ঈমান সবার আগে-২
১৩. ঈমানের সবচেয়ে বড় রোকন তাওহীদ, শিরক মিশ্রিত ঈমান আল্লাহর কাছে ঈমানই নয়
ঈমানের সর্বপ্রথম রোকন হচ্ছে ‘ঈমান-বিল্লাহ’ (আল্লাহর উপর ঈমান)। আর ঈমান বিল্লাহর প্রথম কথা হচ্ছে, আল্লাহ তাআলার অস্তিত্ব স্বীকার করা, একমাত্র তাঁকেই ‘রব’ ও সত্য মাবুদ বলে মানা, রুবুবিয়্যত ও উলূহিয়্যতের বিষয়ে তাঁর সাথে কাউকে শরীক না করা। একমাত্র আলিমুল গাইব, হাজির-নাজির, মুখতারে কুল (সব বিষয়ে নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী), মুশকিল কুশা (সংকট মোচনকারী) বিপদাপদে তাঁকেই ত্রাণকারী মনে করবে। তাঁর বিশেষ হক ও একান্ত বৈশিষ্ট্যসমূহে কাউকে শরীক করবে না। সাধারণ কার্যকারণ ও উপায়-উপকরণের উর্ধ্বের বিষয়ে আল্লাহ ছাড়া কারো কাছে সাহায্য প্রার্থনা করবে না। দৃঢ় বিশ্বাস রাখবে যে, জীবন-মৃত্যু, উপকার-অপকার, সুস্থতা ও নিরাপত্তা একমাত্র তাঁরই হাতে। তিনিই তা দান করেন। রিযিকদাতা একমাত্র তিনি। গোটা জগতের এক, অদ্বিতীয় স্রষ্টা ও নিয়ন্ত্রকও তিনিই। শরীয়ত দান ও হালাল-হারাম নির্ধারণ তাঁরই অধিকার। এতে কাউকে শরীক করবে না- না কোনো ইজম বা মতবাদকে, না কোনো নেতা বা দলকে, না রাষ্ট্র বা সম্প্রদায়কে। মোটকথা, তাওহীদকে পূর্ণরূপে ধারণ করা ও শিরক থেকে পুরাপুরি বেঁচে থাকা ঈমানের সবচেয়ে বড় রোকন। আল্লাহ তাআলার কাছে মুশরিকের ঈমান ঈমানই নয়। মুশরিককে তিনি কখনো মাফ করেন না।
মুশরিকের বিষয়ে আল্লাহ তাআলার অভিযোগ তো এটাই যে, সে ঈমানের সাথে শিরক মিশ্রিত করে।
وَمَا يُؤْمِنُ أَكْثَرُهُمْ بِاللَّهِ إِلَّا وَهُمْ مُشْرِكُونَ l أَفَأَمِنُوا أَنْ تَأْتِيَهُمْ غَاشِيَةٌ مِنْ عَذَابِ اللَّهِ أَوْ تَأْتِيَهُمُ السَّاعَةُ بَغْتَةً وَهُمْ لَا يَشْعُرُونَ l قُلْ هَذِهِ سَبِيلِي أَدْعُو إِلَى اللَّهِ عَلَى بَصِيرَةٍ أَنَا وَمَنِ اتَّبَعَنِي وَسُبْحَانَ اللَّهِ وَمَا أَنَا مِنَ الْمُشْرِكِينَ
* তাদের অধিকাংশ আল্লাহ্য় বিশ্বাস করে, কিন্তু তাঁর শরীক করে। * তবে কি তারা আল্লাহর সর্বগ্রাসী শাস্তি থেকে অথবা তাদের অজ্ঞাতসারে কিয়ামতের আকস্মিক উপস্থিতি থেকে নিরাপদ?
* বল, ‘এটাই আমার পথ : আল্লাহর প্রতি মানুষকে আমি আহবান করি সজ্ঞানে-আমি এবং আমার অনুসারীগণও। আল্লাহ্ মহিমান্বিত এবং যারা আল্লাহর শরীক করে আমি তাদের অন্তর্ভুক্ত নই।’-ইউসুফ (১২) : ১০৬-১০৮
আল্লাহ তাআলার দাবি সবসময় এটাই ছিল এবং কিয়ামত পর্যন্ত এটাই থাকবে যে, ‘আল্লাহর প্রতি ঈমান যেন’ খাঁটি তাওহীদের সাথে হয় এবং সব ধরনের শিরকের মিশ্রণ থেকে পাক সাফ হয়। কিছু আয়াত দেখুন :
قُلْ إِنِّي أُمِرْتُ أَنْ أَعْبُدَ اللَّهَ مُخْلِصًا لَهُ الدِّينَ l وَأُمِرْتُ لِأَنْ أَكُونَ أَوَّلَ الْمُسْلِمِينَ
* বল, ‘আমি তো আদিষ্ট হয়েছি, আল্লাহর আনুগত্যে একনিষ্ঠ হয়ে তাঁর ‘ইবাদত করার; * আর আদিষ্ট হয়েছি, আমি যেন আত্মসমর্পণকারীদের অগ্রণী হই।’-আযযুমার (৩৯) : ১১-১২
أَمِ اتَّخَذُوا آَلِهَةً مِنَ الْأَرْضِ هُمْ يُنْشِرُونَ l لَوْ كَانَ فِيهِمَا آَلِهَةٌ إِلَّا اللَّهُ لَفَسَدَتَا فَسُبْحَانَ اللَّهِ رَبِّ الْعَرْشِ عَمَّا يَصِفُونَ l لَا يُسْأَلُ عَمَّا يَفْعَلُ وَهُمْ يُسْأَلُونَ l أَمِ اتَّخَذُوا مِنْ دُونِهِ آَلِهَةً قُلْ هَاتُوا بُرْهَانَكُمْ هَذَا ذِكْرُ مَنْ مَعِيَ وَذِكْرُ مَنْ قَبْلِي بَلْ أَكْثَرُهُمْ لَا يَعْلَمُونَ الْحَقَّ فَهُمْ مُعْرِضُونَ l وَمَا أَرْسَلْنَا مِنْ قَبْلِكَ مِنْ رَسُولٍ إِلَّا نُوحِي إِلَيْهِ أَنَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا أَنَا فَاعْبُدُونِ
