ঈমান সবার আগে-৩
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
১৬. ঈমান পরীক্ষার উপায়
মানুষের জন্য ঈমানের চেয়ে বড় কোনো নেয়ামত নেই। এই নেয়ামতের কারণে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করবে, আল্লাহ তাআলার শোকরগোযারী করবে এবং এর সংস্কার ও সংরক্ষণের জন্য ইসলামী শিক্ষা অনুযায়ী মেহনত করবে।
সকাল-সন্ধ্যায় মনে-প্রাণে বলবে-
رضيت بالله ربا وبالإسلام دينا وبمحمد نبيا
আমি রব হিসেবে আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট, দীন হিসেবে ইসলামের প্রতি সন্তুষ্ট আর নবী হিসেবে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি সন্তুষ্ট।
أصبحنا وأصبح الملك لله، والحمد لله، لا إله إلا الله، وحده لا شريك له، له الملك وله الحمد، وهو على كل شيء قدير ...
এই সকালে (সন্ধ্যায় ‘Ôأمسينا’ এই সন্ধ্যায়) আমরা আল্লাহর, গোটা রাজত্ব আল্লাহর এবং সকল প্রশংসা আল্লাহর। কোনো মাবূদ নেই আল্লাহ ছাড়া, তিনি এক, তার কোনো শরীক নেই। তাঁরই রাজত্ব, এবং তাঁরই প্রশংসা। আর তিনি সর্বশক্তিমান ...
এবং
اللهم ما أصبح بي من نعمة أو بأحد من خلقك، فمنك وحدك لا شريك لك، فلك الحمد ولك الشكر.
ইয়া আল্লাহ, এই সকালে (সন্ধ্যায় : ‘ما أمسى بي’ এই সন্ধ্যায়) যা কিছু নেয়ামতের আমি অধিকারী হয়েছি বা তোমার কোনো সৃষ্টি অধিকারী হয়েছে তা একমাত্র তোমারই পক্ষ হতে। তোমার কোনো শরীক নেই। সুতরাং তোমারই প্রশংসা এবং তোমারই জন্য শোকরগোযারী।
ঈমানের লালন ও বর্ধন এবং সংস্কার ও সুরক্ষার জন্য জ্ঞান-গবেষণা এবং কর্ম ও দাওয়াতের অঙ্গনে কী কী পদক্ষেপ ব্যক্তিগতভাবে ও সম্মিলিতভাবে নিতে হবে এই মুহূর্তে তা আলোচনা করা উদ্দেশ্য নয়। এখন শুধু একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজের বিষয়ে নিবেদন করছি। আর তা এই যে, আমরা প্রত্যেকে যেন মাঝে মধ্যে নিজের ঈমান পরীক্ষা করি, যে -আল্লাহ না করুন- আমাদের ঈমান শুধু মৌখিক জমা খরচ নয় তো। এমন তো নয় যে, আমাদের ঈমান শুধু নামকে ওয়াস্তের, যা ‘গ্রহণযোগ্য ঈমান’এর মানদন্ডে উত্তীর্ণই হয় না! আল্লাহ না করুন, যদি বাস্তব অবস্থা এমন হয় তাহলে এখনই নিজের ইসলাহ ও সংশোধন আরম্ভ করা উচিত।
সহজতার জন্য কুরআন, সুন্নাহ ও সীরাতে সালাফের আলোকে নিজের ঈমান পরীক্ষার কিছু উপায় সংক্ষেপে উল্লেখ করা হল। আল্লাহ তাআলা আমাদের তাওফীক দান করুন।
মনে রাখতে হবে, মৌলিকভাবে ঈমান যাচাইয়ের দুইটি পর্যায় আছে। প্রথম পর্যায় : আমার ঈমান ঠিক আছে কি না। দ্বিতীয় পর্যায় : সবলতা ও দুর্বলতার বিচারে আমার ঈমানের অবস্থান কোথায়।
এখানে শুধু প্রথম পর্যায়ের সাথে সংশ্লিষ্ট কিছু কথা নিবেদন করছি। এর জন্য নিম্নোক্ত উপায়গুলো ব্যবহার করা অধিক সহজ :
ক. আমার মাঝে কোনো কুফরী আকীদা নেই তো?
প্রথম কাজ এই যে, আমাদেরকে ইসলামী আকাইদ সঠিকভাবে জানতে হবে এবং চিন্তা করতে হবে আমার মধ্যে ঐসব আকীদার পরিপন্থী কোনো কিছু নেই তো? যদি থাকে তাহলে আমাকে তৎক্ষণাৎ তাওবা করতে হবে এবং ইসলামী আকীদার পরিপন্থী এই মতবাদকে বাতিল ও কুফরী বিশ্বাস করে এর সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করতে হবে।
কুরআন কারীমে মুশরিকদের, আখিরাতে অবিশ্বাসীদের, ইহুদি, নাসারা, মুনাফিকদের, পার্থিবতাবাদী, বেদ্বীন,
নাস্তিকচক্রসহ সকল ভ্রান্ত মতবাদের খন্ডন বিদ্যমান রয়েছে। চিন্তা-ভাবনার সাথে কুরআন তিলাওয়াত করে কিংবা কোনো নির্ভরযোগ্য তরজমা ও সংক্ষিপ্ত তাফসীরের সাহায্যে কুরআন পাঠ করে এবং প্রয়োজনে কোনো আলিমের কাছে সবক পড়ে কাফিরদের প্রত্যেক শ্রেণীর বাতিল আকীদা সম্পর্কে জেনে নিজেদের বোধ-বিশ্বাসের পরীক্ষা নেয়া কর্তব্য যে, আমার মধ্যে ঐসবের কোনো কিছু নেই তো?
খ. আমার মধ্যে নিফাক নেই তো?
নিফাকের বিভিন্ন প্রকার আছে। এক. বিশ্বাসগত নিফাক। এ প্রবন্ধে এ নিয়েই আলোচনা করা উদ্দেশ্য। বিশ্বাসগত নিফাকের অর্থ, অন্তরে কুফরী মতবাদ বা ইসলাম বিদ্বেষ লালন করেও কথা বা কাজে মুসলিম দাবি করা। বিশ্বাসগত নিফাক হচ্ছে কুফরীর এক কঠিনতম প্রকার। এটা যার মধ্যে আছে সে সরাসরি কাফির। তবে যথাযথ দলীল-প্রমাণ ছাড়া কারো বিষয়ে নিফাকের সন্দেহ করা বা কাউকে নিফাকের অভিযোগে অভিযুক্ত করা জায়েয নয়। হ্যাঁ, যখন কারো কথা বা কাজের দ্বারা নিফাক প্রকাশিত হয়ে পড়ে, অন্তরে লালিত কুফরী আকীদা ও ইসলাম-বিদ্বেষ জিহবায়ও এসে যায় তখন তো এর বিষয়ে মুসলমানদের সাবধান হতেই হবে এবং সরকারকেও এই লোক সম্পর্কে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে।
বিশ্বাসগত নিফাকের রূপগুলো কী কী কুরআন কারীমে তা ঘোষণা করা হয়েছে। সেগুলো জেনে নিজেকে যাচাই করা উচিত, আমার মধ্যে এসবের কোনো কিছু নেই তো?
বিশ্বাসগত নিফাকের বিভিন্ন রূপ আছে। কয়েকটি এই :
* ইসলামী শরীয়ত বা শরীয়তের কোনো বিধানকে অপসন্দ করা।
* ইসলামের, ইসলামের নবীর, ইসলামের কিতাবের, ইসলামী নিদর্শনের কিংবা ইসলামের কোনো বিধানের বিদ্রূপ বা অবজ্ঞা করা।
* ইসলামের কিছু বিশ্বাস ও বিধানকে মানা, আর কিছু না মানা।
* শরীয়তের কোনো বিধানের উপর আপত্তি করা বা তাকে সংস্কারযোগ্য মনে করা।
* ইসলামের কোনো অকাট্য ও দ্ব্যর্থহীন আকীদা বা বিধানের অপব্যাখ্যা করা।
গ. শাআইরে ইসলামের বিষয়ে আমার অবস্থান কী?
শাআইরে ইসলামকে ‘শাআইর’ এজন্য বলা হয় যে, তা ইসলামের চিহ্ন। প্রধান ‘শাআইর’ এই : এক. ইসলামের কালিমা, দুই. আল্লাহর ইবাদত (বিশেষত নামায, যাকাত, রোযা, হজ্ব) তিন. আল্লাহর রাসূল, চার. আল্লাহর কিতাব, পাঁচ. আল্লাহর ঘর কা’বা, অন্যান্য মসজিদ ও ইসলামের অন্যান্য পবিত্র স্থান, বিশেষত মসজিদে হারাম, মিনা, আরাফা, মুযদালিফা, মসজিদে আকসা ও মসজিদে নববী। ছয়. হজ্বে কুরবানীর জন্য নির্ধারিত ঐ পশু, যাকে ‘হাদী’ বলে। কুরআন মজীদে (২২ : ৩২, ৩০) আল্লাহ তাআলা ইসলামের শাআইর (নিদর্শনাবলী) কে ‘শাআইরুল্লাহ’ ও ‘হুরুমাতুল্লাহ’ নামে ভূষিত করেছেন। এবং এই নিদর্শনগুলোর মর্যাদা রক্ষার আদেশ করেছেন। আর ইরশাদ করেছেন, এগুলোর মর্যাদা রক্ষা প্রমাণ করে, অন্তরে তাকওয়া আছে, আল্লাহর ভয় আছে।
নিজের ঈমান যাচাইয়ের এক গুরুত্বপূর্ণ উপায় এই যে, আমি আমার অন্তরে খুঁজে দেখি, নিজের কথা ও কাজ পরীক্ষা করে দেখি আমার মাঝে শাআইরে ইসলামের ভক্তি-শ্রদ্ধা আছে কি না। তদ্রূপ কেউ শাআইরুল্লাহর অবমাননা করলে আমার কষ্ট হয় কি না। এমন তো নয় যে, কেউ শাআইরের অবমাননা করছে, আর আমি একে তার ব্যক্তিগত বিষয় মনে করে নিরব ও নির্লিপ্ত থাকছি? না আমার কষ্ট হচ্ছে, না এই অশোভন আচরণ সম্পর্কে আমার মনে ঘৃণা জাগছে, আর না এই বেআদবের বিষয়ে আমার অন্তরে কোনো বিদ্বেষ, না তার থেকে ও তার কুফরী কার্যকলাপ থেকে বারাআত (সম্পর্কচ্ছেদের) কোনো প্রেরণা!!
