উলূমে মাকসূদার বিষয়ে তারাক্কী : কিছু সরল চিন্তা
দ্বীনী ইলম হাসিলের বিভিন্ন পর্যায়
দ্বীনী ইলম হাসিল করা প্রত্যেক মুসলিমের দায়িত্ব। মুসলিম উম্মাহর প্রত্যেক শ্রেণী দ্বীনী ইলম অন্বেষণ করবেন। তবে ইলম অন্বেষণের বিভিন্ন পর্যায় রয়েছে :
প্রথম পর্যায় : ফরযে আইন ইলম। এতে আছে আকাইদ ও ঈমানিয়াতের বুনিয়াদী ইলম, কুরআন তিলাওয়াত শিক্ষা, ইবাদত-বন্দেগীর প্রয়োজনীয় মাসাইল, পরস্পরের অপরিহার্য হক ও অধিকার এবং এ সংক্রান্ত আদাবুল মুআশারার ইলম, আখলাক তথা চরিত্র ও আচরণ সংক্রান্ত ফরয ইলম এবং মুয়ামালা ও লেনদেন বিষয়ক ফরয ইলম ইত্যাদি।
এই ইলম হাসিলের মৌলিক পন্থা হল আহলে ইলমের সোহবত ও সাহচর্য। কুরআন মজীদের প্রসিদ্ধ আয়াত-
فاسئلوا اهل الذكر ان كنتم لا تعلمون
এর দাবি এটাই।
দ্বিতীয় পর্যায় : কুরআন মজীদ ও হাদীস শরীফ অধ্যয়ন। প্রত্যেক মুসলিমের এই পরিমাণ আরবী ভাষাজ্ঞান অর্জন করা কাম্য, যার দ্বারা মূল আরবী থেকে কুরআন ও হাদীসের বাণী অনুধাবন করা যায়। মূল ভাষায় কুরআন ও হাদীস বোঝার স্বাদ থেকে কোনো মুমিনেরই বঞ্চিত থাকা উচিত নয়। তবে এরপরও হক্কানী আলিমগণের সোহবত এবং নির্ভরযোগ্য ও মানসম্পন্ন অনুবাদ ও ভাষ্য থেকে অমুখাপেক্ষী হওয়ার সুযোগ নেই।
এই দুই পর্যায়ের ইলম সর্বশ্রেণীর মুসলমানকেই অর্জন করতে হবে। আর মাদরাসায় আহলে ইলম ও আহলে ফন্নের সোহবতে থেকে একটি দীর্ঘ নেসাবের মধ্য দিয়ে ইলমে দ্বীন হাসিলের যে প্রচেষ্টা তা শুধু উপরোক্ত দুই পর্যায়ের মাঝে সীমাবদ্ধ থাকার জন্য নয়; বরং এই পড়াশোনার অন্যতম লক্ষ্য সাধারণ মুসলমানের জন্য উপরোক্ত দুই পর্যায়ের ইলম সরবরাহ করার যোগ্যতা অর্জন করা। এজন্য কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিষয়বস্ত্তগত অভিন্নতা থাকলেও ধরন ও পর্যায়গত মৌলিক পার্থক্য থাকবে। কয়েকটি তুলনা দ্বারা বিষয়টি পরিষ্কার করা যায়।
ক. আরবী ভাষাজ্ঞান : আগেই বলা হয়েছে, সাধারণ মানুষের জন্যও আরবী ভাষার জ্ঞান অর্জন কাম্য তদ্রূপ মাদরাসার তালিবে ইলমরাও এই ইলম হাসিল করবে, কিন্তু পার্থক্য হল, সাধারণ মানুষ কুরআন ও হাদীসে ব্যবহৃত প্রসিদ্ধ শব্দগুলোর অর্থ জানবেন এবং বাক্যের ভাবার্থ অনুধাবনের যোগ্যতা অর্জন করবেন। তো কুরআন-হাদীসে সচরাচর ব্যবহৃত আরবী বাক্যসমূহ পাঠ করলে বা শ্রবণ করলে তার সাধারণ অর্থ বুঝতে সক্ষম হওয়া এই পর্যায়ের ইলমের উদ্দেশ্য। নাহব-ছরফ ও অন্যান্য শাস্ত্রের চর্চা ও ব্যুৎপত্তি ছাড়াও এই যোগ্যতা অর্জন করা সম্ভব।
