হেফাযতে ইসলাম ও ওহাবী-সুন্নী হযবরল
ধর্মপ্রাণ মানুষমাত্রই এখন হেফাযতে ইসলামের সমর্থক। বিশেষত ৫ মে হেফাযতের ঢাকা অবরোধ উপলক্ষে শাপলা চত্বরে তাঁদের ক্লান্ত-শ্রান্ত মানুষগুলোর উপর গভীর রাতে সমস্ত বাতি নিভিয়ে হাজার হাজার সশস্ত্র র্যাব-পুলিশ-বিজিবি সদস্য যে বিভীষিকাময় অভিযান চালায় এবং সরকার পক্ষ যেভাবে তার জন্যে বিজয়োল্লাস করতে থাকেন, দিগন্ত ও ইসলামিক টিভি বন্ধ করে দেন তাতে হেফাযতে ইসলামের প্রতি আম জনতার সহানুভূতি ও সহমর্মিতা বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়ে যায়।
হেফাযতে ইসলামের নেতৃবর্গ ও ইসলামী জনতার জন্যে এটা সম্পূর্ণ একটি ধর্মীয় ও ধর্মরক্ষার আন্দোলন হলেও সরকারী মোর্চা ও বামপন্থ'ীদের দৃষ্টিতে এটা সম্পূর্ণ একটা রাজনৈতিক আন্দোলন, যা তাদেরকে উচ্ছেদ করে বিরোধী দলকে শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করবে বলে তাঁরা আশঙ্কা করেন। এ জন্যে এই জনপ্রিয় অরাজনৈতিক সংগঠনটি নিশ্চিহ্ন করার জন্যে হত্যা-গুম, জেল-জুলুম, রিমান্ড এবং তাবত নির্মূলপ্রক্রিয়া এখন কওমী মাদরাসা ও হেফাযতের বিরুদ্ধে পূর্ণোদ্যমে চালু রয়েছে। ফলে কেবল দেশের অভ্যন্তরেই নয়, বহির্বিশ্বেও এর প্রবল প্রতিক্রিয়া হচ্ছে। বিশ্বের সবচাইতে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের দেশে-যে দেশে শতকরা ৮৫ জন মুসলমান সেখানে ধর্ম ও ধর্মের প্রচারক-সেবকদের উপর অত্যাচার অবিচার দলন-পেষণ দেখে মুসলিম বিশ্বের সর্বত্র হায় হায় রব উঠেছে। অন্ধের চোখ বন্ধ থাকলেও প্রলয় বন্ধ থাকে না। এর শেষ কোথায়, পরিণতি কী, তা একমাত্র ভবিতব্যই জানেন।
বাহ্যত হেফাযতের আন্দোলনে আলেম সমাজ ও দ্বীনদার মুসলমানগণ অমানুষিক অত্যাচার নিপীড়নে, হামলা-মামলার শিকারে পরিণত হলেও এবং তাঁদের যথেষ্ট লোকক্ষয় হলেও গোটা জাতিকে তা নাড়া দিয়েছে সন্দেহ নেই।
সরকারী দল, প্রশাসন ও তাদের প্রচারযন্ত্রসমূহ, মন্ত্রীযন্ত্রী পরামর্শকরা পুলিশ হত্যা থেকে কুরআন পোড়ানো পর্যন্ত এমনকি ব্যাংক লুটের প্রচেষ্টা জাতীয় হাস্যকর অপপ্রচার চালালেও তা হালে পানি পাচ্ছে না। সাধারণ মানুষ এগুলোকে প্রচারণা ও দুর্নাম রটিয়ে দুর্বল করার প্রচেষ্টা ছাড়া আর কিছুই মনে করছে না। প্রধানমন্ত্রী মদীনাসনদ অনুযায়ী দেশ চলছে বলে জাতিকে বুঝাবার চেষ্টা করেছেন। এমনকি নাস্তিক ব্লগাররাও এখন কুরআন তিলাওয়াতের দ্বারা সভা শুরুর তাগিদ অনুভব করছে। টিভি চ্যানেলগুলোতে প্রায়শ টকশোতে হেফাযত-প্রসঙ্গ ঘুরেফিরে আসছে।
হেফাজত ও এর নের্তৃবর্গের নামে যে সকল কুৎসা রটনা করা হচ্ছে সেগুলোর সাথে নতুন যুক্ত হয়েছে ‘ওহাবী তত্ত্ব’। ইংরেজ আমলের বস্তাপঁচা সে তত্ত্বটি উঠিয়ে কেউ কেউ বলছেন-এরা সুন্নী মুসলিম নয়; বরং ওহাবী মুসলিম।
