৩ ঈ.) দৌলতপুর থেকে উত্তর দিকে সরে এসে উজানীতে (কচুয়া, চাঁদপুর) বসতি গড়ে তোলেন এবং সেখানেই মাদরাসা ও খানকাহর কার্যক্রম চালু করেন।

কারী ইবরাহীম রাহ.-এর দুইজন পত্নী ছিলেন। একজন হলেন আরবের মক্কা মুকাররমার অধিবাসী। তাঁর ঘরে হযরতের যে সকল সন্তানাদি জন্মগ্রহণ করেছেন তাদের মধ্যে হযরত মাওলানা কারী শামসুল হক রাহ. (১৯৭৩ ঈ.) ছিলেন বিশেষ ব্যক্তিত্বের অধিকারী। আর তাঁরই পুত্র হলেন মাওলানা মুবারক কারীম রাহ.।

মাওলানা মুবারক কারীম রাহ. হিজরী ১৩৩৪, মোতাবেক বাংলা ১৩২০ সনে জন্মগ্রহণ করেন। উজানী মাদরাসায় প্রাথমিক শিক্ষা লাভের পর নোয়াখালি ইসলামিয়ায় উচ্চ শিক্ষা অর্জন করেন। শরহে বেকায়া, হেদায়া, জালালাইন ইত্যাদি সেখানেই অধ্যয়ন করেন। তিনি নোয়াখালির প্রসিদ্ধ আলেম হযরত মাওলানা গিয়াস উদ্দীন রাহ. ও হযরত মাওলানা কাসিম রাহ.-এরও শিষ্যত্ব লাভ করেন।

তাঁর তালীম-তারবিয়তে যাদের বিশেষ অবদান ছিল তাদের মধ্যে তাঁর ফুফা হযরত মাওলানা নূরুল্লাহ রাহ. (নোয়াখালি), অপর ফুফা ফখরে বাঙাল হযরত মাওলানা তাজুল ইসলাম রাহ., চাচা হযরত মাওলানা ইসমাঈল রাহ. ও শ্রদ্ধেয় পিতা হযরত মাওলানা কারী শামসুল হক রাহ.-এর ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি পিতা থেকে খেলাফত ও বাইয়াতের ইজাযতপ্রাপ্ত হন।

শৈশব থেকেই তাঁর উপর ছিল দাদাজানের সেণহের ছায়া। তাঁর অভ্যাস এই ছিল যে, প্রতিদিন মাদরাসায় রওনা হওয়ার সময় বাড়ি (যা উজানী মাদরাসার দক্ষিণে পাঁচ পুকুরিয়ায় অবস্থিত) থেকে বের হয়ে প্রথমে দাদাজানের কাছে যেতেন। তিনি মাদরাসার পশ্চিম দিকে এক বাড়িতে থাকতেন। দাদাজানের কাছ থেকে দুআ ও ইজাযত নিয়ে মাদরাসায় উপস্থিত হতেন। (তাঁর হেদায়াতুন্নাহুর বছর) দাদাজানের মৃত্যুর দিন পর্যন্ত এটা ছিল তাঁর প্রতিদিনের কাজ।

ইন্তিকালের দিন তিনি দুআ ও ইজাযতের জন্য গেলেন। তবে সেদিনের বিষয়টি ছিল একটু ব্যতিক্রম। সেদিন দাদাজান বললেন, ফেরার সময় এদিক হয়ে যেও। তাই ফেরার সময় তিনি দেখা করতে গেলেন আর এর কিছু সময় পরই হযরত রাহ.-এর ইন্তেকাল হয়ে যায়।

ওয়াজ ও নসীহত এবং তালকীন ও ইরশাদই ছিল হযরত মাওলানা মুবারক কারীম রাহ.-এর কর্মজীবন। তাঁর দ্বারা হাজার হাজার মানুষের জীবনে আসে আমূল পরিবর্তন। নিজেদের মধ্যে নূরানিয়ত লাভ করেন হাজার হাজার মানুষ। তিনি অতি সহজ-সরলভাবে আমল ও ইসলাহের কথা বলতেন এবং ফার্সী ও উর্দু কবিতা আওড়াতেন। ১৪০৩ হিজরী থেকে উজানী মাদরাসার ইহতিমাম ও পরিচালনার দায়িত্বও তাঁর কাঁধে অর্পিত হয়।