আল্লাহ না করুন, শাআইরের বিষয়ে এই যদি হয় আচরণ-অনুভূতি তাহলে ঐ সময়ই নিশ্চিত বুঝে নিতে হবে, এ অন্তর ঈমান থেকে একেবারেই শূন্য। সাথে সাথে সিজদায় পড়ে যাওয়া উচিত এবং তওবা করে, সর্বপ্রকার কুফর ও নিফাক থেকে ভিন্নতা ঘোষণার মাধ্যমে ঈমানের নবায়ন করা উচিত।
ঘ. আমার অন্তরে অন্যদের শাআইরের প্রতি ভালবাসা নেই তো?
ইসলাম ছাড়া অন্য সব ধর্ম এবং দ্বীন ও আখিরাত-অস্বীকার সম্বলিত সকল ইজম সম্পূর্ণ বাতিল ও ভ্রান্ত। এদেরও ‘শাআইর’ ও নিদর্শন আছে, মিথ্যা উপাস্য ও আদর্শ আছে, যেগুলোর কোনো সারবত্তা নেই। কিন্তু ইসলাম এই সবের উপহাস ও কটুক্তিরও অনুমতি নিজ অনুসারীদের দেয় না। এক তো এ কারণে যে, তা ভদ্রতা ও শরাফতের পরিপন্থী, এছাড়া এজন্যও যে, একে বাহানা বানিয়ে এরা ইসলামের সত্য নিদর্শনের অবমাননা করবে। কুরআন মজীদে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন :
وَلَا تَسُبُّوا الَّذِينَ يَدْعُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ فَيَسُبُّوا اللَّهَ عَدْوًا بِغَيْرِ عِلْمٍ كَذَلِكَ زَيَّنَّا لِكُلِّ أُمَّةٍ عَمَلَهُمْ ثُمَّ إِلَى رَبِّهِمْ مَرْجِعُهُمْ فَيُنَبِّئُهُمْ بِمَا كَانُوا يَعْمَلُونَ
অর্থ : আল্লাহকে ছেড়ে তারা যাদেরকে ডাকে তোমরা তাদেরকে গালি দিও না। কেননা তারা সীমালঙ্ঘন করে অজ্ঞানতাবশত আল্লাহকেও গালি দিবে; এভাবে আমি প্রত্যেক জাতির দৃষ্টিতে তাদের কার্যকলাপ সুশোভন করেছি অতঃপর তাদের প্রতিপালকের কাছে তাদের প্রত্যাবর্তন। অনন্তর তিনি তাদেরকে তাদের কৃতকার্য সম্বন্ধে অবহিত করবেন। (আল আনআম ৬ : ১০৮)
তো অন্যান্য কওমের রব, ইলাহ ও শাআইরের উপহাস ও কটূক্তি থেকে বিরত থাকা ইসলামের শিক্ষা, যা স্বস্থানে ইসলামী আদর্শের এক উল্লেখযোগ্য সৌন্দর্যের দিক। কিন্তু এর অর্থ কখনো এই নয় যে, তাদের রব ও মাবুদের (যা নিঃসন্দেহে অসার ও অসত্য) এবং এদের শাআইর ও নিদর্শনের (যা পুরোপুরি কল্পনা ও কুসংস্কার প্রসূত) সমর্থন ও সত্যায়ন করা হবে কিংবা এগুলোর প্রশংসা ও মাহাত্ম্য বর্ণনা করা হবে কিংবা অন্তরে আবেগ ও ভক্তি পোষণ করা হবে। কারণ এ তো সরাসরি কুফর। যদি তা বৈধ ও অনুমোদিত হয় তাহলে তো এরপরে ঈমান ও ইসলামের কোনো প্রয়োজনই অবশিষ্ট থাকে না। আর না উপরোক্ত বিশ্বাস ও কর্মের পরও ঈমানের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায়। ভালোভাবে বোঝা উচিত, কোনো কিছুর কটূক্তি-অবজ্ঞা থেকে বিরত থাকার অর্থ এই নয় যে, ঐ বিষয়কে সম্মান করতে হবে বা সত্য মনে করতে হবে। তো কুফরের শাআইরের সম্মান বা ভালবাসা হচ্ছে পরিষ্কার কুফর। আজকাল কিছু মানুষ দেখা যায়, যাদের দৃষ্টিতে নিজেদের তথা ইসলামী শাআইরের তো বিশেষ মর্যাদা নেই, এগুলোর অবমাননাও তাদের মাঝে কোনো প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে না। অথচ এরাই একাত্মতা প্রকাশ করে অন্যদের শাআইরের বিষয়ে। এরা অন্যদের ধর্মীয় উৎসবেও যোগদান করে এবং একে গৌরবের বিষয় মনে করে। একে তারা আখ্যা দেয় ‘সৌজন্য’ ও ‘উদারতা’র চিহ্ন বলে। তাদের জানা নেই, এটা সৌজন্য ও উদারতা নয়, এ হচ্ছে সত্য দীনের বিষয়ে শিথিলতা ও হীনম্মন্যতা এবং আপন জাতির সাথে বড় হীন ও গায়রতহীন আচরণ। হায়! তারা যদি বুঝত যে, কুফর ও শাআইরে কুফরের প্রীতি-আকর্ষণ, এসবের সাথে একাত্মতা প্রকাশ এবং এসবের ভক্তি-উপাসনায় সন্তোষ বা আনন্দ প্রকাশও সরাসরি কুফর।
এই শ্রেণীর মানুষের মনে রাখা উচিত, কুরআনে কারীমের আয়াত
إِنَّكُمْ إِذًا مِثْلُهُمْ
অর্থ : ... তাহলে তো তোমরাও তাদের মত হবে। (৪ : ১৪০)
এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ইরশাদ -
من تشبه بقوم فهو منهم
অর্থ : যে কোনো জাতির সাদৃশ্য গ্রহণ করবে সে তাদেরই অন্তর্ভূক্ত।
মোটকথা, নিজের ঈমানের শুদ্ধতা-অশুদ্ধতা যাচাইয়ের অন্যতম উপায় এ চিন্তা করা যে, অন্তরে বেদ্বীন সম্প্রদায়ের এবং দীন ইসলামের বিদ্রোহীদের শাআইর-নিদর্শনের সমর্থন বা প্রীতি-আকর্ষণ নেই তো। যদি থাকে তাহলে তওবা করে নিজেকে সংশোধন করবে, আল্লাহ তাআলার কাছে শাআইরুল্লাহর ভক্তি-ভালবাসা এবং শাআইরুল্লাহর সংরক্ষণ ও সমর্থনের তাওফীক প্রার্থনা করবে। কুফরের শাআইরের প্রতি ঘৃণা ও সেগুলোর অসারতার বিষয়ে প্রত্যয় ও প্রশান্তি প্রার্থনা করবে।
ঙ. পসন্দ-অপসন্দের ক্ষেত্রে আমার নীতি উল্টা না তো?
জগতে পসন্দ-অপসন্দের অনেক মানদন্ড আছে। মানুষের স্বভাবটাই এমন যে, এতে সৃষ্টিগতভাবেই কিছু বিষয়ের প্রতি আকর্ষণ রয়েছে আর কিছু বিষয়ে অনাগ্রহ ও বিমুখতা বরং ঘৃণা ও বিদ্বেষ। কিন্তু কেউ যখন ইসলাম কবুল করে এবং ঈমানের সম্পদ লাভ করে তখন তার হাতে এসে যায় পসন্দ-অপসন্দের প্রকৃত মানদন্ড। সে মানদন্ড হচ্ছে আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও তাঁর প্রদত্ত শরীয়ত। সুতরাং যা কিছু আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের কাছে পসন্দনীয় এবং শরীয়তে কাম্য তা মুমিনের কাছে অবশ্যই পসন্দনীয় হবে যদিও অন্য কোনো মানদন্ডে লোকেরা তা পসন্দ না করুক, কিংবা স্বয়ং তার কাছেই তা স্বভাবগতভাবে পসন্দের না হোক। আর যা কিছু আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের কাছে অপসন্দের এবং শরীয়তে নিষিদ্ধ তা তার কাছে অবশ্যই অপসন্দনীয় হবে যদিও অন্য কোনো মানদন্ডে লোকেরা তা পসন্দনীয় মনে করে কিংবা স্বভাবগতভাবে তার নিজেরও ঐ বিষয়ের প্রতি আকর্ষণ থাকে। মুমিন সর্বদা নিজের পসন্দ-অপসন্দকে দ্বীন ও ঈমানের দাবির অধীন রাখে। সে তার স্বভাবের আকর্ষণকে আল্লাহ তাআলার রেযামন্দির উপর কোরবান করে।
এজন্য ঈমান যাচাইয়ের এক গুরুত্বপূর্ণ উপায় যে, নিজের অন্তরকে পরীক্ষা করা তাতে পসন্দ-অপসন্দের মানদন্ড কী। আল্লাহ, তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও শরীয়তের পসন্দ-অপসন্দ, না প্রবৃত্তির চাহিদা, নিজের গোত্র, দল, দলনেতা, পার্থিব বিচারে মর্যাদাবান শ্রেণী, শুধু শক্তির জোরে প্রবল জাতিসমূহের সংস্কৃতি, সাধারণের মতামত, পার্থিব জীবনের চাকচিক্য কিংবা এ ধরনের আরো কোনো কিছু?
