সংবিধান যখন অজুহাত
চা প্রেমিক এক ভদ্রলোক বলছিলেন, তিনি ঘুম তাড়াতে যেমন চা পান করেন তেমনি চোখে ঘুম আনতেও তাকে চা পান করতে হয়। অর্থাৎ ঐতিহ্যবাহী ধূমায়িত চা তার ক্ষেত্রে দুটি বিপরীতমুখি জায়গায় কার্যকর। আজ লিখতে বসে সে কথাটি মনে পড়ার কারণ হচ্ছে ‘সংবিধান’। এই ‘সংবিধান’ জিনিসটি এখন এক শ্রেণীর মানুষের কাছে অনেক কিছুর হাতিয়ার। তারা নিজের কোনো মতলব হাসিলের জন্য যেমন সংবিধানের দোহাই দিয়ে থাকেন, তেমনি অন্যদের যৌক্তিক দাবি অগ্রাহ্য করার জন্যও দাঁড় করিয়ে থাকেন সংবিধানের অজুহাত। অথচ ১৯৭২ সালের শেষে যারা নিজেদের মতো করে সংবিধান লিখেছিলেন পরবর্তী তিন বছরে তারাই এতে অপারেশন করেছেন চারবার, এনেছেন চার চারটি সংশোধনী। আর চতুর্থ সংশোধনী তো এমন হয়েছে যে, মূল সংবিধানের পুরো কাঠামোই বদলে ফেলা হয়েছে। মৌলিক অধিকার, বহুদলীয় গণতন্ত্র, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, বিচার বিভাগের স্বকীয়তাসহ বহু কিছুই বিলুপ্ত করা হয়েছিল কয়েক মিনিটে পাশ হওয়া ঐ সংশোধনীতে। এই চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে সরকার পদ্ধতি পরিবর্তন করে সংসদীয় গণতন্ত্র থেকে এক দলীয় রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারেই শুধু গমন করা হয়নি; বরং ৩ বছর অতিবাহিত হয়ে যাওয়ার পর আবার একই সংসদের মেয়াদ ৫ বছর বৃদ্ধি করা হয়েছিল। একই নিয়মে এসেছে সর্বশেষ ১৫ তম সংশোধনীটিও। এতেও নির্বাচনকালীন সরকার কাঠামো বদলে ফেলা হয়েছে। যে তত্ত্বাবধায়কের আন্দোলনে শত শত লোক হতাহত হয়েছে, অসংখ্য হরতাল-অবরোধের মাধ্যমে দেশ অচল হয়েছে এবং তৎকালীন সরকারী দলকে সংবিধান সংশোধন করতে বাধ্য করা হয়েছে সেটিও বিলুপ্ত করে ফেলা হয়েছে ১৫তম সংশোধনীতে। সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের এদেশে ‘আল্লাহর উপর
পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ সংবিধানের
মূলনীতি থেকে সরিয়ে সেখানে
জবরদস্তিমূলকভাবে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ এবং দেশের সরকারী- বেসরকারী অর্থ ও বাজার ব্যবস্থা সম্পূর্ণ পুঁজিবাদী হওয়া সত্ত্বেও মূলনীতিতে লেখা হয়েছে ‘সমাজতন্ত্র’-এর কথা।
সামরিক আইনকে বৈধতা দেওয়ার জন্যও সংবিধান সংশোধিত হয়েছে ২ বার। একজন লোককে স্বপদে ফেরানোর জন্য আনা হয়েছে পৃথক সংশোধনী। এমনকি ক্ষমতাসীনদের প্রতিকৃতি অফিস-আদালতে ঝুলানোর জন্যও কাটছাট করা হয়েছে সংবিধান।
নামে গণতান্ত্রিক সরকার হলেও যুগ যুগ থেকে ক্ষমতাসীনরা এই সংবিধানের দোহাই দিয়েই ভোগ করে চলেছেন প্রাচীনকালের রাজা-রাণীদের থেকেও অধিক ক্ষমতা। এই ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য যত দফা সংবিধানে প্রবেশ করানো দরকার তা তারা করাবেন এবং যেভাবে ব্যাখ্যা দেওয়া দরকার তা তারা আদায় করবেন।