* তারা মৃত্তিকা থেকে তৈরি যেসব দেবতা গ্রহণ করেছে সেগুলো কি মৃতকে জীবিত করতে সক্ষম? * যদি আল্লাহ ব্যতীত বহু ইলাহ থাকত আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীতে, তবে উভয়ই ধ্বংস হয়ে যেত। অতএব তারা যা বলে তা থেকে ‘আরশের অধিপতি আল্লাহ পবিত্র, মহান। * তিনি যা করেন সে বিষয়ে তাঁকে প্রশ্ন করা যাবে না; বরং তাদেরকেই প্রশ্ন করা হবে। * তারা কি তাঁকে ছাড়া বহু ইলাহ গ্রহণ করেছে? বল, ‘তোমরা তোমাদের প্রমাণ উপস্থিত কর। এটাই, আমার সাথে যারা আছে তাদের জন্য উপদেশ এবং এটাই উপদেশ ছিল আমার পূর্ববর্তীদের জন্য।’ কিন্তু তাদের অধিকাংশই প্রকৃত সত্য জানে না, ফলে তারা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। * আমি তোমার পূর্বে এমন কোনো রাসূল প্রেরণ করিনি তার প্রতি এই ওহী ছাড়া যে, ‘আমি ছাড়া অন্য কোনো ইলাহ্ নেই; সুতরাং আমারই ‘ইবাদত কর।’-আল আম্বিয়া (২১) : ২১-২৫
وَمَا تَفَرَّقَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ إِلَّا مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَتْهُمُ الْبَيِّنَةُ l وَمَا أُمِرُوا إِلَّا لِيَعْبُدُوا اللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ حُنَفَاءَ وَيُقِيمُوا الصَّلَاةَ وَيُؤْتُوا الزَّكَاةَ وَذَلِكَ دِينُ الْقَيِّمَةِ l إِنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا مِنْ أَهْلِ الْكِتَابِ وَالْمُشْرِكِينَ فِي نَارِ جَهَنَّمَ خَالِدِينَ فِيهَا أُولَئِكَ هُمْ شَرُّ الْبَرِيَّةِ
* যাদেরকে কিতাব দেওয়া হয়েছিল তারা তো বিভক্ত হল তাদের নিকট সুস্পষ্ট প্রমাণ আসার পর। * তারা তো আদিষ্ট হয়েছিল আল্লাহর আনুগত্যে বিশুদ্ধচিত্ত হয়ে একনিষ্ঠভাবে তাঁর ‘ইবাদত করতে এবং সালাত কায়েম করতে ও যাকাত দিতে, এ-ই সঠিক দ্বীন। * কিতাবীদের মধ্যে যারা কুফরী করে তারা এবং মুশরিকরা জাহান্নামের আগুনে স্থায়ীভাবে অবস্থান করবে; তারাই সৃষ্টির অধম।-আলবায়্যিনাহ (৯৮) : ৪-৬
اتَّخَذُوا أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِنْ دُونِ اللَّهِ وَالْمَسِيحَ ابْنَ مَرْيَمَ وَمَا أُمِرُوا إِلَّا لِيَعْبُدُوا إِلَهًا وَاحِدًا لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ سُبْحَانَهُ عَمَّا يُشْرِكُونَ l يُرِيدُونَ أَنْ يُطْفِئُوا نُورَ اللَّهِ بِأَفْوَاهِهِمْ وَيَأْبَى اللَّهُ إِلَّا أَنْ يُتِمَّ نُورَهُ وَلَوْ كَرِهَ الْكَافِرُونَ l هُوَ الَّذِي أَرْسَلَ رَسُولَهُ بِالْهُدَى وَدِينِ الْحَقِّ لِيُظْهِرَهُ عَلَى الدِّينِ كُلِّهِ وَلَوْ كَرِهَ الْمُشْرِكُونَ
* তারা আল্লাহ ছাড়া তাদের পন্ডিতগণকে ও সংসার-বিরাগীগণকে তাদের প্রভুরূপে গ্রহণ করেছে এবং মারইয়াম-তনয় মসীহকেও। কিন্তু তারা এক ইলাহের ‘ইবাদত করার জন্যই আদিষ্ট হয়েছিল। তিনি ছাড়া অন্য কোনো ইলাহ নেই। তারা যাকে শরীক করে তা থেকে তিনি কত পবিত্র! * তারা তাদের মুখের ফুৎকারে আল্লাহর জ্যোতি নিভিয়ে দিতে চায়। কাফিরগণ অপ্রীতিকর মনে করলেও আল্লাহ তাঁর জ্যোতির পূর্ণ উদ্ভাসন ছাড়া অন্য কিছু চান না। * মুশরিকরা অপ্রীতিকর মনে করলেও অন্য সকল দ্বীনের উপর জয়যুক্ত করার জন্য তিনিই পথনির্দেশ ও সত্য দ্বীনসহ তাঁর রাসূল পাঠিয়েছেন।-আত তাওবা (৯) : ৩১-৩৩
আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করা হারাম। এর দ্বারা ঈমান নষ্ট হয়ে যায় এবং মানুষ কাফির ও মুশরিক হয়ে যায়। তা সে পাথর বা মূর্তিকে শরীক করুক কিংবা জিন্ন ও শয়তানকে করুক; অথবা ফেরেশতাদেরকে করুক, কিংবা কোনো নবী ও রাসূলকে শরীক করুক, যাঁদেরকে আল্লাহ তাআলা পাঠিয়েছেন তাওহীদ গ্রহণ ও শিরক বর্জনের পয়গাম দিয়ে। কিংবা এমন কোনো আলিম ও বুযুর্গকে শরীক করুক, যিনি জীবনভর মানুষকে তাওহীদের দাওয়াত দিয়েছেন, কিংবা এমন কোনো নেতা ও গুরুকে শরীক করুক, যে কথা ও কাজের দ্বারা মানুষকে তাওহীদ থেকে নিবৃত্ত রেখেছে। সর্বাবস্থায় শিরক শিরকই বটে আর এতে লিপ্ত ব্যক্তি আল্লাহর দুশমন ও বিদ্রোহী কাফির ও মুশরিক।
কুরআন হাকীমে সব প্রকারের শিরক প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে এবং সকল শ্রেণীর মুশরিককে জাহান্নামের হুঁশিয়ারি শোনানো হয়েছে।
(তরজমা) হে বনী আদম! আমি কি তোমাদের নির্দেশ দিই নাই যে, তোমরা শয়তানের দাসত্ব করো না, কারণ সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু?
