শাওয়াল ১৪৩৪   ||   আগস্ট ২০১৩

আল্লামা কাজী মু’তাসিম বিল্লাহ (রহ.) : সংক্ষিপ্ত জীবনালেখ্য

মাওলানা আহমদ মায়মূন

হযরতুল আল্লাম কাজী মুতাসিম বিল্লাহ আলেম সমাজ ও ইসলামী পরিমন্ডলে একটি পরিচিত নাম। জ্ঞান ও পান্ডিত্যের বরমাল্যে ভূষিত এ শিক্ষাবিদ ব্যক্তিত্ব গত ১৫ জুলাই মোতাবেক ৫ রমযান রোজ সোমবার সন্ধ্যা ছয়টা পঁয়তাল্লিশ মিনিটে তাঁর অসংখ্য শিষ্য-শাগরিদ, ভক্ত-অনুরক্ত ও আত্মীয়-স্বজনকে শোকসাগরে ভাসিয়ে আল্লাহ তাআলার সান্নিধ্যে চলে গেছেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। আল্লাহ তাআলা তাঁর দ্বীনী খেদমতগুলো কবুল করুন এবং মানুষ হিসেবে তাঁর জীবনের ভুল-ত্রুটিগুলো ক্ষমা করে দিয়ে তাঁকে জান্নাতের উচ্চ মাকাম নসীব করুন।

বড়দের কর্মময় জীবন থেকে পরবর্তীদের অনেক কিছু শেখার থাকে। তাদের জীবনগাঁথা হয় পরবর্তী জীবনপথের যাত্রীদের আলোর দিশারী। এখানে অনুরাগী পাঠকদের পিপাসা নিবৃত্তির উদ্দেশ্যে আজকের এ অপূর্ণাঙ্গ ও অতি সংক্ষিপ্ত উপস্থাপনা।

এক. ১৯৩৩ সালের ১৫ জুন মোতাবেক ১৩৪০ বঙ্গাব্দের ১ আষাঢ়, বর্তমান ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ থানাধীন গোপালপুর গ্রামের বিখ্যাত কাজী পরিবারে বাবা মাওলানা সাখাওয়াত হোসাইন ও মা কুররাতুন নিসার কোল জুড়ে আসে এক নতুন অতিথি। মহীয়সী কুররাতুন নিসার (কুররাতুল আইনাইন) দুচোখ শীতল করা এক নতুন মেহমান। বাবা-মা আদর করে নাম রাখলেন মুতাসিম বিল্লাহ। তাঁরা হয়ত জানতেন না, তাদের এ সন্তানটি একদিন আলেম সমাজে একজন প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ হিসেবে অধিষ্ঠিত হবে। কিন্তু কালান্তরে তাই হলো। সুনাম ও সুখ্যাতির সেই উচ্চ মার্গে তিনি পৌঁছলেন, যেখানে পৌঁছানো মহান আল্লাহ তাআলার কাছে তাঁর জন্য সুনির্ধারিত ছিল।

