বালাকোট থেকে মতিঝিল
সম্ভবত ইতিহাসের একটি ঘুর্ণন বলা যায়। একই রকম ঘটনা ঘুরে ফিরে ঘটে। সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার চরিত্রেও মিল দাঁড়িয়ে যায়। অনেক সময় ঘটে যায় দিন-তারিখেরও মিল। বেদনার ঘটনা, দুঃখের ঘটনায় এরকম মিল ঘটে গেলে মানুষের বুকে শোকের চর জেগে ওঠে। আবেগাকুল মানুষ তখন আগের ঘটনার সঙ্গে পরের ঘটনার আরও অনেক কিছুরই মিল খুঁজে দেখার চেষ্টা করে। অনেক সময় দুটি ঘটনার চরিত্র, ব্যক্তিত্ব ও মানের ক্ষেত্রে সমতা হয়তো থাকে না। কিন্তু উদ্দেশ্যগত মিল এবং দিন-তারিখ ও সংখ্যাতাত্ত্বিক অন্যান্য সাদৃশ্যের কারণে মিল খুঁজে পেয়ে সান্ত্বনা লাভের উপায় বের করারও চেষ্টা করে। সম্প্রতি এরকমই একটি ঘটনা ঘটে গেছে।
কষ্টের এই মিল, বেদনার এই সামঞ্জস্য কেউ প্রত্যাশা করেনি। অথচ কিছু মিল ও অমিল নিয়ে ঘটে গেছে সেটাই।
আজ থেকে ১৮২ বছর আগে ব্রিটিশ ভারতের সীমান্ত অঞ্চল বালাকোটে সংঘটিত এক রক্তক্ষয়ী ঘটনার প্রতিচ্ছবি দাঁড়িয়ে গেল স্বাধীন বাংলাদেশের বুকে : ঢাকার মতিঝিলে। সে ঘটনাটি ঘটেছিল ১৮৩১ সালের ৬ মে। এ ঘটনাটি ঘটেছে ২০১৩ সালের ৬ মে। সেটি ঘটেছিল জুমাবারের দিনদুপুরে। এটি ঘটেছে সোমবার শেষরাতের বাতি নেভানো অন্ধকারে। সেটি ছিল যুদ্ধ, এটি ছিল নিরস্ত্র, ঘুমন্ত লাখো মানুষের অবস্থানে নির্বিচার আক্রমণ। ওই ঘটনায় ৭০০ মুসলিম মুজাহিদের মধ্যে শহীদ হয়েছিলেন ৩০০ জন। আর এই ঘটনায় (সরকারি বিবরণ অনুযায়ী কেউ হতাহত হয়নি) ২৫০০ থেকে ৩০০০ মানুষ ‘নিহত’ হয়েছেন বলে দাবি উঠেছে। ওই ঘটনায় আক্রান্ত মুসলমানরা ছিলেন ভিনজাতির মানুষের সঙ্গে লড়াইরত। আর এ ঘটনায় স্বজাতির কয়েকটি বাহিনী তাদের ওপর হামলে পড়েছে।
বালাকোট আন্দোলনের মূল কথা ছিল-কুসংস্কার থেকে ইসলামী চিন্তা ও আমল রক্ষা, তাওহীদবাদী নিখাঁদ আধ্যাত্মিকতার বিকাশ ও ব্রিটিশ বেনিয়াদের কবল থেকে স্বদেশকে মুক্ত করার সংগ্রাম। ওই আন্দোলনের নাম ছিল তরিকায়ে মুহাম্মদী। ইতিহাসের সূত্র অনুযায়ী, ওই যুগের গ্রহণযোগ্য সব আলেম ও ইসলামপন্থী মানুষ ওই আন্দোলনের প্রতি সমর্থক ও সহানুভূতিশীল ছিলেন। আর এই আন্দোলনের মূল কথা হচ্ছে, সংবিধানে ‘আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ পুনঃস্থাপন, ইসলামবিরোধী উগ্র নাস্তিক ব্লগারদের মৃত্যুদন্ডের আইন প্রণয়ন করে শাস্তিদান এবং ইসলামী সংস্কৃতি ও জীবনাচারের বিকাশ। এই আন্দোলনের নাম হেফাজতে ইসলাম। এই আন্দোলনের সঙ্গেও দেশের সমকালের সত্যপন্থী গ্রহণযোগ্য সব আলেম ও সব পর্যায়ের মুসলমানরা সহানুভূতিশীল রয়েছেন বলে গণমাধ্যমে এসেছে।