* আর আমারই ইবাদত কর, এটাই সরল পথ।-ইয়া সীন (৩৬) : ৬০-৬১
قُلْ يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنْ كُنْتُمْ فِي شَكٍّ مِنْ دِينِي فَلَا أَعْبُدُ الَّذِينَ تَعْبُدُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ وَلَكِنْ أَعْبُدُ اللَّهَ الَّذِي يَتَوَفَّاكُمْ وَأُمِرْتُ أَنْ أَكُونَ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ l وَأَنْ أَقِمْ وَجْهَكَ لِلدِّينِ حَنِيفًا وَلَا تَكُونَنَّ مِنَ الْمُشْرِكِينَ l وَلَا تَدْعُ مِنْ دُونِ اللَّهِ مَا لَا يَنْفَعُكَ وَلَا يَضُرُّكَ فَإِنْ فَعَلْتَ فَإِنَّكَ إِذًا مِنَ الظَّالِمِينَ l وَإِنْ يَمْسَسْكَ اللَّهُ بِضُرٍّ فَلَا كَاشِفَ لَهُ إِلَّا هُوَ وَإِنْ يُرِدْكَ بِخَيْرٍ فَلَا رَادَّ لِفَضْلِهِ يُصِيبُ بِهِ مَنْ يَشَاءُ مِنْ عِبَادِهِ وَهُوَ الْغَفُورُ الرَّحِيمُ
(তরজমা) বল, হে মানুষ! তোমরা যদি আমার দ্বীনের প্রতি সংশয়যুক্ত হও তবে জেনে রাখ তোমরা আল্লাহ ছাড়া যাদের ইবাদত কর আমি তাদের ইবাদত করি না। পরন্তু আমি ইবাদত করি আল্লাহর যিনি তোমাদের মৃত্যু ঘটান এবং আমি মুমিনদের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্য আদিষ্ট হয়েছি।
(আমাকে আরও আদেশ দেয়া হয়েছে যে,) তুমি একনিষ্ঠভাবে দ্বীনে প্রতিষ্ঠিত হও এবং কখনই মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না, এবং আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকেও ডাকবে না, যা তোমার উপকারও করে না, অপকারও করে না, কারণ তা করলে তখন তুমি অবশ্যই জালিমদের অন্তর্ভুক্ত হবে।
এবং আল্লাহ তোমাকে ক্লেশ দিলে তিনি ছাড়া তা মোচনকারী আর কেউ নেই এবং আল্লাহ যদি তোমার মঙ্গল চান তবে তাঁর অনুগ্রহ রদ করবার কেউ নেই। তাঁর বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা তিনি মঙ্গল দান করেন। তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।-সূরা ইউনুস (১০) ১০৪-১০৭
إِنَّ اللَّهَ لَا يَغْفِرُ أَنْ يُشْرَكَ بِهِ وَيَغْفِرُ مَا دُونَ ذَلِكَ لِمَنْ يَشَاءُ وَمَنْ يُشْرِكْ بِاللَّهِ فَقَدِ افْتَرَى إِثْمًا عَظِيمًا
* নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তাঁর সাথে শরীক করা ক্ষমা করেন না। তা ছাড়া অন্যান্য অপরাধ যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন; এবং যে কেউ আল্লাহর শরীক করে সে এক মহাপাপ করে।-আন নিসা (৪) : ৪৮
স্বরণ রাখা উচিত, তাওহীদই হল ঐ বিষয় যার দাওয়াত নিয়ে সকল নবী রাসূলকে আল্লাহ পাঠিয়েছেন, সর্বশেষ নবী ও রাসূল হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকেও এই তাওহীদ প্রতিষ্ঠার জন্যই পাঠিয়েছেন। তাঁর উম্মতেরও এটাই দায়িত্ব। রিব’য়ী ইবনে আমের রা.সহ অন্যান্য সাহাবীদের ভাষায়-
الله ابتعثنا لنخرج من شاء من عبادة العباد إلى عبادة الله ومن ضيق الدنيا إلى سعتها، ومن جور الأديان إلى عدل الإسلام.
অর্থাৎ আল্লাহ আমাদের প্রেরণ করেছেন আল্লাহর বান্দাদেরকে বান্দার গোলামী থেকে মুক্ত করে আল্লাহর ইবাদতে দাখেল করতে। দুনিয়ার সংকীর্ণতা থেকে তার প্রশস্ততার দিকে নিয়ে যেতে এবং সকল ধর্মের জুলুম থেকে মুক্ত করে ইসলামের ইনসাফের ছায়াতলে নিয়ে আসতে।
১৪. ঈমানের দাবি, মুয়ালাত ও বারাআত ঈমানের ভিত্তিতেই হবে
যারা ঈমানের নেয়ামত ও ইসলামের আলো থেকে বঞ্চিত তাদের কাছে বর্ণ, বংশ, ভাষা, ভূখন্ড, সংস্কৃতি, মতবাদ, রাজনৈতিক দল ও দর্শন ইত্যাদি বিভিন্ন মানদন্ডের ভিত্তিতে জাতীয়তা নির্ধারিত হয়, আর এই জাতীয়তাই তাদের কাছে মুয়ালাত ও বারাআত (বন্ধুত্ব ও সম্পর্কচ্ছেদ) এবং পারস্পরিক সাহায্য ও সহযোগিতার মানদন্ড হয়ে থাকে। ইসলামের দৃষ্টিতে এটা সরাসরি জাহেলিয়্যাত। ইসলামের দৃষ্টিতে বর্ণ, বংশ, ভাষা ও ভূখন্ড নির্বিশেষে সকল মুমিন এক জাতি। আর অন্যান্য অমুসলিম বিভিন্ন জাতি হলেও ইসলামের বিপরীতে তারা অভিন্ন জাতি। ‘‘আলকুফরু মিল্লাতুন ওয়াহিদা’’ (সকল কুফর অভিন্ন মিল্লাত) যেমন শরীয়তের দলীল দ্বারা প্রমাণিত তেমনি তা বাস্তবতাও বটে।
ইসলামের শিক্ষায় ‘মুয়ালাত’ ও ‘বারাআত’ (তথা বন্ধুত্ব পোষণ ও বর্জন)-এর মানদন্ড ঈমান। আর পরস্পর সহযোগিতার মানদন্ড ভালো কাজ ও খোদাভীরুতা।