যদি তার কাছে মানদন্ড হয় প্রথম বিষয়টি তাহলে আল্লাহর শোকর গোযারী করবে আর যদি মানদন্ড হয় দ্বিতীয় বিষয়গুলো তাহেল খালিস দিলে তওবা করবে। নিজের পসন্দকে আল্লাহ ও তাঁর বিধানের অধীন করবে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর উসওয়ায়ে হাসানার (শরীয়ত ও সুন্নতের) অনুগামী করবে এবং ঈমানের তাজদীদ ও নবায়ন করবে।
আল্লাহর পসন্দকে অপসন্দ করা কিংবা আল্লাহর অপসন্দকে পসন্দ করা অথবা আল্লাহর বিধান অপসন্দকারীদের আংশিক আনুগত্য করা, এসবকে কুরআনে হাকীমে আল্লাহ তাআলা মুরতাদ হওয়ার কারণ সাব্যস্ত করেছেন এবং বলেছেন এগুলোর কারণে বান্দার সকল আমল নষ্ট হয়ে যায়। ইরশাদ হয়েছে :
إِنَّ الَّذِينَ ارْتَدُّوا عَلَى أَدْبَارِهِمْ مِنْ بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُمُ الْهُدَى الشَّيْطَانُ سَوَّلَ لَهُمْ وَأَمْلَى لَهُمْ l ذَلِكَ بِأَنَّهُمْ قَالُوا لِلَّذِينَ كَرِهُوا مَا نَزَّلَ اللَّهُ سَنُطِيعُكُمْ فِي بَعْضِ الْأَمْرِ وَاللَّهُ يَعْلَمُ إِسْرَارَهُمْ l فَكَيْفَ إِذَا تَوَفَّتْهُمُ الْمَلَائِكَةُ يَضْرِبُونَ وُجُوهَهُمْ وَأَدْبَارَهُمْ l ذَلِكَ بِأَنَّهُمُ اتَّبَعُوا مَا أَسْخَطَ اللَّهَ وَكَرِهُوا رِضْوَانَهُ فَأَحْبَطَ أَعْمَالَهُمْ
অর্থ : যারা নিজেদের কাছে সৎপথ ব্যক্ত হওয়ার পর তা পরিত্যাগ করে, শয়তান তাদের কাজকে শোভন করে দেখায় এবং তাদেরকে মিথ্যা আশা দেয়। এটা এজন্য যে, আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তা যারা অপসন্দ করে তাদেরকে তারা বলে ‘আমরা কোন কোন বিষয়ে তোমাদের আনুগত্য করব।’ আল্লাহ তাদের গোপন অভিসন্ধি অবগত আছেন। ফিরিশতারা যখন তাদের মুখমন্ডলে ও পৃষ্ঠদেশে আঘাত করতে করতে প্রাণ হরণ করবে, তখন তাদের দশা কেমন হবে! এটা এজন্য যে, তারা তা অনুসরণ করে, যা আল্লাহর অসন্তোষ জন্মায় এবং তার সন্তুষ্টিকে অপ্রিয় গণ্য করে। তিনি এদের কর্ম নিষ্ফল করে দেন। (সূরা মুহাম্মাদ ৪৭ : ২৫-২৮)
একই সাথে পরিষ্কার ঘোষণা করেছে যে, আল্লাহ তাআলার পসন্দ হল ঈমান আর অপসন্দ হল কুফর ও শিরক। আল্লাহর কাছে ঈমান ও ঈমান সংশ্লিষ্ট সবকিছু পসন্দনীয়। আর কুফর, শিরক এবং কুফর ও শিরকের সাথে সংশ্লিষ্ট সবকিছু অপছন্দনীয়।
وَلَا تَنْكِحُوا الْمُشْرِكَاتِ حَتَّى يُؤْمِنَّ وَلَأَمَةٌ مُؤْمِنَةٌ خَيْرٌ مِنْ مُشْرِكَةٍ وَلَوْ أَعْجَبَتْكُمْ وَلَا تُنْكِحُوا الْمُشْرِكِينَ حَتَّى يُؤْمِنُوا وَلَعَبْدٌ مُؤْمِنٌ خَيْرٌ مِنْ مُشْرِكٍ وَلَوْ أَعْجَبَكُمْ أُولَئِكَ يَدْعُونَ إِلَى النَّارِ وَاللَّهُ يَدْعُو إِلَى الْجَنَّةِ وَالْمَغْفِرَةِ بِإِذْنِهِ وَيُبَيِّنُ آَيَاتِهِ لِلنَّاسِ لَعَلَّهُمْ يَتَذَكَّرُونَ
অর্থ : মুশরিক নারীকে ঈমান না আনা পর্যন্ত তোমরা বিবাহ করো না। মুশরিক নারী তোমাদেরকে মুগ্ধ করলেও, নিশ্চয়ই মুমিন কৃতদাসী তাদের অপেক্ষা উত্তম। ঈমান না আনা পর্যন্ত মুশরিক পুরুষদের সাথে তোমরা বিবাহ দিও না, মুশরিক পুরুষ তোমাদেরকে মুগ্ধ করলেও, মুমিন কৃতদাস তাদের অপেক্ষা উত্তম। তারা জাহান্নামের দিকে আহবান করে এবং আল্লাহ তোমাদেরকে নিজ অনুগ্রহে নিজ জান্নাত ও ক্ষমার দিকে আহবান করেন। তিনি মানুষের জন্য স্বীয় বিধান সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেন, যাতে তারা তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। (আলবাকারা ২ : ২২১)
وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يُعْجِبُكَ قَوْلُهُ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَيُشْهِدُ اللَّهَ عَلَى مَا فِي قَلْبِهِ وَهُوَ أَلَدُّ الْخِصَامِ l وَإِذَا تَوَلَّى سَعَى فِي الْأَرْضِ لِيُفْسِدَ فِيهَا وَيُهْلِكَ الْحَرْثَ وَالنَّسْلَ وَاللَّهُ لَا يُحِبُّ الْفَسَادَ l وَإِذَا قِيلَ لَهُ اتَّقِ اللَّهَ أَخَذَتْهُ الْعِزَّةُ بِالْإِثْمِ فَحَسْبُهُ جَهَنَّمُ وَلَبِئْسَ الْمِهَادُ
অর্থ : আর মানুষের মধ্যে এমন ব্যক্তি আছে, পার্থিব জীবন সম্পর্কে যার কথাবার্তা তোমাকে চমৎকৃত করে এবং তার অন্তরে যা আছে সে সম্বন্ধে সে আল্লাহকে সাক্ষী রাখে। প্রকৃতপক্ষে সে ভীষণ কলহপ্রিয়। যখন সে প্রস্থান করে তখন সে পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টির এবং শস্যক্ষেত্র ও জীবজন্তু ধ্বংসের চেষ্টা করে। আর আল্লাহ অশান্তি পসন্দ করেন না। যখন তাকে বলা হয় ‘তুমি আল্লাহকে ভয় কর তখন তার আত্মাভিমান তাকে পাপে লিপ্ত করে, সুতরাং জাহান্নামই তার জন্য যথেষ্ট। নিশ্চয়ই তা নিকৃষ্ট বিশ্রামস্থল। (আলবাকারা ২ : ২০৪-২০৬)
وَلَا تُصَلِّ عَلَى أَحَدٍ مِنْهُمْ مَاتَ أَبَدًا وَلَا تَقُمْ عَلَى قَبْرِهِ إِنَّهُمْ كَفَرُوا بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ وَمَاتُوا وَهُمْ فَاسِقُونَ l وَلَا تُعْجِبْكَ أَمْوَالُهُمْ وَأَوْلَادُهُمْ إِنَّمَا يُرِيدُ اللَّهُ أَنْ يُعَذِّبَهُمْ بِهَا فِي الدُّنْيَا وَتَزْهَقَ أَنْفُسُهُمْ وَهُمْ كَافِرُونَ
অর্থ : তাদের মধ্যে কারো মৃত্যু হলে তুমি কখনো তার জন্য জানাযার সালাত আদায় করবে না এবং তার কবরের পাশে দাঁড়াবে না। তারা তো আল্লাহ ও তার রাসূলকে অস্বীকার করেছিল এবং পাপাচারী অবস্থায় তাদের মৃত্যু হয়েছে। সুতরাং তাদের সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি তোমাকে যেন মুগ্ধ না করে। আল্লাহ তো এর দ্বারাই পার্থিব জীবনে শাস্তি দিতে চান; তারা কাফির থাকা অবস্থায় তাদের আত্মা দেহ ত্যাগ করবে। (আততাওবা ৯ : ৮৪-৮৫)
চ. নিজের ইচ্ছা বা পছন্দের কারণে ঈমান ছাড়ছি না তো?
নিজের ইচ্ছা ও চাহিদা, স্বভাব ও রুচি-অভিরুচি, আত্মীয়তা ও সম্পর্কের আকর্ষণ ইত্যাদির সাথে যে পর্যন্ত ঈমানের দাবিসমূহের সংঘর্ষ না হয় ঐ পর্যন্ত ঈমানের পরীক্ষা হয় না। ঐ সকল বিষয়ের দাবি আর ঈমান-আকীদার দাবির মধ্যে একটিকে গ্রহণ করার পরিস্থিতি তৈরি হলেই ঈমানের পরীক্ষা হয়ে যায়। এই পরিস্থিতিই হচ্ছে মুমিনের ঈমানী পরীক্ষার মুহূর্ত। আল্লাহ তাআলা বান্দার ঈমান পরীক্ষার জন্য, মুমিন ও মুনাফিকের মাঝে পার্থক্য করার জন্য এমনসব পরিস্থিতি সৃষ্টি করেন এবং দেখেন, পরীক্ষায় কে সত্য প্রমাণিত হয়, কে মিথ্যা, কার ঈমান খাঁটি সাব্যস্ত হয়, কার ঈমান নামকেওয়াস্তে।
মুমিনের কর্তব্য, এই পরীক্ষার মুহূর্তে পূর্ণ সতর্ক থাকা। যেহেতু এসব ক্ষেত্রে দুটোকে গ্রহণের সুযোগ নেই তাই অবশ্যই তাকে কোনো একটি দিক প্রাধান্য দিতে হবে। এই প্রাধান্যের ক্ষেত্রে তাকে প্রমাণ দিতে হবে ঈমানের। যদি সে আল্লাহ, রাসূল, হিদায়েতের কিতাব, এবং দীন ও শরীয়তকে প্রাধান্যের মানদন্ড হিসেবে গ্রহণ করে এবং ঈমান ও ঈমানের দাবিসমূহের বিপরীতে নিজের ইচ্ছা ও চাহিদা, স্বভাবগত পসন্দ-অপসন্দ এবং আত্মীয়তা ও সম্পর্কের আকর্ষণ ও দুর্বলতাকে জয় করতে পারে তাহলে সে আল্লাহর কাছে সফল ও ঈমানী পরীক্ষায় কামিয়াব। পক্ষান্তরে যদি সে নিজের স্বভাব, কামনা-বাসনা ও পার্থিব সম্পর্ককে প্রাধান্যের মাপকাঠি সাব্যস্ত করে আর এসবের খাতিরে ঈমান ও ঈমানের দাবিসমূহের কোরবান করে তাহলে সে ব্যর্থ ও ঈমানী পরীক্ষায় নাকাম। তার নিশ্চিত জানা উচিত, তার ঈমান শুধু নামকে ওয়াস্তের, অন্তর নিফাক দ্বারা পূর্ণ।