দুই. মুখে ভাষা ফোটার পর পিতা-মাতার নিকট তাঁর লেখাপড়ার শুভসূচনা হলেও অল্প দিনেই স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে ১৯৪৩/৪৪ সালের দিকে তিনি তার বাবার কর্মস্থল যশোরের মনিরামপুর থানার লাউড়ী আলিয়া মাদরাসায় নহম (মিজান) জামাতে ভর্তি হন। এখানেই তিনি অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে নহম জামাত থেকে ঊলা (ফাজিল) জামাত পর্যন্ত লেখাপড়া করেন এবং ঊলা জামাতের বার্ষিক পরীক্ষায় স্টার মার্ক পেয়ে উত্তীর্ণ হন। এরপর ১৯৫৩ সালের রমযানের পর তিনি ভারতের দারুল উলূম দেওবন্দে তখনকার ফুনুনাত ও মওকূফ আলাইহি জামাতে ভর্তি হন এবং দুবছরে ফুনুনাতের পড়াশোনা সমাপ্ত করে ১৯৫৫-৫৬ শিক্ষাবর্ষে দাওরায়ে হাদীস পাশ করেন। দাওরায়ে হাদীস সমাপ্ত করার পর তিনি হযরত শায়খুল ইসলাম হোসাইন আহমদ মাদানী রহ.-এর পবিত্র হাতে বায়আত গ্রহণ করেন। ১৯৫৭ সালের ৫ ডিসেম্বর শায়খুল ইসলাম হযরত মাদানী রহ. ইনতেকাল করলে তার ২/৩ মাস পর তিনি দেশে ফিরে আসেন। দেশে ফিরে আসার পর তাঁর শ্রদ্ধেয় উস্তায, শায়খুল ইসলাম মাদানী রহ.-এর বিশিষ্ট খলীফা হযরত মাওলানা শায়খ তাজাম্মুল আলী রহ. তাকে খেলাফত দান করেন।

তিন. ১৯৫৭ সালে দেওবন্দ থেকে তাঁর দেশে ফিরে আসার পর তাঁর ছেলেবেলার সেই লাউড়ী আলিয়া মাদরাসায় শিক্ষকতায় যোগদানের মাধ্যমে তাঁর কর্ম জীবনের শুভ সূচনা হয়। ১৯৫৯ সালে ঢাকার বড়কাটারা মাদরাসায় তিনি শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৬২ সালে তিনি বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জামিয়া ইমদাদিয়া কিশোরগঞ্জে মুহাদ্দিস হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৬২ সাল থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত এ প্রতিষ্ঠানে তিনি হাদীস, তাফসীর, ফিকহ, কালাম-শাস্ত্র, তর্কশাস্ত্র ইত্যাদি বিষয়ে অত্যন্ত সুনামের সাথে দরস দান করেন। ১৯৬৯ সালে উপমহাদেশের খ্যাতনামা হাদীস বিশারদ আল্লামা আব্দুল্লাহ দরখাস্তি রহ.-এর পরামর্শক্রমে তিনি ঢাকায় এসে আরো কয়েকজন স্বনামধন্য আলেমে দ্বীনের সাথে জামিয়া মাদানিয়া যাত্রাবাড়ী মাদরাসা প্রতিষ্ঠায় অংশগ্রহণ করেন। প্রতিষ্ঠাকালীন সময় থেকে নিয়ে দীর্ঘ আটবছর তিনি এ জামিয়ার মুহতামিম ও শায়খুল হাদীসের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৭ সালের শুরুর দিকে তিনি  মোমেনশাহীর কাতলাসেন আলিয়া মাদরাসায় প্রধান মুহাদ্দিস পদে যোগদান করেন।  এ প্রতিষ্ঠানে ৩ বছর অধ্যাপনার দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৯-৮০ সালের শিক্ষাবর্ষে এক বছর তিনি ঢাকার মিরপুরে অবস্থিত জামিয়া হোসাইনিয়া আরজাবাদ মাদরাসায় মুহাদ্দিস হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮০ সালে তিনি ঢাকার জামিয়া শারইয়্যাহ মালিবাগে মুহতামিম হিসেবে যোগদান করেন এবং ১৯৮০ সাল থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত এগার বছর এ মাদরাসায় মুহতামিম ছিলেন। তার সুদক্ষ পরিচালনায় এ প্রতিষ্ঠানটি দাওরায়ে হাদীস পর্যন্ত উন্নীত হয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ জামিয়ায় পরিণত হলে তিনিই এর সম্মানিত শায়খুল হাদীস নিযুক্ত হন। এ সময় তিনি মাদরাসা-মসজিদের ইমাম ও খতীবের দায়িত্ব পালন করেন। এ ছাড়া ১৯৮০ সালে যখন তিনি জামিয়া শারইয়্যাহ মালিবাগের মুহতামিম ছিলেন, তখনকার কোনো এক সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁকে ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগে খন্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দান করেন। সেখানে তিনি অত্যন্ত সুনামের সাথে ২ বছর মুসলিম শরীফের অধ্যাপনা করেন। সেখানকার ধর্মমুক্ত পরিবেশে তিনি আকৃষ্ট হতে না পেরে স্বেচ্ছায় ইস্তফা দিয়ে চলে আসেন। ১৯৯২ সালের শুরুর দিকে তিনি যশোরের দড়াটানা মাদরাসায় মুহতামিম ও শায়খুল হাদীস হিসেবে যোগদান করে দুবছর সেখানে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৪ সালে ঢাকার তাঁতিবাজারস্থ জামিয়া ইসলামিয়ায় মুহতামিম ও শায়খুল হাদীস হিসেবে যোগদান করে ৪ বছর দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৭ সালে তিনি পুনরায় ঢাকার জামিয়া শারইয়্যাহ মালিবাগে মুহতামিম ও শায়খুল হাদীস এবং মাদরাসা-মসজিদের খতীব হিসেবে যোগদান করেন। এক পর্যায়ে বার্ধক্যজনিত কারণে খতীবের দায়িত্ব থেকে অব্যহতি গ্রহণ করলে ইনতেকালের পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত তিনি এ প্রতিষ্ঠানের মুহতামিম ও শায়খুল হাদীস পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তার সুদক্ষ পরিচালনার ফলে এ প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশের প্রথম শ্রেণীর ঐতিহ্যবাহী দ্বীনী শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে অন্যতম প্রতিষ্ঠানরূপে মর্যাদা লাভ করে।