হযরত রাহ. সম্পর্কে এ তথ্যগুলো আমাকে দিয়েছেন হযরতের দৌহিত্র মৌলভী মুহাম্মাদ হারুন ইবনে মুহাম্মাদ আবু তাহের। হযরতের হুসনে আখলাক সম্পর্কে আমাকে আরও একটি তথ্য তিনি দিয়েছেন, যা আমার আগে জানা ছিল না। আর তা এই যে, হযরত সব সময় খাদেমদেরকে নিয়ে এবং বাড়ির কাজের লোকদেরকে সঙ্গে নিয়ে একই দস্তরখানে খাবার খেতেন। আর সাধারণত তিনি নিজেই খাবার বণ্টন করতেন।

আল্লাহ তাআলা হযরত রাহ.কে জান্নাতুল ফেরদাউসের উচ্চ মাকাম দান করুন। দুনিয়ার এই শতবর্ষী জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে অফুরন্ত জীবনের জন্য সদকায়ে জারিয়া বানান। আমীন।

আমি জানতে পেরেছি যে, হযরতের আত্মীয়স্বজন ও ভক্তবৃন্দ হযরতের বিস্তারিত জীবনী সংকলনের উদ্যোগ নিয়েছেন এবং এর কিছু কাজও শুরু হয়েছে। আল্লাহ তাআলা এই মহৎ কাজে পূর্ণ সাহায্য করুন এবং সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে তা সমাপ্ত করার তাওফীক দান করুন। আমীন।

আগেই বলা হয়েছে যে, তিনি তরীকতের সনদ তাঁর পিতা থেকে লাভ করেছেন। তিনি তাঁর পিতা কারী ইবরাহীম রাহ. থেকে লাভ করেছেন। আর কারী সাহেব রাহ. ছিলেন হযরত মাওলানা রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী রাহ.-এর মুজায।

কারী ইবরাহীম রাহ.-এর খলীফাগণের মধ্যে চরমোনাইয়ের হযরত মাওলানা ইসহাক রাহ.ও শামিল। যিনি হলেন হযরত মাওলানা ফজলুল কারীম রাহ.-এর শ্রদ্ধেয় পিতা এবং শায়খ ও মুর্শিদ। আকাবিরের তিরোধানের পর যে বন্ধুগণ এখন তাদের সিলসিলার ঝান্ডাবাহী হয়েছেন তাদের ও আমাদের সকলকে সর্বদা মনে রাখতে হবে যে, তরীকতের মূলকথা হল তাযকিয়ায়ে নফস ও ইসলাহে কলব। যার রূহ হল আত্মার সকল ব্যাধি থেকে পবিত্রতা লাভ করা, তাকওয়া অর্থাৎ গুনাহসমূহ থেকে বেঁচে থাকা এবং সংযমের জীবন অবলম্বন করা ও ধীরে ধীরে ইহসানের মাকামে উত্তীর্ণ হওয়া। 

মূর্খতার কারণে কিংবা বিভিন্ন বাহানায় তরীকতের মধ্যে যেসব ভুল চিন্তা, ভ্রান্ত মতবাদ, মুনকার রেওয়ায়েত, গর্হিত কাজকর্ম এবং অনর্থক রসম ও রেওয়াজের অনুপ্রবেশ ঘটেছে তা থেকে পাকসাফ থাকাই হযরত গাঙ্গুহী রাহ.-এর সিলসিলায়ে তরীকতের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। আর এটি সকল যুগের আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের আকাবির ও মাশায়েখের একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যও বটে। তাই আমাদের উপর ফরয হল আমরা যেন এর প্রতি লক্ষ্য রাখি। এটি শরীয়তের দৃষ্টিতেও ফরয আবার সিলসিলার উসূল অনুযায়ীও ফরয। আর আকাবিরের উসূল তো শরীয়তের দলিল-প্রমাণের ভিত্তিতেই হয়ে থাকে। অন্যথায় তাঁরা আমাদের আকাবির ও অনুসরণীয়ই বা হবেন কীভাবে?

