প রি ণা ম :ক্ষমতাদর্পীর বন্দিত্ব সবার জন্য পাঠশালা
ক্ষমতায় এসেছিলেন ক্যুদেতার মাধ্যমে। সেনাপ্রধান ছিলেন। সামরিক-বাহিনী তার অধীনে ছিল। দোর্দন্ড প্রতাপ নিয়ে দেশ শাসন করেছেন। দেশের ভেতরের ও বাইরের সব ইস্যুতে যখন তার মন যা চেয়েছে তিনি তাই করেছেন। বিনা বিচারে মানুষ হত্যা, গুম, মসজিদের ভেতরে সশস্ত্র অভিযান আর দেশজুড়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েমে বিরাট ‘সাফল্য’ হাতের মুঠোয় নিয়েছেন। নির্বাচন দিয়েছেন, সংসদ বসিয়েছেন আবার ভেঙ্গে দিয়েছেন। আস্থাভাজন কর্মচারীর মতো প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দিয়েছেন। বাতিল করে আরেকজনকে বসিয়েছেন। প্রধান বিচারপতিসহ বহু বিচারপতি বরখাস্ত করেছেন। বিচারপতিদের গৃহবন্দী করেছেন। মন চাইলে কোর্টও বন্ধ করে দিয়েছেন। স্বৈরশাসক হিসেবে শক্তির ‘খেলতামাশায়’ তার জুড়ি ছিল না। এভাবে ৯ বছর পার করলেও মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের ইজারাদার পশ্চিমা মোড়লশক্তির পিঠচাপড়ানো সহযোগিতা পেতে তার কোনো অসুবিধা হয়নি। কারণ, তিনি তাদের এজেন্ডা তার দেশে বাস্তবায়নে কোনো কৃপণতা দেখাননি। ‘দিলমন’ উজাড় করে দিয়েই মার্কিনী স্বার্থ পুরা করেছেন। শেষ পর্যন্ত দেশ ছেড়েছেন। বিশ্ব মোড়লদের সঙ্গে আস্থার সম্পর্কের কারণে তাকে কোনো বিপদে তখন পড়তে হয়নি। সে-ই তিনিই পাঁচ বছর পর ফুরফুরা মেজাজে নিজের দেশে উড়ে এসে এক জানকান্দানি অবস্থায় পড়েছেন। কঠিন নাজেহাল এক পরিস্থিতির মধ্যে তার দিনগুলো এখন কাটছে। হ্যাঁ, পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট ও সেনাপ্রধান পারভেজ মোশাররফের কথাই আমাদের মনে পড়েছে। তার অবস্থা এখন সবার জন্যই এক উন্মুক্ত পাঠশালায় পরিণত হয়েছে।
ক্ষমতার মসনদে বসে অপরাধ করেছিলেন তিনি অনেক। সহজে দেশ ছাড়তে পারায় সেসব নিয়ে একদম ভাবিত ছিলেন না। লন্ডন থেকে মাঝে-মধ্যেই দেশের গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতেন। এরই মধ্যে দেশে ফিরে রাজনীতির কিংবা দেশের হাল ধরার একটা খায়েশ তার মধ্যে আবারো চাঙ্গা হয়ে উঠে। নতুন নির্বাচনের ঘোষণা শুনেই তিনি নিজের দেশে উড়ে আসেন। এর ক’দিন পরই তার বিপদ শুরু হয়। প্রথম ধাক্কাটা আসে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে। তারা সাফ জানিয়ে দেন পাকিস্তানের কোনো আসন থেকে তিনি নির্বাচন করতে পারবেন না। এরপর ২০০৭ সালে বিচারকদের গৃহবন্দী করার তার একটি পুরনো নির্দেশের বিরুদ্ধে মামলা হয়। তিনি কোর্টে গেলে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়। সেখান থেকে পালিয়ে এসে তার খামারবাড়িতে আশ্রয় নেন। ১৯ এপ্রিল শুক্রবার তাকে গ্রেফতার করা হয়। পরের দিন ইসলামাবাদের সন্ত্রাসবিরোধী একটি আদালতে নিয়ে যাওয়া হলে তাকে ১৪ দিনের রিমান্ডে নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। ৪ মে তাকে আবারো আদালতে হাজির করার কথা রয়েছে। এখন তিনি তার খামারবাড়িতেই বন্দী অবস্থায় আছেন। ধারণা করা হচ্ছে, আপাতত সেখানেই তার পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদ চলবে। তার বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে বেশ কয়েকটি। শোনা যাচ্ছে, আরো কটি মামলা দায়েরের প্রস্ত্ততি চলছে। তার অবিচার ও জুলুমের কারণে ক্ষুব্ধ মানুষেরা এখন মুখ খুলতে শুরু করেছেন। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, চলমান মামলা কিংবা অন্য কোনো মামলায় শিগগিরই তাকে কারাগারের ভেতরে দেখা গেলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
পারভেজ মোশাররফ পাঁচ বছর আগে ক্ষমতা ছেড়ে লন্ডনে চলে যাওয়ার পরও তার অহংটা একদম ছাড়তে পারছিলেন না। তার শাসনামলের অন্যায়-অপরাধ নিয়ে কথা উঠলেই তিনি বেশ তুড়িমারা ভঙ্গিতেই বলতেন-‘আমি কাউকেই ভয় পাই না।’ সে কারণেই তিনি দেশে ফিরেছেন। তবে নিন্দুকেরা বলছেন, তার এই নির্ভীকতা আর আস্থার শেকড় গাড়া ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নীরব আষ্কারার ভেতর। তিনি ধরেই নিয়েছিলেন আমেরিকা তার সঙ্গে থাকলে দেশে ফিরেও তিনি কোনো বিপদে পড়বেন না। কিন্তু তার এ হিসাবটা ঠিক থাকেনি, উল্টে গেছে। কুদরতের ফয়সালার সামনে অনেক অংকই শেষ পর্যন্ত ভুল প্রমাণিত হয়। ক্ষমতাদর্পী শাসক আর ভিনদেশি খুটির জোরে কুঁদানো মানুষদের সামনে আজকের পারভেজ মোশাররফ ‘ইবরতের’ এক খোলা পোস্টার। এত অত্যাচার ভালো নয়, এত দর্প-অহং ঠিক নয়, পেছনের শক্তির আস্কারায় এতো লাফানো নিরাপদ নয়। আসুন, পারভেজ মোশারফকে দেখি এবং যার যার জায়গা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করি। ষ