আমি যদি মুমিন হই তাহলে আল্লাহর সব মুমিন বান্দার সাথে আমার বন্ধুত্ব ও ভালবাসা। তা সে যে বর্ণের, যে ভাষার, যে বংশের বা যে দেশেরই হোক না কেন। তার রাজনৈতিক পরিচয়ও যা-ই হোক না কেন। তার সাথে আমার ঈমানী বন্ধুত্ব সর্বাবস্থায় অটুট থাকবে। (উল্লেখ্য, কোনো মুসলমানের রাজনৈতিক দলের সদস্য হওয়ার এবং ঐ দলীয় পরিচিতি বহন করার শরয়ী বিধান কী এবং এতে কী আলোচনা আছে তা এ নিবন্ধের বিষয়বস্ত্ত নয়) মুমিনের সাথে আমার এই বন্ধুত্ব ঈমানের কারণে এবং আল্লাহর জন্য, সাম্প্রদায়িক চেতনা থেকে নয়। একারণে আল্লাহর নাফরমানীর ক্ষেত্রে না তার সঙ্গ দিব, না তার সাহায্য করব। সে যদি কোনো অমুসলিমের উপরও জুলুম করে আমি তার সহযোগিতা করব না; বরং সাধ্যমত তাকে জুলুম থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করব।
আর যে অমুসলিম (দ্বীন ও আখিরাত অস্বীকারকারী কিংবা ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো দ্বীনের অনুসারী যে কোনো কাফির, মুশরিক, মুনাফিক) তার সাথে আমার আল্লাহর জন্যই বিদ্বেষ, কারণ সে আমার, তার ও গোটা জগতের রব আল্লাহর বিদ্রোহী। আর যেহেতু এই শত্রুতা শুধু আল্লাহর জন্য, কোনো সাম্প্রদায়িক চেতনা থেকে নয়, একারণে আমি তার সাথে কখনো না-ইনসাফী করব না; বরং যদি দেখি, সে মজলুম হচ্ছে আর তাকে জুলুম থেকে মুক্ত করার সামর্থ্য আমার আছে তাহলে জুলুম থেকে মুক্ত করতেও আমি পিছপা হব না।
দু’জন লোকের মাঝে হয়তো ভাষা, ভূখন্ড, বর্ণ, গোত্র, আত্মীয়তা ও রাজনৈতিক পরিচয় সব বিষয়ে অভিন্নতা আছে, কিন্তু এদের একজন মুসলিম অন্যজন অমুসলিম, তো এই সকল অভিন্নতার কারণে মুসলিমের উপর অমুসলিমের যে হক্বগুলো সাব্যস্ত হয় তা তো ঐ মুসলিম অবশ্যই আদায় করবেন কিন্তু এদের মাঝে বন্ধুত্বের সম্পর্ক হতে পারে না; বরং মুসলিম তাকে আল্লাহর জন্য দুশমনই মনে করবে যে পর্যন্ত না সে ঈমান আনে ও ইসলাম কবুল করে।
(তরজমা) তোমার জন্য ইবরাহীম ও তার অনুসারীদের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ। যখন তারা তাদের সম্প্রদায়কে বলেছিল, ‘তোমাদের সঙ্গে এবং তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যার ইবাদত কর তার সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। আমরা তোমাদেরকে মানি না। তোমাদের ও আমাদের মধ্যে সৃষ্টি হল শত্রুতা ও বিদ্বেষ চিরকালের জন্য; যদি না তোমরা এক আললাহতে ঈমান আন’।-সূরা মুমতাহিনা ৬০ : ৪
আল্লাহ তাআলার হুকুম :
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا إِنَّ مِنْ أَزْوَاجِكُمْ وَأَوْلَادِكُمْ عَدُوًّا لَكُمْ فَاحْذَرُوهُمْ
* ‘হে মুমিনগণ! তোমাদের স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততিগণের মধ্যে কেউ কেউ তোমাদের শত্রু; অতএব তাদের সম্পর্কে তোমরা সতর্ক থেক।- আত্তাগাবুন (৬৪) : ১৪
এ প্রসঙ্গে কুরআনে হাকীমের শিক্ষা অতি স্পষ্ট। কুরআনে আমাদের মনোযোগের সাথে পাঠ করা উচিত যে, ইবরাহীম আ. তার মুশরিক পিতা আযরের সাথে কী আচরণ করেছিলেন, নূহ আ.-এর কাফির পুত্রের সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা কী বলেছেন। লূত আ.-এর স্ত্রী সম্পর্কে কী বলেছেন আর এর বিপরীতে ফিরাউনের মুমিন স্ত্রী সম্পর্কে কী বলেছেন। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর চাচা আবু তালিবকে কী বলেছেন, যিনি তাঁর সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছিলেন, কিন্তু কুফর ও শিরক থেকে তওবা করে ইসলাম কবুল করেননি। কুরআন কারীম, সীরাতে নববী ও হায়াতুস সাহাবা বিষয়ক গ্রন্থাদিতে এ ধরনের ঘটনা আমাদের বার বার পাঠ করা উচিৎ, যাতে বিষয়টি আমাদের সামনে ভালোভাবে স্পষ্ট হয়ে যায়।
মোটকথা, ‘মুয়ালাত’ (বন্ধুত্ব) ও ‘মুয়াদাত’ (শত্রুতা)-এর মানদন্ড’ দ্বীন ইসলামের অতি গুরুত্বপূর্ণ নীতি। ইসলামে ‘মুয়ালাতের’ মানদন্ড হচ্ছে ঈমান ও ইসলাম আর ‘মুয়াদাত’-এর ভিত্তি শিরক ও কুফর। যে কেউ মুসলিম উম্মাহর অন্তর্ভুক্ত সে শুধু ঈমান ও ইসলামের কারণেই, অন্য কোনো বৈশিষ্ট্য ছাড়াই মুয়ালাতের হক্বদার এবং সকল বাস্তব মানবিক অধিকার ( যার বিধান ইসলাম দিয়েছে, বর্তমান সময়ের অসার, অবাস্তব বা প্রতারণামূলক মৌখিক অধিকার নয়) তার প্রাপ্য। আর যে শিরক বা অন্য কোনো ধরনের কুফর অবলম্বন করেছে (প্রত্যেক কুফর শিরকেরই কোনো না কোনো প্রকার) তার সাথে ‘মুয়ালাত’ হারাম; বরং তা কুফরের চিহ্ন।
অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এই যে, ‘মুয়ালাত’ ও ‘বারাআতে’র এই নীতিতে অন্যদের কথা তো বলাই বাহুল্য, স্বয়ং পিতামাতাও ব্যতিক্রম নন।
আল্লাহ তাআলার ইরশাদ-
وَوَصَّيْنَا الْإِنْسَانَ بِوَالِدَيْهِ حَمَلَتْهُ أُمُّهُ وَهْنًا عَلَى وَهْنٍ وَفِصَالُهُ فِي عَامَيْنِ أَنِ اشْكُرْ لِي وَلِوَالِدَيْكَ إِلَيَّ الْمَصِيرُ l وَإِنْ جَاهَدَاكَ عَلى أَنْ تُشْرِكَ بِي مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ فَلَا تُطِعْهُمَا وَصَاحِبْهُمَا فِي الدُّنْيَا مَعْرُوفًا وَاتَّبِعْ سَبِيلَ مَنْ أَنَابَ إِلَيَّ ثُمَّ إِلَيَّ مَرْجِعُكُمْ فَأُنَبِّئُكُمْ بِمَا كُنْتُمْ تَعْمَلُونَ
