নিজের ইলমী মারকাযের সাথে সম্পর্ক রাখার গুরুত্ব এবং আদাবে ইসলামিয়ার উপর কাজ করার প্রয়োজনীয়তা-২
[২৭ শাবান ১৪৩১ হিজরীতে
হাইআতু আবনাইল জামিয়ার (জামিয়াতুল উলূমিল ইসলামিয়া ঢাকা) মজলিসে প্রদত্ত বয়ান।]
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
কীভাবে আদব আসবে?
আদবের জন্য ‘আকল’ দরকার। আকলে সালীম ও তাজরেবার (সুস্থ বিবেকবুদ্ধি ও অভিজ্ঞতার) দরকার। সোহবতের দরকার আর ইলমের দরকার। আদব জানতে হবে কুরআন-হাদীস থেকে, সীরাতে সাহাবা থেকে, হায়াতুস সালাফ থেকে। আদাবে ইসলামিয়ার মাওয়াদ তো প্রচুর। সব মাওয়াদ তো সবার জমা করা মুশকিল হবে।
আমরা সবাই আদবের উপর মুতালাআ করব। কুরআন মাজীদ থেকে, হাদীসের কিতাব থেকে, সীরাতের কিতাবে, হায়াতুস সালাফের কিতাবে। যার কাছে যেটা থাকে। অন্তত থানভী রাহ.-এর ‘আদাবুল মুআশারাত’ তো থাকবে। ‘আদাবে জিন্দেগী’ নামে, চার-পাঁচটি রিসালাহর একটা মাজমূআ আছে। ঐগুলো তো থাকবে। হায়াতুল মুসলিমীন, তালীমুদ্দীন তো থাকবে। এগুলো থেকে পড়ি। মেশকাত আর দাওরায়ে হাদীসের কিতাবে যে কিতাবুল আদাব আছে তা পড়ি, বিশেষ করে তিরমিযী শরীফের কিতাবুল আদাব। অন্তত ‘মেশকাতে’র কিতাবুল আদাব।
হাদীস শরীফের মুতালাআর প্রতি অবহেলা
এই যে আমাদের মহা মুসীবত, হাদীসের কিতাব যখন পড়ে যাই তখন হাদীসের কিতাবের সাথে সম্পর্ক। এরপর কোনো মাদরাসায় হাদীসের কিতাবের দরস দিলে আবার হাদীসের কিতাবের সাথে সম্পর্ক; আর দরস না দিলে সম্পর্ক নেই। খালি দরসের দায়ে পড়া; পড়তে তো হবে পড়ার মহববতের জন্য, পড়ার জরুরতের জন্য। আমি মনে হয় আমার তালিবে ইলম ভাইদের সাথে আলোচনাও করেছি যে দরসী মুতালাআ হল এক নাম্বার।
তবে এই দায়িত্ব পালনের পর আমি আধাঘন্টা সময় বের করতে পারি অন্য ইযাফী মুতাআলার জন্য। ইযাফী মুতাআলার কি শেষ আছে?
ক. দায়েমী মুতালাআ
খ. মাওযূভিত্তিক মুতালাআ
গ. মৌসুমী মুতালাআ
তিনটি মুতলাআ। এটা সব তালিবে ইলমের থাকতে হয়। অল্প সময় বের করেও হোক না কেন।
মৌসুমী মুতালাআ
রমযান আসল। রমযানের সিয়ামের মাসায়েল, ক্বিয়ামূল লাইল, তারাবীহ ও তাহাজ্জুদের মাসায়েল। ইতিকাফের মাসায়েল, ঈদুল ফিতরের মাসায়েল, সাদাকাতুল ফিতরের মাসায়েল। কতগুলো মাসায়েল। এগুলো যিন্দেগীতে একবার মুতালাআ করেছি, তার উপর ইকতিফা করব কেন?
