ই স লা মে র পূ র্ণা ঙ্গ তা প্রসঙ্গ : রাষ্ট্রব্যবস্থা ও জীবনব্যবস্থায় ইসলাম
কিছুদিন পূর্বে ‘মদীনা সনদ’ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-পর্যালোচনা শুরু হওয়ায় গত সংখ্যায় ঐ সনদের বিস্তারিত বর্ণনা পাঠকদের নিকট পেশ করা হয়েছিল।
ঐ সনদকে কিছু লোক তাদের মতলব হাসিলের জন্য ভুলভাবে উপস্থাপন করে থাকে এবং এ ধরনের বিভ্রান্তিকর ও অসত্যেভরা একটি প্রবন্ধের বিষয়ে আসা একটি প্রশ্নের জবাব লিখেছিলেন মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক ছাহেব আলকাউসারের মার্চ ২০১০ সংখ্যায়। ঐ প্রবন্ধে লেখকের দাবি ছিল মদীনা ছিল ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র এবং মদীনা সনদ হচ্ছে তার প্রমাণ। পাঠকবৃন্দের জন্য ঐ জবাবের সারসংক্ষেপ
পুনঃমুদ্রণ করা হল।-সম্পাদক
প্রত্যেক মুসলমানের ‘জরুরিয়্যাতে দ্বীন’ সম্পর্কে (অর্থাৎ দ্বীনের স্বতঃসিদ্ধ ও মৌলিক বিষয় সম্পর্কে) সহীহ ইলম ও বিশুদ্ধ ধারণা থাকা অপরিহার্য। একজন পাঠককে অন্তত এই পরিমাণ জ্ঞান ও প্রজ্ঞার অধিকারী হওয়া আবশ্যক, যাতে সে গলদ আকীদাধারী বর্ণচোরা লেখক, কলামিস্টদের মিথ্যাচার বা অপব্যাখ্যায় বিভ্রান্ত না হয়। বর্তমান সময়ে চিন্তা ও কলমের অনাচার এত প্রবল যে, কে কাকে বাধা দেয়! মিথ্যাকে প্রতিহত করার যে তিনটি উপায় ছিল, অর্থাৎ ভদ্রতা ও শরাফত, আখিরাতের ভয় এবং চার আসমানী কিতাবের সঙ্গে অবতীর্ণ পঞ্চম বস্ত্ত-‘আলহাদীদ’ (বা ডান্ডা), কোনোটাই তো কার্যকর নেই। প্রথম দুই বস্ত্তর কথা তো বলাই বাহুল্য। এসব থেকে পাকছাফ থাকাই প্রগতিশীলতা ও মুক্তবুদ্ধির প্রথম শর্ত। অতএব আমাদের বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের নিকট এসবের আশা করাও অন্যায়। আর শাসনের দন্ড তো আজকালকার দিনে থাকে আল্লাহর দুশমন-শ্রেণীর হাতে। অতএব তাদের লেখালেখিতে যদি আপনি এ ধরনের কুফরিয়াত দেখেন, এমনকি তাতে যুক্তি-প্রমাণ এবং হাওয়ালা-উদ্ধৃতিও দৃষ্টিগোচর হয় তাতেও আশ্চর্য হওয়ার কোনো কারণ নেই। এই সম্প্রদায়ের লোকেরা তো খন্ড ও পৃষ্ঠা নম্বরসহ মিথ্যাচার করে থাকে।
আপনি যে প্রবন্ধ ও প্রতিবেদনের কথা বলেছেন তা এখন আমার সামনে রয়েছে। আমি তো এখানে কোনো যুক্তি-প্রমাণ দেখতে পাচ্ছি না, শুধু কতগুলি অসার দাবির সমষ্টি। সেগুলোও স্ববিরোধিতায় পূর্ণ! আর ‘প্রমাণ’ হিসেবে কিছু থাকলে সেটিও অবাস্তব ও কল্পনাপ্রসূত। ‘যুক্তি’ বা ‘প্রমাণ’ বলা যায় এমন কিছুর অস্তিত্ব এখানে নেই।
লেখকের স্ববিরোধিতার একটি দৃষ্টান্ত লক্ষ করুন :
সে একদিকে দাবি করেছে যে, ইসলামে রাজনীতির বিষয়ে কোনো বিধান নেই, অন্যদিকে দুইবার রাজতন্ত্রকে ইসলামবিরোধী বলেছে। প্রশ্ন এই যে, ইসলামে যদি রাজনীতি সম্পর্কে কোনো কিছুই না থাকে তাহলে ইসলামে রাজতন্ত্র নিষিদ্ধ হওয়ার সিদ্ধান্ত সে কোথায় পেল?!
উল্লেখিত প্রবন্ধ ও প্রতিবেদন দু’টোতেই মদীনা-সনদের উল্লেখ দেখা যাচ্ছে। তারা এই ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেছে যে, মদীনা-সনদের কোথাও মদীনার রাষ্ট্র-ব্যবস্থা ইসলাম হবে বা তা শরীয়া আইন অনুযায়ী পরিচালিত হবে এমন কথা বলা হয়নি।
প্রশ্নোক্ত প্রবন্ধে তো নির্লজ্জভাবে এই দাবি করা হয়েছে যে, মদীনা ছিল একটি ধর্ম-নিরপেক্ষ রাষ্ট্র!