পক্ষান্তরে মাদরাসার তালিবে ইলমগণ আরাবিয়্যাতের যে ইলম অর্জন করবেন তাতে উপরোক্ত বিষয়ের সাথে আলফাযের সহীহ ইশতিকাক ও তালীল, জুমলার সহীহ তারকীব বোঝা, আরবী ইবারত শুদ্ধভাবে পাঠ করতে পারা এবং আরবী ভাষায় লিখিত উলূম ও ফুনূনের গ্রন্থাদি অধ্যয়নের যোগ্যতা অর্জন করা প্রাথমিক উদ্দেশ্যের অন্তর্ভুক্ত। এরপর আরাবিয়্যাতের সহীহ যওক, ফাসাহাত ও বালাগাতের ইহসাস ও উপলব্ধি এবং জাহেলী যুগের নযম ও নছর থেকে সঠিক ভাব ও মর্ম আহরণের যোগ্যতা অর্জনও আরাবিয়্যাতের দরস-তাদরীসের অন্যতম উদ্দেশ্য।
খ. কুরআন ও হাদীসের তরজমা : কুরআন মজীদ ও হাদীস শরীফের তরজমা সাধারণ মানুষও পড়বে, মাদরাসার তালিবে ইলমরাও পড়বেন তবে উভয় পাঠের পর্যায় ভিন্ন। সাধারণ মানুষ মৌলিকভাবে নির্ভর করবে বিশুদ্ধ ও গ্রহণযোগ্য অনুবাদের উপর। আর তার প্রাথমিক আরবী ভাষাজ্ঞান তাকে সহায়তা করবে অনুবাদের সাহায্যে মূল পয়গামের স্বাদ অর্জনে।
পক্ষান্তরে মাদরাসার তালিবে ইলম মৌলিকভাবে নির্ভর করবে মতনে কুরআনের উপর । সঙ্গে বাংলা, উর্দু বা আরবী ভাষায় লিখিত কুরআন মজীদের তরজমা থাকবে সহায়ক হিসাবে। অতএব বিভিন্ন তরজমার মধ্যে কোন্ তরজমাটি কুরআনের ভাব প্রকাশে অধিকতর নিকটবর্তী তা তুলনা করার যোগ্যতা তার মধ্যে তৈরি হতে হবে। সাধারণ মানুষের তরজমা পাঠের উদ্দেশ্য এটা নয়।
গ. ফিকহ ও মাসায়েলের ইলম : সাধারণ মানুষও মাসায়েলের ইলম অর্জন করবেন। একজন তালিবে ইলমও ফিকহ সম্পর্কে পড়াশোনা করবেন কিন্তু এই দুই অধ্যয়নে বৈশিষ্ট্যগত ও পর্যায়গত অনেক পার্থক্য রয়েছে। কিছু মৌলিক
পার্থক্য এই-
১. সাধারণ মানুষ মাসাইলের ইলম হাসিল করবেন নিজ নিজ মাতৃভাষায়, পক্ষান্তরে মাদরাসার তালিবে ইলম ইবতিদায়ী স্তর অতিক্রম করার পরই ফিকহের মৌলিক আরবী গ্রন্থসমূহ অধ্যয়ন করবেন।
২. সাধারণ মানুষের জন্য মাসাইলের সঙ্গে দলীল জানা জরুরি নয়, পক্ষান্তরে মাদরাসার তালিবে ইলম ফিকহে মুজাররাদের পর ফিকহে মুদাল্লালের পাঠ গ্রহণ করবেন।
৩. সাধারণ মানুষের জন্য অন্যান্য