ইসলাম, স্বাধীনতা ও স্বজাত্যবোধের বিবেচনায় এই দুটি আন্দোলনের মাঝে মিল অনেক। নেতৃত্বের প্রধান অংশের বৈশিষ্ট্য ও ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের মাঝে আন্দোলনের প্রতি সমর্থনের দিক থেকেও দুটি আন্দোলনের মাঝে মিল কম নেই। এমনকি ট্র্যাজেডি ও বিপর্যয়ের দিক থেকেও তেমন অমিল পাওয়া যায় না। কেবল বিপর্যয়-পরবর্তী প্রতিরোধের ঘটনার বিষয়টি এখনও অমীমাংসিত। এটি বলতে পারবে হয়তো আগামী দিনের ইতিহাস।
ইসলামী বিশ্বকোষ (১৬ শ’ খন্ড-১ম ভাগ, প্রথম প্রকাশ, পৃষ্ঠা : ৪৫, ৪৬, ৪৭)-এর বিবরণ অনুযায়ী ওই ঘটনায় মুসলমানদের বিপক্ষে শিখনেতা শের সিংয়ের বাহিনীর সেনাসংখ্যা ছিল ১০ হাজার। মতিঝিলের এ ঘটনাতেও নিরস্ত্র ঘুমন্ত মানুষের ওপর হামলাকারীদের সংখ্যা ছিল ১০ হাজার।
ওই ঘটনায় হতাহত মুসলমানদের অনেকের লাশ ও তাদের সঙ্গের অমূল্য ঐতিহাসিক সামানপত্র আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। আর এ ঘটনায় (জোর অভিযোগ উঠেছে) ‘নিহতদের’ লাশ গায়েব করে দেওয়া হয়েছে।
ওই ঘটনার যিনি প্রধান ছিলেন তাঁর নাম ছিল সাইয়েদ আহমদ শহীদ, আর এই কাফেলার যিনি প্রধান তাঁর নাম শাহ আহমদ শফী।
তবে তার মধ্যেও পার্থক্য একটা ছিল। বালাকোটের ঘটনায় লাশের অবমাননা ও ধ্বংসযজ্ঞের কাজটি করা হয় তিন দিন পর। আক্রমণকারী শিখদের মূল বাহিনী বালাকোট ত্যাগ করার পর চরম বিদ্বেষী কিছু শিখ সেনার হাতে এসব ধ্বংসযজ্ঞ সম্পন্ন হয়। এর আগের চিত্রটি ছিল অন্য রকম। যুদ্ধ শেষে সেনাপতি শের সিং সেনাদের দিয়ে সাইয়েদ আহমদ শহীদের লাশ খুঁজে বার করান। তখন তার দেহ ছিল মস্তক থেকে বিচ্ছিন্ন। শের সিং ওই লাশ সম্মানের সঙ্গে দাফনের জন্য স্থানীয় মুসলমানদের প্রতি অনুরোধ জানান। নিজে ওই লাশের ওপর একটি চাদর বিছিয়ে দেন। আর এ ঘটনায় ‘নিহতদের’ লাশের প্রতি আক্রমণকারী স্বজাতির সেনাদের ন্যূনতম সম্মান প্রকাশের কোনো ঘটনা কেউ শুনেনি। বরং গায়েব হয়ে যাওয়া হাফেয আলেমের লাশগুলোর প্রতি ভয়ংকর অবমাননা ও অসদাচরণের গল্প এখন সারা দেশের বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে।
বর্তমান পাকিস্তানের হাজারা জেলার কুনহার নদীর পাশে ছিল বালাকোটের অবস্থান। একটি উঁচু ময়দান। কোনো জনবসতি সেখানে ছিল না। তার পাশেই ছিল মাট্টিকোট পাহাড়।