কুরআন-সুন্নাহর শিক্ষায় এই নীতি বারবার উচ্চারিত; মুসলিমের জন্য প্রাধান্যের মানদন্ড হল আল্লাহ, তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং ঈমান ও ঈমানের দাবিসমূহ। এটি আল্লাহর পক্ষ হতেই নির্দেশিত। সুতরাং একে যে প্রাধান্যের মানদন্ড হিসেবে গ্রহণ করল না সে কুফরের রাস্তা অবলম্বন করল।
নমুনা হিসেবে কয়েকটি আয়াত দেখুন :
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا لَا تَتَّخِذُوا آَبَاءَكُمْ وَإِخْوَانَكُمْ أَوْلِيَاءَ إِنِ اسْتَحَبُّوا الْكُفْرَ عَلَى الْإِيمَانِ وَمَنْ يَتَوَلَّهُمْ مِنْكُمْ فَأُولَئِكَ هُمُ الظَّالِمُونَ l قُلْ إِنْ كَانَ آَبَاؤُكُمْ وَأَبْنَاؤُكُمْ وَإِخْوَانُكُمْ وَأَزْوَاجُكُمْ وَعَشِيرَتُكُمْ وَأَمْوَالٌ اقْتَرَفْتُمُوهَا وَتِجَارَةٌ تَخْشَوْنَ كَسَادَهَا وَمَسَاكِنُ تَرْضَوْنَهَا أَحَبَّ إِلَيْكُمْ مِنَ اللَّهِ وَرَسُولِهِ وَجِهَادٍ فِي سَبِيلِهِ فَتَرَبَّصُوا حَتَّى يَأْتِيَ اللَّهُ بِأَمْرِهِ وَاللَّهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الْفَاسِقِينَ
অর্থ : হে মুমিনগণ! তোমাদের পিতা ও ভাই যদি ঈমানের মোকাবেলায় কুফরিকে পসন্দ করে, তবে তাদেরকে অন্তরঙ্গরূপে গ্রহণ করো না। তোমাদের মধ্যে যারা তাদেরকে অন্তরঙ্গরূপে গ্রহণ করে তারাই জালিম। বল, ‘তোমাদের নিকট যদি আল্লাহ তার রাসূল এবং আল্লাহর পথে জিহাদ করা অপেক্ষা বেশি প্রিয় হয় তোমাদের পিতা, তোমাদের সন্তান, তোমাদের ভ্রাতা, তোমাদের পত্নী, তোমাদের সগোষ্ঠি, তোমাদের অর্জিত সম্পদ, তোমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য যার মন্দা পড়ার আশংকা কর এবং তোমাদের বাসস্থান যা তোমরা ভালবাস তবে অপেক্ষা কর আল্লাহর বিধান আসা পর্যন্ত।’ আল্লাহ সত্যত্যাগী সম্প্রদায়কে সৎপথ প্রদর্শন করেন না। (আততাওবা ৯ : ২৩-২৪)
এর চেয়ে আরো স্পষ্ট ‘নস’ ও বাণীর প্রয়োজন আছে কি? যে, আল্লাহর কাছে মুক্তি শুধু তখনই পাওয়া যাবে যখন আমাদের গ্রহণ বর্জনের মানদন্ড হবে আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও তাঁর দীন। আর পার্থিব সকল সম্পর্ক হবে এর অধীন যাতে মোকাবেলার সময় আমরা আল্লাহর ইচ্ছাকেই অগ্রগণ্য করতে পারি। আমাদের মধ্যে কেউ যদি প্রাধান্যের এই আসমানী মানদন্ড ত্যাগ করে কোনো পার্থিব সম্পর্ককে, নিজের গোত্র (বংশীয় বা রাজনৈতিক) বা গোত্রপতিদের চিন্তা বা পসন্দকে প্রাধান্যের মানদন্ড বানালো তাহলে নিঃসন্দেহে সে ঈমানের পরীক্ষায় নিজেকে অকৃতকার্য করল।
বস্ত্তত প্রাধান্যের মানদন্ড-প্রসঙ্গ এক স্পষ্ট বাস্তবতা। চিন্তা করলেই বোঝা যাবে, ঈমানের গোটা বিষয়টা নির্ভরশীল প্রাধান্যের উপরই। ঈমানের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করলে সব জায়গায় এটিই দেখা যাবে, ঈমান বিল্লাহর প্রথম কথা, গায়রুল্লাহ থেকে বিমুখ হয়ে আল্লাহর দিকে রুজু করা, শুধু তাঁরই ইবাদত কর, সকল তাগূতের (আল্লাহ ও তাঁর দীনের সাথে যুদ্ধরত বিদ্রোহী) আনুগত্য অস্বীকার কর এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ইতাআত (আনুগত্য) কর।
তদ্রূপ ঈমান বির রাসূলের গুরুত্বপূর্ণ কথা, রাসূলের উপর নাযিলকৃত কিতাব ও শরীয়ত এবং তাঁর উসওয়ায়ে হাসানাকে দুনিয়ার সকল ইজম, মতবাদত ও সংস্কৃতির চেয়ে অগ্রগণ্য মনে কর এবং ঐ সব থেকে বিমুখ হয়ে একেই গ্রহণ কর। আর আল্লাহর মনোনীত দীন ইসলামে পরিপূর্ণভাবে দাখিল হও।
তদ্রূপ ঈমান বিল আখিরাতের অনিবার্য অর্থ, আখিরাতের জীবনকে সফল ও সজ্জিত করার দাবিসমূহকে দুনিয়ার জীবনের কামনা-বাসনার উপর প্রাধান্য দাও।
এভাবে ঈমানের এক একটি বিষয় নিয়ে চিন্তা করতে থাকুন, দেখবেন, ঈমান ও ইসলামের অর্থই হচ্ছে হেদায়েতকে গোমরাহীর উপর, আলোকে অন্ধকারের উপর, কল্যাণকে অকল্যাণের উপর, তাওহীদকে শিরকের উপর, সুন্নতকে বিদআতের উপর, নেকীকে গোনাহের উপর, আনুগত্যকে বিদ্রোহের উপর, আখিরাতকে দুনিয়ার উপর, ইসলামকে গায়রে ইসলামের উপর, এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে অন্য সবার উপর প্রাধান্য দেওয়া।
ইরশাদ হয়েছে -
مَنْ كَفَرَ بِاللَّهِ مِنْ بَعْدِ إِيمَانِهِ إِلَّا مَنْ أُكْرِهَ وَقَلْبُهُ مُطْمَئِنٌّ بِالْإِيمَانِ وَلَكِنْ مَنْ شَرَحَ بِالْكُفْرِ صَدْرًا فَعَلَيْهِمْ غَضَبٌ مِنَ اللَّهِ وَلَهُمْ عَذَابٌ عَظِيمٌ l ذَلِكَ بِأَنَّهُمُ اسْتَحَبُّوا الْحَيَاةَ الدُّنْيَا عَلَى الْآَخِرَةِ وَأَنَّ اللَّهَ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الْكَافِرِينَ l أُولَئِكَ الَّذِينَ طَبَعَ اللَّهُ عَلَى قُلُوبِهِمْ وَسَمْعِهِمْ وَأَبْصَارِهِمْ وَأُولَئِكَ هُمُ الْغَافِلُونَ l لَا جَرَمَ أَنَّهُمْ فِي الْآَخِرَةِ هُمُ الْخَاسِرُونَ
অর্থ : যে ঈমান আনার পর আল্লাহকে অস্বীকার করল এবং কুফরির জন্য হৃদয় উন্মুক্ত রাখল তার উপর আপতিত হবে আল্লাহর গযব এবং তার জন্য মহা শাস্তি; তবে তার জন্য নহে, যাকে কুফরির জন্য বাধ্য করা হয় কিন্তু তার হৃদয় ঈমানে অবিচলিত। তা এই জন্য যে, তারা দুনিয়ার জীবনকে আখিরাতের উপর প্রাধান্য এবং আল্লাহ কাফের সম্প্রদায়কে হেদায়েত করেন না। তারাই ঐ সমস্ত লোক আল্লাহ যাদের অন্তর, কর্ণ ও চক্ষু মোহর করে দিয়েছেন এবং তারাই গাফেল। নিশ্চয়ই তারা আখেরাতে হবে ক্ষতিগ্রস্ত। (আন নাহল ১৬ : ১০৬-১০৯)
যাদু ও কুফর থেকে তাওবা করে যারা আল্লাহ ও তার রাসূল হযরত মূসা আ.-এর উপর ঈমান এনেছিলেন, ফিরাউন তাদেরকে হাত পা কেটে শূলিতে চড়ানোর হুমকি দিয়েছিল, কিন্তু তাদের জবাব ছিল এই-
قَالُوا لَنْ نُؤْثِرَكَ عَلَى مَا جَاءَنَا مِنَ الْبَيِّنَاتِ وَالَّذِي فَطَرَنَا فَاقْضِ مَا أَنْتَ قَاضٍ إِنَّمَا تَقْضِي هَذِهِ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا l إِنَّا آَمَنَّا بِرَبِّنَا لِيَغْفِرَ لَنَا خَطَايَانَا وَمَا أَكْرَهْتَنَا عَلَيْهِ مِنَ السِّحْرِ وَاللَّهُ خَيْرٌ وَأَبْقَى l إِنَّهُ مَنْ يَأْتِ رَبَّهُ مُجْرِمًا فَإِنَّ لَهُ جَهَنَّمَ لَا يَمُوتُ فِيهَا وَلَا يَحْيَا l وَمَنْ يَأْتِهِ مُؤْمِنًا قَدْ عَمِلَ الصَّالِحَاتِ فَأُولَئِكَ لَهُمُ الدَّرَجَاتُ الْعُلَا l جَنَّاتُ عَدْنٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا وَذَلِكَ جَزَاءُ مَنْ تَزَكَّى
অর্থ : তারা বলল ‘আমাদের কাছে যে স্পষ্ট নিদর্শন এসেছে তার উপর এবং যিনি আমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন তাঁর উপর তোমাকে আমরা কিছুতেই প্রাধান্য দিব না। সুতরাং তুমি কর যা তুমি করতে চাও। তুমি তো কেবল এই পার্থিব জীবনের উপর কর্তৃত্ব করতে পার।’ ‘ আমরা নিশ্চয়ই আমাদের প্রতিপালকের প্রতি ঈমান এনেছি যাতে তিনি আমাদের অপরাধ ক্ষমা করেন এবং তুমি আমাদেরকে যে জাদু করতে বাধ্য করেছ তাও ক্ষমা করেন। আর আল্লাহ শ্রেষ্ঠ ও স্থায়ী। যে তার প্রতিপালকের কাছে অপরাধী হয়ে উপস্থিত হবে তার জন্য তো আছে জাহান্নাম, সেখানে সে মরবেও না বাঁচবেও না এবং যারা তার নিকট উপস্থিত হবে মুমিন অবস্থায়, সৎকর্ম করে তাদের জন্য আছে সমুচ্চ মর্যাদা-স্থায়ী জান্নাত, যার পাদদেশে নহর প্রবাহিত, সেখানে তারা স্থায়ী হবে এবং এই পুরস্কার তাদেরই, যারা পবিত্র। (ত্বহা ২০ : ৭২-৭৬)