মাযহাব সম্পর্কে জানা এবং বিভিন্ন মাযহাবের তুলনামূলক বিশ্লেষণ প্রয়োজন নেই, পক্ষান্তরে মাদরাসার তালিবে ইলমকে ‘ফিকহে মুজাররাদ’ ও ‘ফিকহে মুদাল্লালের’ পর ‘ফিকহে মুকারানের’ পাঠ গ্রহণ করতে হবে।
৪. সাধারণ মানুষ শুধু মাসাইলের ইলম অর্জন করেন পক্ষান্তরে মাদরাসার তালিবে ইলম অধ্যয়ন করেন ইলমুল ফিকহ বা ফিকহ-শাস্ত্র। অতএব ইলমুল ফিকহের ইসতিলাহাত ও আদিল্লা এবং কাওয়াইদ ও যাওয়াবিত তার পাঠ্যসূচিতে রয়েছে।
একই কথা উলূমুল কুরআন ও উলূমুল হাদীসের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। মাদরাসার তালিবে ইলম এই সকল বিষয়ের ফন্নী ও শাস্ত্রীয় পাঠ গ্রহণ করে থাকেন আর সাধারণ মানুষ অর্জন করেন বিধানটুকুর জ্ঞান।
এই সামান্য তুলনা দ্বারা ইলম চর্চার পর্যায়গত পার্থক্য বোঝা যায়। আরো বোঝা যায়, যারা মাদরাসায় এসে ইলমে দ্বীন অর্জনে সচেষ্ট হন তাদের প্রাথমিক গন্তব্য কী।
এক কথায় বলা যায় যে, মাদরাসার নেসাবভুক্ত পড়াশোনার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে পরিপক্ক ‘কিতাবী ইসতি’দাদ’ এবং এই পর্যায়ের ‘ফন্নী ইসতি’দাদ’ হাসিল করা, যদ্বারা আগামীতে ‘ফন্নী মাহারাত’ হাসিলের মেহনত করে যাওয়া সম্ভব হয়।
ইলমী তরক্কী
তরক্কী বা উন্নতি শব্দটি চলমানতা নির্দেশ করে। কারণ উন্নতি বলে এক পর্যায় থেকে পরবর্তী পর্যায়ে উপনীত হওয়াকে। অতএব তা স্থবিরতার সম্পূর্ণ পরিপন্থী। বিশেষত ইলম ও দ্বীনের ক্ষেত্রে তা অক্ষরে অক্ষরে সত্য। এজন্য ইলম ও দ্বীনের ক্ষেত্রে অল্পেতুষ্টি প্রশংসনীয় নয়। কারণ তা উন্নতির পথে প্রতিবন্ধক। এজন্য ইলমী তরক্কীর জন্য প্রথম করণীয় হচ্ছে স্থবিরতা পরিত্যাগ করা এবং আত্মতুষ্টি ও আত্মতৃপ্তি পরিহার করে দীর্ঘ সফরের মানসিক প্রস্ত্ততি গ্রহণ করা। তালাবুল ইলম এমন একটি বিষয়, যা জীবনব্যাপী সাধনা ও অন্বেষা দাবি করে।
ইলমী তরক্কীর দুই পর্যায়
ছাত্রজীবন ও শিক্ষকতা-জীবন প্রকৃতপক্ষে তালাবুল ইলমের দুটো পর্যায়। এই দুই পর্যায়ের মধ্যে বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যগত পার্থক্য রয়েছে। মৌলিক পার্থক্যগুলো এই :
১. ছাত্রজীবনের মেহনত মূলত ইসতি’দাদ তৈরির মেহনত। পক্ষান্তরে তাদরীসী যিন্দেগীর মেহনত হচ্ছে
