হারামাইনের মিম্বর থেকে দুর্নীতির পরিণাম এবং প্রতিকারের উপায়
[মসজিদ আলহারাম, মক্কা মুকাররমা]
২২.০২.১৪৩৪ হি., ০৪.০১.২০১৩ ঈ.
হামদ ও সালাতের পর, সৎ মুমিন বান্দা যখন কোনো পদে অধিষ্ঠিত হবেন তখন তিনি হবেন দেশ ও মানুষের সহায়-সম্পদের একজন নিবেদিত প্রহরী, যিনি মানুষের অধিকার রক্ষা করবেন, ন্যায়ের প্রসার ঘটাবেন এবং একনিষ্ঠভাবে কাজ করবেন, আর জাতির অর্জনকে সংরক্ষণ করবেন। নিজে সততা বজায় রাখবেন, অন্যকে সংশোধন করবেন, নৈতিকতার আদেশ করবেন দুর্নীতিকে দমন করবেন।
ইসলাম ‘তত্ত্বাবধান’কে এমন এক দায়িত্ব সাব্যস্ত করেছে, যা ব্যক্তির উপরও বর্তায়, সমাজের উপরও বর্তায় । আর এটাই হল ‘ইহতিসাব’ তথা কল্যাণের আশায় কিছু করা। ‘ইহতিসাব’ ব্যাপক অর্থে এমন এক নিয়ন্ত্রণ ও পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা, যা ব্যক্তি ও সমাজ, প্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্র সবকিছুকে দুর্নীতি ও অবক্ষয় থেকে হেফাজত করে।
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন:
الَّذِينَ إِنْ مَكَّنَّاهُمْ فِي الْأَرْضِ أَقَامُوا الصَّلَاةَ وَآَتَوُا الزَّكَاةَ وَأَمَرُوْا بِالْمَعْرُوفِ وَنَهَوْا عَنِ الْمُنْكَرِ وَلِلَّهِ عَاقِبَةُ الْأُمُورِ
অর্থ : তারা এমন যাদেরকে আমি যমীনে ক্ষমতা দান করলে তারা সালাত কায়েম করবে, যাকাত দেবে এবং সৎকাজের আদেশ দেবে ও অসৎকাজ থেকে নিষেধ করবে; আর সব কাজের পরিণাম আল্লাহরই অধিকারে। -সূরা হজ্ব : ৪১
রাসূলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন : তোমাদের কেউ যখন কোন অন্যায় দেখে সে যেন তা হাত দিয়ে প্রতিরোধ করে, যদি সক্ষম না হয় তাহলে মুখে তা বাধা দেবে, যদি তাতেও সক্ষম না হয় তাহলে অন্তর দিয়ে তা ঘৃণা করবে, এটাই ঈমানের দুর্বলতম স্তর। -জামে তিরমিযী, হাদীস ২১৭২ মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১১৪৬০
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন :
وَالْمُؤْمِنُونَ وَالْمُؤْمِنَاتُ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ يَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوْفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَيُقِيمُوْنَ الصَّلَاةَ وَيُؤْتُوْنَ الزَّكَاةَ وَيُطِيعُوْنَ اللَّهَ وَرَسُوْلَهُ أُولَئِكَ سَيَرْحَمُهُمُ اللَّهُ إِنَّ اللَّهَ عَزِيزٌ حَكِيمٌ
অর্থ : আর মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীরা একে অপরের বন্ধু, তারা ভাল কাজের আদেশ দেয় আর অন্যায় কাজ থেকে নিষেধ করে, আর তারা সালাত কায়েম করে, যাকাত প্রদান করে এবং আল্লাহ ও তার রাসূলের আনুগত্য করে। এদেরকে আল্লাহ শীঘ্রই দয়া করবেন, নিশ্চয় আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। -সূরা তাওবা : ৭১
রাসূলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন : আল্লাহ বিশেষ কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর আমলের কারণে সকলকে শাস্তি দেন না। যখন অন্যায় প্রকাশ্যে ঘটতে থাকে আর তারা সেটাকে প্রতিহত করতে সক্ষম হওয়া সত্ত্বেও প্রতিরোধ না করে তখন আল্লাহ বিশেষ সাধারণ- সবাইকে আযাব দেন। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৭৭২০
হে মুসলিম সমাজ! ‘ইহতিসাব’ হল নৈতিক, ধর্মীয়, রাজনৈতিক, সামাজিক, প্রাতিষ্ঠানিক ও অর্থনৈতিক ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণমূলক এক দায়িত্ববোধ। উলামায়ে কেরাম বলেন : ‘ইহতিসাব’ হচ্ছে, ন্যায়-নিষ্ঠা প্রতিষ্ঠা, দুর্নীতি ও অবক্ষয় রোধ এবং কল্যাণ ও শিষ্টাচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সৎ কাজের আদেশ করা, যখন তা ছেড়ে দেয়া হয়, অসৎ কাজে নিষেধ করা, যখন সেই মন্দ কাজ প্রকাশ পায়।
প্রিয় ভাইগণ! ব্যক্তিগত ও সামাজিক কর্মকান্ডের যে কোন ক্ষেত্রে দুর্নীতির আশ্রয় নেয়া একটি বক্র ও ভ্রান্ত পদ্ধতি। দুর্নীতিকারী বহু ধরনের অপকর্ম ও নেতিবাচক কাজে লিপ্ত হয়, যাতে সে অবৈধ অর্থ লাভ করতে পারে, কোন পদের অযোগ্য হয়েও তার অধিকারী হতে পারে, ফলে কালো টাকার রাস্তা উন্মুক্ত হয় এবং সাংগঠনিক দক্ষতা, প্রতিষ্ঠানের ভিত ও উৎপাদন দুর্বল হয়ে পড়ে।
দুর্নীতি একটি ভুল পথ, যা বাহ্যত চাকচিক্যময় হলেও তার আনন্দ অস্থায়ী, সারাক্ষণ থাকে ভয়। এর কারণে ধর্ম, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ, সংস্কৃতি ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সর্বত্রই অবক্ষয় ছড়িয়ে পড়ে। দুর্নীতি এমনই সুবিস্তৃত মহামারি, কোনভাবেই যাকে আয়ত্তে আনা যায় না। দুর্নীতির ফলে সমাজে ব্যাপক শ্রেণীবৈষম্যেরও সৃষ্টি হয়।
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন :
ظَهَرَ الْفَسَادُ فِي الْبَرِّ وَالْبَحْرِ بِمَا كَسَبَتْ أَيْدِي النَّاسِ لِيُذِيقَهُمْ بَعْضَ الَّذِيْ عَمِلُوْا لَعَلَّهُمْ يَرْجِعُوْنَ
অর্থ : মানুষের কৃতকর্মের দরুণ জলে স্থলে ফাসাদ প্রকাশ পায়। যার ফলে আল্লাহ তাদের কতিপয় কৃতকর্মের স্বাদ তাদেরকে আস্বাদন করান, যাতে তারা ফিরে আসে। -সূরা রুম : ৪১
সাধারণ বা বিশেষ যে কোন কর্তব্যেই নির্ধারিত ও নিয়মিত পথ ছেড়ে ভিন্ন বা অনিয়মতান্ত্রিক পথ অবলম্বন করাই হচ্ছে দুর্নীতি। যা অন্যায় ও বিশ্বাসঘাতকতাও বটে। দুর্নীতির ফলে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন কর্মকান্ডেই যোগ্য ও উপযুক্তদের অবমূল্যায়ন হয়। জনসেবার মান কমে যায়, সহজ কাজ কঠিন হয়ে পড়ে ও কাজ উদ্ধার করা কষ্টকর হয়। উৎপাদন ব্যাহত হয়, মানুষের সেবা ও কল্যাণ রহিত হয়, কর্তব্য ও সময়ের প্রতি গুরুত্ব হালকা হয়ে যায়। সর্বোপরি দুর্নীতির কারণে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও ইনসাফপূর্ণ বিচার ব্যবস্থাও ভেঙ্গে পড়ে।