সংবিধান নিয়ে বলার আছে অনেক কথাই। সংবিধানের কতটুকু অংশ জনগণকেন্দ্রিক আর কতটুকু ক্ষমতাসীনদের জন্য, কতটুকু বাস্তবসম্মত আর কতটুকু বাস্তবতাবিবর্জিত, কতটুকু জনগণের অভিপ্রায়ের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ আর কতটুকু তাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া, কতটুকু রাষ্ট্রের অনুকূলে আর কতটুকু প্রতিকূলে-এমন অনেক প্রশ্নের জবাবই খোঁজার অবকাশ রয়েছে সচেতন নাগরিকদের। আজকের আলোচ্য বিষয় সেটি নয়। এই নিবন্ধটি মূলত উটপাখি স্বভাবের লোকদের থেকে গণমানুষকে সতর্ক করার উদ্দেশ্যে। উটপাখিকে নাকি বোঝা নিতে বললে সে বলে, আমি তো ভাই পাখি। বোঝা বইবো কী করে? আবার উড়তে বলা হলে জবাব দেয়, আমি তো উট, উড়তে জানি না। একই অবস্থা দেশের গুটিকতক লোকের, যারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশায়। কিন্তু একটি ব্যাপারে তাদের জাত-স্বভাব এক। তা হল, ধর্মীয় কোনো বিষয় এলেই অথবা ধর্মপ্রাণ লোকরা কোনো দাবি তুললেই তারা স্ব স্ব স্থান থেকে জোর গলায় বলতে শুরু করে-এটা তো সংবিধান পরিপন্থী। এ দাবি সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক। এটি বাস্তবায়ন করতে গেলে সংবিধান লঙ্ঘিত হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। একই দোহাই দেওয়া হয় ইসলাম-বিদ্বেষীদের রক্ষার জন্য। এটি তো তার সাংবিধানিক অধিকার, তাকে কিছু বললে বাক-স্বাধীনতা ও মুক্তচিন্তার নীতির বরখেলাপ হয়ে যাবে ইত্যাদি।
ইসলাম-বিদ্বেষীদের রক্ষা ও লালন এবং ইসলামপন্থীদের অগ্রাহ্য ও দমনের ক্ষেত্রে সংবিধানের অজুহাত পেশ করার প্রচলিত প্রবণতা নিয়েই কয়েকটি কথা আরজ করতে চাচ্ছি।
এক. সংবিধান কী এবং তা কার জন্য?
এ প্রশ্নের সংক্ষিপ্ত জবাব নেওয়া যেতে পারে সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদের (২) উপধারা থেকে। এখানে বলা হয়েছে, ‘‘জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তিরূপে এই সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন।’’
একই অনুচ্ছেদের (১) উপধারার বাংলা পাঠ হচ্ছে, ‘‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ এবং জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল এই সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে কার্যকর হইবে।’’
এই অনুচ্ছেদে যা বলা হয়েছে তার সারমর্ম হল-
ক) সংবিধান হচ্ছে জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তি।
খ) প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ।
গ) সেই ক্ষমতার প্রয়োগ হবে জনগণের পক্ষে।
এখন প্রশ্ন হল এই অনুচ্ছেদে বারবার উচ্চারিত ‘জনগণ’ দ্বারা কাদেরকে বুঝানো হয়েছে? দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মপ্রাণ কোটি কোটি জনতাকে নাকি কতিপয় চিহ্নিত ধর্মবিদ্বেষী ও অবিশ্বাসীদেরকে? যদি ‘জনগণ’ বলতে আমজনতাই উদ্দেশ্য হয়ে থাকে তাহলে তাদের দাবি-দাওয়া প্রত্যাখ্যানের জন্য সংবিধানের অজুহাত কেন তোলা হচ্ছে?
দুই. সংবিধানে কিছু লিখলেই কি তা জনগণের কথা হয়ে যায়?
সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতাসীনরা অনেক কিছু সংবিধানে প্রবেশ করিয়েছেন আবার বাদ দিয়েছেন বেশ কিছু জিনিস। এসব কি জনগণের অভিপ্রায়। উদাহরণস্বরূপ ৭২ সনের সংবিধান প্রণয়নের পর সে সংবিধান অনুযায়ী যে সরকার নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় এল তিন বছরের মাথায় তারাই সরকার কাঠামো পরিবর্তন করে বহুদলীয় সংসদীয় পদ্ধতি প্রবর্তন করল। প্রশ্ন হল, তাদেরকে ভোট দেওয়ার সময় জনগণের এই বিপরীতমুখি অভিপ্রায় ছিল কি না? ৫ বছরের জন্য নির্বাচিত হয়ে তিন বছর অতিবাহিত হওয়ার পর আরো ৫ বছর ক্ষমতা বৃদ্ধি করা হল সংবিধান সংশোধন করে, এটিও নাকি জনগণের অভিপ্রায় ছিল। এমনিভাবে বর্তমান সরকারী দলটি নির্বাচনের সময় তাদের ইশতেহারে বলেছিল, ‘ক্ষমতায় গেলে তারা কুরআন-সুন্নাহ পরিপন্থী কোনো আইন করবে না।’ প্রশ্ন হল, এমন ওয়াদাকারী দলটিকে ভোট দেওয়ার সময় জনগণের কি এমন অভিপ্রায় ছিল যে, তারা ক্ষমতায় বসে সংবিধান থেকে ‘আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ ফেলে দিয়ে তাতে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ যোগ করবে? ১৯৯০ সনের গণআন্দোলনের পর নির্বাচিত সরকার যখন সংবিধান সংশোধন করে সরকার পদ্ধতি পরিবর্তন করছিল তখন একজন সিনিয়র আইনজীবী, যিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রীও বটে প্রশ্ন উত্থাপন করেছিলেন যে, এ সংসদ যে সরকার পদ্ধতিতে নির্বাচিত হয়ে এসেছে তাদেরকে কি জনগণ এই অধিকার দিয়েছে যে, তারা নিজেদের ক্ষমতা বৃদ্ধি করে রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী বনে যাক। কোনো বিবেকবান মানুষই প্রশ্নটির যৌক্তিকতা অস্বীকার করবেন না। কারণ ঐ নির্বাচনের সময় রাষ্ট্রের সাংবিধানিক নীতি ছিল রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার। অর্থাৎ রাষ্ট্রপতি হচ্ছেন দেশের প্রধান নির্বাহী আর মন্ত্রীসভা ছিল তার অধীনে, কিন্তু ঐ সংবিধানের আওতায় নির্বাচিত সংসদ নেতা সংবিধান সংশোধন করে নিজেই বনে গেছেন প্রধান নির্বাহী। আর রাষ্ট্রপতি পদটিকে করে ফেলেছেন শুধু আনুষ্ঠানিকতা। অবশ্য তখনকার বিধি অনুযায়ী ঐ সংশোধনীতে রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরের পূর্বে গণভোটের আয়োজন করা হয়েছিল। একইভাবে উদাহরণ হতে পারে পঞ্চদশ সংশোধনীর তত্ত্বাবধায়ক বিলুপ্তি সংক্রান্ত বিষয়টি। যে সংসদ নির্বাচিত হল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সেই সংসদই সংবিধান সংশোধন করে বাতিল করে দিল সে পদ্ধতি। এটিও কি জনগণের অভিপ্রায়? তারা কি নির্বাচনী ইশতেহারে বলেছিল যে, আমরা ক্ষমতায় গেলে তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি বাতিল করব?
তিন. ধর্মদ্রোহিতা কি সংবিধানসম্মত?