যিইসতি’দাদ ব্যক্তির ফন্নী কামাল হাসিলের মেহনত। অন্যভাষায় বললে, ছাত্রজীবনের মেহনতের মূল লক্ষ্য হচ্ছে ইসতি’দাদ অর্জন করা, পক্ষান্তরে তাদরীসী যিন্দেগীর মেহনতের উদ্দেশ্য হচ্ছে ইখতিসাসের মাকামে উন্নীত হওয়া।
২. তালিবে ইলমী যিন্দেগীর মেহনত মৌলিকভাবে নির্ধারিত নেসাবের অধীন। পক্ষান্তরে তাদরীসী যিন্দেগীর মেহনত নেসাবের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এক্ষেত্রে নেসাবের সহায়ক ভূমিকা থাকলেও মৌলিকভাবে এই মেহনত হচ্ছে ফন্ন-কেন্দ্রিক।
৩. তালিবে ইলমী যিন্দেগীর মেহনতে নিজেকে গড়ে তোলাই মূল উদ্দেশ্য। পক্ষান্তরে তাদরীসী যিন্দেগীর মেহনতের মৌলিক উদ্দেশ্য হচ্ছে তালিবে ইলমের মাঝে কিতাবী ইসতি’দাদ তৈরি করা এবং ফন্নী ইসতি’দাদের মেহনতে আত্মনিয়োগের প্রেরণা সৃষ্টি করা। এককথায়, তা হচ্ছে ‘মরদুম সাযী’র মেহনত।
৪. ইলমী ক্ষেত্রে ছাত্রজীবনের বড় বিষয় হচ্ছে হক্কুন নাফ্স পক্ষান্তরে তাদরীসী যিন্দেগীর মূল বিষয় হচ্ছে হক্কুল গায়র। এ বৈশিষ্ট্যগুলো সম্পর্কে চিন্তা করলে দেখা যায়, এই পর্যায়ের তালাবুল ইলম অনেক বেশি উদ্যম, একনিষ্ঠতা ও কর্মতৎপরতা দাবি করে।
উলূমে মাকসূদাতে সাধারণ ইসতি’দাদ হাসিলের জন্য কিছু বিষয়
উলূমে মাকসূদার তিনটি মৌলিক প্রকার, উলূমুল কুরআন, উলূমুল হাদীস ও উলূমুল ফিকহ সম্পর্কে ইখতিসাস হাসিলের পূর্বে সাধারণ ফন্নী ইসতি’দাদ হাসিল করা অপরিহার্য। ইতিপূর্বে বলা হয়েছে যে, ছাত্রজীবনের মূল লক্ষ্য হচ্ছে পরিপক্ক কিতাবী ইসতি’দাদ হাসিল করা এবং ফন্নী ইসতিদাদের অন্তত প্রাথমিক পর্যায়টি অতিক্রম করা। কিতাবী ইসতিদাদ হাসিলের উপায় এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট উলূম ও ফুনূন তথা ‘উলূমে আলিয়্যা’ এ প্রবন্ধের বিষয়বস্ত্ত নয়। উলূমে মাকসূদা সম্পর্কে আলোচনা করাই এ প্রবন্ধের উদ্দেশ্য।
তালিবে ইলমী যিন্দেগীতে (ছাত্রজীবনে) করণীয় কাজ
একথা অনস্বীকার্য যে, উলূমে মাকসূদার ক্ষেত্রে ইখতিসাসের মাকামে উন্নীত হওয়া অনেক উঁচু লক্ষ্য। এর জন্য প্রয়োজন দীর্ঘ সাধনা। তাই তালিবুল ইলম-যিন্দেগী থেকে সচেতন হলে গন্তব্যে পৌঁছা অনেক সহজ হয়। উলূমুল কুরআন, উলূমুল হাদীস ও উলূমুল ফিকহ বিষয়ে তালিবে ইলম যিন্দেগীতেই বর্তমান নেসাবের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে যে সব ক্ষেত্রে পরিপক্কতা অর্জন করা সম্ভব তার একটি সংক্ষিপ্ত খসড়া পেশ করছি।
