বর্তমান সময়ে সীরাত অধ্যয়নের গুরুত্ব ও প্রাসঙ্গিকতা
পৃথিবীর ইতিহাসে এমন অনেক বিস্ময়কর মনীষার উদাহরণ পাওয়া যায় যাদের চিন্তা-চেতনা ও দর্শন সারা পৃথিবীতে বিস্তার লাভ করেছে এবং যাদেরকে তাদের স্বতন্ত্র আদর্শ ও কৃতিত্বের কারণে মানুষ আজো শ্রদ্ধা ও ভক্তির সাথে স্মরণ করে থাকে। এইসব মহামানবদের কারো কারো জ্ঞান ও প্রতিভা সরাসরি ‘ওহিয়ে এলাহী’ থেকে আহরিত ও উৎসারিত আর কারো গ্রহণযোগ্যতা ও প্রতিভা তার নিজস্ব চিন্তা, দর্শন এবং রুচি ও হিকমতের ফসল।
দুজাহানের সর্দার, রাসূলে রহমত, মুহাম্মাদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এইসব মহান ব্যক্তিদের মাঝেও পরিপূর্ণ ও সুমহান ব্যক্তিত্ব। যার পূর্ণতা ও বিশ্বজনীনতা অন্যদের চেয়ে ভিন্ন, যা কোন যুগ, জীবন ও ভৌগলিক সীমানা ছাড়িয়ে জগতের প্রতিটি ক্ষেত্রে বিস্তৃত হয়ে আছে। জলে-স্থলে, আপন ও পর সকলে তার থেকে উপকৃত হয়েছে এবং হচ্ছে বরং কেয়ামত পর্যন্ত এই ‘ফায়জান’ জারি থাকবে। ইনশা আল্লাহ।
এই মহামানবের শান ও মর্যাদা, জগৎখ্যাতি ও গ্রহণযোগ্যতার স্বাতন্ত্র ও ভিন্নতার এটিও এক বিরাট দলিল যে, আজ পর্যন্ত তার মুবারক ব্যক্তিত্বকে যে পরিমাণ ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার সাথে দেখা হয় তার শতভাগের একভাগও অন্য কারো ভাগ্যে জুটেনি!
নবুওতে মুহাম্মাদীর জন্য এগুলো এক মু’জিযাস্বরূপ যে, আজ পর্যন্ত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতিটি কথা, প্রতিটি কাজ, প্রতিটি নড়াচড়া ও ইশারা, সর্বোপরি জনতায় ও নির্জনতায় তাঁর একেকটি ভাব ও ভাষার নমুনা পৃথিবীতে রয়েছে! তাঁর উঠাবসা, চলাফেরা, জীবনযাপন, পোশাক-পরিচ্ছেদ, খানা-পিনা ও চেহারা-সূরত ইত্যাদি সকল কিছুর পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা সীরাতের পাতায় পাতায় রয়েছে। সীরাত সংকলকগণ অত্যন্ত আমানতদারির সাথে তা সংরক্ষণ করেছেন এবং আজো সীরাতের সংকলন, চর্চা ও অধ্যয়ন অব্যাহত রয়েছে।
সীরাত অধ্যয়নের ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি
সীরাত অধ্যয়নের সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গির সাথে ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গির কিছুটা ভিন্নতা রয়েছে। কারণ একজন মুসলমানের জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুবারক সীরাত অধ্যয়ন শুধু জ্ঞান বা জ্ঞানবৃদ্ধির বিষয়ই নয়, এটা তার দ্বীনী প্রয়োজন। নিমেণাক্ত বিষয়গুলোর মাধ্যমে তা সহজেই বুঝে আসবে।
১. সীরাত অধ্যয়ন একটি উত্তম আমল
উলামায়ে কেরাম এই বিষয়ে একমত যে, সীরাতে নববী সর্বযুগীয় একটি মু‘জিযা। সীরাতে নববী আল্লাহ তায়ালার হিকমত ও প্রজ্ঞার নিদর্শন এবং কুরআনে কারীমের জীবন্ত ব্যাখ্যা।
কুরআনে কারীমে ‘আসমা ও সীফাতে’র আয়াতগুলো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আকায়েদ বা বিশ্বাস, আহকামের আয়াতগুলো তাঁর উত্তম জীবনযাপন, প্রভাব ও প্রতাপের আয়াতগুলো তাঁর মহত্ব ও মর্যাদা এবং রহমত ও শান্তির আয়াতগুলো তাঁর সৌন্দর্য প্রকাশ করছে। মোটকথা কুরআনের যে কোনো ধরনের আয়াত আপনি নেবেন তাতেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পয়গাম্বরী সীরাত ও তার নবুওতী মাকামের নমুনা দেখতে পাবেন। এই বাস্তবতাকেই মা আয়েশা রাযি. নিজের ভাষায় বর্ণনা করেছেন-
كان خلقه القرآن
-মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ২৫৩০২
আর কুরআন সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে-
