অমর বালাকোট-সংগ্রামী : নোয়াখালীর মাওলানা গাজী ইমামুদ্দীন বাঙ্গালী রাহ.
তার নামটাই এসেছে প্রথমে এবং প্রধান হয়ে। তৎকালীন পূর্ববঙ্গ অঞ্চলের প্রেক্ষাপটে। ব্রিটিশকবলিত বাংলা-ভারত উপমহাদেশজুড়ে পরিচালিত স্বাধীনতা সংগ্রাম বা জিহাদ আন্দোলনের তিনি ছিলেন প্রথম সারির একজন কান্ডারি। ১৮২০ সাল থেকে ১৮৩১ সাল পর্যন্ত তিনি সে আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ওতপ্রোতভাবে; নিবেদন, সমর্পণ, সংগঠন ও নেতৃত্ব নিয়ে। আজাদির সংগ্রামে নিবেদিত এই মহান পুরুষের জন্মভিটা ছিল তৎকালীন পূর্ববঙ্গের নোয়াখালীর হাজীপুরে। গবেষক-আলেম গোলাম রসূল মেহেরের গ্রন্থে লেখা হয়েছে, সুধারাম-হাজীপুর। আর ইতিহাস বিশ্লেষক চিন্তাবিদ, দাঈ সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভীর গ্রন্থে উল্লেখ হয়েছে, হাজীপুর-বাংলাদেশ। তিনি ছিলেন বিপ্লব-সাধনা ও আধ্যাত্মিকতার ইমাম, আন্দোলনের প্রাণপুরুষ সাইয়েদ আহমদ শহীদ (রহ.)-এর বিশিষ্ট শিষ্য ও খলীফা। এই আন্দোলন চলাকালে পূর্ববঙ্গ থেকে বিপ্লবী আলেম রিক্রুট এবং পূর্ববঙ্গে সে আন্দোলনের দ্যুতি ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ সবচেয়ে বেশি করেছেন তিনিই।
উনবিংশ শতকের এই দরবেশ বিপ্লবী তার জীবনের শেষ প্রায় দুটি যুগ কাটান নোয়াখালীর সাদুল্লাপুরে। তৎকালীন এক দ্বীনদার দারোগা (ভূস্বামী) সাবের খাঁ স্বেচ্ছায় তার বহু খেদমত করেছেন। ঠাঁই গোজার জন্য তাকে কিছু জায়গা-জমি দিতে চেয়েছেন। তিনি তাতে সম্মত না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত ওই দারোগা তার স্ত্রীর নামে এক প্রকার জোর করে সাদুল্লাপুরের জায়গাটুকু দান করেন। তখন থেকেই তার পরিবার ও বংশধরের বসবাস সাদুল্লাপুরে। সুতরাং আমাদের যেতে হবে সেখানেই। সে হিসেবে দুপুর গড়িয়ে চৌমুহনী থেকে সাদুল্লাপুরের উদ্দেশে যাত্রা। সঙ্গী মাওলানা উমায়ের কোববাদীর সঙ্গে যোগ হয়েছেন আলেম-লেখক নেযামুদ্দীন। এখলাসপুর-মাইজদি হয়ে আসরের সময় আমরা পৌঁছলাম ধন্যপুর মিফতাহুল উলূম মাদরাসার সামনে। অভিজ্ঞ রাহবার হিসেবে সেখানে যুক্ত হলেন ওই মাদরাসার নওজোয়ান মুহাদ্দিস মাওলানা নূরুল আলম।
৯ মার্চের বিকাল। গাছের ছায়াগুলো তখন বেশ দীর্ঘ। মাওলানা গাজী ইমামুদ্দীনের ভিটার মুখে প্রাচীন মসজিদের সামনে এসে দাঁড়ালাম। সামনে ছোট মাঠ ও পুকুর। দক্ষিণ পাশে ঘন গাছ-গাছালিতে ঢাকা অপ্রশস্ত কবরস্থান। সীমানা প্রাচীর দিয়ে ঘেরাও করা। এই কবরস্থানে শুয়ে আছেন তার স্ত্রী, মেয়েরা। শুয়ে আছেন শত বছর আগে চলে যাওয়া তার পরিবারের আরও ক’জন মুরবিব। কিন্তু তিনি এখানে নেই। এ মসজিদ তার আমলে তাকে কেন্দ্র করেই নির্মিত। এই ভিটা তাকে ঘিরেই এখন জনবসতি। তার জীবন ও জীবনের ঘটনা নিয়ে বহু কিংবদন্তি এই দহলিজে বিচরণ করছে। এর সবকিছুর সঙ্গেই তার স্মৃতির পরশ আছে, কেবল তার কবরটি এখানে নেই।
তিনি আর কেউ নন, বিখ্যাত আলেম-দরবেশ ও যোদ্ধা মাওলানা গাজী ইমামুদ্দীন বাঙ্গালী (রহ.)। দুঃখ-সুখের এক অপার্থিব জীবন ছিল তার।
দুই.