فَإِمَّا يَأْتِيَنَّكُمْ مِنِّي هُدًى فَمَنِ اتَّبَعَ هُدَايَ فَلَا يَضِلُّ وَلَا يَشْقَى l وَمَنْ أَعْرَضَ عَنْ ذِكْرِي فَإِنَّ لَهُ مَعِيشَةً ضَنْكًا وَنَحْشُرُهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَعْمَى l قَالَ رَبِّ لِمَ حَشَرْتَنِي أَعْمَى وَقَدْ كُنْتُ بَصِيرًا l قَالَ كَذَلِكَ أَتَتْكَ آَيَاتُنَا فَنَسِيتَهَا وَكَذَلِكَ الْيَوْمَ تُنْسَى
অর্থ : ... পরে আমার পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে সৎপথের নির্দেশ আসলে যে আমার পথ অনুসরণ করবে সে বিপথগামী হবে না ও দুঃখ কষ্ট পাবে না। ‘যে আমার স্মরণে বিমুখ থাকবে, অবশ্যই তার জীবন যাপন হবে সংকুচিত এবং আমি তাকে কিয়ামতের দিন উত্থিত করব অন্ধ অবস্থায়’। সে বলবে, হে আমার প্রতিপালক! কেন আমাকে অন্দ অবস্থায় উত্থিত করলে? তিনি বলবেন, ‘এমনই আমার নিদর্শনাবলি তোমার কাছে এসেছিল কিন্তু তুমি তা ভুলে গিয়েছিলে এবং সেভাবে আজ তুমিও বিস্মৃত হলে। (ত্বহা : ২০ : ১২৩-১২৬)
فَإِذَا جَاءَتِ الطَّامَّةُ الْكُبْرَى l يَوْمَ يَتَذَكَّرُ الْإِنْسَانُ مَا سَعَى l وَبُرِّزَتِ الْجَحِيمُ لِمَنْ يَرَى l فَأَمَّا مَنْ طَغَى l وَآَثَرَ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا l فَإِنَّ الْجَحِيمَ هِيَ الْمَأْوَى l وَأَمَّا مَنْ خَافَ مَقَامَ رَبِّهِ وَنَهَى النَّفْسَ عَنِ الْهَوَى l فَإِنَّ الْجَنَّةَ هِيَ الْمَأْوَى
অর্থ : অতঃপর যখন মহা সংকট উপস্থিত হবে। মানুষ যা করেছে তা সেই দিন স্মরণ করবে এবং প্রকাশ করা হবে জাহান্নাম দর্শকদের জন্য। অনন্তর যে সীমালঙ্ঘন করে এবং পার্থিব জীবনকে অগ্রাধিকার দেয়। জাহান্নামই হবে তার আবাস। পক্ষান্তরে যে নিজ প্রতিপালকের সামনে উপস্থিত হওয়ার ভয় রাখে এবং প্রবৃত্তি থেকে নিজেকে বিরত রাখে জান্নাতই হবে তার আবাস। (আননাযিআত ৭৯ : ৩৪-৪১)
অপরাধীর উপর দয়ার কারণে হতে পারে কোনো বিচারক হদ কায়েম করা থেকে বিরত থাকবে। আল্লাহ তাআলা হুশিয়ার করে দিয়েছেন যে, কক্ষনো না, আল্লাহর বিধান ও হুদূদকে সব কিছুর চেয়ে অগ্রগণ্য রাখ, যদি তোমরা মুমিন হও।
الزَّانِيَةُ وَالزَّانِي فَاجْلِدُوا كُلَّ وَاحِدٍ مِنْهُمَا مِئَةَ جَلْدَةٍ وَلَا تَأْخُذْكُمْ بِهِمَا رَأْفَةٌ فِي دِينِ اللَّهِ إِنْ كُنْتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآَخِرِ وَلْيَشْهَدْ عَذَابَهُمَا طَائِفَةٌ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ
অর্থ : ব্যভিচারিণী ও ব্যভিচারী-তাদের প্রত্যেককে এক শত কশাঘাত করবে, আল্লাহর বিধান কার্যকরি করণে তাদের প্রতি দয়া যেন তোমাদেরকে প্রভাবান্বিত না করে, যদি তোমরা আল্লাহ এবং পরকালে বিশ্বাসী হও; মুমিনদের একটি দল যেন তাদের শাস্তি প্রত্যক্ষ করে। (আন নূর ২৪ : ২)
যদিও এখন হদ কায়েম করার বিষয়ে সরকারগুলোর যে অনীহা তার প্রধান কারণ সম্ভবত অপরাধীর প্রতি (অন্যায়) দয়া নয়; বরং মূল কারণ সাধারণত অপরাধ ও অশ্লীলতার সাথে মানসিক ঐক্য এবং ঐসব মুরবিবর ভয় যারা আপাদমস্তক বর্বরতায় ডুবে থেকে ইসলামের ইনসাফের আইনকে বর্বর বলে আখ্যায়িত করে। বলাবাহুল্য, এসব কারণে ইসলামী হুদূদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া আরো বেশি ঈমানহীনতা।
এটা সম্ভব যে, কিছু শাসক ঈমানদার হয়েও এবং ইসলামের বিধান ও দন্ডকে ইনসাফপূর্ণ মনে করেও ভীরুতার কারণে তা কার্যকর করার সাহস করেন না। এদের উপর অবশ্য নিফাক ও ইলহাদের হুকুম জারি হবে না।
তো নিবেদন করা হচ্ছিল যে, নিজের ঈমান যাচাই করার এক গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি হল, নিজের অবস্থা বিচার করা যে, আমার কাছে প্রাধান্যের মানদন্ড ঈমান ও ইসলামের পরিবর্তে নিজের রুচি-অভিরুচি, প্রবৃত্তির চাহিদা কিংবা নিজের দল, গোত্র ও সম্প্রদায়ের পক্ষপাত নয় তো। যদি এমন হয় তাহলে তৎক্ষণাৎ তওবা করে শুধু এবং শুধু ইসলামী প্রাধান্যের মাপকাঠি অবলম্বন করতে হবে এবং ঈমানের তাজদীদ ও নবায়ন করতে হবে।
আমলের সংশোধনের হিম্মত যদি এই মুহূর্তে না হয় তাহলে ঈমান তো দিলের বিষয়। ঈমানের সংশোধন তো তৎক্ষণাৎ হতে পারে। আর এর দ্বারা অন্তত আল্লাহ ও তাঁর দীনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের অপরাধ থেকে তো নিষ্কৃতি পাওয়া যেতে পারে।
ছ. আল্লাহকে হাকিম ও বিধানদাতা মেনে নিতে আমার মনে কোনো দ্বিধা -নাউযুবিল্লাহ- নেই তো?
এক তো হচ্ছে বর্তমানকালের বাস্তবতা যা আমাদেরই কর্মফল যে, ভূপৃষ্ঠের কোনো অংশ এমন নেই যেখানে রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলামী বিধান কার্যকর, কিন্তু মুমিনমাত্রের জানা আছে যে, মুসলিম উম্মাহর প্রকৃত অবস্থা এ নয়, মুসলিম উম্মাহ তো পূর্ণাঙ্গ দ্বীন ও শরীয়তের অধিকারী। যাতে বড় একটি অংশ রয়েছে রাজ্য-শ্বাসন বিষয়ক। উম্মাহর নেতৃত্ব ও পরিচালনা যাদের উপর ন্যস্ত তাদের ফরয দায়িত্ব ঐ নীতি ও বিধান অনুযায়ী দেশ পরিচালনা করা, সালাত কায়েম করা, যাকাত আদায় করা, আমর বিল মারূফ, নাহি আনিল মুনকার (সকল মন্দের প্রতিরোধ ও প্রতিাবদ), ন্যায় ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠা ও ‘খিলাফত আলা মিনহাজিন নুবুওয়াহ’ (নববী আদর্শ অনুযায়ী যমীনে খেলাফত পরিচালনা করা)-এর দায়িত্ব পালন করা, ইসলামী হদ, কিসাস ও তাযীর (দন্ডবিধি) কার্যকর করা, সাধ্যানুযায়ী ইসলামী জিহাদের দায়িত্ব পালন করা, রাষ্ট্র পরিচালনা (আইন-বিচার, নির্বাহী) এর ক্ষেত্রে নতুন-পুরাতন জাহেলিয়াতের বিধি-বিধান এবং নতুন-পুরাতন সকল তাগূতি ব্যবস্থা থেকে সম্পূর্ণরূপে মুখ ফিরিয়ে ইসলামী বিধি-বিধানের আনুগত্য করা। এ হচ্ছে ইসলামের শিক্ষা এবং এ হচ্ছে মুসলিম উম্মাহর প্রকৃত অবস্থা :
وَعَدَ اللَّهُ الَّذِينَ آَمَنُوا مِنْكُمْ وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ لَيَسْتَخْلِفَنَّهُمْ فِي الْأَرْضِ كَمَا اسْتَخْلَفَ الَّذِينَ مِنْ قَبْلِهِمْ وَلَيُمَكِّنَنَّ لَهُمْ دِينَهُمُ الَّذِي ارْتَضَى لَهُمْ وَلَيُبَدِّلَنَّهُمْ مِنْ بَعْدِ خَوْفِهِمْ أَمْنًا يَعْبُدُونَنِي لَا يُشْرِكُونَ بِي شَيْئًا وَمَنْ كَفَرَ بَعْدَ ذَلِكَ فَأُولَئِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَ l وَأَقِيمُوا الصَّلَاةَ وَآَتُوا الزَّكَاةَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ
অর্থ : তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান আনে ও সৎকাজ করে আল্লাহ তাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন যে, তিনি অবশ্যই তাদেরকে পৃথিবীতে প্রতিনিধিত্ব দান করবেন, যেমন তিনি প্রতিনিধিত্ব দান করেছিলেন তাদের পূর্ববর্তীগণকে এবং তিনি অবশ্যই তাদের জন্য প্রতিষ্ঠিত করবেন তাদের দ্বীনকে যা তিনি তাদের জন্য পসন্দ করেছেন এবং তাদের ভয় ভীতির পরিবর্তে তাদেরকে অবশ্য নিরাপত্তা দান করবেন। তারা আমার ইবাদত করবে, আমার কোন শরিক করবে না, অতঃপর যারা অকৃতজ্ঞ হবে তারা তো সত্যত্যাগী। তোমরা সালাত কায়েম কর, যাকাত দাও এবং রাসূলের আনুগত্য কর, যাতে তোমরা অনুগ্রহভাজন হতে পার। (আন নূর ২৪ : ৫৫-৫৬)
الَّذِينَ إِنْ مَكَّنَّاهُمْ فِي الْأَرْضِ أَقَامُوا الصَّلَاةَ وَآَتَوُا الزَّكَاةَ وَأَمَرُوا بِالْمَعْرُوفِ وَنَهَوْا عَنِ الْمُنْكَرِ وَلِلَّهِ عَاقِبَةُ الْأُمُورِ