نيست حجت قول پير وامر پير +   قول حق وفعل احمد را بگير

অর্থ : পীরের কথা ও কাজ দলিল নয় (যদি সুন্নাহ-নির্ভর না হয়)। আল্লাহর বাণী ও রাসূলের সুন্নাহকে আঁকড়ে ধর।

এটি তো দেওবন্দী মাকতাবায়ে ফিকিরের অতি প্রসিদ্ধ ও সর্বজনগৃহীত দর্শন।

যেমন, যিকিরের কালেমাসমূহ সহীহশুদ্ধ ও তাজবীদের সাথে উচ্চারণ করা জরুরি। এতে কোনো প্রকার অবহেলা করা উচিত নয়। সাধারণ লোকদেরকে কুরআন সহীহ-শুদ্ধ করা ও যিকিরের শব্দসমূহ সহীহ-শুদ্ধ করার প্রতি উদ্বুদ্ধ করা জরুরি।

তেমনিভাবে যিকির আস্তে বা উঁচু আওয়াজ উভয় পদ্ধতিতে জায়েয হলেও চিৎকার করে যিকির করা কিন্তু নিষিদ্ধ।  (যিকির তো ওয়াজ নয়, এটি হল ইবাদত। তাই এতে স্পীকার ব্যবহার করা বিশেষত আওয়াজ যদি হালকার বাইরে পৌঁছে থাকে তবে তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।) এ থেকে বিরত থাকা জরুরি। যিকিরের সময় যদি অনিচ্ছায় কারো ওয়াজদ-এর অবস্থা সৃষ্টি হয় তবে সে মাজুর। কিন্তু কৃত্রিমভাবে এমন করা হারাম। এমনকি এই অবস্থা কামনা করাও ঠিক নয়। বরং যিকিরের সময় স্থিরতা ও গাম্ভীর্য কাম্য।

অলিক কল্পকাহিনী, যা দ্বারা আকীদা-বিশ্বাসের মধ্যে সংশয় সৃষ্টি হওয়ার কিংবা শরীয়ত পরিপালনে উদাসীনতা সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা হয় তা থেকে বেঁচে থাকা জরুরি। কোনো কিছু বয়ান করতে হলে দায়িত্বশীলতার সাথে তাহকীক করার পর বয়ান করা উচিত। কোনো রেওয়ায়েত কিংবা কোনো মাসআলা তাহকীক করা ছাড়া বলা- করা নাজায়েয।

আর শুধু যিকিরকেই যথেষ্ট মনে করা জায়েয নয়। আকীদা পরিশুদ্ধ করা, ফরয-ওয়াজিবসমূহের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া, হকসমূহ আদায় করা, মুআমালা-লেনদেনে স্বচ্ছতা, গুনাহসমূহ থেকে বেঁচে থাকা, সামাজিকতার ক্ষেত্রে ইসলামের তালীম ও শিক্ষা মেনে চলা এবং আত্মার ব্যাধিসমূহের সংশোধন করা ও এর প্রতি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া তরীকতের প্রতীক ও শিআর হওয়া উচিত। শরীয়ত ও সুন্নতের অনুসরণই হল আমাদের কাজ আর শরীয়তের দলিল-প্রমাণসমূহ হল আমাদের দলিল।

সুতরাং ফরযে আইন পরিমাণ ইলমের ব্যাপক প্রচার-প্রসার করা জরুরি। এ বিষয়ে মুরীদদেরকে কোনো ছাড় দেওয়া উচিত নয়। এটি তো অতি লজ্জার বিষয় যে, কেউ বারো তাসবীহ অতি গুরুত্বের সাথে আদায় করে অথচ কুরআনের তিলাওয়াত শিখে না। দস্তরখান ব্যবহারের সুন্নত হাতছাড়া করে না, কিন্তু হালাল-হারামের মাসআলা জানে না। আর কার্যকরভাবেও এর প্রতি যত্নশীল হয় না। পাগড়ির সুন্নত ভুলেও ছুটে না, কিন্তু নামাযের রোকন ও ওয়াজিবসমূহ আদায় এবং নামাযের সূরা-কেরাত শুদ্ধ করার প্রতি কোনো গুরুত্ব নেই।

আল্লাহ তাআলা হযরত মাওলানা কারী ইবরাহীম রাহ. এবং তাঁর সিলসিলার সকল আকাবিরের প্রতি পূর্ণ রহমত নাযিল করুন, যারা সহীহ-শুদ্ধভাবে কুরআন তিলাওয়াত এবং কুরআনী শিক্ষার প্রচার-প্রসারের লক্ষ্যে নিজেদের জীবন ওয়াকফ করে দিয়েছেন।

রুশদ ও হেদায়েত এবং ঈমান  ও কুরআনের বিষয়ে এই পূর্ববাঙলা যে সকল আউলিয়ায়ে কেরামের নিকট দায়বদ্ধ তাঁদের মধ্যে হযরত মাওলানা কারী ইবরাহীম রাহ. এবং তাঁর সিলসিলার বুযুর্গগণ বিশেষভাবে অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ তাআলা তাঁদেরকে উম্মতের পক্ষ থেকে উত্তম প্রতিদান দান করুন। আমীন।

হযরত মাওলানা হাকীম মুহাম্মাদ আখতার রাহ.

