বিদায় রমযান : অক্ষয় হোক সওমের শিক্ষা
মাহে রমাযান আমাদের মাঝে এসেছিল তাকওয়া ও খোদাভীতির আহবান নিয়ে। দেখতে দেখতে এ মোবারক মাস বিদায় নিল এবং এ মাসে বিশেষ রহমতের যে আসমানী ধারা বর্ষিত হচ্ছিল তারও সমাপ্তি ঘটল। তবে মাহে রমাযান সারা বছরের জন্য রেখে গেছে তাকওয়ার শিক্ষা এবং এক মাসের সিয়াম ও কিয়াম-লব্ধ সংযম ও সাধনার যোগ্যতা। প্রত্যেক মুমিন যা নিজ নিজ যোগ্যতা অনুসারে ধারণ করেছেন।
তাকওয়ার মূল কথা সংযম ও আত্মনিয়ন্ত্রন, আল্লাহর ভয়ে গুনাহ ও পাপাচার এবং গর্হিত ও অশোভন আচরণ থেকে বিরত থাকা। এটি এমন এক বিষয়, যা মানবের পার্থিব শান্তি ও লৌকিক মুক্তির জন্য অপরিহার্য।
কারো মনে হতে পারে, তাকওয়া শুধু প্রয়োজন আখিরাতের জন্য। কারণ তাকওয়া একটি ধর্মীয় বিষয়। আর ধর্মের উপকারিতা শুধু পরকালে। এই চিন্তা সঠিক নয়। ইসলাম এমন এক ধর্ম, যা আমাদের দুনিয়া-আখিরাত দু’টোই সুন্দর করে। ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ দ্বীন। তাই তা একটি কামিল তাহযীব ও পূর্ণাঙ্গ সংস্কৃতি উপহার দেয়। এ কারণে ইসলামের একজন প্রাজ্ঞ অনুসারী একজন সভ্য ও সংস্কৃতিবান মানুষ। একজন মুত্তাকীই একজন প্রকৃত সুশীল ও নীতিবান ব্যাক্তি।
তাকওয়া শুধু অন্তরের বিশেষ অবস্থার নাম নয়, কিংবা নয় শুধু বিশেষ বেশ ধারণের নাম। তাকওয়া হচ্ছে জীবনের সকল ক্ষেত্রে সংযমী হওয়া। এর সূচনা বিশ্বাসে আর বিস্তার জীবনের সকল ক্ষেত্রে। মানবের চিন্তা-চেতনা, বোধ-বিশ্বাস, রুচি-প্রকৃতি, আচার-ব্যবহার, আচরণ-উচ্চারণ সব কিছুই তাকওয়ার ক্ষেত্র। সুতরাং এই সকল ক্ষেত্রে সংযমী ও আল্লাহর বিধানের অনুগত ব্যাক্তিই মুত্তাকী।
বিখ্যাত সাহাবী উবাই ইবনে কা’ব রা.-এর উজ্জ্বল উপমা অনেকেরই জানা আছে। হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব রা. তাঁকে তাকওয়ার অর্থ জিজ্ঞাসা করেছিলেন। তিনি উত্তরে বললেন, আমীরুল মুমিনীন! আপনি কি কখনো কাঁটাদার ঝোপঝাড়ের মধ্য দিয়ে পথ চলেছেন? হযরত ওমর রা. বললেন, চলেছি। উবাই ইবনে কা’ব রা. জিজ্ঞাসা করলেন, কীভাবে চলেছেন? হযরত ওমর রা. বললেন, পড়নের কাপড় ভালোভাবে গুটিয়ে নিয়েছি এরপর সাবধানে সেই পথ অতিক্রম করেছি। হযরত উবাই রা. বললেন, এরই নাম ‘তাকওয়া’।
অর্থাৎ জীবন-পথে এমনভাবে চলার চেষ্টা, যাতে শরীয়তের দৃষ্টিতে যা কিছু গর্হিত, যা কি ছু অশোভন তার আছর থেকে আমার কর্ম ও বিশ্বাস মুক্ত থাকে। তাহলে তাকওয়ার শিক্ষা গ্রহণের অর্থ, জীবনের সকল অঙ্গনে এক নিরবচ্ছিন্ন সংযম-সাধনায় অবতীর্ণ হওয়া। চেতনা-বিশ্বাসের সংযম আবেগ-অনুভূতির সংযম, আচার-ব্যবহারের সংযম, আচরণ-উচ্চারণে সংযম ইত্যাদি সবই তাকওয়ার একটি প্রকার। সুতরাং খুব সহজেই বোঝা যায়, তাকওয়ার শিক্ষা কত বিস্তৃত আর তা মানবকে ইহ-জাগতিক বিচারেও কত উঁচুতে নিয়ে যেতে পারে। এ থেকে আরো বোঝা যায়, ইসলাম শুধু মানুষের পরকাল নয়, ইহকালকেও শুভ্র-সুন্দর করে।
বর্তমান ‘সভ্য’ সমাজের অবক্ষয় ইসলামের প্রয়োজন ও প্রাসঙ্গিকতা আরো স্পষ্টভাবে তুলে ধরছে। কবি বলেন,
وبضدها تتبين الأشياء
‘বিপরীত বস্ত্ত দ্বারাই বাস্তব সৌন্দর্য প্রকাশিত হয়।’
বর্তমান যুগের শিক্ষা ও সংস্কৃতির ‘আলোক’প্রাপ্ত ব্যাক্তি ও সমাজের মাঝে সংযম ও সুনীতির ব্যাপক অনুপস্থিতি, সত্য কথন ও সত্য-গ্রহণে ভীরুতা, গোষ্ঠি ও সম্প্রদায়গত সংকীর্ণতা, পদ-পদবীর মোহ, অর্থ ও ক্ষমতার লালসা, প্রতিপক্ষের প্রতি চরম অসহিষ্ণুতা, অনৈতিকতা ও উচ্ছৃঙ্খলতায় উৎসাহ দান এবং এসব কিছু সত্ত্বেও মৌখিক শালীনতার চর্চা এ সভ্যতাকে একটি ব্যর্থ সভ্যতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। ফলে ইসলামের সত্য ও সরল আদর্শের প্রয়োজন ও প্রাসঙ্গিকতা যেন ‘দৃষ্টিগ্রাহ্য’ হয়ে গিয়েছে।