জনসাধারণের মৌলিক অধিকার তথা শিক্ষা, চিকিৎসা, খাবার, নিরাপত্তা ও জনগণের সেবা গ্রহণের সুযোগ ইত্যাদি বিষয় ঝুঁকির মুখে পড়লেও দুর্নীতির কারণে সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করা হয় না। দুর্নীতি সত্যবাদিতা, বিশ্বস্ততা, ন্যায়পরায়ণতা ও সুযোগ-সুবিধার সুষম বণ্টনের উপর প্রতিষ্ঠিত চারিত্রিক মূল্যবোধের স্খলন ঘটায়। দুর্নীতি নেতিবাচক মনোভাব, কর্তব্যে অবহেলা ও অবিচার ছড়িয়ে দেয়। যার ফলে সমাজে পরস্পরে হিংসা-বিদ্বেষ, মানসিক চাপ ও চরম হতাশা বিরাজ করে। দুর্নীতির ফলে ব্যক্তিস্বার্থই সর্বত্র প্রাধান্য পায় এবং দেশ জাতি ও কল্যাণের প্রতি যথার্থ আন্তরিকতা অনুপস্থিত থাকে। উপরন্তু নিজ দল, গোত্র ও পক্ষকেই একমাত্র বিবেচনা করা-এই নোংরা স্বজনপ্রীতিকে উসকে দেয়। ফলে তা নৈতিক বন্ধন ও সামাজিক মূল্যবোধকে হুমকিতে ফেলে দেয়।
প্রিয় ভাইগণ! দুর্নীতির বহু রূপ, বহু আকার ও নানা পদ্ধতি রয়েছে। যেমন-অর্থ আত্মসাৎ, ঘুষ, ক্ষমতা ও পদের অপব্যবহার, গোপন তথ্য পাচার বা যে তথ্য প্রচার করা বাঞ্ছনীয় সেটা গোপন রাখা, বিভিন্ন চুক্তি, রেকর্ড ও রায়ের ক্ষেত্রে স্বেচ্ছাচারিতা, কর্তব্য ও সময়ের মূল্যায়ণ না করা, এমনিভাবে আইনশৃঙ্খলার যথাযথ বাস্তবায়নে টালবাহানা করা বা বেপরোয়া হওয়া, রাষ্ট্রীয় সম্পদ অপচয় করা, অপরিকল্পিত প্রকল্প বাস্তবায়ন করা ইত্যাদি। এভাবে বহু ক্ষেত্রেই দুর্নীতি হয়ে থাকে যা গুনে শেষ করা দুষ্কর।
হে মুসলমানগণ! দুর্নীতি এক ভয়াবহ ব্যাধি। কঠোর হাতে একে দমন করা ছাড়া এর কোনো প্রতিকার নেই। দুর্নীতি থামাতে হবে এবং সকল ক্ষেত্রে সংশোধন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। ইনশাআল্লাহ, এটাই হল যাবতীয় কল্যাণ ও সাফল্যের মূল চাবি কাঠি। দুর্নীতি রোধ করলে শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠিত হবে এবং ন্যায়পরায়ণতা বিস্তার লাভ করবে।
দুর্নীতি দমন ও প্রতিরোধ কোন নির্দিষ্ট পক্ষ বা বিশেষ ব্যক্তির কাজ নয়। বরং এটা সকলের দায়িত্ব, আন্তরিকভাবে দায়িত্ব নিয়ে সকলকে এগিয়ে আসতে হবে।
বিচারের ক্ষেত্রে সততা ও ইনসাফ বজায় রাখা রাষ্ট্রের ভাব-মর্যাদাকে রক্ষা করে, দেশ ও জনগণের মধ্যকার সম্পর্ককে সুসংহত করে এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদ ও আইনশৃঙ্খলার প্রতি আস্থা বিনির্মাণ করে। রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠান, অর্থনীতি ও নীতিগত বিভিন্ন অবস্থানে সততা অবলম্বন দুর্নীতি দমনে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। সততার মাপকাঠি হচ্ছে ধার্মিকতা, সত্যবাদিতা, ন্যায়বিচার, স্পষ্টতা ও স্বচ্ছতা। যেখানে সততা থাকবে সেখানে সঠিক ও ভাল কাজের প্রতিযোগিতা হবে এবং শ্রেষ্ঠ থেকে শ্রেষ্ঠতর ফলাফল উপস্থাপনের মর্যাদাকর লড়াই হবে।