মাওলানা মুবারক কারীম রাহ.-এর পর মাত্র এক মাসের ব্যবধানে ২২ রজব ১৪৩৪ হিজরী, মোতাবেক ২ জুন ২০১৩ ঈসায়ী, রবিবার সন্ধ্যায় পরপারে পাড়ি জমালেন উপমহাদেশের প্রসিদ্ধ মুর্শিদ, পীরে তরিকত হযরত মাওলানা হাকীম মুহাম্মাদ আখতার (করাচির হযরত) রাহ.।

হযরত হাকীম সাহেব রাহ. আল্লাহ তাআলার সেসব তাওফীকপ্রাপ্ত বান্দাদের একজন, যাদের প্রতি আল্লাহ তাআলার বিশেষ তাওয়াজ্জুহ থাকে। যাদেরকে আল্লাহ তাআলা অগণিত গুণ-বৈশিষ্ট্য ও নেয়ামত দ্বারা পরিপূর্ণ করে দেন। প্রথমদিকে হযরত বিভিন্ন মুজাহাদার তাওফীকপ্রাপ্তির নেয়ামত লাভ করেন। পরবর্তীতে সেসব মুজাহাদার ফসল-ঈমান ও আমলের তারাক্কী, সর্বদা নানামুখী দ্বীনী খেদমতের সুযোগ এবং আল্লাহর খাস বান্দাদের মুহাববত ও বান্দাদের মাঝে গ্রহণযোগ্যতার নেয়ামত লাভ করেন।

ذلك فضل الله يؤتيه من يشاء، والله ذو الفضل العظيم

হযরত রাহ.-এর দ্বীনী খেদমত সময়ের হিসাবে অর্ধ শতাব্দীরও বেশি। আর তার বিস্তৃতি সমগ্র বিশ্বময়। হযরত রাহ. সম্পর্কে অনেক কিছুই লেখা হচ্ছে এবং অনেক কিছুই লেখা হবে। আলহামদুলিল্লাহ তিনি অনেক বড় মাদরাসা (যার অনেকগুলো শাখা রয়েছে) ও অনেক বড় খানকাহ (আমাদের দেশেও যার শাখা আছে), হাজার হাজার মুরীদ, ভক্ত ও অনুরাগী রেখে গেছেন। এগুলো ইনশাআল্লাহ কিয়ামত পর্যন্ত তাঁর জন্য সদকায়ে জারিয়া হবে।

আমি শুধু এতটুকু আরজ করছি যে, তাঁর কথা ও কাজের মূল্যায়ন করা বড়দের কাজ। আমি তো একজন ক্ষুদ্র তালিবে ইলম। তাঁর প্রতি আমার মুহাববত এজন্য যে, মাশায়েখের প্রতি নিজেকে বিলীন করার গুণ ছিল তাঁর মাঝে। তাঁর প্রথম শায়খ হযরত মাওলানা আবদুল গনী ফুলপুরী রাহ., দ্বিতীয় শায়খ হযরত মাওলানা আবরারুল হক সাহেব হারদুঈ রাহ. ও আরো একজন শায়খ হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ আহমদ প্রতাবগড়ি সকলের ব্যাপারে তাঁর কর্মপন্থা ছিল অভিন্ন।

দ্বিতীয় বিষয় এই যে, আমাদের আকাবিররা তাঁর অনেক কদর করতেন। হযরত মাওলানা মুফতী শফী রাহ., হযরত মাওলানা ইউসুফ বানূরী রাহ.সহ সে যুগের সকল আকাবির তাঁর প্রশংসাকারী ও কদরদান ছিলেন।