* আমি তো মানুষকে তার পিতা-মাতার প্রতি সদাচরণের নির্দেশ দিয়েছি। মা সন্তানকে কষ্টের পর কষ্ট সহ্য করে গর্ভে ধারণ করে এবং তার দুধ ছাড়ান হয় দুই বৎসরে। সুতরাং আমার প্রতি ও তোমার পিতা-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও। প্রত্যাবর্তন তো আমারই নিকট। * তোমার পিতা-মাতা যদি তোমাকে পীড়াপীড়ি করে আমার সমকক্ষ দাঁড় করাতে যে বিষয়ে তোমার কোনো জ্ঞান নেই, তুমি তাদের কথা মেনো না, তবে পৃথিবীতে তাদের সাথে বসবাস করবে সদভাবে এবং যে বিশুদ্ধচিত্তে আমার অভিমুখী হয়েছে তার পথ অবলম্বন কর, অতঃপর তোমাদের প্রত্যাবর্তন আমারই কাছে এবং তোমরা যা করতে সে বিষয়ে আমি তোমাদেরকে অবহিত করব।-লুকমান (৩১) ১৪-১৫
আরো ইরশাদ-
مَا كَانَ لِلنَّبِيِّ وَالَّذِينَ آَمَنُوا أَنْ يَسْتَغْفِرُوا لِلْمُشْرِكِينَ وَلَوْ كَانُوا أُولِي قُرْبَى مِنْ بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُمْ أَنَّهُمْ أَصْحَابُ الْجَحِيمِ l وَمَا كَانَ اسْتِغْفَارُ إِبْرَاهِيمَ لِأَبِيهِ إِلَّا عَنْ مَوْعِدَةٍ وَعَدَهَا إِيَّاهُ فَلَمَّا تَبَيَّنَ لَهُ أَنَّهُ عَدُوٌّ لِلَّهِ تَبَرَّأَ مِنْهُ إِنَّ إِبْرَاهِيمَ لَأَوَّاهٌ حَلِيمٌ
* আত্মীয়-স্বজন হলেও মুশরিকদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা নবী এবং মু’মিনদের জন্য সংগত নয় যখন এটা সুস্পষ্ট হয়ে গিয়েছে যে, নিশ্চিতই এরা জাহান্নামী। * ইবরাহীম তার পিতার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেছিল, তাকে এর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল বলে; অতঃপর যখন তাঁর কাছে এটা সুস্পষ্ট হল যে, সে আল্লাহর শত্রু তখন ইবরাহীম তার সম্পর্ক ছিন্ন করল। ইবরাহীম তো কোমলহৃদয় ও সহনশীল।-আত তাওবা (৯) : ১১৩-১১৪
সূরা মুজাদালায় ‘মুয়ালাত’ ও ‘বারাআতে’র উপরোক্ত নীতি অত্যন্ত স্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে।
ইরশাদ হয়েছে-
* তুমি কি তাদের প্রতি লক্ষ কর নাই যারা, আল্লাহ যে সম্প্রদায়ের প্রতি রুষ্ট, তাদের সাথে বন্ধুত্ব করে? তারা তোমাদের দলভুক্ত নয়, তাদের দলভুক্তও নয় এবং তারা জেনে শুনে মিথ্যা শপথ করে।
* আল্লাহ তাদের জন্য প্রস্ত্তত রেখেছেন কঠিন শাস্তি। তারা যা করে তা কত মন্দ! * তারা তাদের শপথগুলোকে ঢাল স্বরূপ ব্যবহার করে, আর তারা আল্লাহর পথ হতে নিবৃত্ত করে; অতএব তাদের জন্য রয়েছে লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি। * আল্লাহর শাস্তির মুকাবিলায় তাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি তাদের কোনো কাজে আসবে না; তারাই জাহান্নামের অধিবাসী, সেখানে তারা স্থায়ী হবে। * যে দিন আল্লাহ পুনরুত্থিত করবেন তাদের সকলকে, তখন তারা আল্লাহর নিকট সেইরূপ শপথ করবে যেইরূপ শপথ তোমাদের কাছে করে এবং তারা মনে করে যে, এতে তারা ভালো কিছুর উপর রয়েছে। সাবধান! তারাই তো প্রকৃত মিথ্যাবাদী।
* শয়তান তাদের উপর প্রভাব বিস্তার করেছে; ফলে তাদেরকে ভুলিয়ে দিয়েছে আল্লাহর স্মরণ। তারা শয়তানেরই দল। সাবধান! শয়তানের দল অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত। * যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ করে, তারা হবে চরম লাঞ্ছিতদের অন্তর্ভুক্ত। * আল্লাহ সিদ্ধান্ত করেছেন, আমি অবশ্যই বিজয়ী হব এবং আমার রাসূলগণও। নিশ্চয় আল্লাহ শক্তিমান, পরাক্রমশালী। * তুমি পাবে না আল্লাহ ও আখিরাতে বিশ্বাসী এমন কোনো সম্প্রদায়, যারা ভালবাসে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধাচারীগণকে- হোক না এই বিরুদ্ধাচারীরা তাদের পিতা, পুত্র, ভাই অথবা তাদের জ্ঞাতি-গোত্র তাদের অন্তরে আল্লাহ সুদৃঢ় করেছেন ঈমান এবং তাদেরকে শক্তিশালী করেছেন তাঁর পক্ষ থেকে রূহ দ্বারা। তিনি তাদেরকে দাখিল করবেন জান্নাতে, যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত; সেখানে তারা স্থায়ী হবে; আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তারাও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট, তারাই আল্লাহর দল। জেনে রাখ, আল্লাহর দলই সফলকাম হবে।-আল মুজাদালা (৫৮) : ১৪-২২
আরো ইরশাদ-