এক. উলূমুল কুরআন :
১. তরজমায়ে কুরআন প্রসঙ্গে প্রথম করণীয় হচ্ছে কুরআন মজীদের সহীহ তরজমা শিক্ষা করা। এটি আমাদের নেসাবে রয়েছে। দীর্ঘ তাফসীরী আলোচনায় না গিয়ে তরজমায়ে কুরআনের দরস মাতৃভাষায় কুরআন মজীদের সহীহ তরজমা শেখার জন্যই নিবেদিত হওয়া উচিত। এক্ষেত্রে যে বিষয়গুলো লক্ষণীয় তা হচ্ছে :
ক. তালিবে ইলমগণ প্রথমে মতনে কুরআন অধ্যয়ন করবেন এবং কুরআনের বাণী বোঝার চেষ্টা করবেন।
খ. কঠিন শব্দগুলো নোট করবেন এবং কোনো আরবী লোগাতের সহযোগিতায় অর্থ তাহকীক করবেন।
গ. নাহবী তারকীবের দিকে লক্ষ্য রাখবেন।
ঘ. এরপর একাধিক নির্ভরযোগ্য তরজমা থেকে ওই অংশটুকু অধ্যয়ন করবে। তাফসীরে উছমানী থেকে তরজমায়ে শায়খুল হিন্দ রাহ. ও তাফসীরে বয়ানুল কুরআন থেকে তরজমায়ে হাকীমুল উম্মত থানভী রাহ. অধ্যয়ন করা যায়। অতি সম্প্রতি ‘আসান তরজমায়ে কুরআন’ নামে হযরত মাওলানা মুফতী তকী উছমানী ছাহেবের তরজমায়ে কুরআন ও সংক্ষিপ্ত তাফসীর এসেছে।
তদ্রূপ বাংলা তরজমার ক্ষেত্রে এমদাদিয়া লাইব্রেরীকৃত তরজমা ও ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত তরজমাও সহজলভ্য। মনোযোগের সাথে একাধিক তরজমা অধ্যয়ন করে বিভিন্ন তরজমার পার্থক্য অনুধাবনের চেষ্টা করবেন এবং বিভিন্ন বাংলা তরজমায় যে ভুল-ত্রুটি বা অসংগতি আছে তা চিহ্নিত করার যোগ্যতা অর্জনে সচেষ্ট হবেন। মোটকথা, মাতৃভাষায় মাআনিল কুরআনের সঠিক উপস্থাপন ও উপস্থাপনের পর্যালোচনা-দুটো যোগ্যতাই অর্জন করতে হবে।
ঙ. বাংলা ভাষায় সঠিকভাবে কুরআনের তরজমা ও ভাবার্থ প্রকাশের মেহনত হযরত মাওলানা আবু তাহের মিসবাহ দামাত বারাকাতুহুমের ‘এসো কুরআন শিখির’ মাধ্যমে হওয়া উচিত।
চ. অর্থ ও মর্ম বোঝার জন্য কোনো সংক্ষিপ্ত তাফসীর-গ্রন্থ যেমন, আইসারুত তাফাসীর, ছফওয়াতুত তাফাসীর বা এ জাতীয় কোনো আরবী তাফসীর সঙ্গে রাখা যায়।