তৃতীয় কথা এই যে, তিনি মাসায়েলের মধ্যে হস্তক্ষেপ করতেন না। এক্ষেত্রে নিজ আকাবির আহলে ফতোয়া মাওলানা মুফতী রশীদ আহমদ রাহ. ও অন্যদের ফতোয়া অনুযায়ী আমল করতেন।

হযরত রাহ.-এর মাজালিস ও তাসানিফ থেকে যৎসামান্য ইস্তিফাদা করার তাওফীক আল্লাহ তাআলা এই অধমকেও দিয়েছেন। হযরতের সংকলনে প্রকাশিত তাঁর প্রথম শায়খের কিতাব ‘‘মারিফাতে ইলাহিয়্যাহ’’ অধ্যয়নের তারগীব তো আমাদের খেড়িহর মাদরাসার উস্তায হযরত মাওলানা আবদুল বারী (১৪৩৩ হি.) তখনই দিয়েছিলেন যখন আমরা মাধ্যমিক স্তরের ছাত্র ছিলাম। হযরতের মাওয়ায়েয ছাড়াও আরো দুটি কিতাব বার বার অধ্যয়নের সুযোগ হয়েছে। একটি হল ‘‘মাজালিসে আবরার’’ আর অপরটি ‘‘মওদুদী সাহেব আকাবিরে উম্মত কি নযর মে’’

তাঁর যে সকল বিষয় বিশেষভাবে পছন্দনীয় তার সংখ্যা তো অনেক। তবে তাঁর মাওয়ায়েয থেকে পঠিত দুটি পংক্তি দ্বারা আমার অনেক উপকার হয়েছে। পংক্তি দুটি হল -

پابند محبت كبهى آزاد نہيں ہے +  اس قيد كى آے دل كوئى ميعاد نہيں ہے.

অর্থ : মুহাববতের বন্দী কখনো স্বাধীন নয় / আর এই বন্দিত্বের (হে মন!) কোনো মেয়াদ নেই।

خم كہ از دريا درو  راہے بود +  پيش او جيحونہا زانو زند

অর্থ : যে মটকার সংযোগ হয় সাগরের সাথে / জায়হূন নদীও থাকে নতজানু তার সামনে।

আর তাঁর শায়খ মাওলানা আহমদ প্রতাবগড়ী রাহ.-এর পংক্তি থেকেও-

ہوتى نہيں يوں تكميل محبت +  اپنى تمنا جو ہوتى ہے پورى

অর্থ : এভাবে হয় না মুহাববতের পূর্ণতা / যেখানে শুধু নিজের তামান্নাই পূরণ করা হয়।

সাধারণত তরীকতের সিলসিলাগুলোতে -আল্লাহ হেফাযত করুন- ধীরে ধীরে অনেক রসম ও রেওয়াজ এবং বিভিন্ন গর্হিত বিষয় অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। কিন্তু এখানে খুশির বিষয় এই যে, হযরতের সিলসিলা তো হাকীমুল উম্মত থানভী রাহ.-এর সিলসিলা। যা উপমহাদেশের প্রসিদ্ধ ও সর্বজনগৃহীত এবং শরীয়ত ও সুন্নতের পাবন্দ সিলসিলাসমূহের অন্যতম। আর মাশাআল্লাহ হাকীমুল উম্মত রাহ.-এর রেখে যাওয়া গোটা কুতুবখানায় এ বিষয়টিই বিদ্যমান যে, কোনটি আসল তরীকত আর কোনটি নকল। কোন বিষয়গুলো মূল মাকসাদ আর কোনগুলো ওসীলা। কোন জিনিসটি হাকীকত আর কোনটি রসম ও প্রথা। আর কোন বিষয়গুলোর সবটুকুই অহেতুক ও গর্হিত।

