অমর বালাকোট-সংগ্রামী মিঠানালার সুফী নূর মুহাম্মদ নিজামপুরী রাহ.
ফেনী ট্রাংকরোড থেকে মীরসরাইয়ের মিঠাছড়া। ছোট-খাটো যানজটসহ দু’ঘণ্টার পথ। ডানদিকের বাঁক ধরে একটু এগিয়ে গেলে হাতের ডানে দেয়ালতোরণ। উপরে লেখা : গাজীয়ে বালাকোট সুফী নূর মুহাম্মদ নিজামপুরী রাহ.। চালকের আসনে বসা তোয়াহা ভাই তোরণের নিচ দিয়ে ঢালু ও সরুপথে গাড়ি নামিয়ে দিলেন। সাথী মাওলানা উমায়ের কোববাদী পরিচিতজনদের ফোন করে করে গন্তব্যপথ সম্পর্কে ধারণা নিতে থাকলেন। সফরে সওয়ারির আয়োজন থেকে নিয়ে সার্বিক সহযোগিতার দায়িত্ব নিজ থেকে কাঁধে তুলে নিয়েছেন এই তরুণ আলেম। সারিবদ্ধ মেহগনির মাঝে পাকাপথ। নিঝুম-নীরব গ্রামীণ পরিবেশ। থেমে থেমে জিজ্ঞাসা, কয়েকবার। পাঁচ কিলোমিটার পথ প্রায় আধাঘণ্টায়। এরপরই উপস্থিত, গন্তব্যে। মিঠানালা গ্রাম, আগের নাম মলিয়াশ। সেই মিঠানালার একপাশে সুফী-বিপ্লবী, সাধক-যোদ্ধা নূর মুহাম্মদ নিজামপুরীর মাযার-মসজিদ। সামনে মাঝারি একটি পুকুর।
আমরা নেমে পড়লাম। অল্প সময়ের মধ্যেই দেখা হলো জয়নুল আবেদীন (মৌলভী হক) আর মসজিদ-মাযার কমপ্লেক্সের বর্তমান মোতাওয়াল্লী কামরুলুদ্দীনের সঙ্গে। বার বার জিজ্ঞাসার পরও তারা তাদের নাম এভাবেই বলেছেন। দু’জনই পৌঢ়। এঁরা অবিবাহিত সুফী নিজামপুরীর জ্ঞাতী বোন আমেনা খাতুনের চতুর্থ প্রজন্মের বংশধর। একজন তাঁর ছেলের দিক থেকে, আরেকজন মেয়ের দিক থেকে। পাশেই তাদের বাড়ি। তাদের সঙ্গে কথা হলো। তারা জানেন এবং জানান, সুফী নিজামপুরী ছিলেন ‘তরিকতের’ একজন বড় বুযুর্গ। তাঁর জীবনে বহু অলৌকিক ঘটনা ছিল বলেও তারা শুনেছেন। কিন্তু এই মহান সুফী-বুযুর্গ ব্যক্তিই যে একজন বড়মাপের ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতাযোদ্ধা ছিলেন-এ তথ্যটুকুর ব্যাপারে তাদের উপলব্ধি খুব পরিষ্কার বলে মনে হলো না। তারা বলেছেন- তিনি গাজীয়ে বালাকোট ছিলেন। কিন্তু ‘গাজীয়ে বালাকোট’ শব্দবন্ধের গভীরতা এবং স্বাধীনতার ইতিহাসে এর ওজন ও ব্যাপকতা অনুযায়ী তাদের চোখে-মুখে কোনো উদ্ভাসই লক্ষ্য করা যায়নি। একটু কি হোঁচট খেলাম! না, বিস্ময়ের কিছুই নেই। ইতিহাসের ঝকঝকা আয়নার ওপর বিস্মৃতির শ্যাওলা এখন বেশ পুরু। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে বিভক্তির স্তূপীকৃত ছাই। মহান সাধক ও বিপ্লবী যোদ্ধা সুফী নূর মুহাম্মদ নিজামপুরীর চেহারার বড় অংশই তো ঢাকা পড়ে আছে। সে প্রেক্ষাপট সামনে রাখলে এই সরল দুই ‘মাযার সেবকের’ কোনো ‘দায়’ চোখে পড়তে পারে না।
দুই.