তৃতীয় কথাটি হচ্ছে সংবিধানের কোনো অনুচ্ছেদে কি ইসলামের বিরুদ্ধে কুৎসা রটানোর বিধান আছে। আল্লাহ তাআলা, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, কুরআন মজীদ ও ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়ানো ও কুৎসা রটানোর সুযোগ সংবিধানের কোন অনুচ্ছেদে দেওয়া হয়েছে? যদি তা না দেওয়া থাকে তাহলে ঐ অবিশ্বাসী, কুৎসা রটানোয় লিপ্ত লোকদের হীনকর্ম বন্ধ করে তাদের শাস্তির আওতায় আনার দাবি করা হলে তাদের রক্ষা করার জন্য কেন সংবিধানের দোহাই দেওয়া হয়? কেউ কেউ বলে থাকেন সংবিধানে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। সুতরাং অবিশ্বাসী ও ধর্মদ্রোহীদের ঐসব বলার অধিকার আছে। তাহলে দেখা যাক সংবিধানের এ সংক্রান্ত অনুচ্ছেদটি ‘৩৯/
(১) চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা প্রদান করা হইল।
(৩) রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশী রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা ও নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত অবমাননা,
মানহানি বা অপরাধ সংগঠনে প্ররোচনা নিষেধ সাপেক্ষে-
(ক) প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব
প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের এবং
(খ) সংবাদ ক্ষেত্রের স্বাধীনতার
নিশ্চয়তা প্রদান করা হইল।’’
এ হচ্ছে সেই ৩৯ অনুচ্ছেদ, যার দোহাই দিয়ে পার পেয়ে যেতে চায় ইসলামের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনাকারী ও তাদের লালনকারী ব্যক্তিরা। কিন্তু পুরো অনুচ্ছেদটি তাদের জন্য রক্ষাকবচ নয়; বরং তাদের বিরুদ্ধেই বটে।
নজর দেওয়া যাক আবার উপরে উদ্ধৃত ৩৯ নং অনুচ্ছেদটির দিকে। দেখা যাচ্ছে এতে (১) ও (২) দুটি উপধারা রয়েছে এবং (২) উপধারায় রয়েছে (ক) ও (খ) দুটি শাখা। এর মধ্যে (১) উপধারায় চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে এবং এটি শর্তহীন। অর্থাৎ রাষ্ট্র বা অন্য কেউ কোনো নাগরিককে কোনো বিষয়ে চিন্তা করতে বাধা দিতে পারবে না এবং তার বিবেক-বুদ্ধির উপর হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। আর কারো মনের চিন্তাকে রাষ্ট্র বা অন্য কারো নিয়ন্ত্রণ করা আদৌ সম্ভব নয়। কিন্তু এখানে কারো চিন্তা ও বিবেকের কথা প্রকাশের কথা বলা হয়নি এবং নিশ্চিতভাবে সেটি উদ্দেশ্যও নয়। কারণ তা বলা হয়েছে (২) উপধারাতে। সেখানে বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার কথা বলা হয়েছে। আর এর জন্য আরোপ করা হয়েছে ৮টি শর্ত। ঐ ৮ শর্তের কোনোটি লঙ্ঘন করে বাক অথবা ভাব প্রকাশের স্বাধীনতা ভোগ করা যাবে না। যে শর্তগুলো আরোপিত হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে জনশৃঙ্খলা, শালীনতা ও নৈতিকতা লঙ্ঘিত না হওয়া। ঐতিহ্যগতভাবে ধর্মপ্রাণ জনগণের এ দেশে ধর্ম ও ধর্মীয় বিষয়াদি নিয়ে কটাক্ষ করলে, ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের হেয়-প্রতিপন্ন করলে জনশৃঙ্খলা নষ্ট হবে না বা সেটি শালীনতা ও নৈতিকতার পরিপন্থী হবে না-এমন কথা কি কোনো বিবেকবান মানুষ ভাবতে পারেন? বিশ্বাসী লেকদের কাছে তাদের ঈমান হচ্ছে সবার আগে। সে ঈমানের কোনো অঙ্গে আঘাত করা হলে তারা তো নিজেদেরকে আক্রান্ত বোধ করবেই। এদেশে কি সে কথা বার বার প্রমাণিত হয়নি? তা হলে এ কথা স্পষ্ট হল যে, ধর্মবিদ্বেষী কথাবার্তা ও প্রচারণার পক্ষে ৩৯ অনুচ্ছেদকে ঢাল হিসেবে পেশ করা প্রতারণা বৈ কিছু নয়। এটি এমন যে, কোনো বে-নামাযী ব্যক্তি, কুরআন মজীদের সূরা নিসার ৪৩ নং আয়াতের বরাতে বলল যে, কুরআনে নামাযের নিকটবর্তী হতেও বারণ করা হয়েছে। আর আয়াতের অন্য অংশ উল্লেখ করল না। অথচ পুরো আয়াতের তরজমা হচ্ছে, ‘তোমরা নেশাগ্রস্ত হয়ে নামাযের কাছেও যেও না।’
চার. ধর্মীয় বিষয়ে দাবি উঠালেই কি তা সংবিধান পরিপন্থী হয়ে যায়?