এই মওসুম এসেছে, একবার নতুন করে বেহেশতী যেওরে মাসআলাগুলো দেখে নিই! হাদীসের কিতাব আমার কাছে যেটা আছে সেখান থেকে একবার পুরো কিতাবুস সওম পড়ি। ইলম তাজা হবে। এভাবে যে বিষয়ের মৌসুম ঐ বিষয়ের উপর আমি মুতালাআ করি। মুতালাআ তাজা করি।
বিষয়ভিত্তিক মুতালাআ
বিষয়ভিত্তিক মুতাআলা তো এক বিশাল সমুদ্র। তাওহীদের উপর মুতালাআ দরকার। সুন্নত-বিদআতের উপর মুতালাআ দরকার। এই যে আদাবুল মুআশারা, ছফায়ে মুআমালা-এর একেক শাখা কত লম্বা। কিন্তু লম্বা হলেও এগুলোর উপর আকাবিরদের রিসালা আছে। আমি উস্তাযের সাথে মশওয়ারা করে নির্বাচিত দু’তিনটি রিসালাহ ইনতিখাব করি। শুধু সেটাই মুতালাআ করি।
সামর্থ্য অনুযাযী গড়ে তুলি কুতুবখানা
প্রত্যেক তালিবুল ইলমের কাছে একটি কুতুবখানা থাকা লাগবে। তোমাদের
উস্তাযদের কাছ থেকে শিখ। দেখ, তাঁদের প্রত্যেকের কাছে নির্বাচিত কিছু কিছু কিতাব আছে এবং যা আছে তার চেয়ে বেশি মুতালাআ। তালিবে ইলমের যামানা থেকে, মালিবাগে থাকতে। দেওবন্দের যামানায়, দেওবন্দ থেকে আসার পর এবং এখনও।
ইলমকে হালের সাথে মিলিয়ে হালনাগাদ রাখতে হবে। কী যেন বলে আপডেট?, হালতের মুওয়াফেক রাখতে হয়। আপনার মুতালাআ হল পঞ্চাশ বছর আগের। যামানা এখন পঞ্চাশ বছর এগিয়ে গেছে-এটা হবে নাকি? মুতালাআ সবসময় জারি রাখতে হয়, বা-খবর থাকতে হয়। সেটার জন্য এক উপায় হল, নিজের কাছেও কুতুবখানা থাকতে হয়। বলবে, আমার এত স্বচ্ছলতা আছে নাকি? ইস্তেগনা ঠিক রেখে ফকীর মওলবীদেরও বড় বড় কুতুবখানা ছিল।
হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুর রশীদ নুমানী রাহ. এর কুতুবখানা
নূমানী রাহ. বয়স বেশি হয়ে যাওয়ার কারণে যখন বিন্নুরী টাউন থেকে বিদায় নিয়ে চলে যান তখনও তাঁর বেতন ১৯০০ রুপির মত। এটা ছিল ১৪১২ হিজরী, ১৯৯২ এর কথা। তাছাড়া তিনি আহলে খায়রের মাঝে পরিচিত ছিলেন না যে তাঁর কাছে হাদিয়া-তোহফা আসবে। ডাক্তার আমজাদ নামে একজন সেখানে ছিলেন। ঐ বেচারা কীভাবে খবর পেয়েছিল। ঐ ডাক্তারের ভাগ্নি ও ভাগ্নিজামাই হুযূরের কাছে পড়তে আসত। তাদের ‘মাদরাসা আয়েশা’ তে হুযূরকে সবক পড়ানোর অনুরোধ করেন। সেই ডাক্তার আমজাদের ভাগ্নি নূমানী সাহেবের কাছে কিতাবুল আছার, মুয়াত্তা মুহাম্মাদ, কিতাবুল হুজ্জাহ আলা আহলিল মাদীনাসহ দাওরার সব কিতাব পড়েছে। দৈনিক আসত। সে আর তার স্বামী আসত। পর্দা রক্ষা করে পড়ত। আর ‘মতন’ স্বামীর চেয়ে ভাল পড়ত স্ত্রী। ওরা কিভাবে হুযূরের খোঁজ পাওয়ার পর উমরা করিয়েছে, হয়ত খোঁজ-খবরও রেখেছে। এছাড়া পুরো জীবন অভাবেই গিয়েছে। একজন তাঁকে শিখিয়েছেন হিযবুল বাহর-এর আমল। হুযূর আমাকে শিখিয়েছেন।
হিযবুল বাহরের আমলের পর তাঁর ভাষায়-‘কাভী কাভী তঙ্গী হো জাতি হ্যায়, লেকিন ও ফাক্বাহ ফের নেহী আয়া, এতনা ফাক্বাহ ফের নেহী আয়া।’
এই ছিল হালত। কিন্তু তাঁর ব্যক্তিগত কুতুবখানা অনেক প্রতিষ্ঠানের কুতুবখানা থেকে বড় ছিল। কলেবরে যে রকম বড়, দুষ্প্রাপ্যতার (নাওয়াদের-এর) দিক থেকে তো কথাই নেই।
কীভাবে হয়েছে? হুযুরের কাছে গেলে আমাকে বলতেন, ‘‘ক্যায়সে আয়া, বাস পে ইয়া প্যায়দাল আয়ে?’’