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا لَا تَتَّخِذُوا بِطَانَةً مِنْ دُونِكُمْ لَا يَأْلُونَكُمْ خَبَالًا وَدُّوا مَا عَنِتُّمْ قَدْ بَدَتِ الْبَغْضَاءُ مِنْ أَفْوَاهِهِمْ وَمَا تُخْفِي صُدُورُهُمْ أَكْبَرُ قَدْ بَيَّنَّا لَكُمُ الْآَيَاتِ إِنْ كُنْتُمْ تَعْقِلُونَ l هَا أَنْتُمْ أُولَاءِ تُحِبُّونَهُمْ وَلَا يُحِبُّونَكُمْ وَتُؤْمِنُونَ بِالْكِتَابِ كُلِّهِ وَإِذَا لَقُوكُمْ قَالُوا آَمَنَّا وَإِذَا خَلَوْا عَضُّوا عَلَيْكُمُ الْأَنَامِلَ مِنَ الْغَيْظِ قُلْ مُوتُوا بِغَيْظِكُمْ إِنَّ اللَّهَ عَلِيمٌ بِذَاتِ الصُّدُورِ l إِنْ تَمْسَسْكُمْ حَسَنَةٌ تَسُؤْهُمْ وَإِنْ تُصِبْكُمْ سَيِّئَةٌ يَفْرَحُوا بِهَا وَإِنْ تَصْبِرُوا وَتَتَّقُوا لَا يَضُرُّكُمْ كَيْدُهُمْ شَيْئًا إِنَّ اللَّهَ بِمَا يَعْمَلُونَ مُحِيطٌ
* হে মু’মিনগণ! তোমাদের আপনজন ছাড়া অন্য কাউকেই অন্তরঙ্গ বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না। তারা তোমাদের ক্ষতি করতে ত্রুটি করবে না; যা তোমাদেরকে বিপন্ন করে তাই তারা কামনা করে। তাদের মুখে বিদ্বেষ প্রকাশ পায় এবং তাদের হৃদয় যা গোপন রাখে তা আরও গুরুতর। তোমাদের জন্য নিদর্শনসমূহ বিশদভাবে বিবৃত করেছি, যদি তোমরা অনুধাবন কর। * দেখ, তোমরাই তাদেরকে ভালবাস কিন্তু তারা তোমাদেরকে ভালবাসে না অথচ তোমরা সব কিতাবে ঈমান রাখা আর তারা যখন তোমাদের সংস্পর্শে আসে তখন বলে, ‘আমরা বিশ্বাস করি; কিন্তু তারা যখন একান্তে মিলিত হয় তখন তোমাদের প্রতি আক্রোশে তারা নিজেদের অঙ্গুলির অগ্রভাগ দাঁতে কেটে থাকে। বল, ‘তোমাদের আক্রোশেই তোমরা মর।’ অন্তরে যা রয়েছে সে সম্বন্ধে আল্লাহ সম্যক অবগত। * তোমাদের মঙ্গল হলে তা তাদেরকে কষ্ট দেয় আর তোমাদের অমঙ্গল হলে তারা তাতে আনন্দিত হয়। তোমরা যদি ধৈর্যশীল হও এবং মুত্তাকী হও তবে তাদের ষড়যন্ত্র তোমাদের কিছুই ক্ষতি করতে পারবে না। তারা যা করে নিশ্চয়ই আল্লাহ তা পরিবেষ্টন করে আছেন।-আলে ইমরান ৩ : ১১৮-১২০
এখানে কিছু অবুঝ মুসলমানের ভুল ধারণারও সংশোধন করা হয়েছে, যারা সামাজিক সৌজন্যের নামে ধর্মীয় ক্ষেত্রে চরম শিথীলতার শিকার হয় এবং বলে, ‘তারা অমুসলিম হলেও তো আমাদের ভাই/বন্ধু!’ নাউযুবিল্লাহি মিন যালিক। নিঃসন্দেহে এটা চরম নির্বুদ্ধিতা। কেউ যদি বুঝে শুনে একথা বলে তাহলে এটাই তার ‘মুনাফিক’ হওয়ার স্পষ্ট নিদর্শন। আমাদের তরফ থেকে তো এই নির্বুদ্ধিতা যে, এদের প্রতি প্রীতি ও ভালবাসা পোষণ করতে থাকব অথচ তারা তাদের ভ্রান্ত ধর্ম বা মতবাদে এতই কট্টর যে, আমাদের প্রতি ভালোবাসা তো দূরের কথা, আমাদেরকে তারা হীনতম শত্রু মনে করে এবং আমাদেরকে যন্ত্রণা দেওয়ার ক্ষেত্রে, দেশে দেশে আমাদের ভাইবোনদের ব্যাপক হত্যা-নির্যাতনের ক্ষেত্রে কোনো অপচেষ্টা বাদ রাখে না।
এ বিষয়ে এই আয়াতগুলো মনোযোগের সাথে পাঠ করুন : ২ : ২৫৭; ৩ : ২৮; ৪ : ১৩৯; ৫ : ৫১, ৫৭, ৮১; ৮ : ৭২-৭৩; ৯ : ২৩-২৪, ৬৭, ৭১; ৪৫ : ১৯
সহযোগিতা করা না-করার মানদন্ড
ইসলামী আদর্শে সহযোগিতা করা বা না-করার যে মানদন্ড উপরে বলা হয়েছে তার সাথে সংশ্লিষ্ট কুরআনে কারীমের কয়েকটি আয়াত দেখুন :
وَلَا يَجْرِمَنَّكُمْ شَنَآَنُ قَوْمٍ أَنْ صَدُّوكُمْ عَنِ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ أَنْ تَعْتَدُوا وَتَعَاوَنُوا عَلَى الْبِرِّ وَالتَّقْوَى وَلَا تَعَاوَنُوا عَلَى الْإِثْمِ وَالْعُدْوَانِ وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ شَدِيدُ الْعِقَابِ
তোমাদেরকে মসজিদুল হারামে প্রবেশে বাধা দেওয়ার কারণে কোনো সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ তোমাদেরকে যেন কখনোই সীমালংঘনে প্ররোচিত না করে। সৎকর্ম ও তাকওয়ায় তোমরা পরস্পর সাহায্য করবে এবং পাপ ও সীমালংঘনে একে অন্যের সাহায্য করবে না। আল্লাহকে ভয় করবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ শাস্তিদানে কঠোর।-আল মাইদাহ (৫) : ২
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا كُونُوا قَوَّامِينَ لِلَّهِ شُهَدَاءَ بِالْقِسْطِ وَلَا يَجْرِمَنَّكُمْ شَنَآَنُ قَوْمٍ عَلَى أَلَّا تَعْدِلُوا اعْدِلُوا هُوَ أَقْرَبُ لِلتَّقْوَى وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ خَبِيرٌ بِمَا تَعْمَلُونَ
*হে মুমিনগণ! আল্লাহর উদ্দেশ্যে ন্যায় সাক্ষ্যদানে তোমরা অবিচল থাকবে; কোনো সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ তোমাদেরকে যেন কখনও সুবিচার বর্জনে প্ররোচিত না করে, সুবিচার করবে, তা তাকওয়ার নিকটতর এবং আল্লাহকে ভয় করবে, তোমরা যা কর নিশ্চয়ই আল্লাহ তার সম্যক খবর রাখেন।-আল মাইদাহ (৫) : ৮
হাদীস শরীফে আছে,
ليس منا من دعا إلى عصبية، وليس منا من قاتل على عصبية، وليس منا من مات على عصبية.