চার. হযরত কাজী সাহেব রহ. দেওবন্দ থেকে লেখাপড়া শেষ করে দেশে ফিরে আসার পর কর্ম জীবনের প্রথম দিকে ১৯৫৯ সালের ১২ জুন মাগুরার কলেজপাড়ার শাহ সূফী আলহাজ্ব আব্দুল হামীদ রহ.-এর কন্যার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে দাম্পত্য জীবন শুরু করেন। দীর্ঘ ৫৪ বছরের সংসার জীবন পার করে তিনি পরোলোকে পাড়ি দেওয়ার সময় রেখে যান তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রীসহ চার ছেলেকে। এ ছাড়া তাঁর একমাত্র কন্যা তাঁর ইনতেকালের দেড় বছর পূর্বে বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে শোকসাগরে ভাসিয়ে তিন ছেলে ও এক মেয়ে রেখে পরপারে চলে যান। এ নিয়ে তিনি ৫ সন্তানের জনক। প্রথম ছেলে হাফেজ কাজী আরিফ বিল্লাহ মাহবুব হেফজ খানার শিক্ষক। দ্বিতীয় ছেলে হাফেজ কাজী মাহমুদ মাদরাসা-মসজিদের খেদমতে নিয়োজিত। তৃতীয় ছেলে মাওলানা কাজী মানসুর সৌদি আরবে চাকুরিরত। চতুর্থ ছেলে কাজী মারূফ যশোরে কর্মরত।

পাঁচ. হযরত আল্লামা কাজী মুতাসিমবিল্লাহ রহ.-এর পিতা মরহুম মাওলানা কাজী সাখাওয়াত হোসাইন জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ ও কংগ্রেসের সক্রিয় কর্মী ছিলেন। ৪৭র দেশ বিভক্তির আগে জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ যখন অখন্ড ভারতের দাবিতে সোচ্চার আন্দোলন করেছিল তখন তাঁর পিতা তাঁকে বিভিন্ন সভা-সমাবেশে নিয়ে যেতেন। তাঁর দাদা ও নানা সবাই জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ ও কংগ্রেসের সমর্থক ছিলেন। ফলে আল্লামা কাজী মুতাসিম বিল্লাহ (রহ.)-এর রক্তে মাংসে জমিয়ত ও মাদানী রহ. ও তাঁর রাজনৈতিক চিন্তাধারা সেই বাল্য বয়স থেকেই প্রভাব ফেলতে শুরু করে। পরবর্তীতে মাদানী রহ.-এর ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য তাঁর রাজনৈতিক আদর্শকে আরো জোরালো করে। তাই তিনি ৪৭র দেশ বিভক্তিকে সমর্থন করেন নি।