আসলে ওহাবী আন্দোলন খ্রিষ্টীয় অষ্টাদশ শতাব্দীর আরবের একটি সংস্কার আন্দোলন। এ আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মাদ বিন আবদুল ওয়াহহাব (১৭০৩-১৭৯২ খ্রি.) একজন ধর্মীয় আলেম এবং সংস্কারক ছিলেন। তিনি আমাদের এ ভারতীয় উপমহাদেশের বিপ্লবী আলেম মাওলানা শাহ ওলিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভীর সমসাময়িক ছিলেন। সে যুগে যে ব্যাপকভাবে পীরপূজা, গোরপূজা, ব্যক্তিপূজা শুরু হয়ে গিয়েছিল এবং তুর্কী সুলতানরা ইসলামী আদর্শ থেকে দূরে সরে যেভাবে আয়েশী রাজা-বাদশাহর জীবন যাত্রা শুরু করেছিলেন, তিনি ছিলেন তার ঘোর সমালোচক। তিনি সর্বপ্রথম নজদ প্রদেশকে এবং পরে মক্কা-মদীনাসহ গোটা হেজাজ তথা আরব উপদ্বীপে তাঁর অনুসারীদের শাসন প্রতিষ্ঠা করেন এবং এভাবে তুর্কী সুলতানদের শক্ত প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠেন। তিনি ছিলেন সুন্নী চারটি প্রধান মাযহাবের অন্যতম হাম্বলী মাযহাবের অনুসারী। ইসলামের ইতিহাসের শুরু থেকে সুন্নীদের প্রতিপক্ষরূপে চলে আসছিল শিয়া পন্থীরা-যারা ইসলামের খিলাফতী ধারণার বিপক্ষে ‘ইমামতে’র ধারণায় বিশ্বাসী। বিশ্বের প্রায় দেড়শ কোটি মুসলমানদের মধ্যে ৫/৬ কোটি শিয়া ছাড়া অপর সকলেই সুন্নী। এমনকি যারা কোন নির্দিষ্ট মাযহাবের অনুসারী নন, হাদীসের অনুসারীরূপে নিজেদেরকে আহলে হাদীস বলে পরিচয় দেন, তাঁরাও এ অর্থে সুন্নী। তাঁরাও আমাদেরই মত শিয়াদেরকে ভ্রান্ত বলে বিশ্বাস করেন। এমতাবস্থায় মুহাম্মাদ বিন আবদুল ওয়াহহাবের অনুসারীদেরকে সুন্নীদের প্রতিপক্ষরূপে দাঁড় করিয়ে অপপ্রচারে লিপ্ত হওয়াটা ছিল একান্তই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এ গরজটা তুর্কী সুলতানরা খুব বেশি অনুভব করেছিলেন, ঠিক যেভাবে ৬ দফা ঘোষণার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে আইয়ুব-ইয়াহইয়া খান তথা পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার দুর্নাম করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিল এবং সর্বপ্রকার দমন পীড়নের ব্যবস্থা অবলম্বন করেছিলেন। মক্কা-মদীনার হারামাইন যেহেতু তুর্কী শাসকদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিল আর আমাদের ধর্মপ্রাণ হাজী সাহেবগণ মক্কা-মদীনায় যিয়ারতে গিয়ে সে সব প্রচারণায় প্রভাবিত হয়ে পড়তেন, তাই এ উপমহাদেশেও ওহাবী বিরোধী প্রচারণা ছড়িয়ে পড়ে। এ প্রচারণা যেহেতু ব্যাপকভাবে হয়েছিল তাই ব্রিটিশ আমলে বৃটিশ সরকার সে অস্ত্রটি আমাদের আজাদী সংগ্রামের সংগ্রামী আলেমগণের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করে। তারা আজাদী সংগ্রামের পথিকৃত বালাকোটের শহীদ মাওলানা সৈয়দ আহমদ বেরলভী ও শাহ ইসমাঈল শহীদকে সাথে সাথে গোটা মুজাহিদ আন্দোলন ও আজাদী সংগ্রামকে ‘ওহাবী আন্দোলন’ বলে অভিহিত করে। সাথে সাথে আমাদের বাংলাদেশের বীর মুক্তিযোদ্ধা মাওলানা নিসার আলী ওরফে তীতুমীর এবং হাজী শরীয়তুল্লাহর ফরায়েজী আন্দোলন সবই বৃটিশ ঐতিহাসিক ও আমলা ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টার প্রমুখ কর্তৃক (ওহাবী) বলে অভিহিত হয়। হান্টারের ভাষ্যমতে, সৈয়দ আহমদ বেরলভী মক্কায় গিয়ে ওহাবী আন্দোলনে দীক্ষিত হয়ে আসেন, অথচ তিনি বা আমাদের তীতুমীর, হাজী শরীয়তুল্লাহ প্রমুখ বীরপুরুষগণ যখন ১৮২০ সালের দিকে হজে যান তখন মক্কা-মদীনায় সুদৃঢ় তুর্কী শাসন চলছিল এবং ঐ সব পবিত্র নগরীতে ওহাবী আন্দোলনের নামটি উচ্চারণ করাও ছিল গুরুতর অপরাধ। এর এক দশক পূর্বেই তুর্কী সুলতানরা ১২৪৪ হিজরীতে/১৮১৩ খ্রি. ওহাবীদেরকে হটিয়ে মুক্ত করে ফেলেছিলেন। সুতরাং ওটা ছিল নেহাৎই রাজনৈতিক প্রচারণা এবং অসত্য বিবরণ। তাই ১৮৬৪ সালে ‘গ্রেট ওহাবী ট্রায়াল’ নামে উপমহাদেশীয় স্বাধীনতা সংগ্রামীদের বিরুদ্ধে ‘কোলকাতা হাইকোর্টে’ সরকারী মামলা হয়েছিল-যার ভিত্তিতে অনেকেরই ফাঁসি ও দ্বীপান্তরের শাস্তি হয়েছিল। সে মামলার অভিযুক্তগণ আদালতে তাদেরকে ওহাবী বলে অভিহিত করার প্রতিবাদ করে বলেছিলেন, আমরা ওহাবী নই, মুহাম্মাদী তরীকার অনুসারী।’ তারা ওহাবীর পরিবর্তে তাদেরকে সুন্নী বলে অভিহিত করার দাবী করেছিলেন। স্বয়ং হান্টার লেখেন, কার্যত ওহাবীরা হচ্ছে সুন্নী সম্প্রদায়ের একটি অগ্রগামী অংশ এবং ইসলামের শুদ্ধাচারপন্থী অংশ। বাংলা ও উত্তর পশ্চিম ভারতের প্রায় সকল মুসলমানই সুন্নী সম্প্রদায়ভুক্ত। (ইন্ডিয়ান মুসলিমস পৃ. ৪৫-৪৬)
ভারতবর্ষে ওহাবী-সুন্নী দ্বন্দ্বের সূচনা
১. এল বিভান জোনস লেখেন, গোঁড়া মৌলবীরা সাইয়েদ আহমদ শহীদের অনুসারীদের কট্টর সংস্কার আন্দোলনকে ওহাবীটজম বলে কুৎসা রটায়। (Nicknamed them Wahhabies) The people of the mosque, p. 206 (London 1932)
২. ঐতিহাসিক পি হার্ডি লেখেন, The follwers of Syed Ahmad Barelvi Continued to maintain an active guerrilla war on the North West frontier in the region of Black mountain ... . the Ulama were a potential political force and that it was necessary to divided them politically from the supporters of Syed Ahmad Brelvi
অর্থাৎ সৈয়দ আহমদ বেরলভীর অনুসারীরা ভারতবর্ষের উত্তর সীমান্তের কালোপাহাড় এলাকায় একটি গেরিলাযুদ্ধ অব্যাহতভাবে চালিয়ে যাচ্ছিল। ... আলেমসমাজ আরো একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক শক্তিরূপে বিরাজমান ছিল। তাই তাদেরকে রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত করে সাইয়েদ আহমদ বেরলভীর অনুসারীদের থেকে সরিয়ে আনাটা অপরিহার্য হয়ে ওঠে। (দি মুসলিমস অব ব্রিটিশ ইন্ডিয়া পৃ. ২৬৮)
৩. দেওবন্দী আলেমগণ ক্রমাগত ব্রিটিশ শাসন বিরোধী ফতোয়া দিয়ে যাচ্ছিলেন। পি হার্ডি বলেন,
The collection of fatwas by Deobandi ulama are of immence importance for understanding the pre-ocopations of Indian Muslims.
অর্থাৎ দেওবন্দী আলেমগণের ফতোয়া সংকলনগুলো পরাধীন ভারতের মুসলমানদের মন ও মনন গঠনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হত। (প্রাগুক্ত পৃ. ১৭১)
৪. এমতাবস্থায় বৃটিশ সরকারের জন্যে যা অত্যন্ত দরকারী হয়ে পড়েছিল তা হচ্ছে-
For every Alim who issued a fatwa that India was Dar-ul-Harb there would be one who declared that it was Dar-ul-Islam. Deoband represented the first response.