অর্থ : আমি এদেরকে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা দান করলে এরা সালাত কায়েম করবে, যাকাত দিবে এবং সৎকাজের নির্দেশ দিবে ও অসৎকাজ থেকে নিষেধ করবে; আর সকল কর্মের পরিণাম আল্লাহর ইখতিয়ারে। (হজ্ব ২২ : ৪১)
يَا دَاوُودُ إِنَّا جَعَلْنَاكَ خَلِيفَةً فِي الْأَرْضِ فَاحْكُمْ بَيْنَ النَّاسِ بِالْحَقِّ وَلَا تَتَّبِعِ الْهَوَى فَيُضِلَّكَ عَنْ سَبِيلِ اللَّهِ إِنَّ الَّذِينَ يَضِلُّونَ عَنْ سَبِيلِ اللَّهِ لَهُمْ عَذَابٌ شَدِيدٌ بِمَا نَسُوا يَوْمَ الْحِسَابِ
অর্থ : হে দাউদ! আমি তোমাকে পৃথিবীতে প্রতিনিধি করেছি, অতএব তুমি লোকদের মধ্যে সুবিচার কর এবং খেয়াল খুশির অনুসরণ করো না, কেননা তা তোমাকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করবে। যারা আল্লাহর পথ থেকে ভ্রষ্ট হয় তাদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি, কারণ তারা বিচারদিবসকে বিস্মৃত হয়ে আছে। (ছফ ৩৮ : ২৬)
وَأَنِ احْكُمْ بَيْنَهُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ وَلَا تَتَّبِعْ أَهْوَاءَهُمْ وَاحْذَرْهُمْ أَنْ يَفْتِنُوكَ عَنْ بَعْضِ مَا أَنْزَلَ اللَّهُ إِلَيْكَ فَإِنْ تَوَلَّوْا فَاعْلَمْ أَنَّمَا يُرِيدُ اللَّهُ أَنْ يُصِيبَهُمْ بِبَعْضِ ذُنُوبِهِمْ وَإِنَّ كَثِيرًا مِنَ النَّاسِ لَفَاسِقُونَ l أَفَحُكْمَ الْجَاهِلِيَّةِ يَبْغُونَ وَمَنْ أَحْسَنُ مِنَ اللَّهِ حُكْمًا لِقَوْمٍ يُوقِنُونَ l يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا لَا تَتَّخِذُوا الْيَهُودَ وَالنَّصَارَى أَوْلِيَاءَ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ وَمَنْ يَتَوَلَّهُمْ مِنْكُمْ فَإِنَّهُ مِنْهُمْ إِنَّ اللَّهَ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ
অর্থ : কিতাব অবতীর্ণ করেছি যাতে তুমি আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন সে অনুযায়ী তাদের বিচার নিষ্পত্তি কর, তাদের খেয়াল খুশির অনুসরণ না কর এবং তাদের সম্বন্ধে সতর্ক হও যাতে আল্লাহ যা তোমার প্রতি অবতীর্ণ করেছেন তারা তার কিছু থেকে তোমাকে বিচ্যুত না করে। যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয় তবে জেনে রাখ যে, কোন কোন পাপের কারণে আল্লাহ তাদেরকে বিপদাপন্ন করতে চান এবং মানুষের মধ্যে অনেকেই তো সত্যত্যাগী। তবে কি তারা জাহেলী যুগের বিধিবিধান কামনা করে? নিশ্চিত বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের জন্য বিধান দানে আল্লাহর চেয়ে কে শ্রেষ্ঠতর? হে মুমিনগণ! তোমরা ইহুদী ও খৃস্টানদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না, তারা পরস্পর পরস্পরের বন্ধু। তোমাদের মধ্যে কেউ তাদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করলে সে তাদেরই একজন হবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ জালেম সম্প্রদায়কে সৎপথে পরিচালিত করেন না। (মায়েদা ৫ : ৪৯-৫১)
এই আয়াতগুলোতে মুসলিম শাসকদের কর্তব্য এবং তাদের রাষ্ট্র পরিচালনার নীতি দুই-ই রয়েছে। এই বাস্তবতা স্মরণ রাখলে জানা যাবে, কোনো মুসলিম ভূখন্ডে শাসকদের জন্য আইন প্রণয়নের ক্ষেত্র হচ্ছে, যেখানে কুরআন-সুন্নাহ নিশ্চুপ এবং ইজমায়ে উম্মত ও খোলাফায়ে রাশেদীনের ঐকমত্যপূর্ণ ফয়সালায় যার নজির নেই। অন্যভাষায়, নবউদ্ভূত ইজতিহাদী প্রসঙ্গসমূহ, মোবাহ ক্ষেত্রসমূহ এবং ব্যবস্থাপনাগত বিষয়াদি (যা মোবাহ বিষয়াদিরই অন্যতম বড় অংশ)-এই তিনটি ক্ষেত্রেই মুসলিম শাসকদের আইন প্রণয়নের প্রয়োজন হতে পারে এবং এর অবকাশও তাদের আছে।
আর এর প্রথমটি অর্থাৎ নবউদ্ভূত ইজতিহাদী প্রসঙ্গসমূহের বিধানও সমসাময়িক ফকীহগণের উপর ন্যস্ত করা অপরিহার্য।
যেসব বিষয়ে কুরআন-সুন্নাহর সুস্পষ্ট ও সুনির্ধারিত নির্দেশনা আছে সেখানে হুবহু ঐ শিক্ষা ও নির্দেশনার অনুসরণ করা ও তা কার্যকর করা জরুরি। এসব বিষয়ে নতুন আঙ্গিকে বিন্যাস ও সংকলনের কাজ হতে পারে, কিন্তু তা পরিবর্তন-পরিবর্ধনের কোনো সুযোগ নেই। তদ্রূপ সেসব থেকে বিমুখ হয়ে আলাদা আইন প্রণয়ন কিংবা তার স্থলে মানব রচিত (যে-ই হোক এর রচয়িতা) কোনো আইন গ্রহণের কোনো অবকাশ নেই। কেউ এমনটা করলে যদি নিজেকে অপরাধী মনে করে, অন্তরে আল্লাহর প্রতি, আখিরাতের প্রতি, তাঁর রাসূল, তাঁর কিতাব, তাঁর বিধান ও শরীয়তের প্রতি ঈমান থাকে, আর তার উপলব্ধি এই থাকে যে, আল্লাহর বিধান অনুসারেই রাজ্য পরিচালনা করা ফরয, এতেই আছে কল্যাণ ও কামিয়াবি কিন্তু ঈমানী কমযোরি ও বুযদিলির কারণে আমি তা করতে পারছি না। তাহলে অন্তরে ঈমান থাকার কারণে এবং ঐ হারাম কাজে নিজেকে অপরাধী মনে করার কারণে তার উপর কাফির-মুনাফিকের হুকুম আরোপিত হবে না। পক্ষান্তরে অবস্থা যদি এই হয় যে, আল্লাহর বিধান তার পসন্দ নয়, ইসলামকে সে ঘর ও মসজিদে আবদ্ধ রাখতে চায়, জীবনের সকল ক্ষেত্রে ইসলামের নেতৃত্বে তার ঈমান নেই, আসমানী বিধিবিধানের উপর মানব রচিত আইন-কানুনের শ্রেষ্ঠত্বে বিশ্বাসী, তাহলে কোনো সন্দেহ নেই তার এই কর্ম ও অবস্থান সরাসরি কুফর। আর এই কুফরের সাথে কথায় বা আচরণে ঈমানের দাবি সরাসরি নিফাক ও মুনাফেকী।
রাববুল আলামীনের হুকুম পড়ুন :
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللَّهِ وَالرَّسُولِ إِنْ كُنْتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآَخِرِ ذَلِكَ خَيْرٌ وَأَحْسَنُ تَأْوِيلًا l أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِينَ يَزْعُمُونَ أَنَّهُمْ آَمَنُوا بِمَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ وَمَا أُنْزِلَ مِنْ قَبْلِكَ يُرِيدُونَ أَنْ يَتَحَاكَمُوا إِلَى الطَّاغُوتِ وَقَدْ أُمِرُوا أَنْ يَكْفُرُوا بِهِ وَيُرِيدُ الشَّيْطَانُ أَنْ يُضِلَّهُمْ ضَلَالًا بَعِيدًا l وَإِذَا قِيلَ لَهُمْ تَعَالَوْا إِلَى مَا أَنْزَلَ اللَّهُ وَإِلَى الرَّسُولِ رَأَيْتَ الْمُنَافِقِينَ يَصُدُّونَ عَنْكَ صُدُودًا
অর্থ : হে মুমিনগণ যদি তোমরা আল্লাহ ও আখিরাতে বিশ্বাস কর তবে তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর, আনুগত্য কর রাসূলের এবং তাদের, যারা তোমাদের মধ্যে ক্ষমতার অধিকারী; কোন বিষয়ে তোমাদের মধ্যে মতভেদ দেখা দিলে তা পেশ কর আল্লাহ ও রাসূলের কাছে। এটাই উত্তম এবং পরিণামে প্রকৃষ্টতর। তুমি তাদেরকে দেখ নাই যারা দাবী করে যে, তোমার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে এবং তোমার পূর্বে যা অবতীর্ণ হয়েছে তাতে তারা বিশ্বাস করে, অথচ তারা তাগূতের কাছে বিচারপ্রার্থী হতে চায়, যদিও তা প্রত্যাখ্যান করার জন্য তাদেরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং শয়তান তাদেরকে ভীষণভাবে পথভ্রষ্ট করতে চায়। তাদেরকে যখন বলা হয় আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তার দিকে এবং রাসূলের দিকে আস, তখন মুনাফিকদেরকে তুমি তোমার থেকে মুখ একেবারে ফিরিয়ে নিতে দেখবে। (আন নিসা ৪ : ৫৯-৬১)
‘তাগূতে’র অর্থ আল্লাহর ঐ বিদ্রোহী বান্দা, যে আল্লাহর মোকাবেলায় নিজেকে বিধানদাতা মনে করে এবং মানুষের উপর তা কার্যকর করতে চায়।