কর্ম জীবনের শুরু থেকেই তিনি সরাসরি জমিয়তের রাজনীতির সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৬৬ সালে তিনি অল পাকিস্তান জমিয়তের কেন্দ্রীয় সদস্য নির্বাচিত হন। এবং সাথে সাথে তিনি জমিয়তের গঠনতন্ত্র প্রণয়নের জন্য গঠিত সাবকমিটির সদস্য মনোনীত হন। এ সময় জমিয়তকে

সর্বস্তরে সংগঠিত করার উদ্দেশ্যে এবং জমিয়তের নানামূখী কর্মসূচী নিয়ে উভয় পাকিস্তানের শহর-বন্দর ও গ্রামগঞ্জ চষে বেড়ান। কিন্তু ৭১র স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে ইসলামী রাজনীতি থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেন। তবে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধত্তর পরিবেশে ভেঙ্গেপড়া  বাঙ্গালী মুসলমান ও উলামায়ে কেরামের কল্যাণে তিনি যে অবদান রেখেছিলেন তা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। যুদ্ধের পর বাঙ্গালী মুসলমানদের বিরাট একটি অংশ দেখতে পেল যে, ভারতনিয়ন্ত্রিত এ সরকারের হাতে তাদের ঈমান ও ইসলাম ভুলুন্ঠিত হতে যাচ্ছে। এ ভয়াবহ পরিস্থিতিতে উলামায়ে কেরাম যখন নানারকম আতঙ্কে আতঙ্কিত ছিলেন তখন আল্লামা কাজী মুতাসিম বিল্লাহ রহ. হ্যন্ডমাইক নিয়ে বাংলাদেশের গ্রাম থেকে গ্রামে, শহর থেকে শহরে মসজিদে মসজিদে ঘুরে বেড়িয়েছেন। মনোবল ভেঙ্গে পড়া মুসলিম সমাজকে সান্ত্বনা দিয়েছেন যে, মুসলমান ! তুমি যদি সত্যিকার মুসলমান হও তবে নজরুল-তাজউদ্দীন সরকার তোমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।

এ ছাড়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর ফেদায়ে মিল্লাত হযরত মাওলানা আসআদ মাদানী রহ. ও মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশকে সঙ্গে নিয়ে তিনি বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করেন। তার মধ্যস্থতায় ফেদায়ে মিল্লাত রহ. রাষ্ট্রপতিকে বলেছিলেন, এ দেশের অনেক জায়গায় মসজিদ-মাদরাসা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এতে মুসলিম বিশ্বে আপনার এ বদনাম হচ্ছে যে, আপনি ইসলামের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। কাজেই অতি দ্রুত বন্ধ হওয়া মসজিদ-মাদরাসাগুলো খুলে দেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করুন। বঙ্গবন্ধু সে অনুরোধ রক্ষা করে বন্ধ হওয়া মসজিদ-মাদরাসাগুলো খুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। তখন আল্লামা কাজী মুতাসিম বিল্লাহ (রহ.) বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন এ দেশের সাধারণ উলামায়ে কেরাম স্বাধীনতার বিরোধিতা করেন নি, কাজেই আপনি তাদের হয়রানি বন্ধ করার নির্দেশ দিন। বঙ্গবন্ধু তাঁর অনুরোধ রক্ষা করার আশ্বাস দিয়েছিলেন।