২. কুরআন মজীদের বিষয়বস্ত্তগত অধ্যয়ন : ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলো সম্পর্কে কুরআন মজীদের কিছু কিছু আয়াত মুখস্থ থাকা প্রত্যেক তালিবে ইলমের জন্য প্রয়োজন। তাওহীদ, রিসালাত, আখিরাত, ইবাদাত, মুয়ামালাত-মুয়াশারাত ও আখলাক সংক্রান্ত বিভিন্ন শিরোনামে কুরআন মজীদের নির্বাচিত কিছু আয়াত সঠিক তরজমা ও ভাবার্থসহ মুখস্থ করবেন। মারহালা ছানাবিয়্যাহ থেকেই তালিবে ইলমরা উস্তাদের নেগরানীতে তা শুরু করতে পারেন।
৩. উলূমুল কুরআনের সঙ্গে পরিচয় : উলূমুল কুরআনের ইসতিলাহাত, আনওয়া ও মাসাইলের উপর পূর্ববর্তীরা অনেক গ্রন্থ রচনা করেছেন। তন্মধ্যে জালালুদ্দীন সুয়ূতী রাহ. কৃত ‘আলইতকান ফী উলূমিল কুরআন’, বদরুদ্দীন আইনী রাহ.-এর ‘আলবুরহান ফী উলূমিল কুরআন’ উল্লেখযোগ্য। উলূমুল কুরআনের মাবাদিয়াত, মুসতালাহাত, বুনিয়াদী মাসাইল এবং এ প্রসঙ্গে সালাফের গ্রন্থাদি সম্পর্কে তালিবে ইলমদের পরিচিতি অর্জন এ বিষয়ের উদ্দেশ্য।
৪. তাফসীরুল কুরআন : এটি উলূমুল কুরআনেরই একটি অংশ। তবে গুরুত্বের কারণে একে আলাদাভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে তাফসীরুল কুরআন সংক্রান্ত নীতিমালা, তাফসীর বিলমানকূল, তাফসীর বিলমা’কূলের সঙ্গে ইসরাইলিয়্যাত ওয়া মাওযূআত, মুতাজাদ্দিদীন ও মুলহিদীনের তাহরীফাত, ইসতিশরাক ও মুছতাশরিকীন ইত্যাদি প্রসঙ্গে প্রাথমিক অধ্যয়ন থাকবে। সঙ্গে সঙ্গে প্রসিদ্ধ তাফসীর-গ্রন্থসমূহের সাথে পরিচিতি এবং নির্বাচিত কিছু গ্রন্থের নির্ধারিত স্থান তালিবুল ইলমের অধ্যয়নে থাকতে পারে।
৫. আহকামুল কুরআন : এ বিষয়ে সংক্ষিপ্ত ও সহজ অন্তত একটি কিতাব মুতালাআ করে ফেলা উচিত।
এই কয়েকটি বিষয় তালিবুল ইলমী-যিন্দেগীতেই মুশফিক উস্তাদের নেগরানীতে সম্পন্ন করা যায় এবং বর্তমান নেসাবের সঙ্গেই তা সম্ভব।
দুই. উলূমুল হাদীস
ক. মতনে হাদীস : প্রাথমিক শ্রেণী থেকেই হাদীস শরীফের অধ্যয়ন শুরু হওয়া দরকার। ইবতিদায়ী শ্রেণীতে শুধু আখলাকে হাসানা ও সাধারণ আদাবে যিন্দেগী বিষয়ক হাদীস। ছানাবিয়্যাহ পর্যায়ে আকাইদ ও ইবাদাত সংক্রান্ত হাদীস, মুতাওয়াসসিতা পর্যায়ে মুয়ামালাত ও মুয়াশারাত বিষয়ক হাদীস অধ্যয়নসূচিতে থাকতে পারে। ছানাবিয়্যাহর শেষ জামাত ও মুতাওয়াসসিতার প্রথম জামাতে আহাদীসে আহকাম অধ্যয়নসূচিতে আসতে পারে।
খ. তরজমায়ে হাদীস : মাতৃভাষায় সহীহ শুদ্ধভাবে হাদীস শরীফের তরজমা ও ভাবার্থ বর্ণনা করার যোগ্যতা অর্জনের প্রচেষ্টা অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করা উচিত।