ওই পাহাড় থেকেই শিখ আক্রমণকারী বাহিনী হামলা করে। আর এ ঘটনাটির অবস্থান স্বাধীন দেশ-ঢাকার হৃদপিন্ড; মতিঝিল। চারপাশে অফিসভবন, ব্যস্ত নগর, তামাশার সভ্যতা। ওই ঘটনায় যারা শহীদ হয়েছিলেন তাদের সংখ্যা চাপা দেওয়ার কোনো চেষ্টা কেউ করেনি। আর এই ঘটনায় যারা হতাহত হয়েছেন তাদের ‘শহীদ’ বলে উচ্চারণ করাই মুশকিল হয়ে গেছে। আর ‘নিহতদের’ ব্যাপারে বলা হচ্ছে, কেউ হতাহত হয়নি। এ ঘটনায় ‘শান্তিপূর্ণ, দক্ষতাপূর্ণ ও বিচক্ষণতাপূর্ণ’ অভিযান চালানো হয়েছে বলে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে মন্ত্রিপরিষদসহ সরকারপন্থী নেতাকর্মী, বুদ্ধিজীবীরা স্বস্তি প্রকাশ করেছেন।
ওই ঘটনার পর ইতিহাস তাদের জন্য যুগে যুগে কেঁদেছে, সাড়া দিয়েছে, প্রতিরোধ গড়েছে। আর এই ঘটনার পর নিঃশব্দে চোখের পানি মুছতেও নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে।
তবে, একটা ক্ষেত্রে আগের ও পরের ঘটনায় অদ্ভুৎ মিল খুঁজে পাওয়া যায়। সেটা হচ্ছে আক্রান্ত মুসলমানদের প্রতি চরম মিথ্যাচার ও বিদ্বিষ্ট বিষোদগার। ওই ঘটনার প্রায় তিন যুগ পর ব্রিটিশ সিভিলিয়ান হান্টারের লেখায় সাইয়েদ আহমদ শহীদকে ‘দস্যু ও ডাকাত সর্দার’ হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করা হয়েছে। আর এ ঘটনার তিন দিন পর হেফাজতে ইসলামের কর্মীদের ‘বাংলাদেশ ব্যাংক ও সচিবালয়ে লুটপাট চালানোর নিশ্চিত তথ্য ছিল’ বলে অভিযোগ তোলা হয়েছে। বেদনাদায়ক ও হাস্যকর!
অদ্ভুত রুদ্ধবাক বেদনার এক ভুবনে ডুবে আছে সারাদেশ। কেউ জানে না এ কষ্টের শেষ কোথায়? ৭ মে হাটহাজারীর সংবাদ সম্মেলনে হেফাজতে ইসলামের পক্ষ থেকে বেদনাঘন যে বক্তব্য পেশ করা হয়েছে, সংবাদপত্রে সেটি পড়ে চোখের পানি ধরে রাখা কঠিন হয়ে যায়। তবে আল্লাহ, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও ইসলামের মর্যাদা রক্ষা এবং ইসলামবিদ্বেষী উগ্র নাস্তিকদের বিচার চাওয়ার ‘অপরাধে’ চালানো এই অভিযানের বারুদ ধর্মপ্রাণ মানুষের বুকে কত যুগ আগুনের মতো জ্বলতে থাকবে- সে ধারণা হয়তো এখনই করা মুশকিল। এখন তো মানুষ নিঃশব্দে কেঁদে চলেছে। কোটি মজলুমের কপোল আর বুকে নোনা পানির স্রোত। তাদের মুনাজাতের হাত আরশের দিকে উঠানো। মজলুমের এই হাহাকারভরা ফরিয়াদে কখন কেঁপে উঠবে আল্লাহর আরশ, আকাশ-বাতাস, বান্দা কীভাবে তা বলবে? ষ