শাহ সুফী নূর মুহাম্মদ নিজামপুরী রাহ. ছিলেন সমকালের এক শ্রেষ্ঠ বুযুর্গ সাধক এবং একইসঙ্গে নিবেদিত এক স্বাধীনতা-সংগ্রামী। উনবিংশ শতকের বাংলা-ভারত সর্বব্যাপী পরিচালিত জিহাদ আন্দোলনের একজন সশস্ত্র যোদ্ধা। আন্দোলনের প্রাণপুরুষ রায়বেরেলির সাইয়েদ আহমদ শহীদ রাহ.-এর একজন খলিফা এবং তাঁর প্রায় ১০ বছরের সংগ্রাম-সাধনার সঙ্গী। ১৮২২ সালে কলকাতায় তিনি তার মুর্শিদের হাতে বাইয়াত হন। তাঁর সঙ্গে হজ্বের সফরে যান। তাঁর সঙ্গে হিজরতও করেন। ১৮২৬ সালে ব্রিটিশ সরকার ও সে সরকারের স্থানীয় মিত্র-অনুচর শিখ রাজন্যবর্গের হাত থেকে সাধারণ মুসলিম প্রজাদের মুক্ত করার জন্য সীমান্ত অঞ্চল- পেশোয়ার, মর্দান ও পাঞ্জাবে অভিযান শুরু হলে তিনি বীরদর্পে অভিযাত্রী কাফেলার সঙ্গে যুক্ত থাকেন। ১৮৩০ সালে মায়ারের যুদ্ধে তিনি আহত হন। ১৮৩১-এর ৬ মে বালাকোটের রক্তাক্ত ময়দানেও তাঁর বীরত্বপূর্ণ উপস্থিতির কথা জানা যায়। ওইদিনই চরম বিয়োগান্তক ঘটনার পর অন্য যোদ্ধাদের সঙ্গে তিনিও বিক্ষিপ্ত হয়ে ময়দান থেকে সরে পড়তে বাধ্য হন। এরপর কিছুকাল আত্মগোপন করে কলকাতায় কাটিয়ে মীরসরাইয়ের মিঠানালায় ফিরে আসেন। ইসলামী বিশ্বকোষের চতুর্দশ খন্ডের ২১০-২১১ পৃষ্ঠায় তাঁর জীবনের ওপর একটি সংক্ষিপ্ত নিবন্ধ রয়েছে।
তিনি উঁচু মাপের আলেম ছিলেন, বড় মুহাদ্দিস ছিলেন। ছিলেন সমকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কামেল বুযুর্গ। তাঁর হাতে বাইআত গ্রহণ করে খেলাফত পেয়েছেন মশহুর বুযুর্গ পশ্চিমবঙ্গের ফতেহ আলী উয়াইসী রাহ.। ফতেহ আলী ওয়াইসী রাহ.-এর খলিফা ছিলেন ফুরফুরার প্রথম পীর আবু বকর সিদ্দিকী রাহ.। সে হিসেবে তিনি ছিলেন ফুরফুরার পীর সাহেবের দাদাপীর। ছারছীনার প্রথম পীর মাওলানা নেছারুদ্দীন রাহ. ছিলেন ফুরফুরার পীরের খলিফা। সে হিসেবে সুফী-বিপ্লবী নিজামপুরী রাহ. ছিলেন ছারছীনা পীরের পরদাদা-পীর। মূলত এ দেশের আধ্যাত্মিক বহু কেন্দ্র ও ধারার তিনি ছিলেন উৎস। গভীর তাকওয়া সম্পন্ন এ মনীষীর বহু কারামতের কথা লোকমুখে শোনা যায়। শত বছর আগের দুর্লভ কোনো কোনো গ্রন্থেও পাওয়া যায়।