চতুর্থ আরজিটি হল সংবিধান কি ধর্মীয় বিষয়ে দাবি উঠাতে, আইন প্রণয়নের জন্য চাপ দিতে বারণ করেছে, সংবিধানের ২ (ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। এবং ৪১ অনুচ্ছেদে আইন, জনশৃঙ্খলা ও নৈতিকতা সাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিকের যে কোনো ধর্ম অবলম্বন, পালন বা প্রচারের অধিকারের নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছে। তাহলে ধর্মীয় কোনো দাবি উঠালেই তাকে সংবিধান পরিপন্থী আখ্যায়িত করা হবে কেন? উদাহরণস্বরূপ যদি জনগণ কর্তৃক এমন দাবি উত্থাপিত হয় যে, দেশে এখন ভয়বাহ দুর্নীতি চলছে। ঘুষ-প্রতারণার মাধ্যমে হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে জনগণের কষ্টার্জিত সম্পদ। প্রচলিত আইন দ্বারা এসবের প্রতিকার হচ্ছে না। সুতরাং এই অন্যায় প্রতিরোধের লক্ষ্যে কঠোর আইন করা হোক এবং ইসলামের ফৌজদারি দন্ডবিধির আদলে ঘুষ-দুর্নীতিবাজদের থেকে সকল সম্পদ ফেরত নিয়ে তাদেরকে জনসম্মুখে কঠোর শাস্তি দেওয়া হোক এবং এহেন কর্মপ্রতিরোধের লক্ষ্যে সকল সরকারী কর্মচারী, মন্ত্রীবর্গ, বিচারপতিগণ, সংসদ সদস্যগণ, প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার সাথে সাথে এবং ক্ষমতা থেকে বিদায় নেওয়ার সময় তাদের সম্পদের বিস্তারিত বিবরণ জনসম্মুখে প্রকাশ করার বিধান করা হোক। তাহলে কি এ দাবিকে সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকার পরিপন্থী বলে উড়িয়ে দিতে হবে? এমনিভাবে বিনা কারণে সময়ে সময়ে বাজারমূল্য বাড়িয়ে দেওয়ার প্রবণতা রোধের জন্য যদি ইসলামের মজুদদারী ও মনোপুলেশন বিরোধী বাজারব্যবস্থা প্রবর্তনের দাবি উঠে তাহলে কি সেটি এজন্য প্রত্যাখ্যানযোগ্য হবে যে, এটি ব্যবসায়ীদের মৌলিক অধিকার হরণ করবে এবং মুক্ত বাজার অর্থনীতিতে এমন দাবি গ্রহণযোগ্য নয়। এ ধরনের আরেকটি বিষয় হচ্ছে, নারী সমাজের মর্যাদা রক্ষা ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত মুসলমানদের এমন দাবি যে, নারীজাতির মান-মর্যাদা রক্ষা এবং বদ-দ্বীন পুরুষদের থেকে তাদেরকে রক্ষার জন্য মেয়েদের পৃথক শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তন করতে হবে এবং কর্মস্থলে তাদেরকে নিজ ইজ্জত-আব্রু রক্ষা করে চলার স্বার্থে তাদের পোশাক-আশাক ইসলামী ধাঁচের হতে হবে এবং কোনোক্রমেই তাদেরকে অধিকার দেওয়ার নামে পণ্যে পরিণত করা যাবে না, যত্রতত্র মডেল হিসেবে প্রচার করে মাতৃজাতির মর্যাদাহানি করা চলবে না-তাহলে কি জোর গলায় বলে উঠতে হবে যে, এসব সংবিধানবিরোধী দাবি? যেখানে দামি-দামি বিদ্যালয়গুলোতেও ছাত্রীদের ইজ্জত নিরাপদ নয় এমনকি ইদানীং বিধর্মী শিক্ষকের কুনজর ও বদ হাত থেকেও তারা নিরাপদে থাকছে না সেখানে নারী অধিকারের নামে পৃথক শিক্ষাব্যবস্থা বা মেয়েদের শালীন পোশাকের বিরোধিতা আসলে কার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য? নারীদের নাকি এক শ্রেণীর লোভী ও চালাক পুরুষদের? সংবিধানের কোথায় এমন ব্যবস্থা নেওয়ার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে?
ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের পক্ষ থেকে আরেকটি দাবি অনেকবার উচ্চারিত হয়েছে, কাদিয়ানীদের মুসলিম নাম ব্যবহার করে প্রতারণা বন্ধের। সে দাবি বার বার অস্বীকার করা হয়েছে সংবিধানের দোহাই দিয়ে। এ দেশের যে সকল রাজনীতিক ও তাদের পন্থী বুদ্ধিজীবী ও সাংবাদিক প্রকাশ্যে ধর্মীয় অনুশাসন ও ধর্মপ্রাণ লোকদের তিরস্কার করে থাকেন তাদের কিন্তু মিথ্যা নবীর দাবিদার গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর অনুসারীদের জন্য অনেক দরদ দেখা যায়। কাদিয়ানীদের ঘৃণিত প্রতারণা বন্ধের প্রশ্ন উঠলেই তারা ধর্মীয় অধিকার ও সংবিধানের জিগির তুলে থাকেন। তাদের কথা হচ্ছে ৪১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ‘‘প্রত্যেক নাগরিকের যে কোনো ধর্ম অবলম্বন, পালন বা প্রচারের অধিকার রয়েছে।’’ এ কথা বলে আসলে তারা মূল বিষয়টি আড়াল করে থাকেন। কারণ ধর্মপ্রাণ মুসলিম সমাজের পক্ষ থেকে কখনো কাদিয়ানী ধর্ম বন্ধ করা বা তাদেরকে নিজ ধর্ম পালন থেকে বিরত রাখার কোনো দাবি করা হয়নি। বরং তারা যে মিথ্যা নবীর দাবিদার ব্যক্তির অনুসারী হয়েও নিজেদেরকে মুসলমান হিসেবে প্রকাশ করে সাধারণ মুসলমান সমাজকে প্রতারিত করে যাচ্ছে সে অপতৎপরতা বন্ধ এবং তাদের জামাতকে মুসলিম বলা ও তাদের উপাসনালয়কে মসজিদ বলা থেকে বিরত রাখার যুক্তিসঙ্গত দাবিই মাত্র করা হয়েছে।
ওআইসি ফিকহ একাডেমিসহ বিশ্বের বড় বড় ইসলামী গবেষণা সংস্থাগুলো বহু আগেই এ সম্প্রদায়কে কাফের ঘোষণা করেছে এবং বিশ্বের বহু দেশে আইন করে তাদেরকে মুসলিম পরিচয় দিতে বারণ করা হয়েছে এবং এর জন্য তাদেরকে আত্মপক্ষ সমর্থনের ব্যাপক সুযোগও দেওয়া হয়েছে। তাদের তৎকালীন সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতারা নিজ নিজ বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন। এর পর নিরপেক্ষভাবে ফয়সালা দেওয়া হয়েছে। তারপরও কাদিয়ানীদের এ দেশীয় হিতাকাঙ্খীরা তাদেরকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন এবং অজুহাত পেশ করছেন সংবিধানের ৪১ অনুচ্ছেদের। অথচ এ অনুচ্ছেদ তাদের জন্য কিছুতেই রক্ষাকবচ হতে পারে না। কারণ অনুচ্ছেদের শুরুতেই বলা হয়েছে আইন, জনশৃঙ্খলা ও নৈতিকতা সাপেক্ষে ... । অর্থাৎ এখানে নৈতিকতার শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে বিশ্বের উচ্চ স্তরের ইসলামী গবেষণা সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানগুলো এবং বহু দেশ ও বহু আদালতে প্রতারক হিসাবে প্রমাণিত কাদিয়ানীরা নৈতিকতার মানদন্ডে উন্নীত হল কীভাবে?