لا يخلق على كثرة الرد، ولا تنقضي عجائبه
সুতরাং বোঝা গেল কুরআনের অলৌকিকতা (তার ইলম ও মারেফাত) যেমন কখনো শেষ হবে না, তেমনি আমলী কুরআন সীরাতে তাইয়েবার অলৌকিকতাও কখনো শেষ হবে না।-জামে তিরমিযী, হাদীস : ২৯০৬
কুরআন যদি কেয়ামত পর্যন্ত তার সর্বময় উলূম ও ফুনূনের মাধ্যমে মানবজীবনে পূর্ণতার পথ প্রদর্শক হয়ে থাকে তাহলে সীরাতে নববীও তার জীবন্ত আদর্শের সকল শাখা-প্রশাখা
বিস্তার করে মানবতার শান্তি ও কামিয়াবির পথ দেখাবে।
২. সীরাত অধ্যয়ন মুমিনের ঈমান ও আনুগত্যের দাবী
আল্লাহ তাআলা কুরআনে কারীমে মুসলমানদেরকে রাসূল ও রিসালাতের উপর বিশ্বাস স্থাপনের সাথে সাথে তার পূর্ণ অনুসরণ ও আনুগত্য করার নির্দেশ দিয়েছেন।
(তরজমা) তোমরা ঈমান আন আল্লাহর প্রতি ও তাঁর বার্তাবাহক উম্মী নবীর প্রতি যে আল্লাহ ও তাঁর বাণীতে ঈমান আনে এবং তোমরা তার অনুসরণ কর, যাতে তোমরা সঠিক পথ পাও।-সূরা আরাফ (৭) : ১৫৮
(তরজমা) তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর ও রাসূলের আনুগত্য কর এবং সতর্ক হও; যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও তবে জেনে রাখ যে, স্পষ্ট প্রচারই আমার রাসূলের কর্তব্য।-সূরা মায়িদা (৫) : ৯২
(তরজমা) বল, তোমরা যদি আল্লাহকে ভালবাস তবে আমাকে অনুসরণ কর।-সূরা আলে ইমরান (৩) : ৩১
(তরজমা) কারো কাছে সৎপথ স্পষ্ট হওয়ার পরও যদি সে রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ করে এবং মমিনদের পথ ছাড়া অন্য পথ অনসরণ করে, তবে যেদিকে সে ফিরে যায় সেদিকেই তাকে ফিরিয়ে দিব এবং তাকে জাহান্নামে দগ্ধ করব, আর তা কত মন্দ আবাস।-সূরা নিসা (৪) : ১১৫
এই সব বিষয়ের উপলব্ধি কোনো মুসলমানের অন্তরে তখনই আসতে পারে যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাজ-কর্ম, চলা-ফেরা ও ওঠা-বসা সম্পর্কে কেউ নিজ উৎসাহে জানতে শুরু করবে এবং চোখের সামনে সীরাতের আদর্শ ফুটে থাকবে। আর যথাযথভাবে এর উপলব্ধি সীরাত অধ্যয়ন ছাড়া সম্ভব নয়।
৩. সীরাত অধ্যয়ন কুরআন বোঝার সহায়ক
আমরা জানি যে, কুরআন ইসলামী শরীয়তের মৌলিক ও প্রথম উৎস। এবং মানুষের সুখ-শান্তি ও চিরন্তন সফলতার চাবিকাঠি। পৃথিবীর বহু মানুষ বিশেষত মুসলিমগণ কুরআনকে সহীহ অর্থে বোঝা, তার বিধানাবলী জানা এবং এই সৌভাগ্যগ্রন্থের রহস্য সম্পর্কে অবগত হওয়ার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে থাকে। নিঃসন্দেহে বলা যায়, এটা সহজ হবে সীরাত অধ্যয়নের মাধ্যমে।
উলামায়ে কেরামের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কুরআন বোঝার জন্য ‘আসবাবে নুযূল’ এবং ‘নাসিখ-মানসূখ’-এর ইলম অত্যন্ত জরুরি। আর ‘আসবাবে নুযূল’ এবং ‘নাসিখ-মানসূখ’-এর ইলম সীরাতে নববীর সাথে সম্পৃক্ত। এছাড়া কুরআনের ব্যতিক্রমধর্মী বর্ণনাশৈলী ও শ্রেষ্ঠতম অলংকৃত ভাষার কারণে তা সুসংক্ষিপ্ত একটি কিতাব, যার তাফসীর বা ব্যাখ্যা হলো সীরাতে নবী। সুতরাং কুরআনে কারীমকে না সীরাত থেকে আলাদা করে বোঝা যায় আর না তার বিধানাবলী, আদেশ-নিষেধ এবং তত্ত্ব ও নির্দেশনা সম্পর্কে সঠিক সমাধানে পৌঁছা যায়।
৪. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবন মুসলমানদের জন্য সর্বোত্তম আদর্শ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ব্যক্তিত্ব কোনো সাধারণ ব্যক্তিত্ব নয়, বরং তা এক আদর্শ ও অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব। যে সুন্দরতম ও আস্থাপূর্ণ আদর্শ ব্যক্তিজীবন থেকে সামাজিক জীবন সকল ক্ষেত্রে পরিব্যাপ্ত। কুরআনে মুসলমানদেরকে জীবনের সকল ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ‘উসওয়ায়ে হাসানা’কে আদর্শ বানিয়ে চলার যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তার কারণ এটাই।