১৭৮৮ সালে নোয়াখালীর হাজীপুরে ইমামুদ্দীনের জন্ম। ৩ বছর বয়সে এতীম হয়ে যান। তার আম্মার আবার বিয়ে হয়। অবহেলা ও বঞ্চনার জীবন কাটে তার শৈশব-কৈশোরে। মমতাময়ী মায়ের চোখের পানিতে অনুমোদনের রোদ দেখে দ্বীনী শিক্ষা অর্জনের জন্য পথে নামেন। নোয়াখালী, ঢাকা হয়ে কলকাতায় যান। কোন কোন মাদরাসায় পড়েছেন এখন আর জানা যায় না। লেখাপড়ার শেষ প্রান্তে তিনি শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন দিল্লীর মাদরাসায়ে রহিমিয়ায় উপমহাদেশের শীর্ষ আলেম শাহ আবদুল আযীয (রহ.)-এর। এই শাহ আবদুল আযীযের শিষ্য সাইয়েদ আহমদ শহীদ (রহ.) নিজেও। সাইয়েদ সাহেবের বিশিষ্ট দুজন অনুসারী শাহ ইসমাইল (রহ.) ও শাহ আবদুল হাই (রহ.)ও তার শিষ্য ছিলেন। বাংলাদেশে শাহ আবদুল আযীযের সরাসরি শিষ্য সম্ভবত গাজী মাওলানা ইমামুদ্দীন ছাড়া আর কেউ নেই। শাহ আবদুল আযীয ছিলেন উপমহাদেশের মুসলিম চিন্তানায়ক মনীষী-আলেম শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী (রহ.)-এর ছেলে। তিনিই প্রথম ব্রিটিশকবলিত ভারতবর্ষকে ‘দারুল হরব’ বা শত্রুকবলিত দেশ হিসেবে ফতোয়া দেন এবং তার আধ্যাত্মিক দীক্ষাপ্রাপ্ত শাগরিদ সাইয়েদ আহমদ শহীদকে ভারতবর্ষ মুক্ত করার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করেন।
দিল্লীতে থাকাকালে প্রায় ত্রিশ বছর বয়সী যুবক ইমামুদ্দীন সাইয়েদ আহমদ শহীদের সঙ্গে দেখা করেন। তখন অনেকেই তার কাছে মুরিদ হচ্ছিলেন। ইমামুদ্দীন সে সময়ে মুরিদ হননি। তিনি তার মুরিদ হন লাখনৌর এক বাইয়াতের মজলিসে, আকস্মিক সিদ্ধান্তে। এরপর ৩ দিন কাটে তার প্রায় বেহুশের মতো, মজযুব অবস্থায়। তখন থেকেই তার মুর্শিদ সাইয়েদ আহমদ শহীদের সঙ্গে তিনি সার্বক্ষণিকভাবে যুক্ত হয়ে পড়েন। প্রায় সব সফর, সব অভিযান ও সংগ্রামে তিনি তার সঙ্গেই ছিলেন; একদম ১৮৩১ সালের বালাকোট পর্যন্ত। ১৮২২ সালের কলকাতা সফর এবং সেখান থেকে হজ্বের সফরেও তার উপস্থিতির বর্ণনা রয়েছে। সে সময় তিনি কলকাতা থেকে সাইয়েদ সাহেবের অনুমতি নিয়ে নোয়াখালী আসেন তার আম্মার সঙ্গে দেখা করতে। সাইয়েদ সাহেব হজ্বের সফরে তার আম্মাকে নিয়ে আসতে বললেও বিশেষ অপারগতায় তার আম্মা যেতে পারেননি। তিনি তখন নোয়াখালী