অর্থাৎ এমন প্রত্যেক আলেম যিনি বলেন হিন্দুস্তান দারুল হরব বা শত্রুকবলিত রাষ্ট্র, তার জবাবে আরো একজন করে আলেম থাকা অপরিহার্য যিনি বলবেন, না, হিন্দুস্তান দারুল ইসলাম। দেওবন্দ ছিল প্রথমোক্ত দলের প্রতিনিধিত্বকারী।
৫. পক্ষান্তরে আহমদ রেযা খান ঐ দ্বিতীয় অপ্রিয় দায়িত্বটি গ্রহণ করলেন। হার্ডির ভাষায়-
Ahmad Reza Khan of Barilvi issued a fatwa declaring India to be Dar-ul-Islam, marking it a sin to associate with infidels.
অর্থাৎ আহমদ রেযা খান ভারতবর্ষকে দারুল ইসলাম বলে ঘোষণা করে বিধর্মীদের (হিন্দুদের) সঙ্গে মিলে চলা (স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিচালনা) কে পাপ বলে ঘোষণা দেন। (প্রাগুক্ত পৃ. ২৬৮)
এ-ই হল ভারতীয় উপমহাদেশে ওহাবী-সুন্নী দ্বন্দ্বের ইতিহাস। যাদের জন্যে বেদাতী আলেমরা এ মহান জিহাদ (?) শুরু করেছিলেন সেই ইংরেজ জাতির ঐতিহাসিকরা তা ধরিয়ে দিয়েছেন। ঐ যুগে তিনি আজীবন যালেম বিজাতীয় বিদেশী সরকারের সমর্থন অব্যাহতভাবে যুগিয়ে গেছেন। এমনকি তার মৃত্যুর বছর ১৯২১ সালে খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনের বিরুদ্ধে সরকার পরে আলেমরা একটি সম্মেলন আহবান করেছিলেন।
ফ্রান্সিস রবিনসন এ তথ্যটি ফাঁস করে দিয়ে মন্তব্য করেন-
He had considerable influence with the masses but was not favoured by educated Muslims.
সাধারণ মানুষের উপর তার বেশ প্রভাব ছিল, কিন্তু শিক্ষিত মুসলমানরা তাকে পসন্দ করতেন না। (সেপারিটিজম এমাঙ ইন্ডিয়ান মুসলিমস, পৃ. ৪২২)
সে যুগে আহমদ রেযা খানের সাথে আবদুল মজীদ বদায়ূনী ও আবদুল হামিদ বদায়ূনী নামক দুই ভাই-যাদের প্রথমোক্তজন সরকারী ‘শামসুল উলামা’ খেতাব এবং ১৯২২ সালে গভর্ণর হারকোট বাটলারের দরবার থেকে একটি তমঘা ও সম্মানসূচক তরবারী লাভ করেছিলেন। (প্রাগুক্ত, পৃ. ২৭২)
গেইল মেনান্ট লেখেন, সরকারী মোসাহেবীর পুরস্কার স্বরূপ আবদুল মজীদ লক্ষ্ণৌর সরকার সমর্থক ক্যানিং কলেজের অধ্যাপকের চাকুরি এবং আবদুল হামিদ লক্ষ্ণৌ ঈদগাহর ইমামতি লাভ করতে সমর্থ হয়েছিলেন। (দি খিলাফত মুভমেন্ট দিল্লী অক্সফোর্ড ফ্রেম ১৯৮২, পৃ. ২৭২)
বর্তমানে ‘ওহাবী তত্ত্ব’ পুনঃআবিষ্কারকারীগণ সেই নোংরা ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি করে জানান দিলেন, ব্রিটিশ বেনিয়ারা ৬৫ বছর পূর্বেই এদেশ থেকে পাততাড়ি গোটাতে বাধ্য হলেও তাদের নিমক হালাল অনুগামীরা এখনো বেঁচে আছেন এবং যে কোন বাতিল শক্তিকেই তারা মদত যোগাতে সদা প্রস্ত্তত! সাধু সাবধান!! ষ
লেখক : বহু গ্রন্থপ্রণেতা, অনুবাদক, সম্পাদক
সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ জমিয়তুল মুদাররিসীন (১৯৭২)
সাবেক ইমাম ও খতীব, বাংলাদেশ সচিবালয় মসজিদ ও গণভবন মসজিদ (১৯৭৬-২০০৫)