কখনো পায়দল যেতাম। তো যেদিন পায়দল যেতাম সেদিন খুশীতে বলতাম, ‘‘জ্বী হযরত! প্যায়দাল আয়া’’। শুনে বলতেন, ‘‘বাহুত আচ্ছা কিয়া’’। যেদিন বাসে যেতাম সেদিন জিজ্ঞাসা করতেন, ‘‘কেতনা লেতা হ্যায় বাস পে?’’
বলতাম, ‘‘হযরত! তীস প্যায়সা’’।
হযরত বলতেন, ‘‘তীস প্যায়সা ভী তালিবে ইলম কে লিয়ে কম নেহীঁ হামারে তীস প্যায়সা হোতে তো জমা কর লেতে অ্যাওর দু চার প্যায়সে হো জাতে তো য়েক রেসালা খরিদ লেতে।’’ এভাবে কিতাব জমা হয়েছে।
বি-বাড়িয়া টান বাজার মসজিদের খতীব দারুল উলূম দেওবন্দ থাকাকালে মাতবাখ থেকে দুই রুটি পেতেন। তিনি এক রুটি খেতেন, আরেক রুটি নিয়ে যেত যারা নিয়ে যায়। বিনিময়ে এক পয়সা দিত। তিনি এভাবে পয়সা জমা করে রাসায়েল কিনেছেন। এখনও যিন্দা আছেন।
এরকম ইস্তিগনার সাথে। ইস্তিগনার প্রসঙ্গ কেন আনলাম? একদিন বাংলাবাজার বা চকবাজার গিয়েছি কিতাব কিনতে। একজন লোক খোঁজ করছে ‘ইসলাহী খুতুবাত’ বা অন্য কোনো কিতাব। কি জন্য খোঁজ করেছে সে? নিজের পড়ার জন্য না বোঝা-ই যায়। বলল, আমাদের ইমাম সাহেব বলেছেন, তাঁর বয়ানের জন্য এই কিতাবটা দরকার। তার বলার আন্দাযে, যেভাবে বলছে তাতে বোঝা যাচ্ছে যে, সন্তুষ্টচিত্তে (শরহে ছদর) এর সাথে দিচ্ছে না। এবং তার (ইমাম) বলার আন্দাযও হয়ত ঠিক হয়নি।
এভাবে নয়। আমার কুতুবখানা এভাবে সংগ্রহ হবে না। কিতাব সংগ্রহ হবে নূ’মানী রাহ.-এর মত, টান বাজার মসজিদের খতীব সাহেবের মত। কুতুবখানা সংগ্রহ হবে আমীন সফদারের মত।
মাওলানা আমীন সফদার রাহ.