ও পাশর্ববর্তী অঞ্চলের ৪০ জন বিপ্লবী মুজাহিদকে নিয়ে কলকাতায় ফেরেন। তারপর কাফেলার সঙ্গে হজ্বে যান। তার অবস্থান বেশিরভাগ সময়েই থাকত সাইয়েদ সাহেবের কাছাকাছি। সাহস, আনুগত্য, আস্থা আর নিবেদনের যোগ্যতার কারণে দায়িত্বপূর্ণ বহু কাজে তাকে গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় রাখা হতো। ১৮২৯ সালে পাঞ্জতারে নির্মিত দুর্গে তার কামরা আর সাইয়েদ সাহেবের কামরার মাঝে ছিল আরেকটি কামরা। মাঝের কামরাটি ছিল ঠিকানা ও সূত্র না জানা আরেক বাঙ্গালী সাধক-বিপ্লবী ওয়ারেস আলী বাঙ্গালীর। গোলাম রসুল মেহের তার গ্রন্থে পাঞ্জতার দুর্গের যে নকশাটি দিয়েছেন তাতে অবস্থান ও নামের তালিকায় এ বিষয়টি দেখা গেছে। ২০ জনের ওই তালিকার ১৮ নমবর নামটি ছিল নূর মুহাম্মদ বাঙ্গালীর। অর্থাৎ সুফী নূর মুহাম্মদ নিজামপুরী রাহ.-এর। বাংলা-ভারত সর্বব্যাপী ওই আন্দোলনে অন্য অঞ্চলের মতো বাংলা অঞ্চলের বিপ্লবী মুজাহিদদের নামের সঙ্গে ‘বাঙ্গালী’ শব্দটি যুক্ত করেছেন ঐতিহাসিকরা। সম্ভবত এ শব্দটি মুজাহিদগণের নিজেদের মধ্যেও ব্যবহৃত হত। পরিচয়ের সুবিধার্থে ব্যবহৃত বাঙ্গালী শব্দটি তাদের নামের অংশ হয়ে গিয়েছিল।
বালাকোটের পর তিনি নোয়াখালী ফিরে আসেন। তখন তিনি ছিলেন অর্থ-বিত্তহীন, নাম-ডাকমুক্ত অতি সাধারণ প্রায়-পৌঢ় একজন মানুষ। তার ভেতরের অবস্থা তাকে দেখে বোঝা যেত না। তিনি ছিলেন বড় আলেমে দ্বীন, বড় বিপ্লবী-মুজাহিদ, বড় আল্লাহওয়ালা দরবেশ। তার স্বরূপ যখন ধীরে ধীরে প্রকাশ হতে থাকে তখন তার চারপাশে দ্বীনপাগল মানুষেরা এসে ভিড় করেন। তার জীবন যাপন ও দ্বীনী কাজে সহায়ক হিসেবে বহু মানুষ নিজেদের নিবেদন করেন। নোয়াখালী ফিরে আসার পর তার কামাল ও মহত্বের বিষয়টি কিছুদিনের মধ্যে সংশ্লিষ্টজনদের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে। তার জীবনের বহু কারামতের ঘটনা তাই লোকের মুখে মুখে চর্চা হয়। কিন্তু ফিরে আসার পর প্রথম পর্যায়ে অপরিচিতিজনিত অনেক রকম প্রতিকূলতার মধ্যে তাকে পড়তে হয়েছে। তার বিয়ের জন্য তিনি একা যান তৎকালীন বড় বুযুর্গ রামগতির চাঁদশাহ ফকীর (রহ.)