পাঁচ. শেষ কথা : সংবিধান সংশোধনে বাধা কোথায়?
শেষ কথাটি হচ্ছে সংবিধান মতে প্রজাতন্ত্রের মালিক জনগণ এবং জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তিই হচ্ছে সংবিধান। এবং সংবিধান নিজেই সংশোধিত হওয়ার যে বিধান তার মধ্যে রেখেছে সে অনুযায়ী তাকে ১৫ বার সংশোধনও করা হয়েছে। তাহলে কোনো গণদাবি বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে সংবিধানের সংশোধন প্রয়োজন হলে তা করতে বিলম্ব করা হবে কেন? লক্ষ লক্ষ ধর্মপ্রাণ নাগরিক কোনো ন্যায়সঙ্গত দাবি করল আর তা সংবিধান বিরোধী বলে এক কথায় উড়িয়ে দেওয়া হল তাহলে প্রশ্ন আসবে যে, কার জন্য সংবিধান? নাগরিকের জন্য, নাকি নাগরিক সমাজ সংবিধানের জন্য? বিখ্যাত দার্শনিক কবি শেখ সাদী বলে গেছেন, ‘‘খোরদান বরায়ে জিস্তান আস্ত, না জিস্তান বরায়ে খোরদান।’’ অর্থাৎ খাবার জীবনের জন্য, কিন্তু জীবন খাবারের জন্য নয়।
মনে রাখতে হবে, সংবিধান কিন্তু প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক বলেছে জনগণকে। আর সে জনগণ তাদের সৃষ্টিকর্তার কতিপয় বিধান পালনের দাবি জানিয়ে আসছে। লাখ লাখ কণ্ঠ একত্র হয়ে আওয়াজ তুলেছে, কোনো ক্ষমতার জন্য নয়; বরং দেশ ও মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকার জন্য, আল্লাহর আজাব থেকে রক্ষার জন্য। তাদের দাবি অগ্রাহ্য করাই হবে সংবিধানের লঙ্ঘন। কারণ সংবিধান জনগণের স্বার্থে নিজেকে সংশোধন করার বিধান রেখেছে (১৪২ অনুচ্ছেদ)। এমনকি মৌলিক অধিকার সংক্রান্ত যে ২৬ অনুচ্ছেদের দোহাই দেওয়া হয় তার (৩) উপধারাতেও বলা হয়েছে, ‘‘সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদের অধীন প্রণীত সংশোধনের ক্ষেত্রে এই অনুচ্ছেদের কোনো কিছুই প্রয়োজন হইবে না।’’
সুতরাং গণদাবি বাস্তবায়নে প্রয়োজনে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। বিশেষত যেখানে সরকারী দলের হাতে রয়েছে সংসদের তিন চতুর্থাংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা। আর সংবিধান সংশোধন করতে প্রয়োজন মাত্র দুই তৃতীয়াংশ সদস্যদের সম্মতি।
মনে রাখতে হবে, সংবিধানের অজুহাত দিয়ে গণদাবি উপেক্ষা করতে থাকলে তার পরিণতি এক সময় ভয়াবহ রূপ নিতে পারে, তখন মূল সংবিধান নিয়েও প্রশ্ন উত্থাপিত হতে পারে এবং এভাবে গণবিস্ফোরণ ঘটার আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ষ