মারহালায়ে ছানাবিয়্যাহ থেকেই মতনে হাদীসের দরসে এ বিষয়টি বিশেষভাবে বিবেচ্য হতে পারে। বিশেষ করে ফযীলত দ্বিতীয় বর্ষে মিশকাত শরীফের দরসে প্রতিটি হাদীসের সহীহ তরজমা, হাদীস শরীফের শিক্ষা ও তালীমাত এবং আলফাযে গরীবার তাশরীহের বিষয়ে বিশেষভাবে যত্নবান হওয়া চাই।
গ. উসূলুল হাদীস : উসূলুল হাদীসের মুসতালাহাত, বুনিয়াদী মাসাইল, আনওয়াউ উলূমিল হাদীস এবং আনওয়াউল মুসান্নাফাত ফিলহাদীস সম্পর্কে মুতাওয়াসসিতা দ্বিতীয় বর্ষের (হেদায়া) আগে এবং আসমাউর রিজাল, ইলালুল হাদীস, আলআহাদীসুল মাওযূআহ এবং হুজ্জিয়তে হাদীস ও ইছতিশরাক সম্পর্কে বুনিয়াদী ধারণা তাকমীলের আগেই হয়ে যাওয়া সম্ভব।
তিন. উলূমুল ফিকহ : এ বিষয়ে আমাদের নেসাবে বেশ কিছু কিতাব রয়েছে। ফিকহে মুজাররাদ, ফিকহে মুদাল্লাল ও ফিকহে মুকারান তিন বিষয়েই বিদ্যমান কিতাবসমূহকে কেন্দ্র করেই প্রয়োজনীয় ইসতিদাদ তৈরির প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব। তবে ফিকহে মুকারানে প্রবেশ করার আগে অর্থাৎ
মারহালায়ে মুতাওয়াসসিতার আগেই ফিকহে হানাফীর আদিল্লা বিষয়ে অন্তত একটি কিতাব মুতালাআ করে ফেলতে হবে।
ফিকহে মুকারানের সঙ্গে ‘আলইখতিলাফ : উসূলুহু ওয়া আহকামুহু’; ‘আসবাবু ইখতিলাফিল আইম্মা’ এবং ‘আছারুল আদিল্লাতিশ শারইয়্যাহ ফিখতিলাফিল আইম্মা’ এবং ‘আদাবুল ইখতিলাফ’ বিষয়ে বুনিয়াদী ধারণা অর্জন করা অপরিহার্য।
বিভিন্ন মুখতালাফ ফীহ মাসাইলের ক্ষেত্রে তাহকীকী উসলূব বোঝার জন্য হিদায়ার সঙ্গে নাসবুর রায়া ও ফাতহুল কাদীরের নির্ধারিত কিছু অংশ যদি তালিবুল ইলম কোনো মাহির ও মুশফিক উস্তাদের নিকট পড়ে নেন তাহলে ফন্নী ইসতিদাদ হাসিলের পথে তা বেশ সহায়ক হবে ইনশাআল্লাহ।
মাযাহিবে আরবাআর মৌলিক গ্রন্থসমূহের সাথে পরিচিতি ও মুরাজাআতের অভ্যাসও এ সময়ই গড়ে উঠতে পারে।
একজন তালিবে ইলম কোনো যী-ইসতিদাদ ও মুশফিক উস্তাদের নেগরানীতে উপরোক্ত পন্থায় মেহনত করতে থাকলে তালিবে ইলমী যিন্দেগীতেই উলূমে মাকসূদার ক্ষেত্রে প্রাথমিক পর্যায়ের ফন্নী ইসতিদাদ তৈরি হবে ইনশাআল্লাহ। এরপর ইখতিসাস হাসিলের জন্য আহলে ফনের সোহবতে থেকে দীর্ঘ সাধনায় আত্মনিয়োগ করতে হবে।