প্রকৃতপক্ষে কোনো তাগুত ব্যক্তি বা দলের বানানো আইন-কানুন হচ্ছে সত্য দ্বীন ইসলামের বিপরীতে বিভিন্ন ‘ধর্ম’, যা থেকে সম্পর্কচ্ছে করা ছাড়া ঈমান সাব্যস্ত হয় না। আল্লাহর বিরুদ্ধে কিংবা আল্লাহর সাথে তাগূতের উপাসনা বা আনুগত্য করা কিংবা তা বৈধ মনে করা, তদ্রূপ আল্লাহর দীনের মোকাবেলায় বা তার সাথে তাগূতের আইন-কানুন গ্রহণ করা বা গ্রহণ করাকে বৈধ মনে করা সরাসরি কুফর ও শিরক। তাগূত ও তার বিধি-বিধান থেকে সম্পর্কচ্ছেদ ছাড়া ঈমানের দাবি নিফাক ও মুনাফিকী।
এই নিফাক থেকে বাঁচার ন্যূনতম উপায়, শাসক-জনগণ সকলেরই অন্তরে এই কামনা থাকা যে, হায়! আমাদের এখানে যদি ইসলামী বিধান কার্যকর হত, আমাদের দেশ ইসলামের বিধান অনুযায়ী পরিচালিত হত। অন্তত অন্তরেও যদি পূর্ণাঙ্গ ইসলামের ঈমান থাকে এবং ইসলামের রাজ্য চালনার নীতি ও বিধানের মর্যাদা-মাহাত্ম্য ভালবাসা অন্তরে বিদ্যমান থাকে তাহলে এটাও অনেক বড় ব্যাপার। এর জন্যও আল্লাহ তাআলার শোকরগোযারি করা কর্তব্য।
পক্ষান্তরে দিলের অবস্থা যদি এই হয় যে,-নাউযুবিল্লাহ-আল্লাহকে হাকিম ও শাসক মেনে নিতেই দ্বিধা ও সংকোচ কিংবা অস্বীকৃতি থাকে, রাজনীতি ও রাজ্য চালনায় আসমানী বিধানের ‘অনুপ্রবেশ’ কেন,-এই যদি হয় মনের কথা তাহলে নিশ্চিত বুঝতে হবে, অন্তর ঈমান থেকে শূন্য এবং ঐ লোক ইসলামের গন্ডি থেকে খারিজ। তাকে কুফর ও নিফাক থেকে সম্পর্কচ্ছেদ করে খাঁটি মনে তাওবা করতে হবে এবং ইসলামের পূর্ণতা, পূর্ণাঙ্গতা ও জীবনের সকল ক্ষেত্রে তার অবশ্য অনুসরণীয় হওয়ার উপর বিশ্বাস স্থাপন করে পূর্ণ ইসলামে প্রবেশের মাধ্যমে ঈমানের নবায়ন করতে হবে, যাতে কম সে কম ঈমানের পর্যায়ে আল্লাহ ও তার দীনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের অপরাধ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। এরপর হতে পারে-যদি সদিচ্ছা থাকে-কখনো কর্মগত বিদ্রোহ থেকেও মুক্তি পাওয়া যাবে।
মনে রাখুন, হেদায়েত ও দীনে হকের বিজয় কাফির -মুশরিক ও মুনাফিকরদে কাছে সহনীয় নয়। তাদের কাছে এটা খুবই অসহনীয় যে, শুধু আল্লাহর ইবাদত হবে এবং আল্লাহর কালিমা বুলন্দ হবে। মুসলিম উম্মাহর ঈমানী তারাক্কী এবং উম্মাহ হিসেবে তাদের প্রতিষ্ঠা তাদের চরম গাত্রদাহের কারণ। এখন যদি ইসলামের কালেমা পাঠ করেও আমারও অবস্থা সেটাই হয় আর আমার দোসতীও হয় তাদের সাথেই তাহলে আমি কীভাবে ঈমানের দাবি করি? আমার আদর্শ তো নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তাঁর সাহাবীগণ। কুরআন মজীদের বর্ণনায় তো তাঁদের অবস্থা এই-
مُحَمَّدٌ رَسُولُ اللَّهِ وَالَّذِينَ مَعَهُ أَشِدَّاءُ عَلَى الْكُفَّارِ رُحَمَاءُ بَيْنَهُمْ تَرَاهُمْ رُكَّعًا سُجَّدًا يَبْتَغُونَ فَضْلًا مِنَ اللَّهِ وَرِضْوَانًا سِيمَاهُمْ فِي وُجُوهِهِمْ مِنْ أَثَرِ السُّجُودِ ذَلِكَ مَثَلُهُمْ فِي التَّوْرَاةِ وَمَثَلُهُمْ فِي الْإِنْجِيلِ كَزَرْعٍ أَخْرَجَ شَطْأَهُ فَآَزَرَهُ فَاسْتَغْلَظَ فَاسْتَوَى عَلَى سُوقِهِ يُعْجِبُ الزُّرَّاعَ لِيَغِيظَ بِهِمُ الْكُفَّارَ وَعَدَ اللَّهُ الَّذِينَ آَمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ مِنْهُمْ مَغْفِرَةً وَأَجْرًا عَظِيمًا
অর্থ : মুাহম্মাদ আল্লাহর রাসূল; তার সহচরগণ কাফেরদের প্রতি কঠোর এবং নিজেদের মাঝে পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল; আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি কামনায় তুমি তাদেরকে রুকু ও সিজদায় অবনত দেখবে। তাদের লক্ষণ তাদের মুখমন্ডলে সিজদার প্রভাবে পরিস্ফূট থাকবে; তাওরাতে তাদের বর্ণনা এমন এবং ইনজিলেও তাদের বর্ণনা এমনই। তাদের দৃষ্টান্ত একটি চারাগাছ, যা থেকে বের হয় কিশলয়, অতঃপর তা শক্ত ও পুষ্ট হয় এবং পরে কান্ডের উপর দাঁড়ায় দৃঢ়ভাবে যা চাষীর জন্য আনন্দদায়ক। এই ভাবে আল্লাহ মুমিনদের সমৃদ্ধির দ্বারা কাফেরদের অন্তর্জ্বালা সৃষ্টি করেন। যারা ঈমান আনে ও সৎকাজ করে আল্লাহ তাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ক্ষমা ও মহাপুরস্কারের। (আলফাতহ ৪৮ : ২৯)
কাফির-মুশরিকদের এই ঘৃণা ও ক্রোধ অতীতেও ছিল, এখনও আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে যে পর্যন্ত না তারা কুফর ও শিরক থেকে তওবা করে দ্বীনে হক কবুল করে। মুসলিম উম্মাহর ফরয-যদি নিজের ঈমান রক্ষা করতে হয়-ওদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করা। এরপর কেউ যদি ওদের বন্ধুত্ব থেকে প্রভূত্বের আসনে সমাসীন করে এবং নিজেদের আদর্শ বানিয়ে নেয় তবে? তাদের অবস্থা তো কুরআন মজীদে বারবার উল্লেখ করা হয়েছে-
يُرِيدُونَ لِيُطْفِئُوا نُورَ اللَّهِ بِأَفْوَاهِهِمْ وَاللَّهُ مُتِمُّ نُورِهِ وَلَوْ كَرِهَ الْكَافِرُونَ l هُوَ الَّذِي أَرْسَلَ رَسُولَهُ بِالْهُدَى وَدِينِ الْحَقِّ لِيُظْهِرَهُ عَلَى الدِّينِ كُلِّهِ وَلَوْ كَرِهَ الْمُشْرِكُونَ
অর্থ : তারা আল্লাহর নূর ফুৎকারে নিভিয়ে দিতে চায় কিন্তু আল্লাহ তাঁর নূর পূর্ণরূপে উদ্ভাসিত করবেন, যদিও কাফিররা তা অপসন্দ করে তিনিই তাঁর রাসূলকে প্রেরণ করেছেন হেদায়েত ও সত্য দ্বীনসহ সকল দ্বীনের উপর তা বিজয়ী করার জন্য, যদিও মুশরিকগণ তা অপসন্দ করে। (আসসফ ৬১ : ৮-৯)
اتَّخَذُوا أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِنْ دُونِ اللَّهِ وَالْمَسِيحَ ابْنَ مَرْيَمَ وَمَا أُمِرُوا إِلَّا لِيَعْبُدُوا إِلَهًا وَاحِدًا لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ سُبْحَانَهُ عَمَّا يُشْرِكُونَ l يُرِيدُونَ أَنْ يُطْفِئُوا نُورَ اللَّهِ بِأَفْوَاهِهِمْ وَيَأْبَى اللَّهُ إِلَّا أَنْ يُتِمَّ نُورَهُ وَلَوْ كَرِهَ الْكَافِرُونَ l هُوَ الَّذِي أَرْسَلَ رَسُولَهُ بِالْهُدَى وَدِينِ الْحَقِّ لِيُظْهِرَهُ عَلَى الدِّينِ كُلِّهِ وَلَوْ كَرِهَ الْمُشْرِكُونَ
অর্থ : তারা আল্লাহ ছাড়া তাদের পন্ডিতগণকে এবং সংসারবিরাগীগণকে তাদের প্রভুরূপে গ্রহণ করেছে এবং মারইয়াম তনয় মসীহকেও। অথচ তারা এক ইলাহের ইবাদত করার জন্য আদিষ্ট হয়েছিল। তিনি ছাড়া অন্য কোন ইলাহ নেই। তারা যাকে শরিক করে তা থেকে তিনি কত পবিত্র! তারা তাদের মুখের ফুৎকারে আল্লাহর জ্যোতি নিভিয়ে দিতে চায়। কাফেরগণ অপ্রীতিকর মনে করলেও আল্লাহ তাঁর জ্যোতির পূর্ণ উদ্ভাসন ছাড়া অন্য কিছু চান না। মুশরিকরা অপ্রীতিকর মনে করলেও অন্য সমস্ত দ্বীনের উপর জয়যুক্ত করার জন্য তিনিই পথনির্দেশ ও সত্য দ্বীনসহ তাঁর রাসূল প্রেরণ করেছেন। (আততাওবা ৯ : ৩১-৩৩)
হাদীসে আছে, ইয়াহূদ-নাসারা নিজেদের আহবার-রোহবানের উপাসনা করত না, এখনও করে না, তবে ওরা তাদেরকে হালাল-হারাম নির্ধারণের ক্ষমতা দিয়ে রেখেছিল। আর এ কারণেই আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ওরা নিজেদের আহবার-রোহবানকে ‘রব’ হিসেবে গ্রহণ করেছে। (দ্র. জামে তিরমিযী হাদীস ৩০৯৫) অথচ ‘রব’ শুধু আল্লাহ; না তার রব-গুণে কেউ শরীক হতে পারে, না ইলাহ গুণে। এ কারণে যে কেউ আল্লাহর আহকাম-হুদূদ ও আল্লাহ প্রদত্ত শরীয়তের বিপরীতে কারো জন্য আইন প্রণয়নের অধিকার স্বীকার করে তবে সে সরাসরি শিরকে লিপ্ত হয় এবং বস্ত্তত ঐ ব্যক্তিকে নিজের ‘রব’ হিসেবে গ্রহণ করে। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সর্বপ্রকারের কুফর ও শিরক থেকে বেঁচে থাকার তাওফীক দিন। আমীন।
জ. আমি সাবীলুল মুমিনীন থেকে বিচ্যুত হচ্ছি না তো?