আর উসওয়ায়ে হাসানা সম্পর্কে অবগত হওয়ার জন্য সীরাতে নববী অধ্যয়ন করার চেয়ে উত্তম তরীকা আর কী হতে পারে।
আমরা যখন সীরাত অধ্যয়ন করব তখন জানতে পারব, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেমন ছিলেন একজন সৎ ও বিশ্বস্ত মানুষ, তেমনি ছিলেন একজন শ্রেষ্ঠতম দায়ী ও অভিভাবক। তিনি যেমন ছিলেন একজন ধৈর্যশীল ও শোকরগুজার বান্দা, তেমনি ছিলেন বিরাট শান ও মর্যাদার অধিকারী এক মহাপুরুষ। যেমন ছিলেন একজন উত্তম ও অকৃত্রিম বন্ধু, তেমনি ছিলেন একজন আদর্শ পিতা ও স্বামী। যেমন ছিলেন ইবাদতগুজার ও রাত জাগরণকারী, তেমনি ছিলেন মুজাহিদ ও সফল সেনাপতি। তিনি ছিলেন এক তুলনাহীন ন্যায়পরায়ণ বাদশা ও নেতা এবং ছিলেন রাজনৈতিক ময়দানের সুঅভিজ্ঞ ‘শাহসোয়ার’ এবং একজন সমাজসেবক ও জননেতা। সর্বোপরি তিনি ছিলেন গভীর চিন্তাশীল এক মানুষ।
তার পবিত্র দিল ও যবানে সর্বদা ছিলো আল্লাহর যিকির। সুতরাং বোঝা যায় ইলম, আমল ও ফিকির হতে হবে যিকরে ইলাহীর সাথে। সেই জ্ঞান কোন জ্ঞান নয় যাতে আল্লাহর স্মরণ নেই।
৫. মানুষের উত্থান-পতন সীরাতের অনুসরণের সাথেই জড়িত
সীরাত অধ্যয়নে জানা যায় দুনিয়াতে মানুষের উত্থান-পতনের ক্ষেত্রে আল্লাহ তাআলার অমোঘ নীতি কী। কুরআনে কারীমে এসেছে- (তরজমা) হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহ ও তার রাসূলের আহবানে সাড়া দাও যখন তিনি তোমাদেরকে ওই পয়গামের প্রতি আহবান করেন, যা তোমাদের মাঝে জীবন সঞ্চার করবে।’’-সূরা আনফাল (৮) : ২৪
অতএব বলা যায়, মানুষের জন্য সীরাত অনুসরণের মধ্যেই রয়েছে সুন্দর ও নিরাপদ জীবন। অপর দিকে রাসূলের নাফরমানির পরিণাম হল ধ্বংস। তাই আমরা দেখতে পাই, যারা রাসূলের ডাকে লাববাইক বলে সাড়া দিয়েছেন, তাঁর আদর্শকে চোখের সুরমা বানিয়েছেন তারাই পৃথিবীতে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছেন। আর যারা তাঁর পয়গামকে প্রত্যাখ্যান করেছে তারা ধ্বংস হয়েছে। এমনকি পৃথিবী থেকে তাদের নামনিশানাও মুছে গেছে। আজও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সেই প্রিয় সাহাবাদের নাম যখনই আসে অজান্তেই মুখে এসে যায় ‘রাযিয়াল্লাহু আনহুম’। আর যখন আবু জাহল, আবু লাহাবের নাম আসে অন্তরে ঘৃণা এসে যায়। মন তাদের লা‘নত করে।
সীরাতে নববীর পাঠকের সামনে যখন এইসব বাস্তবতা ফুটে উঠে তখন মানুষের উত্থান-পতনের ক্ষেত্রে আল্লাহ তাআলার এই অমোঘনীতির উপর অবশ্যই ঈমান বেড়ে যায়।
৬. সীরাতে নববী সকল দ্বিধা-সংশয়ের মহৌষধ
সত্যিকার জ্ঞান ও সকল কল্যাণের উৎস হল কুরআনে কারীম ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাত ও সীরাত। যাকে কুরআন ‘হিকমত’ শব্দ দ্বারা উল্লেখ করেছে। এদু’টো ছাড়া যত জ্ঞান-বিজ্ঞান আর ধ্যান-ধারণা আছে তা একপর্যায়ে মানুষকে দ্বিধা-সংশয় আর অস্থিরতার শিকার করে। এ অবস্থায় সীরাতে নববীই সেই পবিত্র মেঘমালা যা হৃদয়ের বিরানভূমিকে সজীব করে তুলতে পারে। সীরাতে নববীই পারে সকল আত্মিক-ব্যাধি থেকে আরোগ্য দান করতে। সীরাতে নববীই পারে বিশ্ব-মানবতাকে মুক্তির পয়গাম শোনাতে।