উপমহাদেশে সাইয়েদ আহমদ শহীদের জিহাদ আন্দোলন নিয়ে প্রায় ২০ বছর গবেষণা করে তিন খন্ডের গ্রন্থ রচনা করেছেন মরহুম মাওলানা গোলাম রসুল মেহের। গত শতাব্দীর ষাটের দশকে লাহোর থেকে প্রকাশিত তার সে গ্রন্থের তৃতীয় খন্ডে ‘সুফী নূর মুহাম্মদ বাঙ্গালী’ শিরোনামে তিনি তিন লাইনের একটি মূল্যায়ন তুলে ধরেছেন। লিখেছেন- অত্যন্ত নিষ্ঠাবান, রিয়ামুক্ত দ্বীনদার ও পরহেযগার বুযুর্গ ছিলেন। বাইআত হওয়ার সময় তাঁর সঙ্গে যা কিছু ছিল তিনি তাঁর সর্বস্ব সাইয়েদ আহমদ শহীদ রাহ.-এর হাতে উপহার হিসেবে তুলে দেন। সেখান থেকে খরচের জন্য তাঁকে কিছু ফেরত দেওয়া হলে তিনি গ্রহণ করেন। বাকি সবটুকু কোষাগারে জমা করে দেওয়া হয়।’
লাখনৌ থেকে প্রকাশিত বিশ্ববিখ্যাত ইসলামী স্কলার সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী রাহ. রচিত ‘কারওয়ানে ঈমান ও আযীমত’ গ্রন্থে বলা হয়েছে- ‘তিনি ছিলেন বাংলা অঞ্চলে সাইয়েদ সাহেবের প্রধান খলিফাদের একজন। জিহাদে সাইয়েদ সাহেবের সঙ্গে তাশরীফ নিয়েছেন। রণাঙ্গনে তিনি আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছেন। এরপর আবারো দেশে ফিরে এসে দ্বীনের প্রচার ও হেদায়াতের কাজ করেছেন।’ ওই গ্রন্থে তাঁর নাম এসেছে আরও কয়েক জায়গায়।
আনুমানিক ১৭৯০ সালে তাঁর জন্ম। মীরসরাইয়ের মিঠানালা গ্রামে তাঁর ইন্তেকাল হয় ১৮৫৮ সালের ১ নভেম্বর- ১২৬৬ বঙ্গাব্দের ১৩ কার্তিক। সারা জীবন তিনি অবিবাহিত ছিলেন। তাঁর তৃতীয় ধাপের একজন অনুসারী মাওলানা আব্দুল গনী ওই গ্রামে পরবর্তী সময়ে তাঁর নামে একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। সুফিয়া নূরিয়া মাদরাসা। এখন সেটি আলিয়া ধারার ফাযিল পর্যায়ের মাদরাসা। ওই গ্রামে স্কুল, মাদরাসা ও সড়কে ‘সুফিয়া’ নামটির বহু ব্যবহার দেখা গেছে। এটি ‘সুফিয়া’ নামের কোনো নারীর নামে নয়, বরং সুফী নূর মুহাম্মদ নামের প্রথমাংশ অবলম্বন করেই করা হয়েছে।
লিখিত ও মৌখিক বিভিন্ন সূত্র থেকে যতদূর জানা গেছে, ১৮৪০ সালের আগে তিনি মিঠানালা গ্রামে ফিরে আসেন। এরপর থেকে প্রকাশ্যে দাওয়াত, এরশাদ ও কুসংস্কারমুক্ত দ্বীনী জীবন প্রতিষ্ঠার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। সঠিক আধ্যাত্মিক ইসলামী জীবনদর্শন চর্চার মধ্য দিয়ে বহু মানুষের রূহানী জগতে বিপ্লব সৃষ্টি করেন। একই সঙ্গে ব্রিটিশ শক্তির শোষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে তিনি সংগঠিত ও ব্যক্তিগত পর্যায়ে বিভিন্ন মহলকে কাজ করে যেতে উদ্বুদ্ধ করেন। ফেনী থেকে নিয়ে চট্টগ্রামের নানা অঞ্চলে তাঁর অনুপ্রেরণায় সঠিক ইসলামী জাগরণ ও ফিরিঙ্গী-বিরোধী বিপ্লবের ব্যাপক আবহ তৈরি হয়।
তিন.