-এর বাড়িতে। তার মেয়ের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। অপরিচিতি ও মুরবিব না থাকার কারণে প্রথমে তার কাছে মেয়ে বিয়ে দেওয়া নিয়ে সংশয় প্রকাশিত হলেও পরে তার তাৎক্ষণিক বুযুর্গি, শরাফত ও কারামত দেখে মুগ্ধতার সঙ্গে তার কাছে মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটে। এ বিষয়ে পারিবারিক পরম্পরাসূত্রে সুন্দর কিছু ঘটনার কথাও জানা যায়। মাসিক আলকাউসার-এর সম্পাদক ও তত্ত্ববধায়ক মুফতী আবুল হাসান মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ ছাহেব ও মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক ছাহেবের মুহতারামা আম্মাজান তার বড় ছেলেকে জানিয়েছেন, মাওলানা গাজী ইমামুদ্দীন (রহ.) ছিলেন তাঁর নানুর খালু। সে কারণেই মুরবিব পরম্পরায় তারা মৌখিকভাবে গাজী সাহেবের বিবাহ ও পরবর্তী সময়ের কিছু কিছু ঘটনা শুনেছেন। এসব ঘটনায় প্রমাণিত হয়, গাজী ইমামুদ্দীন (রহ.) একজন ছাহেবে কারামত মুস্তাজাবুদ্দাওয়াত বুযুর্গ ছিলেন। সমকালে নিজ অঞ্চলে তিনি সব মহলের কাছে বরেণ্য, সম্মানীয় ও সমাদৃত ছিলেন।
দেশে ফিরে আসার পর স্থানীয়ভাবে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে তার যুক্ত হওয়ার লিখিত কোনো বর্ণনা পাওয়া যায় না। কিন্তু মৌখিকভাবে জানা যায়, ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামে বৃহত্তর নোয়াখালী, চট্টগ্রাম ও কুমিল্লা অঞ্চলে ধর্মপ্রাণ মানুষকে উদ্দীপ্ত ও সংগঠিত করার পেছনে তিনি আজীবন ভূমিকা রেখে গেছেন। তার প্রকাশ্য তৎপরতা ছিল ইসলামী শিক্ষা বিস্তার ও শুদ্ধ, সুস্থ দ্বীনী জীবনে মানুষকে দীক্ষাদান। একজন অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন সাধক দরবেশ হিসেবে তার নাম এখনও বৃহত্তর নোয়াখালীর ধর্মপ্রাণ মানুষের ঘরে ঘরে উচ্চারিত হয়। সাইয়েদ আহমদ শহীদের আরেক খলীফা কারামত আলী জৌনপুরী (রহ.) বাংলা অঞ্চলে ইসলামের দাওয়াতের কাজে এলে পরবর্তী সময়ে প্রবীণ এই পীর ভাইয়ের কাছে উপদেশ ও সংস্রব গ্রহণ করতেন। তার কাছে ‘সিরাতুল মুস্তাকীম’ গ্রন্থের পাঠও গ্রহণ করতেন। নৌকায় চড়ে তিনি সাদুল্লাপুরে এসে উঠতেন। ১৮৫০ সালের দিকে নোয়াখালী অঞ্চলে গাজী ইমামুদ্দীনের বহু মুরিদ-অনুসারী, খলীফা গড়ে ওঠেন। এদেরই একজন ছিলেন এদেশের বরেণ্য বুযুর্গ হযরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর দাদা লক্ষ্মীপুরের লুধুয়া নিবাসী মাওলানা আকরামুদ্দীন মিয়াজী (রহ.)।