হাফেজ ইবনুল ইমাদ হাম্বলী তার ইতিহাসগ্রন্থ ‘শাযারাতুয যাহাব’এ ইমামুদ্দীন ওয়াসেতীর জীবনীতে লেখেন-তিনি কালাম শাস্ত্রবিদ ফকীহদের মাঝে বেড়ে উঠেছিলেন। এ জন্য তার মাঝে ছিল যুক্তি ও দর্শনের মেযাজ। কিন্তু একসময় তিনি অনুভব করলেন, তার অন্তরে শান্তি নেই, স্বস্তি নেই এবং ইয়াকীনের নূর নেই। হৃদয় জুড়ে শুধু দ্বিধা-সংশয় আর অস্থিরতা। তিনি কালাম শাস্ত্রবিদদের পথ ছেড়ে সূফিয়ায়ে কেরামের দ্বারস্থ হলেন। কিন্তু সূফিদের রং-ঢং দেখে আরো বিগড়ে গেলেন। অবশেষ তিনি শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ.-এর শরণাপন্ন হয়ে মনের অস্থিরতা খুলে বললেন।
ইবনে তাইমিয়া রহ. তাকে অসিয়ত করলেন-সব কিছু ছেড়ে সীরাতে নববীর অধ্যয়নে মনোযোগ দাও। সীরাতে নববীই সকল আত্মিক ব্যাধির উপশম। সীরাতে নববীই ঈমান ও ইয়াকীনের চিরন্তন উৎস।
শাইখ ইমামুদ্দীন ওয়াসেতী সীরাত অধ্যয়নে ডুবে গেলেন। হৃদয়জুড়ে যে শূন্যতা ও অস্থিরতা বিরাজ করছিলো তা দূর হয়ে গেল। তিনি অনুভব করলেন, হৃদয় থেকে দ্বিধা-সংশয় সরে গেল।
সর্বসাধারণের জন্য সীরাত অধ্যয়ন
এতো ছিল শুধু ঈমান ও ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে সীরাত অধ্যয়নের গুরুত্ব ও উপকারিতা। এখন দেখা যাক বর্তমান সময়ে বিশ্বমানবতার কল্যাণে সীরাত অধ্যয়নের কী গুরুত্ব ও উপকারিতা রয়েছে। বাস্তবতা হল সীরাত অধ্যয়ন যেখানে মুমিনের ঈমানের দাবি, সেখানে সকল মানবের মানবতারও দাবি। এই সত্যকে যারা উপলব্ধি করে না তারা শুধু নিজের দুশমন নয়; বরং সমস্ত মানবতারও দুশমন। কারণ মানবজাতির মধ্যে মানবতার কল্যাণকামী যদি কেউ থাকেন তাহলে নবুয়াত ও রিসালাতের অধিকারী সেই সত্তাই, যার উপর আমার পিতা-মাতা কুরবান। কেউ মানুক আর না-মানুক, অনুসরণ করুক বা না করুক অন্তত এটুকু তো জানা থাকা দরকার যে, একজন মানুষ সকল দিক থেকে কীভাবে সফল ও পরিপূর্ণ হতে পারে? জ্ঞান ও প্রজ্ঞার সঠিক পরিচয় কী এবং কীভাবে কোন্ মানুষের জীবন সকল যুগের মানবতার পথ-প্রদর্শক হতে পারে?
বর্তমান বিশ্বের অবস্থা
এটা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগ। বর্তমান পৃথিবী অনেক এগিয়েছে। নতুন নতুন আবিষ্কার ও উদ্ভাবন সামনে আসছে। আধুনিক যোগাযোগমাধ্যম সারা দুনিয়াকে হাতের মুঠোয় নিয়ে এসেছে। বস্ত্তবাদের সয়লাব। চারিদিকে ভোগ-সামগ্রীর ছড়াছড়ি। শহর তো শহর, গ্রামগঞ্জও আজ আধুনিকতার সাজে সজ্জিত। শুধু উন্নতি হয়নি মানবতার। চরিত্র ও নৈতিকতা বলতে কিছু নেই। সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধন নেই। শান্তি ও নিরাপত্তাও নেই। সর্বত্র ক্ষুণ্ণ হচ্ছে মানুষের অধিকার। চারিদিকে ভয় ও শংকা। কখন কোথায় কী হয়ে যায় কারোরই জানা নেই। নিরাপত্তাহীনতা একটি সমাধানহীন বিষয়ে পরিণত হয়েছে। নীতি-নৈতিকতা তো এভাবে নষ্ট হয়েছে যে, যে কোনো সময় শক্তিশালী দুর্বলের উপর চড়াও হয়ে বসে। হাসতে হাসতে কোনো রাষ্ট্রকে ইরাক, আফগানিস্তান বানিয়ে দেয়। শিল্প-কলার নামে অশ্লীলতা বৈধ করা হচ্ছে। নারীর মান-সম্মান বিকিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সর্বোপরি অশান্তি ও অনিরাপত্তার এমন প্রাদুর্ভাব হয়েছে যে, শান্তির হাজার উপকরণ উদ্ভাবন করেও শান্তি খুঁজে পাচ্ছে না।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আগমনের পূর্বে দুনিয়ার অবস্থা