মহান বুযুর্গ সাধক ও বিপ্লবী যোদ্ধার কবরের সামনে দাঁড়িয়ে যিয়ারত করলাম। ৯ মার্চের সকাল এগারটা। রোদ তাতিয়ে উঠেছে। এরপর আমাদের যাওয়ার কথা নোয়াখালীর সাদুল্লাপুর। মাযার কমপ্লেক্স থেকে বের হয়ে প্রায় দু’ কিলোমিটার দূরে সুফিয়া নূরিয়া মাদরাসা ঘুরে এলাম। ফেরার সময় জয়নুল আবেদীন ও কামরুলুদ্দীন জানালেন, ১৩ কার্তিক সেখানে ঈসালে সওয়াব মাহফিল হয়। ফুরফুরা, ছারছীনাসহ বিভিন্ন আধ্যাত্মিক দরবারের গুণীজনেরা ওই মাহফিলে বয়ান করেন। কুরআন শরীফ খতম হয়, দোয়া ও যিকির-আযকার হয়। তারা সে মাহফিলে আমাদেরও দাওয়াত দিলেন।
যখন ফিরে আসছি বার বার মনের কোনো উঁকি দিল, সাইয়েদ আহমদ শহীদ রাহ.-এর তরিকায়ে মুহাম্মদী বা জিহাদ আন্দোলনের অন্যতম প্রধান কয়েকটি বৈশিষ্ট্য ছিল- মুসলিম জীবনাচার থেকে শিরক দূর করা, বিদআতমুক্ত আধ্যাত্মিকতার প্রচলন দেওয়া এবং আগ্রাসী ফিরিঙ্গী শাসন উৎখাত করে ইসলামী অনুশাসন ভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। সুফী নূর মুহাম্মদ রাহ. ছিলেন সে আন্দোলনেরই অন্যতম যোদ্ধা। তাই তাঁর কবরকে কমপ্লেক্সের আওতায় নিয়ে যাওয়া, মসজিদের সঙ্গে যুক্ত করা, মৃত্যু-তারিখ ধরে ঈসালে সওয়াব মাহফিল করা না হলেই তো তার ক্ষেত্রে বেশি সমীচীন হতো। শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা এ ক্ষেত্রে কিছুটা আবেগাক্রান্ত হয়ে উঠেছে হয়তো। তাই সুফী নিজামপুরীর জীবনদর্শন ও আন্তরিক প্রত্যাশার চেয়ে এখানে ভক্তদের আবেগের মূল্যটাই মুখ্য হয়ে ওঠেছে। সুফী নিজামপুরীর তাসাওউফ, সিলসিলা ও তরিকত নিয়ে এখানে মাহফিলে খুব আলোচনা হয়। এর প্রয়োজন ও উপকারিতা অবশ্যই বিদ্যমান। কিন্তু সে সঙ্গে তাঁর জীবনের জিহাদ-সংগ্রাম, বিপ্লব ও যুদ্ধের কথা তেমন একটা উঠে না। এখানে আলৌকিকত্বের মহিমা উচ্চারিত হয়, তাঁর হৃদয় উত্তাপ করা উৎসর্গের দাস্তান সেভাবে জানানো হয় না। তিনি দরবেশ ছিলেন বার বার বলা হয়, সে সঙ্গে বৃটিশবিরোধী যোদ্ধা ছিলেন সে কথাটি বলা হয় না। তার পরও মহৎ নিয়তে যারা তাঁকে স্মরণ করছেন, আলোচনায় আনছেন এবং তাঁকে ঘিরে নিজেদেরকে আল্লাহর শুদ্ধ বান্দা হিসেবে গড়ে তুলতে চেষ্টা করছেন- তাদের প্রতি আমাদের অভিনন্দন। শুধু ছোট্ট অনুরোধ, তারা যেন সবার সামনে তাঁর গোটা জীবনের উজ্জ্বল অবয়বটা খুলে-তুলে দেখার ও ধরার চেষ্টা করে যান। এ জাতি ও ভূখন্ডের মুক্তিতে ১৮০ বছর আগে যিনি এত অবদান রেখে গেছেন তাঁর সে অবদান ভুলে যাওয়ার মতো অকৃতজ্ঞতা সবার জন্যই হবে আত্মঘাতী। আল্লাহ আমাদের হেফাজত করুন। আমীন। ষ