গোলাম রসুল মেহের লিখেছেন, গাজী ইমামুদ্দীন (রহ.) শেষ জীবন কাটিয়েছেন রাজস্থানের টোঁকের নবাব ওয়াযিরুদ্দৌলার মেহমানদারিতে। কিন্তু বালাকোট পূর্বাপর তথ্য সমন্বয় করে দেখলে মনে হয়-টোঁকে গাজী সাহেবের অবস্থানের ঘটনাটি ঘটেছে বালাকোটের পর পর। এরপর তিনি দেশে ফিরে এসেছেন এবং এখানেই সংসার যাপন ও হেদায়াতের কাজ করেছেন। ১৮৫৮ সালে তিনি নিজ উদ্যোগে সংগঠিত কাফেলা নিয়ে দ্বিতীয়বার হজ্বে যান এবং ফেরার পথে ১৮৫৯ সালে এডেনের কাছে জাহাজে তার ইন্তেকাল হয়। জাহাজের মধ্যে সফরসঙ্গী হাজী সাহেবগণ ইহরামের কাপড়ের কাফন পরিয়ে নামাযে জানাযা পড়ে পাথর বেঁধে তার লাশ সমুদ্রে নামিয়ে দেন। জিহাদ আন্দোলনে পূর্ববঙ্গের প্রধান কান্ডারি এই বিপ্লবী দরবেশের সলিলসমাধি হয় আরব সাগরের এক অজ্ঞাত জায়গায়। তার কবর খুঁজে বের করার এবং কবরের সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর সাধ্য আর কারও নেই। লোক পরম্পরায় শোনা যায়, শেষ জীবনে তিনি প্রকাশ্যে দুআ করেছেন ও আকাঙ্খা ব্যক্ত করেছেন তার কবর যেন লোকেরা খুঁজে না পায়। আল্লাহ তার দুআ কবুল করেছেন। জানা যায়, একই দুআ করেছিলেন তার মুর্শিদ সাইয়েদ আহমদ শহীদ (রহ.)। এ জন্য বালাকোটে শহীদ হওয়ার পর তার লাশ খুঁজে পাওয়া যায়নি। একদল মানুষ বহুদিন পর্যন্ত বিশবাস করত, তিনি বেঁচে আছেন, আত্মগোপন করে আছেন, সময় হলেই প্রকাশ হবেন।
বালাকোটে শহীদ বিপ্লবী মুজাহিদদের তালিকায় বেশ কয়েকজন বাঙ্গালীর নাম রয়েছে। এদের বেশিরভাগই ছিলেন গাজী ইমামুদ্দীনের রিক্রুট। এদেরই একজন ছিলেন তার আপন ভাই-আলীমুদ্দীন শহীদ (রহ.)। ধারণা করা হয় হাজীপুরের এই আলীমুদ্দীন ছিলেন তার বৈপিতৃয় ভাই।
গাজী মাওলানা ইমামুদ্দীন (রহ.)-এর ওপর ড. শাহ মুহাম্মদ শফীকুল্লাহ ইসলামী বিশ্বকোষের ৫ম খন্ডে (দ্বিতীয় সংস্করণ) নাতিদীর্ঘ একটি নিবন্ধ লিখেছেন। অধ্যাপক ড. আহসানুল্লাহ ফয়সাল এ বিষয়ে গবেষণার কাজ চালু রেখেছেন। বাংলা একাডেমী প্রকাশিত ‘চরিতাভিধান’-এ অনুর্ধ্ব মাত্র ১০০ শব্দের একটি ছোট নিবন্ধও রয়েছে তার ওপর।
তিন.