দেখুন, মদীনা-সনদে পরিষ্কার বলা আছে-
وإنه لا يحل لمؤمن أقر بما في هذه الصحيفة، وآمن بالله واليوم الآخر أن ينصر محدثا أو يؤويه وإن من نصره أو آواه، فإن عليه لعنة الله وغضبه يوم القيامة ولا يؤخذ منه صرف ولا عدل. وإنه مهما اختلفتم فيه من شيء فإن مرده إلى الله وإلى محمد.
কিছুদূর গিয়ে ইহুদীদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দফাগুলোতে বলা হয়েছে-
وإنه ما كان بين أهل هذه الصحيفة من حدث، أو اشتجار يخاف فساده فإن مرده إلى الله وإلى محمد رسول الله (صلى الله عليه وسلم)، وإن الله على أتقى ما في هذه الصحيفة وأبره.
(মাজমূআতুল ওয়াছাইকিছ ছিয়ছিয়্যাহ লিল‘আহদিন নববী ওয়াল খিলাফাতির রাশিদাহ, ড, হামীদুল্লাহ পৃ. ৬১, ৬২; আল মুজতামাউল মাদানী ফী ‘আহদিন নুবুওয়াহ, ড. আকরাম জিয়া আল-উমারী পৃ. ১২১, ১২২)
উপরোক্ত দু’টি গ্রন্থে এই ‘সনদে’র মূল সূত্রগুলো দেওয়া আছে।
গিয়োমকৃত সীরাতে ইবনে হিশামের ইংরেজি অনুবাদ যা (The Life of Muhammad (a translation of Ibn-Ishaq’s Sirat Rasulallah) নামে প্রকাশিত, তার ২৩১-২৩৩ পৃষ্ঠায় এই সনদটি বিদ্যমান রয়েছে। তাতে উপরোক্ত দফাগুলির যে তরজমা করা হয়েছে তা হুবহু তুলে দিচ্ছি-
It shall not be lawful to a believer who holds by what is in this document and believes in God and the last day to help an evil-doer or to shelter him,The curse of God and His anger on the day of resurrection will be upon him if he does, andneither repentance nor ransom willl be received from him.
Whenever you differ about a matter it must be referrred to God and to Muhammad.
If any dispute or controyersy likely to cause trouble should arise it must be referred to God and to Muhammad the apostle of God. God accepts what is nearest to piety and goodness in this document.
ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত সীরাতে ইবনে হিশামের বাংলা অনুবাদ থেকে উপরোক্ত দফাগুলির তরজমা তুলে দিচ্ছি-‘২৩. আর যে মুমিন ব্যক্তি এই লিপির বক্তব্য স্বীকার করে নিয়েছে আর সে আল্লাহ ও শেষ দিবসের প্রতি বিশ্বাস পোষণ করে, তার জন্য কোন নতুন ফিতনা সৃষ্টিকারীকে সাহায্য করা বা তাকে আশ্রয় দান বৈধ হবে না। যে ব্যক্তি তাকে সাহায্য করবে বা আশ্রয় দেবে, তার প্রতি আল্লাহর লা’নত ও গযব হবে কিয়ামতের দিনে এবং তার থেকে ফিদয়া (মুক্তিপণ) বা বদলা গ্রহণ করা হবে না।’
২৪. আর যখন তোমাদের মধ্যে কোন বিরোধ উপস্থিত হবে, তখন আল্লাহ তাআলা ও মুহাম্মাদ (সা.)-এর নিকট তা উত্থাপন করতে হবে।’
৬. ‘এই চুক্তিনামা গ্রহণকারী পক্ষসমূহের মধ্যে যদি এমন কোন নতুন সমস্যার বা বিরোধের উদ্ভব হয়-যা থেকে দাঙ্গা বেঁধে যাওয়ার আশংকা দেখা দেয় তাহলে তা আল্লাহ তাআলা এবং আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ (সা.)-এর নিকট মীমাসাংর্থে উত্থাপিত করতে হবে। ... (সীরাতুন নবী (সা.) ২/১৭৯-১৮০)
এই ‘সনদে’ কি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিধানকে সর্বোচ্চ আইন হিসেবে গ্রহণ করা হয়নি? আর এমন সুস্পষ্ট ঘোষণা কি কোনো ধর্ম-নিরপেক্ষ সমাজের সংবিধানে থাকতে পারে?
সহীহ হাদীসে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেছেন-
لا يجتمع دينان في جزيرة العرب.
অর্থ : জাযিরাতুল আরবে দুই দ্বীন একত্র হবে না।-মুয়াত্তা ইমাম মালিক পৃষ্ঠা ৩৬০
এগুলো কি প্রমাণ করে যে, মদীনা ধর্ম-নিরপেক্ষ রাষ্ট্র ছিল?
গোড়ার কথা হচ্ছে, সর্বযুগের বাতিলপন্থী লোকেরা হীনম্মন্যতার শিকার হয়ে থাকে। আমার ধারণা, বর্তমান যুগের বাতিলপন্থীদের মাঝে এই ব্যাধি আরো প্রকট। এজন্য তারা তাদের লালিত কুফরী চিন্তাগুলোকে নিজেদের পক্ষ থেকে বলার মতো সাহস সঞ্চয় করে উঠতে পারে না। ফলে কুরআন-হাদীস, সীরাত-তারীখ, ফিকহ-তাফসীর এবং ইসলামী আকাইদের মধ্যে বিকৃতি ও অপব্যাখ্যার মাধ্যমে কিংবা মনগড়া কথাবার্তা তৈরি করে তা দ্বীনের নামে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। তারা এটুকুও উপলব্ধি করে না যে, এতে তাদের প্রতারণা ও মিথ্যাচার দ্রুত প্রকাশিত হয়ে পড়বে। ষ