ইতিহাস সাক্ষী, এমনই অবর্ণনীয় অবস্থা চৌদ্দশত বছর আগেও পৃথিবীতে বিরাজ করছিলো। যখন দুনিয়া থেকে মানবিকতা নিশ্চিহ্ন হতে চলেছিল। শুধু আরব ভূখন্ডে কেন সারা বিশ্বে অনিরাপত্তা আর অনিশ্চয়তা ছেয়ে গিয়েছিল। সর্বত্র ভয় ও আতংক বিরাজ করছিল। ন্যায়নীতি ও নিরাপত্তা বলতে কিছুই ছিল না। মানুষের কোনো মূল্য মানুষের কাছে ছিল না। কন্যা সন্তানদের জ্যান্ত কবর দেওয়া হতো। দাস-দাসীদের সাথে জানোয়ারের মত আচরণ করা হতো। মদ, জুয়া, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, রাহাজানি এবং সকল প্রকার অন্যায় ও অশ্লীলতা ছিল সাধারণ বিষয়। পৃথিবীর সেই কঠিনতম সময়েই মানবতার দিশারী, রহমাতুললিল আলামীন মুহাম্মাদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরবের মাটিতে আগমন করেন।
তিনি ছিলেন সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন সর্বগুণের অধিকারী, তিনি ছিলেন একজন সাহসী,
পরমুখাপেক্ষীহীন, ধৈর্যশীল, শোকরগুজার, অল্পেতুষ্ট, ত্যাগী, বিনয়ী, দানশীল ও সকল মানবিক গুণের অধিকারী। যেন তাঁর ব্যক্তিত্ব বিশ্ব মানবতার জন্য একটি আয়না, যাতে দেখে দেখে সকল মানুষ নিজের ভেতর-বাইরকে ঠিক করে নিতে পারে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর যখন প্রথম অহী নাযিল হল তখন তাঁর জীবন-সঙ্গিনী খাদিজা রাযি. বলেছিলেন-‘‘আল্লাহ তায়ালা কক্ষনো আপনাকে লাঞ্ছিত করবেন না। আপনি তো আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করেন, বিপদগ্রস্তের পাশে দাঁড়ান, দুর্বলের ভার বহন করেন, মেহমানের সম্মান করেন।’’-সহীহ বুখারী, হাদীস : ৩
তাঁর চরিত্রের প্রশংসা কুরআনে এভাবে এসেছে-তুমি অবশ্যই মহান চরিত্রে অধিষ্ঠিত।-সূরা আলকলাম (৬৮) : ৪
এমনকি মক্কার বিধর্মীরা যারা তাঁর জানের দুশমন ছিল তারাও তাঁর বিশ্বস্ততা, আমানতদারী ও সত্যবাদিতা স্বীকার করত। আবু জাহল বলত, মুহাম্মাদ! আমি তোমাকে মিথ্যাবাদী বলি না, কিন্তু তোমার আনিত বাণীকে ঠিক মনে করতে পারছি না। এমনকি মক্কাবাসীরা তাদের দামী জিনিসগুলো হেফাজতের জন্য কাছে আমানত রাখত। হিজরতের রাতে আলী রাযি.কে নিজের ঘরে রেখে গিয়েছিলেন পরদিন তাদের আমানত তাদেরকে বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য।
ক্ষমার গুণ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ক্ষমার গুণ আলাদাভাবে আলোচনা করার মতই একটি বিষয়। হযরত আয়েশা রাযি. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ব্যক্তিগত বিষয়ে কারো থেকে কখনো বদলা নেননি। খারাপের বদলা খারাপ দিয়ে কখনো নেননি। এমনকি তিনি নিজের জানের দুশমনকেও ছেড়ে দিয়েছেন।
জাবির বিন আবদুল্লাহ রাযি. বর্ণনা করেন-একবার এক যুদ্ধ থেকে ফেরার সময় একস্থানে আমরা বিশ্রামের জন্য থামলাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি বৃক্ষকান্ডে তাঁর তরবারী ঝুলিয়ে রেখে সেখানেই বিশ্রাম করছিলেন। আমরা সবাই একটু দূরে দূরে ছিলাম। হঠাৎ তাঁর ডাকে আমি উঠে গেলাম। কাছে গিয়ে দেখি, এক গ্রাম্যলোক তাঁর সামনে বসে আছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আমি বিশ্রাম করছিলাম তখন এই লোকটি এসে আমার তরবারী নিয়ে নেয়। আমি তাড়াতাড়ি উঠে দেখি আমার খোলা তরবারী তার হাতে। সে আমাকে বলল, আমার হাত থেকে তোমাকে এখন কে বাঁচাবে? আমি বললাম, আল্লাহ। তখন এর হাত থেকে তরবারী পড়ে গেল। হযরত জাবির রাযি. বলেন, এরপরও তিনি কোনোরূপ বদলা নিলেন না।-সহীহ বুখারী, হাদীস : ৪১৩৫