প্রখ্যাত গবেষক মাওলানা গোলাম রসূল মেহের হযরত সাইয়েদ আহমদ শহীদ (রহ.) এবং জিহাদ আন্দোলন নিয়ে লিখিত তার তৃতীয় খন্ডের গ্রন্থটির নাম রেখেছেন, ‘জামাআতে মুজাহিদীন’। এ গ্রন্থে জিহাদ আন্দোলনে অংশ নেওয়া বিপ্লবী মুহাজিদগণের জীবন নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তাতে মাওলানা গাজী ইমামুদ্দীন (রহ.) সম্পর্কে প্রায় দেড় পৃষ্ঠার একটি বিবরণ দেওয়া হয়েছে। আল্লামা সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী (রহ.) লিখিত ‘কারাওয়ানে ঈমান ওয়া আযীমত’ গ্রন্থে ইমামুদ্দীন (রহ.) সম্পর্কিত আলোচনাটি একই রকম। সে আলোচনায় সাইয়েদ সাহেবের কাছে বায়আত হওয়ার ঘটনা থেকে নিয়ে তার আধ্যাত্মিক উচ্চতা বিষয়ক বিশ্বস্ত বিবরণ রয়েছে। এখানে গোলাম রসূল মেহের লিখিত আলোচনাটি তুলে ধরা হল-‘মওলবী ইমামুদ্দীন জেলা সুধারাম, (বর্তমান নোয়াখালীর) হাজীপুর গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন। শাহ আবদুল অযীয মুহাদ্দিসে দেহলভীর কাছ থেকে তিনি শিক্ষা লাভ করেন। সাইয়েদ সাহেব রাজপুতানা থেকে দিল্লী পৌছলে বহু লোক বায়আত করতে শুরু করেন। মওলবী ইমামুদ্দীনও তার মজলিসে বসতেন ও আলাপ-আলোচনা করতেন, কিন্তু বায়আতের দিতে তার আগ্রহ দেখা যেতো না। কিছুদিন পর সাইয়েদ সাহেব রায়বেরেলী থেকে লাখনৌ গেলেন ও সেখানে কয়েক মাস থাকলেন। মওলবী ইমামুদ্দীনও সেখানে এলেন। সাইয়েদ সাহেব বায়আত নেওয়ায় ব্যস্ত হলেন। এসব দেখে মওলবী ইমামুদ্দীনের মনে ভাবান্তর হলো এবং তিনি বায়আত করার জন্য তৈরি হলেন। প্রায় তিন দিন তিনি অচেতন হয়ে থাকলেন। কেবল নামাযের সময়ে কিছুটা সংজ্ঞা ফিরে আসতো। তখন থেকে তিনি সব সময়ের জন্য সাইয়েদ সাহেবের সাহচর্যে থাকতেন। তার শাহাদাত পর্যন্ত তিন তার সাহচর্য ত্যাগ করেননি। সাধারণত ‘তাওয়াজ্জুহ’ দেওয়া প্রসঙ্গে তাঁর উল্লেখ দেখা যায়। অর্থাৎ সাইয়েদ সাহেবের কাছে যারা বায়আতে তওবা করতেন, তাদেরকে ‘তাওয়াজ্জুহ’ দেবার হুকুম হতো মওলবী সাহেবের উপর। চার সদায় সাইয়েদ মীর খান দুররানীকে তিনি তাওয়াজ্জুহ দিয়েছিলেন।
নওয়াব ওয়াযিরুদৌলা ‘ওসায়া’ গ্রন্থে লিখেছেন যে, মওলবী সাহেব ‘সীরাতুল মুসতাকীম’ কয়েকবার খোদ সাইয়েদ সাহেবের কাছে পড়েছিলেন। পাঠদানের সময় সাইয়েদ সাহেব (রহ.) বিচিত্র তাৎপর্য উদঘাটন করতেন। মওলবী ইমামুদ্দীন সকল তাৎপর্য অন্তরে সংরক্ষণ করতেন এবং এই কিতাবের ব্যাখ্যা সম্পর্কে তিনি বিশেষ উপলব্ধি হাসিল করেছিলেন।
হজ্বের সফরকালে তিনি রায়বেরেলী থেকে সাইয়েদ সাহেবের সাথে বেরিয়ে যান। কলকাতায় পৌঁছলে তিনি এজাযত নিয়ে মাতাকে দেখার জন্য গৃহে চলে যান। সাইয়েদ সাহেব মাতাকেও হজ্বের জন্য সাথে নিয়ে আসতে বলে দিলেন। তার আম্মা এলেন না, কিন্তু তাঁর সাথে ত্রিশ-চল্লিশজন লোক যিয়ারত ও বায়আতের উদ্দেশ্যে এলেন। ...