সর্বশেষ কথা এই যে, কুরআন-সুন্নাহয় সিরাতে মুসতাকীম ও হেদায়েতের উপর অবস্থিত নাজাতপ্রাপ্ত লোকদের পথকে ‘সাবীললু মুমিনীন’ বলা হয়েছে এবং এ পথ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়াকে জাহান্নামে যাওয়ার কারণ সাব্যস্ত করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে-
অর্থ : কারো কাছে সৎপথ প্রকাশ হওয়ার পর সে যদি রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ করে এবং মুমিনদের পথ ছাড়া অন্য পথ অনুসরণ করে, তবে যেদিকে সে ফিরে যায় সেদিকেই তাকে ফিরিয়ে দিব এবং জাহান্নামে তাকে দগ্ধ করব, আর তা কত মন্দ আবাস! (আন নিসা ৪ : ১১৫)
এ কারণে নিজের ঈমান যাচাইয়ের সহজ পথ, নিজের আকীদা-বিশ্বাস, চিন্তা-চেতনা এবং জীবন ও কর্ম নিরীক্ষা করা। যদি এতে কোনো কিছু ‘সাবীলুল মুমিনীন’ (মুমিনদের ঐকমত্যপূর্ণ রাস্তা)-এর বিপরীত চোখে পড়ে তাহলে খাঁটি দিলে তওবা করে শুযূয ও বিচ্ছিন্নতা থেকে ফিরে আসব এবং ‘সাবীলুল মুমিনীন’ (মুমিনদের রাস্তায়) চলতে থাকব। যার দ্বিতীয় নাম ‘মা আনা আলাইহি ওয়া আসহা-বী’। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে ঐ রাস্তার উপর দৃঢ়পদ রাখুন। আমীন।
رَبَّنَا لَا تُزِغْ قُلُوبَنَا بَعْدَ إِذْ هَدَيْتَنَا وَهَبْ لَنَا مِنْ لَدُنْكَ رَحْمَةً إِنَّكَ أَنْتَ الْوَهَّابُ
ঝ. দল ও দলনেতা আখেরাতে কাজে আসবে না
যে কেউ দুনিয়াতে ‘সাবীলুল মুমিনীন’ থেকে আলাদা থাকবে সে আখেরাতে আফসোস করতে থাকবে :
وَيَوْمَ يَعَضُّ الظَّالِمُ عَلَى يَدَيْهِ يَقُولُ يَا لَيْتَنِي اتَّخَذْتُ مَعَ الرَّسُولِ سَبِيلًا l يَا وَيْلَتَى لَيْتَنِي لَمْ أَتَّخِذْ فُلَانًا خَلِيلًا l لَقَدْ أَضَلَّنِي عَنِ الذِّكْرِ بَعْدَ إِذْ جَاءَنِي وَكَانَ الشَّيْطَانُ لِلْإِنْسَانِ خَذُولًا
অর্থ : জালিম ব্যক্তি সেইদিন নিজ হস্তদ্বয় দংশন করতে করতে বলবে, হায়, আমি যদি রাসূলের সাথে সৎপথ অবলম্বন করতাম! হায়, দুর্ভোগ আমার! আমি যদি অমুককে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করতাম, আমাকে তো সে বিভ্রান্ত করেছিল, আমার কাছে উপদেশ আসার পর। শয়তান তো মানুষের জন্য মহাপ্রতারক। (আলফুরকান ২৫ : ২৭-২৯)
إِنَّ اللَّهَ لَعَنَ الْكَافِرِينَ وَأَعَدَّ لَهُمْ سَعِيرًا l خَالِدِينَ فِيهَا أَبَدًا لَا يَجِدُونَ وَلِيًّا وَلَا نَصِيرًا l يَوْمَ تُقَلَّبُ وُجُوهُهُمْ فِي النَّارِ يَقُولُونَ يَا لَيْتَنَا أَطَعْنَا اللَّهَ وَأَطَعْنَا الرَّسُولَا l وَقَالُوا رَبَّنَا إِنَّا أَطَعْنَا سَادَتَنَا وَكُبَرَاءَنَا فَأَضَلُّونَا السَّبِيلَا l رَبَّنَا آَتِهِمْ ضِعْفَيْنِ مِنَ الْعَذَابِ وَالْعَنْهُمْ لَعْنًا كَبِيرًا
অর্থ : আল্লাহ কাফেরদেরকে অভিশপ্ত করেছেন এবং তাদের জন্য প্রস্ত্তত রেখেছেন জ্বলন্ত অগ্নি; সেখানে তারা স্থায়ী হবে এবং তারা কোন অভিভাবক এবং সাহায্যকারী পাবে না যেদিন তাদের মুখমন্ডল আগুনে উলট-পালট করা হবে সেদিন তারা বলবে, ‘হায়, আমরা যদি আল্লাহকে মানতাম ও রাসূলকে মানতাম!’ তারা আরো বলবে, ‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা আমাদের নেতা ও বড় লোকদের আনুগত্য করেছিলাম এবং তারা আমাদেরকে পথভ্রষ্ট করেছিল; ‘হে আমাদের প্রতিপালক! তাদেরকে দ্বিগুণ শাস্তি দাও এবং তাদেরকে দাও মহাঅভিসম্পাত। (আলআহযাব ৩৩ : ৬৪-৬৮)
কিন্তু জবাব পাওয়া যাবে যে,
قَالَ لِكُلٍّ ضِعْفٌ وَلَكِنْ لَا تَعْلَمُونَ
অর্থ : আল্লাহ বলবেন, ‘প্রত্যেকের জন্য দ্বিগুণ রয়েছে, কিন্তু তোমরা জান না। (আলআ’রাফ ৭ : ৩৮)
এবং নেতারা বলবে :
فَمَا كَانَ لَكُمْ عَلَيْنَا مِنْ فَضْلٍ فَذُوقُوا الْعَذَابَ بِمَا كُنْتُمْ تَكْسِبُونَ
অর্থ : আমাদের উপর তোমাদের কোন শ্রেষ্ঠত্ব নেই, সুতরাং তোমরা তোমাদের কৃতকর্মের শাস্তি আস্বাদন কর। (আলআরাফ ৭ : ৩৯)
তওবার দরজা খোলা আছে
মওত হাজির হলে তওবার দরজা বন্ধ হয়ে যাবে। এখনই সংশোধনের সময়, খাঁটি তওবা করলে আল্লাহ তাআলা কুফর-শিরক ও নিফাকসহ বড় বড় অপরাধও মাফ করে দেন। শর্ত হচ্ছে, ‘তাওবায়ে নাসূহ’ খালিস তওবা, যে তওবাতে সকল প্রকার কুফর শিরক মুনাফেকী বর্জনের পাশাপাশি সকল প্রকার গুনাহ থেকে বাচার মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি ও কর্ম সংশোধন এবং সাধ্যমত অতীত জীবনের ক্ষতিপূরণও শামিল :
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا لَا تَتَّخِذُوا الْكَافِرِينَ أَوْلِيَاءَ مِنْ دُونِ الْمُؤْمِنِينَ أَتُرِيدُونَ أَنْ تَجْعَلُوا لِلَّهِ عَلَيْكُمْ سُلْطَانًا مُبِينًا l إِنَّ الْمُنَافِقِينَ فِي الدَّرْكِ الْأَسْفَلِ مِنَ النَّارِ وَلَنْ تَجِدَ لَهُمْ نَصِيرًا l إِلَّا الَّذِينَ تَابُوا وَأَصْلَحُوا وَاعْتَصَمُوا بِاللَّهِ وَأَخْلَصُوا دِينَهُمْ لِلَّهِ فَأُولَئِكَ مَعَ الْمُؤْمِنِينَ وَسَوْفَ يُؤْتِ اللَّهُ الْمُؤْمِنِينَ أَجْرًا عَظِيمًا l مَا يَفْعَلُ اللَّهُ بِعَذَابِكُمْ إِنْ شَكَرْتُمْ وَآَمَنْتُمْ وَكَانَ اللَّهُ شَاكِرًا عَلِيمًا
অর্থ : হে মুমিনগণ! মুমিনগণের পরিবর্তে কাফিরগণকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না। তোমরা কি আল্লাহকে তোমাদের বিরুদ্ধে স্পষ্ট প্রমাণ দিতে চাও? মুনাফিকগণ তো জাহান্নামের নিম্নতম স্তরে থাকবে এবং তাদের জন্য কখনো কোন সহায় পাবে না। কিন্তু যারা তওবা করে, নিজেদেরকে সংশোধন করে, আল্লাহকে দৃঢ়ভাবে অবলম্বন করে এবং আল্লাহর উদ্দেশ্যে তাদের দ্বীনে একনিষ্ঠ থাকে, তারা মুমিনদের সঙ্গে থাকবে এবং মুমিনগণকে আল্লাহ অবশ্যই মহাপুরস্কার দিবেন। তোমরা যদি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর এবং ঈমান আন তবে তোমাদের শাস্তিতে আল্লাহর কি কাজ? আল্লাহ পুরস্কারদাতা সর্বজ্ঞ। (আননিসা ৪ : ১৪৪-১৪৭)
ইয়া আল্লাহ! আমরা অন্তর থেকে ঈমান আনছি এবং আপনার শোকর আদায় করছি। আপনি কবুল করুন।
سبحان الله وبحمده عدد خلقه ورضا نفسه وزنة عرشه ومداد كلماته.
رضيت بالله ربا وبالإسلام دينا وبمحمد نبيا
هذا، وصلى الله تعالى وبارك وسلم على سيدنا ومولانا محمد وعلى آله وصحبه أجمعين، والحمد لله رب العالمين. l
মুহাম্মাদ আবদুল মালেক
২৩/০৪/১৪৩৪ হিজরী
০৬/০৩/২০১৩ ঈসাব্দ
বুধবার