মাওলানা আমীন সফদার রাহ. তো আরো ফকীর ছিলেন। কিন্তু তাঁর কুতুবখানায় ছিল আনদারুন নাওয়াদির, দুর্লভ বিভিন্ন রিসালা ও কিতাব। আমাদের মত মাসাদেরের ইন্তেযামের তো প্রশ্নই আসে না। ও-রকম তো ছিলই না। তাঁরা কয়েক কিতাবের কাজ হয়ে যায় এমন কিতাব সংগ্রহ করতেন। আদ্দুররুল মানছূর, জামিউল উছূল, কানযুল উম্মাল এরকম কিতাব সংগ্রহ করতেন।
একবার তাঁর আদ্দুররুল মানছূর-এর দরকার হলো। রাতে তাহাজ্জুদ তো পড়তেন-ই। ঘরের সামনে ছোট্ট বাগান আছে, সেখানে নামায পড়ে দুআ’ করলেন-আল্লাহ, আমার কিতাবের
ইন্তেযাম করে দাও।
এমন কান্নাকাটি করলেন, কাঁদতে কাঁদতে ঘুম এসে গেল। স্বপ্নে দেখেন, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাশরীফ এনেছেন। তাঁর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘‘য়ে ভী মিল জায়েগী, আগে কিতাব কে লিয়ে তুমহে তাকলীফ না হোগী’’ যে কিতাব চেয়েছো সেটাও তুমি পেয়ে যাবে। সামনে আর কিতাবের জন্য তোমার কষ্ট হবে না। পরের দিনই আদ্দুররুল মানছূর-এর ইন্তেযাম হয়ে গেছে। এরপর তো আমরা দেখতাম, বিন্নুরী টাউনে যখন তিনি ছিলেন; সৌদী থেকে কেউ আসল, অমুক জায়গা থেকে কেউ আসলম্ন কয়েকটা কিতাব নিয়ে আসল-হুযুর আপনার জন্য এনেছি। এভাবে ইসতিগনার সাথে চললেও কিন্তু সম্ভব। অর্থস্বল্পতা সত্ত্বেও যদি আগ্রহ থাকে আর আল্লাহর দরবারে দোয়া করতে থাকি, রোনাযারী করতে থাকি তাহলে কুতুবখানা হতে পারে।
কেমন হবে কুতুবখানা
মাওলানা আবু তাহের মিসবাহ’র ভাষায় কুতুবখানা শিশু কুতুবখানা হোক, কিন্তু পূর্ণাঙ্গ হতে হবে। শিশু ছোট্ট কিন্তু সব আছেপ্তপ্ত নাক, চোখ, কান-সবই তো আছে। আমার শিশু কুতুবখানা আস্তে আস্তে একদিন বড় হবে। প্রথম থেকে কিতাবের পরিমাণ বাড়ানোর চেয়ে চেষ্টা করব পূর্ণাঙ্গ করার। জরুরি যত বিষয় আছে সব বিষয়ে তুলনামূলক গুরুত্বপূর্ণ রিসালাহ নির্বাচন করে একটি করে কিতাব বা রিসালাহ সংগ্রহ করব।
তাফসীরের আর কোনো কিতাব নেই, তো অন্তত তাফসীরে উসমানী আর তাফসীরে ইবনে কাসীর থাকুক। আরেকটু সচ্ছলতা এলে তখন মাআরিফুল কুরআন সংগ্রহ করি। কিন্তু মাআরিফুল কুরআন-এর আগে যেহেতু তাফসীরে উসমানী আছে তাহলে এখন মাআরিফুল হাদীস বা রিয়াযুস সালেহীন সংগ্রহ করি। মাদরাসায় পড়েছি, মাদরাসায় কিতাব থেকে গেছে। আমার কিতাব কোথায়? দায়েমী মুতালাআর জন্য কিছু কিতাব তো সবসময় থাকতে হবে আমার কাছে।
দায়েমী মুতালাআ
এটা হল ঈমান হেফাযতের জন্য, ঈমান তাজা রাখার জন্য। এই মুতালাআ আপনি করুন কুরআন মজীদ থেকে, দৈনিক দশ মিনিটই হোক। কুরআন মজীদ মুতালাআ করি, সীরাত এবং হাদীস মুতালাআ করি দশ মিনিট। দশ মিনিট মুতালাআ করি হায়াতুস সাহাবা এবং হায়াতুস সালাফ।
কুরাআন মজীদের সাথে সরাসরি সম্পর্ক আমার হতে হবে। কিন্তু সরাসরি সম্পর্ক আমি যতই কায়েম করি আমার সালাফ সেখান থেকে যা নিতে পেরেছেন আমার নযর, বাছীরাত ঐ পর্যন্ত পৌঁছবে না। সে জন্য তাঁদের সাওয়ানেহে হায়াত, মালফুযাত ও মাকতূবাত মুতালাআ করা মানে এক পর্যায়ের কুরআন-সুন্নাহর তালীমাত মুতালাআ করা। তবে এর অর্থ এই নয় যে, কুরআন-সুন্নাহ সরাসরি মুতালাআ করব না। সরাসরি মুতাআলা তো অবশ্যই করতে হবে। এটা আমাদের বড় দুর্বলতা-আমরা সরাসরি কুরআন-সুন্নাহর মুতালাআ কম করি। কুরআনের সাথে তেলাওয়াতের সম্পর্কের পাশাপাশি ‘মুতালাআয়ে কুরআনের’ সম্পর্ক কায়েম করার চেষ্টা করব। সুন্নাহ মুতালাআর চেষ্টা করব। তাহলে ইনশাআল্লাহ মুতালাআর মাধ্যমে আমার ঈমানও তাজা থাকবে, কাজও হবে।
কিতাব কীভাবে তৈরি করব?