এ অবস্থায় ইসলাম তার পক্ষ-বিপক্ষ উভয় শিবিরকে আহবান করে, আদর্শের শীতল ছায়ায় আশ্রয় নেয়ার।
ইসলাম তার বিরোধীদের বলে, ‘আসলিম তাসলাম’-ইসলামে এসো, শান্তি ও নিরাপত্তা লাভ করবে। সন্ত্রাস, দুর্নীতি, কপটতা ও মিথ্যাচারের পরিবর্তে সততা, সরলতা, শান্তি ও শালীনতার নিশ্চয়তা একমাত্র ইসলামেই আছে। তবে এই সত্য উপলব্ধি করতে হলে তোমাকে প্রগতি ও আধুনিকতার মিথ্যা অভিমান ত্যাগ করে তোমায় বাস্তব অবস্থা চিন্তা করতে হবে। তথাকথিত সভ্যতার মুখোশ সরিয়ে বাস্তবতার আয়নায় একবার নিজের মুখ দেখ, তাহলে দেখবে, দুর্নীতি, সন্ত্রাস এবং মিথ্যাচার ও অবিশ্বাসের কালিমায় তা কেমন কালিমালিপ্ত হয়ে আছে। এই মিথ্যা অভিমানের মুখোশ দিয়ে এত কালিমা আর কতকাল ঢেকে রাখবে? ইসলাম তো এসেছে মুখোশ বওয়ার যন্ত্রনা থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য এবং সকল কলঙ্ক থেকে পবিত্র করার জন্য।
একইভাবে তাকওয়ার দ্বীন ইসলাম তার অনুসারীদের বলে, ‘মুমিনগণ! পুরোপুরি ইসলামে দাখিল হও, শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। নিশ্চয়ই সে তোমাদের প্রকাশ্য দুশমন।’
যারা মুমিন, যাদের আল্লাহ ঈমানের দৌলত নসীব করেছেন তাদের তো ভুলে গেলে চলবে না যে, ইসলাম বিরোধী শিবিরে তারাই ইসলামের মুখপাত্র। তাদের আচরণ-উচ্চারণ দ্বারাই ইসলামের মূল্যায়ন করা হবে। আর বর্ণচোরা শ্রেণী তাদেরকে আঘাত করেই ইসলামকে ঘায়েল করার সুখ পেতে চাইবে। সুতরাং মুমিনদের আচরণ হতে হবে সতর্ক ও ইসলামের বিধানসম্মত। তাদের উচ্চারণ হতে হবে সংযত, শালীন এবং ইসলামের আদব ও শালীনতার উত্তম দৃষ্টান্ত। এক্ষেত্রে আল্লাহর নবীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সীরাত আমাদের জন্য আদর্শ। একইভাবে তাদের লেনদেন, সামাজিকতা, শত্রুতা-মিত্রতা সবই হতে হবে কুরআন-সুন্নাহর আদব ও আহকামে পুরোপুরি উত্তীর্ণ। এককথায় জীবনের সকল ক্ষেত্রে ইসলামী বিধান ও আচরণবিধি আমাদের পূর্ণরূপে অনুসরণ করতে হলে এবং সর্বক্ষেত্রে সংযম ও আত্মনিয়ন্ত্রনের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করতে হবে।
এ দেশে, এই সমাজে যখন হক-বাতিলের দ্বন্দ প্রকাশ্য রূপ ধারণ করেছে তখন ইসলামের অনুসারী সর্বস্তরের মানুষের সর্বোচ্চ সংযম ও সতর্কতার পরিচয় দিতে হবে। এ দেশে যারা ইসলামী শিক্ষার ধারক-বাহক, বিশেষত কওমী মাদরাসার আলিম-তালিবে ইলমের অবস্থান তো এখন তরবারীর ফলার উপর। একটি সময় ছিল যখন ‘কওমী’ শব্দটির সঙ্গেও সমাজের একটি শ্রেণীর পরিচয় ছিল না; কিন্তু সময়ের বিবর্তনে তাঁরা উঠে এসেছেন সর্বস্তরের মানুষের আগ্রহ ও আলোচনায়। এ অবস্থা ও অবস্থানের নাযুকতা উপলব্ধি করা অতি প্রয়োজন। এখন সংযম ও সতর্কতার প্রয়োজন আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি। মনে রাখতে হবে, কোটি কোটি কৌতুহলী চোখ আমাদের আচরণ-উচ্চারণ পর্যবেক্ষণ করছে। আমরা যদি কুরআনী শিক্ষা والله خبير بما تعملون এবং ما يلفظ من قول الا لديه رقيب عتيد এর অনুশীলনে অভ্যস্ত হয়ে থাকি তবে তো ইনশাআল্লাহ কোনো ভয় নেই। নতুবা সময় এসেছে পূর্ণ সংযমে অভ্যস্ত হওয়ার- চিন্তায়, চেতনায়, কর্মে,শব্দে, বাক্যে, বক্তব্যে।
আল্লাহ আমাদের সহায় হোন। আমীন। ষ