ছয়. তিনি মাতৃভাষায় সুদক্ষ হওয়ার পাশাপাশি একজন সুবক্তা ও বাগ্মীও ছিলেন। ঢাকার কয়েকটি বড় মসজিদে খতীবের দায়িত্ব পালনকালে সাধারণ ও শিক্ষিত সর্বস্তরের মানুষ কুরআন ও হাদীস থেকে আহরিত তাঁর সুন্দর সাবলীল বক্তৃতা শুনে যেমন আপ্লুত হত তেমনি তারা ইসলামের বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে সঠিক দিক নির্দেশনা খুঁজে পেত। জনসাধারণের বোধগম্য ধর্মীয় ওয়াজ নসিহত, জ্ঞানগর্ভ আলোচনা এবং রাজনৈতিক মাঠগরম করা বক্তৃতা সর্বক্ষেত্রেই ছিল তাঁর সমান দক্ষতা। ফেনীর ঐতিহাসিক মিজান ময়দানে বড় বড় উলামায়ে কেরামের উপস্থিতিতে তিনি এক ঘণ্টার যে ভাষণটি দিয়েছিলেন তা আজও মুরুববীদের মুখে মুখে ফিরে। মোমেনশাহীর ভালুকায় এক সীরাত মাহফিলে তিনি একটানা ৬ ঘণ্টা বক্তৃতা করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন।

সাত. আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে কলমের সাহায্যে তালীমপ্রাপ্ত জাতির সুযোগ্য উত্তরাধিকারী আল্লামা কাজী মুতাসিম বিল্লাহ রহ. ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সম্পাদক পরিষদের সদস্য হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় বড় ডিগ্রিধারী পন্ডিতদের পাশে বসে তাফসীর, হাদীস ও ধর্মীয় বিষয়ের অসংখ্য গ্রন্থের সম্পাদনা করেছেন। তাঁর লেখা প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের অপূর্ব রসবোধে সিক্ত। নজরুল-রবীন্দ্রের কাব্যভান্ডারের শত শত পংক্তি তাঁর ঠোটস্থ ছিল। বাংলাভাষায় তাঁর রয়েছে একাধিক মৌলিক ও অনুবাদ গ্রন্থ। তাঁর রচিত মৌলিক গ্রন্থ সমূহের মধ্যে রয়েছে ১. ইসলামের দৃষ্টিতে জন্ম নিয়ন্ত্রণ, ২. বৈচিত্রের মাঝে ঐক্যের সূর (২য় খন্ড), ৩. জমিয়ত পরিচিতি ইত্যাদি। তাঁর অনূদিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে; ১. মিশকাত শরীফের কিতাবুল আদাবের অনুবাদ ও ভাষ্য। এটি তানভীরুল মিশকাত (৫ম ও ৬ষ্ঠ খন্ড) নামে ছাপা হয়েছে। ২. হিদায়া ৪র্থ খন্ডের কিতাবুল ওসায়া এর অনুবাদ ও টীকা। ৩. মসজিদের মর্মবাণী।

মাতৃভাষার পাশাপাশি উর্দূ ভাষায়ও তাঁর ভাল দক্ষতা ছিল। উর্দূ ভাষায় লিখে ও বক্তৃতা  করে সেই যৌবনের শুরুতেই তিনি প্রভূত সুনাম অর্জন করেন। দেওবন্দে পড়াকালে শেষ বছরের বার্ষিক প্রতিযোগিতায় তিনি ‘‘মওজুদা আলমী কাশমকাশ আওর উসকা হল’’ নামে একটি গবেষণামূলক প্রবন্ধ লিখে তৎকালীন দারুল উলূম দেওবন্দের মুহতামিম হযরত মাওলানা কারী মুহাম্মাদ তায়্যিব রহ.সহ অনেক বড় বড় উলামায়ে কেরামের ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করেন এবং পুরস্কৃত হন। এ ছাড়া পাকিস্তান আমলে লাহোরে জমিয়ত আয়েজিত এক সমাবেশে তিনি উর্দূতে পৌনে এক ঘণ্টা বক্তৃতা করে যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেন।