কথা তো দূরে চলে গেল। বলছিলাম, আমরা আল-আদাবুল ইসলামিয়ার উপর কিতাব তৈরি করব। এটার জন্য খুত্তা বানাতে হবে। আল-আদাবুল ইসলামিয়ার কয়টা বাব, প্রত্যেক বাবে কয়টা ফসল, কী কী শিরোনাম আসবে। খুত্তা বানানোর জন্যও তো দু ধরনের মুতালাআ লাগবে- খুসুসী মুতালাআ, উমুমী মুতালাআ। খুসূসী মুতালাআর জন্য আপাতত যেহেনে এসেছে ইবনে মুফলিহ রাহ.-এর কিতাব আল-আদাবুশ শরইয়্যাহ। এটা একটু বড় কিতাব। এর চেয়ে ছোট এক জিলদের কিতাব আছে আবুল হাসান মাওয়ারদী রাহ.-এর আদাবুদ দুনইয়া ওয়াদ দ্বীন। আর ইমাম বুখারী রাহ.-এর আল-আদাবুল মুফরাদ। আর তাছাড়া হাদীসের কিতাবের কিতাবুল আদাব। আবার আল-আদাবুল ইসলামিয়ার অনেক মাসআলা কিতাবুল আদাবের শিরোনাম ছাড়াও পাওয়া যায়। যুহদ, আদাবে যাহেরার পাশাপাশি এতে অন্যান্য আদাবে বাতেনা আসবে। যদিও সেগুলোর তাফসীল কম হবে। আদাবে যাহেরার তাফসীলটা বেশি হবে। এই জন্য হাদীসের কিতাবের কিতাবুল আদাব দেখব। বিশেষভাবে তিরমিযী শরীফের কিতাবুল আদাব দেখব। আর ইমাম বুখারী রাহ.-এর আলআদাবুল মুফরাদ সংগ্রহ করব। রাসায়িলের মধ্যে আছে থানভী রাহ. এবং অন্যান্য বুযুর্গদের রিসালাগুলো।
মিন আদাবিল ইসলাম
শায়খ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রাহ.-এর রিসালাহ আছে মিন আদাবিল ইসলাম। অনেক কিছু আছে এই কিতাবে। শায়খ তো কথা শুরুই করেছেন আবু দাউদ শরীফের হাদীস দিয়ে। (সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ৪০৮৬) রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (সিয়াক ও সাবাক থেকে বোঝা যায়) সম্ভবত কোনো এক সফর থেকে ফেরার সময় সাথীদেরকে বলেছেন-
إنكم قادمون على إخوانكم فأصلحوا رحالكم وأصلحوا لباسكم حتى تكونوا كأنكم شامة في الناس
এই হাদীসে ফিকির করলে কত কিছু বের হয়। সফর থেকে ফেরার সময় সাধারণত মানুষের মানসিকতা থাকে, আগে ঘরে যাই, তারপর গোসল করব, কাপড় পাল্টাব, সব করব। কিন্তু রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলছেন, তুমি মদীনায় দাখেল হওয়ার আগে এখানে মনযিল করেছ, এখন এই মনযিলেই সব ঠিকঠাক করে নাও। কাপড় পরিবর্তন কর বা ধুয়ে পরিষ্কার কর। সফরের কারণে উটের পিঠের হাওদাজে সামানাগুলো যে বিক্ষিপ্ত হয়ে গেছে সেগুলো ঠিক কর, গোছগাছ কর। তখন দেখা যাবে, সবাই তাকালে ভাল লাগবে। নেক মানযার দেখলে, ভাল দৃশ্য দেখলে ভাল লাগে।
شامة في الناس কিসের জন্য? রিয়ার জন্য নাকি? ‘‘ইরাহাতুল খালক’’-এর জন্য। এটা দ্বিতীয় মাকসাদ। প্রথম মাকসাদ হল ইসলামের সহীহ তরজুমানী করা। আমি মিন আবনাইল ইসলাম, দেখ ইসলামের তারীফ, ইসলাম এমন মাযহার পছন্দ করে।