হাকীমুল উম্মত রাহ. ও তাঁর খলীফাগণ এবং খলীফাদেরও খলীফাগণ (যাদের মধ্যে হযরত রাহ.-এর বিশেষ মাকাম রয়েছে) আমাদেরকে এই ছবকটি বার বার স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, বায়আতের হাকীকত কী? মুরীদের অর্থ কী? খেলাফত ও খেলাফতনামার প্রকৃত মাকাম কী? বিশেষ করে খেলাফত সংক্রান্ত আকাবিরের তাম্বিহাত (সতর্কবাণী) হযরত শায়খুল হাদীস যাকারিয়া রাহ. আববীতী কিতাবে উল্লেখ করে দিয়েছেন। সিলসিলার সাথে সম্পৃক্ত আমাদের সকল ভাইয়ের এ বিষয়গুলো বারবার পড়া উচিত এবং শব্দ ও পরিভাষা, সূরত ও যাহেরের উপর ক্ষান্ত হওয়ার পরিবর্তে সর্বদা হাকীকতের প্রতি লক্ষ্য রাখা উচিত। হযরত মাওলানা যমীরুদ্দীন রাহ.-এর অন্যতম বিশিষ্ট খলীফা হযরত মাওলানা ইউসুফ দামাত বারাকাতুহুম-এর একটি কথা আমার খুব ভালো লাগে। তিনি বলেন, খিলাফতনামা হল মক্তবে ইশকের দাখেলা ফরম। আর সনদ নির্ভর করে ইত্তিবায়ে সুন্নত ও আখেরাতের নাজাতের উপর।

আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে তাওফীক দান করুন। আমীন।

আল্লাহ তাআলা রহম করুন হযরত হাফেজ্জী হুজুর রাহ.কে। যিনি অতি গুরুত্বের সাথে হযরত হারদুঈ রাহ. ও তাঁর বিশিষ্ট খলীফা করাচির হযরতকে দাওয়াত করে ঢাকায় এনেছেন, সারা দেশজুড়ে সফর করে করে তাঁদেরকে পরিচয় করিয়েছেন এবং নিজেদের মুরীদীন ও মুহিববীনকে তাদের সাথে ইসলাহী সম্পর্ক স্থাপনে উৎসাহ দিয়েছেন। তাই এদেশে হারদুঈ সিলসিলা ও আখতারি সিলসিলার যত খেদমত আছে ইনশাআল্লাহ তার সবকিছুই হযরত হাফেজ্জী হুজুর রাহ.-এর আমলনামায় সদকায়ে জারিয়া হবে।

আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে শোকর আদায়ের এবং কদরদানি করার তাওফীক দান করুন। আমীন।

হযরত মাওলানা কাজী মুতাসিম বিল্লাহ রাহ. (১৩৫২-১৪৩৪ হি., ১৯৩৩-২০১৩ ঈ.)

গত রমযানুল মুবারক ১৪৩৩ হিজরীতে আমরা শায়খুল হাদীস রাহ.-এর জানাযা পড়েছি। যার শোক এখনো হৃদয়ে সতেজ। আবার এই রমযানের শুরুতেই আমরা হারিয়েছি অপর এক শায়খুল হাদীস উস্তাযুল আসাতিযা হযরত মাওলানা কাজী মুতাসিম বিল্লাহ রাহ.কে। দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকার পর তিনি এই নশ্বর দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছেন।

إنا لله وإنا إليه راجعون، إن لله ما أخذ وله ما أعطى وكل شيء عنده بمقدار، العين تدمع والقلب يحزن ولا نقول إلا ما يرضى ربنا

৫ রমযান ১৪৩৪ হিজরী, সোমবার ইফতারের ঠিক পূর্বে হযরতের ইন্তেকাল হয়। আল্লাহ তাআলা হযরতকে মুবারক মৃত্যু দান করেছেন। আশা করি আখিরাতের অন্য সকল মারহালাও মুবারক হবে। আল্লাহ তাআলা হযরতকে বিনা হিসাবে জান্নাত নসীব করুন, তাঁর রেখে যাওয়া আত্মীয়-স্বজন ও ভক্ত-অনুরাগীদেরকে সবরে জামিল নসীব করুন এবং তাঁর দ্বীনী খেদমতসমূহকে বাকি রাখুন। আমীন।

ইনশাআল্লাহ বান্দা আলকাউসারের আগামী কোনো সংখ্যায় হযরত রাহ. সম্পর্কে নিজের অনুভূতি পেশ করার সৌভাগ্য অর্জনের চেষ্টা করব। এ সংখ্যায় মুহতারাম মাওলানা আহমদ মায়মূন ছাহেব দামাত বারাকাতুহুমের লেখা ছাপা হয়েছে।

আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে কবর ও বরযখ এবং হাশর ও নশরের জীবনের জন্য প্রস্ত্ততি গ্রহণের তাওফীক দান করুন। এটাই হল সবচেয়ে বড় কথা; বরং কথা শুধু এটাই।

وآخر دعوانا أن الحمد لله رب العالمين

 

 

 

 

advertisement