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই ক্ষমার আদর্শ শুধু তাঁর পারিবারিক জীবন পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং তার এই গুণ তিনি ইসলামী রাষ্ট্র-প্রধান হয়েও প্রকাশ করেছেন। মক্কার সেই সব দুষ্ট লোকদের কথা কে না জানে, যারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর প্রিয় সাহাবীদের জীবনকে দুর্বিসহ করে তুলেছিল! যাদের কারণে দেশ ছেড়ে হিজরত করার কষ্ট বরদাশত করতে হয়েছে। এইসব মানুষের ক্ষমার তো কোনো প্রশ্নই আসে না, যাদেরকে সারাবিশ্ব অপরাধী বলে স্বীকার করে। কিন্তু রহমতের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা বিজয়ের দিন তাদেরকে মাফ করে দিয়েছেন এবং ঘোষণা করে দিয়েছেন, আজ তোমাদের উপর কোনো অভিযোগ নেই, তোমরা সবাই মুক্ত।
মধ্যমপন্থী ও ভারসাম্য রক্ষাকারী
তাঁর জীবনের আরেকটি উজ্জ্বল দিক, তিনি ছিলেন অত্যন্ত ভারসাম্য রক্ষাকারী। তিনি ইবাদত বা মুআমালাত সকল ক্ষেত্রেই ভারসাম্য ও সহজতা রক্ষা করতেন। তার ইবাদতের অবস্থা এই ছিল যে, রাতে লম্বা কিয়ামের কারণে পা মোবারক ফুলে যেত। যবানে সর্বদা আল্লাহর নামের গুঞ্জন উঠে থাকতো। সবসময় রোযার এহতেমাম করতেন। দারিদ্রে্যর কষ্ট তো বরদাশত করতেনই, কিন্তু এসব কিছু সত্ত্বেও বৈরাগ্য কখনো পছন্দ করেননি। তিনি বিবাহ-শাদি করেছেন। ব্যবসা-বাণিজ্য করেছেন এবং সাহাবাদেরকে উৎসাহিত করেছেন। তিনি ইরশাদ করেন, ‘‘নিজের হাতের কষ্টের কামাইয়ের চেয়ে উত্তম রিজিক আর কিছু নেই।’’
‘‘আল্লাহর নবী হযরত দাউদ আলাইহিস সালাম নিজ হাতে কামাই করে খেতেন।’’-সহীহ বুখারী, হাদীস : ২০৭২
যদি তাঁর মজলিসে ভয় ও আযাবের বয়ানে কান্না ও নীরবতা এসে যেত তাহলে তাঁর হাসি-খুশি মেযাযের কারণে তা আবার আশা ও আনন্দে ভরে উঠত। একবার এক বৃদ্ধা তাঁর খেদমতে হাজির হল, যেন তার জন্য জান্নাতের দোআ করা হয়। আল্লাহর রাসূল ইরশাদ করলেন, কোনো বৃদ্ধা জান্নাতে যাবে না। বৃদ্ধা খুব বিষণ্ণ হয়ে কান্নাকাটি করতে করতে ফিরে এলো। তখন তিনি সাহাবাদেরকে বললেন, তাকে গিয়ে বল, বৃদ্ধরাও জান্নাতে যাবে, তবে জওয়ান হয়ে যাবে।’’-জামে তিরমিযী, শামায়েল, ২/১৭
বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তা
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যৌবনকাল থেকেই ছিলেন একজন শান্তিপ্রিয়, ন্যায়নিষ্ঠ ও হকতরফদার মানুষ।
সীরাতে ইবনে হিশামে আছে, মক্কায় শান্তি ও নিরাপত্তা বিধানে এবং নিপীড়িত মানুষের সাহায্যার্থে ‘হিলফুল ফুযূল’ নামে একটি সংগঠন তৈরী হয়, যে সংগঠনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও শরীক ছিলেন। অথচ সে সময়ে তাঁর বয়স ছিলো মাত্র পনের থেকে ষোল বছর।
একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করলেন, (‘‘আমি আবদুল্লাহ বিন যা‘দানের ঘরে যেখানে ‘হিলফুল ফুযূল’ প্রতিষ্ঠা হয়েছিল) এমন একটি চুক্তিতে শরীক ছিলাম, যার মূল্য আমার কাছে লাল উটনীর চেয়েও বেশি। এই ইসলামের যামানায়ও যদি সেই চুক্তি ও অঙ্গীকার পূরণের জন্য ডাকা হয় তাহলেও আমি লাববাইক বলব।’’-মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ১৬৫৫
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বয়স যখন তেত্রিশ তখন কুরাইশরা কা‘বা ঘরের পুনর্নিমাণের কাজ শুরু করে। তখন হজরে আসওয়াদ স্থাপন নিয়ে গোত্রগুলোর মাঝে ভীষণ দ্বন্দ্ব দেখা দেয় এবং যুদ্ধের উপক্রম হয়। প্রত্যেক গোত্রই এই সৌভাগ্যকে শুধু নিজেদের হক বলে মনে করতে থাকে। এমতাবস্থায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জ্ঞান ও বিচক্ষণতাই তাদের এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ থেকে রক্ষা করে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দৃষ্টিতে যে কোন মানুষের জান ছিল অত্যন্ত মূল্যবান, যার কারণে তিনি অন্যায় হত্যাকে কবীরা গোনাহ বলে ঘোষণা করেছেন। বিদায় হজ্বের ভাষণে বলেছেন, ‘‘লোক সকল! তোমাদের পরস্পরের জান-মাল তোমাদের উপর এমন সম্মানিত যেমন আজকের দিন, এই মাসে ও এই শহরে।