আমরা সবাই ইসলামের তারজুমান
আমরা আসলে সবাই তারজুমানী করছি ইসলামের। আমার ঘরে, ঘরের বাইরে। আমার মাদরাসা, আমার মসজিদ- আমি যেখানে আছি- অফিস-আদালতে আছি, আসলে মুসলমান সবাই তো ইসলামের তারজুমানী করে। বিশেষভাবে মানুষ যাদেরকে উলূমে ইসলাম ও ইলমে দ্বীনের ধারক-বাহক মনে করে তারা তো অবশ্যই তারজুমান। খালি যবানের বয়ান তারজুমান নাকি? আমার সবকিছুই তো তারজুমান। আমার আখলাক, আমার আদাব, আমার মাযহার, আমার আচার-আচরণ, লেবাস-পোশাক, সবকিছুই তারজুমান। আমার দ্বারা যেন দ্বীনের সহীহ তারজুমানী হয়।
আদবের আরেকটি কিতাব
মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবার কিতাবুল আদবও আমি বলব, যাদের কাছে আছে। সবার কাছে এক কিতাব থাকতে হবে- তা জরুরি নয়। কিন্তু এক-দুইটা সবার কাছে থাকতে হবে। যেমন ইমাম বুখারী রাহ.-এর আলআদাবুল মুফরাদ। আকারে ছোট। তাসবীর করিয়ে নিতে পারি, আর এমনিতেও পাওয়া যায় এখন। আবুল হাসান মাওয়ারদী রাহ.-এর কিতাব আদাবুদ দুনইয়া ওয়াদ দ্বীন। এখন সেটাও পাওয়া যায়। আলআদাবুশ শরইয়্যাহ একটু বড়। আমরা চার-পাঁচজন মিলে তার ইন্তেযাম করতে পারি। পাশাপাশি দাওরায়ে হাদীসের কিতাব থেকে কিতাবুল আদাব খুলি। এ সকল কিতাব সামনে রেখে সাথে যদি বর্তমান নতুন লেখকদের কোন রচনা পাওয়া যায়, এগুলোকে সামনে রেখে আমি একটা খুত্তা তৈরি করব। এভাবে ফিকির করে করে পুরো কাঠামোটা তৈরি করে নিতে হবে।
শিরোনামগুলো প্রথমে বিক্ষিপ্তভাবে লিখে ফেলি, পরে তারতীব দিই। একাধিক খুত্তা তৈরি হতে পারে, কোন সমস্যা নেই।
মুতালাআ কিন্তু সবাই করবে। মুতালাআর হাসিল নোট করবে। যা নোট করবে তার এক নোসখা নিজের কাছে রাখবে আর অপর নোসখা এখানে জমা দিবে।
আর আজ কালের মাঝে আমরা সবাই রোজনামচায় লেখার চেষ্টা করব এই মজলিসে কোন হুযুর কী বললেন। এখান থেকে উঠে গেলে কতটুকু থাকে আল্লাহই জানেন। আল্লাহ করুন, পুরোটাই আসুক। এভাবে নোট করব। আর এখানে তাসজীলের ব্যবস্থা থাকা দরকার। থাকলে এ বয়ানগুলো তাসজীল থেকে নকল করলেই বড় এক যাখীরা তৈরি হবে ইনশাআল্লাহ।
সামনে আবনাউল জামিআর কার্যক্রম যখন আরও প্রশস্ত হবে তখন শুরুর যুগের হেদায়েত, শুরুর যুগের ইতিহাস একটি নমুনা হবে সামনের আবনাউল জামিয়ার জন্য। সে নমুনা আমরা ফিকির এবং আমলের মধ্যে পেশ করি। ষ
[বয়ানটি মুসাযযিলা থেকে পত্রস্থ করেছেন মুহাম্মাদ হুজ্জাতুল্লাহ।
নযরে ছানীর পর তা প্রকাশিত হলো।]