অর্থাৎ যে আসাবিয়্যার দিকে ডাকে সে আমাদের দলভুক্ত নয়, এবং সে-ও আমাদের দলভুক্ত নয় যে আসাবিয়্যার ভিত্তিতে লড়াই করে। আর সে-ও না যে আসাবিয়্যার মৃত্যুবরণ করে।-সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ৫১২১
আরেক হাদীসে আছে-
يا رسول الله ما العصبية؟ قال : أن تعين قومك على الظلم.
আল্লাহর রাসূল! ‘আসাবিয়্যাহ’ কী? ইরশাদ করলেন, (আসাবিয়্যাহ হল) নিজ গোত্রের জুলুমে সহযোগী হওয়া।-সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ৫১১৯
এ হাদীসে ‘আসাবিয়্যা’র অর্থও স্পষ্ট হয়েছে যে, কোনো ব্যক্তির, দলের, মতবাদের বা সম্প্রদায়ের শুধু এজন্য সহযোগিতা করা যে, সে আমাদের। সে ন্যায়ের উপর থাকুক কি অন্যায়ের উপর, সঠিক হোক বা ভুল, অথচ ইসলামে সহযোগিতার ভিত্তি নেক আমল ও খোদাভীরুতা। গুনাহ ও জুলুমে কারো সহযোগিতা করা হারাম সে যতই নিকটবর্তী হোক না কেন; বরং জালিমকে জুলুম থেকে নিবৃত্ত রাখাই হচ্ছে তার সহযোগিতা- যেমনটা রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
انصر أخاك ظالما أو مظلوما، فقال رجل : يا رسول الله! أنصره إذا كان مظلوما، أفرأيت إذا كان ظالما، كيف أنصره؟ قال : تحجزه أوتمنعه من الظلم، فإن ذلك نصره.
তুমি তোমার ভাইকে সাহায্য কর, যখন সে মাজলুম তখন, যখন সে জালেম তখনও। এক সাহাবী বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! মজলুমকে সাহায্যের বিষয়টি তো বুঝলাম, কিন্তু জালেমকে কীভাবে সাহায্য করব? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তাকে জুলুম থেকে বিরত রাখবে। আর এটাই হল, জালেমকে সাহায্য করা।-সহীহ মুসলিম, হাদীস : ৬৭৪৭; সহীহ বুখারী, হাদীস : ৬৯৫২
১৫. ঈমান অতি সংবেদনশীল, মুমিন ও গায়রে মুমিনের মিশ্রণ তার কাছে সহনীয় নয়
ইসলাম পূর্ণাঙ্গ দ্বীন, ঈমানের বিষয়টি অতি নাজুক ও সংবেদনশীল। ইসলাম এটা বরদাশত করে না যে, মুসলিম উম্মাহ অন্য কোনো জাতির মাঝে বিলীন হয়ে যাবে কিংবা অন্যদের সাথে মিশে একাকার হয়ে যাবে। ইসলাম তার অনুসারীদের যে পূর্ণাঙ্গ শরীয়ত দান করেছে তাতে এমন অনেক বিধান আছে, যার তাৎপর্যই হচ্ছে, মুসলিমের আলাদা পরিচয় প্রতিষ্ঠিত হওয়া এবং অন্যদের থেকে স্বাতন্ত্রমন্ডিত হওয়া। যেমনটা সে স্বকীয়তা ও স্বাতন্ত্রের অধিকারী চিন্তা-বিশ্বাস, ইবাদত-বন্দেগী, ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনের বিধি-বিধান ইত্যাদি ক্ষেত্রে। বেশভূষা, আনন্দ-বেদনা, পর্ব-উৎসব, সংস্কৃতি ও জীবনাচার বিষয়ে শরীয়তের আলাদা অধ্যায় ও আলাদা বিধিবিধান আছে, যার দ্বারা জাতি হিসেবে মুসলমানদের স্বাতন্ত্র ও স্বকীয়তা সৃষ্টি হয়। বাস্তব ক্ষেত্রে এই বিধানগুলোর অনুসরণ প্রত্যেক মুমিনের জন্য জরুরি। আর এগুলোকে সত্য বলে মানা এবং অন্তর থেকে পছন্দ করা তো ঈমানের অংশ।
তন্মধ্যে অমুসলিমের সাথে সম্পর্কের ধরন বিষয়ক যে সকল বিধান আছে, তা বিশেষভাবে মনোযোগের দাবিদার। তার মধ্যে একটি হুকুম হল, অমুসলিমদের পর্ব-উৎসব থেকে দূরে থাকা এবং তাদের ধর্মীয় নিদর্শনের প্রতি কোন ধরনের সম্মান প্রদর্শন থেকে পরিপূর্ণভাবে বেঁচে থাকা। তাছাড়া মুয়ালাত ও বারাআতের মৌলিক বিধান তো উপরে বলা হয়েছে, এখানে সে বিষয়ক শুধু দু’টি বিধান উল্লেখ করছি : এক. জানাযার নামায, দুই. মাগফিরাতের দুআ। এই দুই বিষয়ে ইসলামের শিক্ষা এই যে, কোনো অমুসলিমের জানাযার নামায পড়া যাবে না এবং কোনো অমুসলিমের জন্য মাগফিরাতের দুআ করা যাবে না। সে অমুসলিম পিতা হোক বা ভাই, উস্তাদ হোক বা মুরবিব, নেতা হোক বা লিডার। সীরাতে নববিয়্যাহর দিকে তাকান, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আপন চাচা আবু তালিবের জানাযার নামায পড়াননি অথচ তিনি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কতইনা পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। সীরাত-তারীখ সম্পর্কে সাধারণ জ্ঞান রাখেন এমন যে কারো তা জানা আছে। এত সহায়তা ও পৃষ্ঠপোষকতা এবং এত নিকটাত্মীয়তা সত্ত্বেও না তার জানাযা পড়েছেন, না তার জন্য দুআয়ে মাগফিরাত করেছেন।
এ বিষয়ে সকল নবী-রাসূল ও সাহাবায়ে কেরামের ঘটনাবলি এত প্রচুর যে, তা আলাদা গ্রন্থের বিষয়। এখানে মাসআলার সাথে সংশ্লিষ্ট শুধু দু’টি আয়াত দেখুন :