আট. কোনো মানুষ বড় হওয়ার পিছনে তার মেধা ও প্রতিভার পাশাপাশি অনেক সদগুণ ক্রিয়াশীল থাকে। হযরত আল্লামা কাজী মুতাসিম বিল্লাহ রহ.ও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। তাঁর সদগুণগুলোর বিস্তারিত আলোচনায় না গিয়ে আজকে শুধু কয়েকটি শিরোনাম উল্লেখ করার ইচ্ছা করছি। তন্মধ্যে ১. তাঁর ব্যাক্তিগত সরলতা ও সততা, ২. দুনিয়ার প্রতি তাঁর নির্মোহতা, ৩. উলামায়ে দেওবন্দের মতাদর্শের উপর ইস্পাত কঠিন অবিচলতা, ৪. ইত্তেবায়ে সুন্নতের প্রবল জযবা, ৫. অতি সুন্দর নামায আদায়, ৬. শায়খুল ইসলাম হযরত মাদানী (রহ.)-এর প্রতি তাঁর আসক্তি পর্যায়ের ভালোবাসা। তাঁর এ সকল গুণের প্রত্যেকটি নিয়ে একাধিক গবেষণা প্রবন্ধ রচিত হতে পারে।

নয়. দারুল উলুম দেওবন্দ থেকে আসার পর জামিয়া শারইয়্যাহ মালিবাগে শিক্ষক হিসেবে যোগদানের পর থেকে এ পর্যন্ত ২৬ বছরের কর্ম জীবনের ১৯টি বছর তাঁর সাথে আমার অম্ল মধুর স্মৃতি বিজড়িত। আজকের আসরে সেই স্মৃতিমালার ঝাঁপি না খুলে অন্য আসরের জন্য তুলে রাখলাম। তিনি আমার প্রাতিষ্ঠানিক উস্তায ছিলেন না। তবে উস্তাযতুল্য অবশ্যই ছিলেন। তাঁর প্রতি সেই সম্মান আমি সব সময় প্রদর্শন করে এসেছি।

দশ. তিনি যাদের সান্নিধ্য পেয়ে বড় হয়েছেন সেসকল সম্মানিত উস্তাযের মধ্যে রয়েছেন: শায়খুল আরব ওয়াল আযম শায়খুল ইসলাম সায়্যিদ হোসাইন আহমদ মাদানী রহ., শায়খুল আদব ওয়াল ফিকহ আল্লামা এজাজ আলী রহ., শায়খুল মাকূল ওয়াল মানকূল আল্লামা ইবরাহীম বলিয়াবী রহ., আল্লামা কারী তায়্যিব রহ., আল্লামা বশীর আহমদ খান রহ., আল্লামা জলীল আহমদ কৈরানবী রহ. এবং বাংলাদেশে আল্লামা শায়খ তাজাম্মুল আলী রহ., আল্লামা শায়খ কমরুদ্দীন রহ. সিলেট, আল্লামা আশরাফ আলী ধর্মন্ডলী রহ. প্রমুখ।