নারীঅধিকার সংরক্ষণ
এখন নারী স্বাধীনতা ও নারীঅধিকারের দাবি নিয়ে শোনা যায় অসংখ্য শ্লোগান তবুও নারী আজ পদেপদে লাঞ্ছিত অথচ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন প্রেরিত হলেন তখন পৃথিবীতে এরকম অবস্থাই বিরাজ করছিল। সে সময় নিজ ইচ্ছায় কোনো নারীর বেঁচে থাকারও অধিকার ছিল না। এমন পরিস্থিতিতেই নবীয়ে রহমত সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নারীদেরকে তাদের প্রাপ্য বুঝিয়ে দিয়েছেন এবং তাদের শিক্ষা-দীক্ষা প্রদানের গুরুত্ব ও ফজীলত বর্ণনা করেছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি তিনজন মেয়ে-সন্তানকে লালন-পালন করে, উত্তম শিক্ষা ও তারবিয়াত প্রদান করে এবং (বিবাহের উপযুক্ত হলে) বিবাহ দিয়ে দেয়; সর্বোপরি তাদের সাথে উত্তম আচরণ করে তার জন্য রয়েছে জান্নাত। তিনি আরো ইরশাদ করেন, ‘‘যার কোনো বোন বা মেয়ে হয় (এবং সে তাকে জিন্দা কবর না দেয় গর্ভাবস্থায় লিঙ্গ পরীক্ষা করে গর্ভ নষ্ট করে দেওয়াও উক্ত কাজের শামিল, তাকে অনর্থক মনে না করে এবং ছেলে-সন্তানকে অগ্রাধিকার না দেয়) তাহলে আল্লাহ তায়ালা তাকে জান্নাতে দাখিল করবেন।’’-জামে তিরমিযী, হাদীস : ১৯১২
ন্যায়নীতি ও ইনসাফ
তৎকালীন সময়ে আরবে ন্যায় ও ইনসাফের হিসাব করা হতো শুধু নিজ বংশ, গোত্র, বর্ণ ও আত্মীয়তার মধ্যে এবং এখনো সারাবিশ্বে তাই চলছে। রাষ্ট্র, ধর্ম ও দলের ভিত্তিতে বিচারের ফয়সালা হচ্ছে। কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই সকল ব্যবধানকে মিটিয়ে দিয়ে ন্যায় ও ইনসাফের এমন নীতি প্রবর্তন করেছেন, যার মাধ্যমে সকল শ্রেণীর মানুষ ইনসাফ লাভ করেছে এবং ইনসাফের প্রশ্নে কারো বংশ-মর্যাদা, ধনী-দরিদ্র, দল, গোত্র ও রাষ্ট্র বাধা হতে পারেনি।
একবার মাখযূম গোত্রের ফাতেমা নামে এক মহিলা চুরির অপরাধে ধরা পড়ল। তখন নববী-আদালত থেকে তার হাত কেটে দেওয়ার ফায়সালা জারি হল। বিষয়টিকে কেউ কেউ সমর্থন করতে না পেরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খুবই প্রিয় একজন সাহাবী হযরত উসামা বিন যায়েদ রাযি. কর্তৃক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে সুপারিশ করল যে, এমন সম্মানিত একজন মহিলাকে এত বড় একটি অপমানজনক শাস্তি না দেওয়া হোক। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত উসামা রাযি.-এর উপর রাগান্বিত হলেন এবং বললেন, তুমি কি আল্লাহ তায়ালার একটি বিধান বাস্তবায়ন করা থেকে বিরত থাকতে সুপারিশ করছ? এরপর তিনি উপস্থিত জনতাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, লোকসকল! তোমাদের পূর্ববর্তী উম্মতদের ভ্রষ্টতার কারণ এটাই ছিল যে, সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তি কেউ চুরি করলে তাকে ছেড়ে দেওয়া হত। আর ‘হদ’ আরোপ করা হতো দুর্বল কেউ
চুরি করলে। আল্লাহর কছম! আমার কন্যা ফাতেমাও যদি চুরি করে আমি তারও হাত কেটে দেব।-সহীহ বুখারী, হাদীস : ৬৮৮৭
সেবামূলক কাজ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র সীরাতের একটি উজ্জ্বলতম দিক হল ‘খেদমতে খাল্ক’ বা সৃষ্টিসেবা। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শুধু একজন সফলতম দায়ী ও মুরুবিবই ছিলেন না, তাঁর ব্যক্তিত্ব বিস্তৃত ছিল সকল সামাজিক কাজ ও সেবামূলক কাজের মাঝে, যার মাধ্যমে মুসলিম-অমুসলিম সকলে উপকৃত হত। তাঁর দান ভালো-মন্দ সকলের জন্য ছিল। কারো পেরেশানী দেখলে তিনি অস্থির হয়ে পড়তেন এবং এগিয়ে গিয়ে তা দূর করার চেষ্টা করতেন।