وَلَا تُصَلِّ عَلَى أَحَدٍ مِنْهُمْ مَاتَ أَبَدًا وَلَا تَقُمْ عَلَى قَبْرِهِ إِنَّهُمْ كَفَرُوا بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ وَمَاتُوا وَهُمْ فَاسِقُون
(তরজমা) তাদের মধ্যে কারো মৃত্যু হলে তুমি কখনও তার জানাযার সালাত পড়বে না এবং তার কবরের পাশে দাঁড়াবে না; তারা তো আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে অস্বীকার করেছিল এবং পাপাচারী অবস্থায় তাদের মৃত্যু হয়েছে।-আত তাওবা (৯) : ৮৪
مَا كَانَ لِلنَّبِيِّ وَالَّذِينَ آَمَنُوا أَنْ يَسْتَغْفِرُوا لِلْمُشْرِكِينَ وَلَوْ كَانُوا أُولِي قُرْبَى مِنْ بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُمْ أَنَّهُمْ أَصْحَابُ الْجَحِيمِ l وَمَا كَانَ اسْتِغْفَارُ إِبْرَاهِيمَ لِأَبِيهِ إِلَّا عَنْ مَوْعِدَةٍ وَعَدَهَا إِيَّاهُ فَلَمَّا تَبَيَّنَ لَهُ أَنَّهُ عَدُوٌّ لِلَّهِ تَبَرَّأَ مِنْهُ إِنَّ إِبْرَاهِيمَ لَأَوَّاهٌ حَلِيمٌ
আত্মীয়-স্বজন হলেও মুশরিকদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা নবী এবং মুমিনদের জন্য সংগত নয়, যখন এটা সুস্পষ্ট হয়ে গিয়েছে যে, নিশ্চিতই তারা জাহান্নামী। * ইবরাহীম তাঁর পিতার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেছিল, তাকে এর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল বলে; অতঃপর যখন তাঁর কাছে এটা সুস্পষ্ট হল যে, সে আল্লাহর শত্রু তখন ইবরাহীম তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করল। ইবরাহীম তো কোমলহৃদয় ও সহনশীল।-আত তাওবা (৯) : ১১৩-১১৪
এখানে এ কথা উল্লেখ করে দেয়া দরকার মনে করছি। তা হল, সাধারণ অবস্থায় অমুসলিম আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী ও অন্য যে কোন বিধর্মীর সাথে সদাচরণ শরীয়তে বৈধ।
নিজের ঈমান-আকীদা এবং ইসলামী স্বাতন্ত্র ও স্বকীয়তা রক্ষা করে তাদের সাথে সদাচরণ শুধু বৈধই নয় বরং শরীয়ত নির্দেশিতও বটে। এমনকি তাদেরকে নফল দান-সদকা দ্বারা সাহায্য-সহযোগিতা করাও জায়েয।
এছাড়া কুরআন মাজীদের এ হুকুম তো সকলের জন্যই প্রযোজ্য।
وَلَا تَسْتَوِي الْحَسَنَةُ وَلَا السَّيِّئَةُ ادْفَعْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ فَإِذَا الَّذِي بَيْنَكَ وَبَيْنَهُ عَدَاوَةٌ كَأَنَّهُ وَلِيٌّ حَمِيمٌ l وَمَا يُلَقَّاهَا إِلَّا الَّذِينَ صَبَرُوا وَمَا يُلَقَّاهَا إِلَّا ذُو حَظٍّ عَظِيمٍ
অর্থ : ভালো ও মন্দ সমান হতে পারে না। মন্দ প্রতিহত করুন উৎকৃষ্টের দ্বারা; ফলে আপনার সাথে যার শত্রুতা আছে সে অন্তরঙ্গ বন্ধুর মত হয়ে যাবে। এই গুণের অধিকারী করা হয় কেবল তাদেরকেই, যারা ধৈর্যশীল, এ গুণের অধিকারী করা হয় কেবল তাদেরকেই যারা মহাভাগ্যবান।-সূরা হা-মীম আস-সাজদা, (৪১) ৩৪-৩৫
যদিও আমাদের কিছু অবুঝ শ্রেণীর মুসলমান ভাইয়ের কর্মপন্থা এর ব্যতিক্রম। তাদেরকে নিজের এবং নিজের গুরুজন ও মুরববী সম্পর্কে অতি সংবেদনশীল দেখা যায়। তাদের ব্যাপারে কেউ সামান্য উচ্চ-বাচ্য করলে তার আর রক্ষা নেই।
পক্ষান্তরে কোনো বেদ্বীন-মুলহিদ ইসলাম ও ইসলামের সুমহান গ্রন্থ আল-কুরআন, নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও শিআরে ইসলাম সম্পর্কে যত অশ্রাব্য গালি-গালাজ, ঠাট্টা-বিদ্রূপ করুক না কেন এ নিয়ে তাদের কোনোই মাথাব্যাথা নেই। অথচ সামাজিক সৌজন্য তো আলাদা বিষয়। আর ক্ষমা-মার্জনা তো হতে পারে ব্যক্তিগত হক সম্পর্কে এবং তা উচিতও। কিন্তু যেখানে দ্বীন-ঈমানের প্রশ্ন এসে দাঁড়াবে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল এবং ইসলাম ও শিআরে ইসলামের প্রশ্ন এসে দাঁড়াবে সেখানে তো প্রত্যেক মুসলমানকে শরীয়তের গন্ডিতে থেকে সাধ্যানুযায়ী ঈমানী গায়রত ও মর্যাদাবোধের পরিচয় দেওয়া কর্তব্য।
অবশ্য এর পন্থা ও উপায় কী হবে এবং শ্রেণীভেদে কার উপর কী ধরনের দায়িত্ব বর্তাবে তা বিজ্ঞ আলেম থেকে জেনে নেওয়া জরুরি।
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে তাওফীক দান করুন। আমীন। ইয়া রাববাল আলামীন।
(চলবে ইনশাআল্লাহ)