প্রত্যাবর্তন
বালাকোটের পর মওলবী সাহেব দেশে ফিরে আসেন। তারপর টোঁকে বসতি স্থাপন করেন। নওয়াব ওয়াযিরুদ্দৌলা ‘সীরাতুল মুসতাকীম’ তার কাছে পড়েছিলেন। নওয়াবের গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ ‘ওসায়া’ প্রণয়নকালে মওলবী সাহেব জীবিত ছিলেন। নওয়াব সাহেব লিখেছেন : ‘তিনি উপদেশ দান কার্যে নিযুক্ত রয়েছেন এবং বহু লোক তার হেদায়াত থেকে কল্যাণ লাভ করেছেন। বহুবার দেখেছি, যিকরে জেহরের তালীমের সময়ে যখনই আল্লাহর পবিত্র নাম মুখে আসতো, তখন বাইরের চেতনা বিলুপ্ত হয়ে অন্তরের আলোকে তিনি নিমজ্জিত হতেন। তার ভাই আলীমুদ্দীনও জিহাদে শরীক ছিলেন এবং বালাকোটের যুদ্ধে শহীদ হন।’
চার.
গাজী ইমামুদ্দীন বাঙ্গালী (রহ.)-এর পঞ্চম প্রজন্মের একজন ৬৪ বছর বয়সী শাহাবুদ্দীন মাহমুদ। আমাদের নিয়ে মসজিদের সামনে বসলেন। তার সঙ্গে তার ভাগ্নে ফিরোজউদ্দীন এবং ফিরোজউদ্দীনের ছেলে মাদরাসার কাফিয়া জামাতে অধ্যয়নরত হাফেজ ইজহারুদ্দীন। পরিবারের পক্ষ থেকে দীর্ঘদেহী বৃদ্ধ শাহাবুদ্দীন এখন এই মসজিদের মোতোওয়াল্লী। গাজী সাহেবের স্মৃতিমূলক কোনো কিছু দেখতে চাওয়ায় আমাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী তিনি বাড়ির ভেতর থেকে নিয়ে এলেন দুটি ছিন্ন পুরনো পোশাক। গাজী সাহেব গায়ে দিতেন। একটি পিতলের বদনা এবং যুদ্ধে ব্যবহৃত তলোয়ারের একটি অংশ। মরিচা ধরে ক্ষয়ে যেতে যেতে এটি ছোট হয়ে গেছে; এখন দেখায় চাকুর মতো। এসবই গাজী সাহেব ব্যবহার করতেন। প্রচন্ড কৌতূহল নিয়ে আমরা জিনিসগুলো দেখলাম। গাজী সাহেবের জীবনী রচনায় কাজে লাগবে অপ্রাপ্ত এমন কোনো তথ্য অবশ্য তার কাছে পেলাম না। তিনি জানালেন, গাজী সাহেব শারীরিক গঠনের দিক থেকে ছিলেন দীর্ঘদেহী।
মাগরিবের আযান হতে দশ মিনিট বাকি, পথে এসে দাঁড়ালাম। সামনেই শুকিয়ে যাওয়া নদী। এটাকে বলা হয় নোয়াখালী খাল। এ খালই ছিল এক সময় চলাচলের পথ। একশ’ ষাট-সত্তর বছর আগে নিশ্চয়ই গাজী ইমামুদ্দীন বাঙ্গালী (রহ.) এ খাল দিয়েই দাওয়াত, সংস্কার ও সংগ্রামের কাজে এদিক ওদিক যেতেন। মাওলানা কারামত আলী জৌনপুরী (রহ.) নৌকায় চড়ে এ পথেই সাদুল্লাপুর আসতেন। তখন নদী কেমন ছিল, দিন কেমন ছিল, মানুষ ও মানুষের মন কেমন ছিল? ঈমান, সাহস ও স্বাধীনতার আকাঙ্খায় উজ্জীবিত সেসব অধ্যায়ের কথা আমরা কি ফিরে দেখার চেষ্টা করব না? নাকি বিস্মৃতির ভারী চাদর দিয়ে স্বাধীনতা ও মানবিকতার সে শুভ্র আকাশটাকে ঢেকে রাখার চেষ্টাই করে যাব সারাজীবন? আমাদের মনে হয় আরেকবার ভেবে দেখা দরকার।