হে মুমিনগণ! এজন্য করণীয় হল, পেশাজীবীর দায়িত্ব ও কাজের সীমা নির্দিষ্ট করে দেওয়া, পরামর্শমূলক নির্দেশিকা প্রণয়ন করা, সমন্বিত সচেতনতা তৈরী করা, জনগণকে তাদের প্রাপ্য অধিকার সম্পর্কে অবগত করা এবং দুর্নীতিবাজদের মুখোশ উন্মোচনে সহায়তার জন্য সাধারণকে উৎসাহিত করা।
এছাড়াও পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থাকে উন্নত ও মজবুত করা এবং এসকল উপকরণের অর্থবহ ব্যবহার নিশ্চিত করা। প্রাতিষ্ঠানিক কাজের পদ্ধতি সম্প্রসারিত করা এবং প্রতিষ্ঠান, শৃঙ্খলা ও অর্থনীতি সব বিষয়ে অডিটের ব্যবস্থা জোরালো করা।
সেই সাথে দুর্নীতি দমনে কঠোর আইন প্রণয়ন করে তা ইনসাফের সাথে কঠোর হস্তে বাস্তবায়ন করা। চাটুকারিতা থেকে দূরে থাকা, সুযোগ-সুবিধা প্রদানে সমতা, যোগ্যতা ও উপযুক্ততাই বিচারের মাপকাঠি- এই নীতি অবলম্বন করা।
কুরআনুল কারীমে ইরশাদ হয়েছে :
إِنَّ خَيْرَ مَنِ اسْتَأْجَرْتَ الْقَوِيُّ الْأَمِينُ
অর্থ : নিশ্চয় আপনি যাদেরকে মজুর নিযুক্ত করবেন তাদের মধ্যে সে উত্তম, যে শক্তিশালী বিশ্বস্ত।
-সূরা কাসাস : ২৬
সকলকেই যা করতে হবে তা হচ্ছে-কর্তব্যে একাগ্রতা, সময়ানুবর্তিতা, সঠিক পরামর্শ প্রদান এবং ঈমানের সাথে সাথে নৈতিকতা অবলম্বন করা যথা-সত্য বলা, আমানত রক্ষা করা, কর্তব্যবোধ, একনিষ্ঠ হওয়া, সুধারণা পোষণ করা, আল্লাহর উপর নির্ভর করা, জনকল্যাণকে গুরুত্ব দেওয়া, সকলের প্রতি আস্থাশীল হওয়া।
একই সাথে স্বাধীন মতামত, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার পরিবেশ বজায় রাখা।
আল্লাহ তাআলা সকলকে হেফাজত করুন।
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন:
وَابْتَغِ فِيمَا آَتَاكَ اللَّهُ الدَّارَ الْآَخِرَةَ وَلَا تَنْسَ نَصِيبَكَ مِنَ الدُّنْيَا وَأَحْسِنْ كَمَا أَحْسَنَ اللَّهُ إِلَيْكَ وَلَا تَبْغِ الْفَسَادَ فِي الْأَرْضِ إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ الْمُفْسِدِينَ
অর্থ : আর আল্লাহ তোমাকে যা দান করেছেন তাতে তুমি আখিরাতের নিবাস অনুসন্ধান কর। তবে তুমি দুনিয়া থেকে তোমার অংশ ভুলে যেয়ো না। তোমার প্রতি আল্লাহ যেরূপ অনুগ্রহ করেছেন তুমিও সেরূপ অনুগ্রহ কর। আর যমীনে ফাসাদ করতে চেয়ো না। নিশ্চয় আল্লাহ ফাসাদকারীদের ভালবাসেন না। -সূরা কাসাস : ৭৭
[বিন্যাস ও ভাষান্তর শাহাদাত হুসাইন জামিআ ইসলামিয়া মদীনা মুনাওয়ারাহ]