তাঁর ছাত্রবৃন্দের মধ্যে রয়েছেন : আল্লামা মাহমুদুল হাসান, প্রিন্সিপ্যাল, যাত্রাবাড়ি মাদরাসা, মুফতী মুহাম্মাদ  ওয়াক্কাস, প্রাক্তন এম.পি. ও প্রতিমন্ত্রী, মুফতী নূরুদ্দীন সাহেব (রহ.) সাবেক ইমাম ও খতীব জাতীয় মসজিদ বায়তুল মুকাররাম, আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসউদ, শায়খূল হাদীস জামিয়া ইকরা, মাওলানা আব্দুল জাববার, মহাসচিব, বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ, মাওলানা খলিলুর রহমান বর্ণভী, প্রিন্সিপ্যাল বরুনা মাদরাসা, মৌলভী বাজার, মাওলানা আনোয়ার শাহ, প্রিন্সিপাল জামিয়া ইমদাদিয়া কিশোরগঞ্জ, মাওলানা ইসহাক ফরিদী (রহ.) সাবেক প্রিন্সিপাল ও শায়খুল হাদীস চৌধুরীপাড়া মাদরাসা-ঢাকা, মাওলানা আতাউর রহমান খান (রহ.), সাবেক এম.পি. কিশোরগঞ্জ, মুফতী আব্দুল্লাহ হরিপুরী সিলেট, মাওলানা  হাফেজ আব্দুর রহমান  হাফেজ্জী মোমেনশাহী, মাওলানা আবুল ফাতাহ মুহাম্মাদ ইয়াহইয়া, মাওলানা আব্দুল ওয়াহেদ, মাওলনা আব্দুল মতিন, মাওলানা আবু সাবের আব্দুল্লাহ, মুফতী মুহাম্মাদ আলী,  মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম, মাওলানা আব্দুল গাফফার, মাওলানা হেমায়েত উদ্দীন প্রমূখ।

এগার.

* সবার প্রতি উপদেশ : তিনি বলতেন, দুনিয়ার মোহে পড়ে তোমরা নিজেদের ইলম ও দ্বীনকে বিক্রি করে দিও না।

* ছাত্রদের উদ্দেশ্যে উপদেশ : ‘‘আকাবিরের যিন্দেগীতেই আমাদের জীবন সমস্যার তাফসীলী সমাধান নিহিত।’’

* স্মরণযোগ্য উপদেশ : ‘‘মুসলিম জাতির বৈশিষ্ট্য হল যে যত বেশি আখেরাতমুখী  হবে দুনিয়া তত বেশি তার পায়ে লুটিয়ে পড়বে। পক্ষান্তরে বিজাতির অনুকরণে সে দুনিয়ার দিকে যতো বেশি ঝুঁকে পড়বে দুনিয়া ততো বেশি তার থেকে দূরে সরে যাবে।  আখেরাতের ধ্বংস তো তার জন্য অবশ্যম্ভাবী।’’

 

* অন্তিম অসিয়ত : ‘‘আমি কাজী মুতাসিম বিল্লাহ (পিতা মাওলানা কাজী সাখাওয়াত হোসাইন (রহ.), ঝুমঝুমপুর, কোতওয়ালী, যশোর) সজ্ঞানে দ্বীনী আমানত হিসেবে আমার ছাত্র, মুতাআল্লিকীন, মুহিববীন, ও সকল ধর্মপ্রাণ মুসলমানকে এ মর্মে অসিয়ত করছি যে, আমার মৃত্যুর পর আমার কোনো কথা ও লেখা দ্বারা আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআত তথা দেওবন্দী আকাবিরের চিন্তা-চেতনার পরিপন্থী ব্যাখ্যা করার কোনো সুযোগ নেই। সকল বাতিল ফিরকা বিশেষ করে মওদূদী জামায়াত, শিরক, বিদআত ও মিলাদ-কিয়াম সম্পর্কে দেওবন্দী আকাবিরের যেই মতামত, আমারও সেই মত। রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনা ও আদর্শগতভাবে আমি আমার উস্তায ও মুরশিদ শায়খুল ইসলাম হযরত মাদানী রহ. -এর অনুসারী। এতে কারও কোনো আপত্তি আমার কাছে গ্রহণীয় নয়। অতএব কেউ যদি আমার দিকে ভিন্ন কোনো মতাদর্শ সম্পর্কিত করেন তাহলে তা প্রত্যাখ্যাত হবে। আমার ছাত্র, ভক্ত, অনুরক্ত, ও সব মুসলমানকে আমি আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআতের আকীদার অনুসারী হওয়ার আবেদন করছি।’’

 

 

advertisement