ইবনে ইসহাক বর্ণনা করেন, একবার আরাশ গোত্রের এক লোক একটি উট নিয়ে মক্কায় এল। আবু জাহল তার কাছ থেকে উটটি খরিদ করল, কিন্তু টাকা দিতে গড়িমশি করছিল। শেষে ব্যর্থ হয়ে একদিন হারামে কা‘বায় এসে কুরাইশ নেতাদের ধরে সবার সামনে ফরিয়াদ করতে শুরু করল। কিন্তু তাদের কেউই আবু জাহলের বিপক্ষে ওই ব্যক্তির ফরিয়াদ কানে তুলল না। তখন রাসূলে রহমত সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামই এই অপরিচিত এক ব্যক্তির ফরিয়াদে সাড়া দিলেন এবং আবু জাহলের কাছ থেকে তার প্রাপ্য আদায় করে দিলেন।-সীরাতে ইবনে ইসহাক ১/২৬৬
হযরত জাবির রাযি. বলেন, আমি মদীনার এক ইহুদীর কাছ থেকে করয নিতাম। এক বছর আমার বাগানে খেজুরের ফলন খুবই কম হল। যার কারণে ওই ইহুদীর করয আদায় করতে পারছিলাম না। এভাবে একটি বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেল। বাগানে নতুন ফল এল। তখন সে আমাকে করয আদায় করার জন্য তাগাদা দিল। কিন্তু ঘটনাক্রমে সে বছরও ফসল কম হয়েছিল। আমি পরবর্তী ফসল পর্যন্ত সময় চাইলাম। কিন্তু সে রাযি হল না। আমি পুরা ঘটনা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট বর্ণনা করলাম। তখন তিনি কয়েকজন
সাহাবীকে নিয়ে সেই ইহুদীর বাড়িতে গেলেন এবং তাকে কয়েকবার বোঝালেন। কিন্তু সে কিছুতেই রাযি হল না। অবশেষে তিনি জাবির রাযি.এর বাগানের বৃক্ষরাজির মাঝে দাঁড়িয়ে বলতে লাগলেন, খেজুর দিতে শুরু কর এবং দেখতে দেখতেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বরকতে এই পরিমাণ খেজুর বের হল যে, ইহুদীর করয আদায় হয়েও অনেক থেকে গেল।-সহীহ বুখারী, হাদীস : ২১২৭
কোমল ও রহম-দিল নবী
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অত্যন্ত রহমদিল ও মহানুভব ছিলেন। আল্লাহ তায়ালা তাকে রহমাতুল লিলআলামীন হিসেবেই প্রেরণ করেছিলেন। তাঁর পুরো জীবনটাই কেটেছে মানুষের প্রতি সহানুভূতি ও সহমর্মিতার মধ্য দিয়ে। তিনি ইরশাদ করেছেন, ‘‘আল্লাহ এমন ব্যক্তির উপর রহম করবেন না, যে মানুষের উপর রহম করে না।’’-জামে তিরমিযী, হাদীস : ২৩৮১
এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কারো উপর বদ-দোয়া করার জন্য দরখাস্ত করল। তখন তিনি অত্যন্ত রাগান্বিত হয়ে বললেন, ‘‘আমি দুনিয়াতে অভিশাপ দিতে আসিনি।’’-মাজমাউয যাওয়াইদ, হাদীস : ১৩০০৭
একবার কয়েকজন কাছে এসে ‘আসসালামু আলাইকুম’-এর পরিবর্তে (নাঊযুবিল্লাহ) ‘আসসামু আলাইকুম’ (অর্থাৎ তোমার মৃত্যু হোক) বলল। আয়েশা রাযি. তা শুনে ক্রদ্ধ হলেন এবং তাদেরকে কঠিন ভাষায় তিরস্কার করলেন। কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে থামিয়ে বললেন, কোমলভাবে বল, আল্লাহ তায়ালা যে কোন বিষয়ে কোমলতা পছন্দ করেন।-সহীহ বুখারী, হাদীস : ৬২৫৬
পশুপাখির হকের প্রতি খেয়াল
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে শুধু মানুষের উপরই সহানুভূতি ও সহমর্মিতার ফুল ঝরিয়েছেন তাই নয়, জীব-জন্তু ও পশুপাখিও তার ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছে।
ইমাম বুখারী ‘আলআদাবুল মুফরাদ’-এ নকল করেন, একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোনো সফরে যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে একস্থানে যাত্রাবিরতি করলেন। সেখানে দেখলেন কাছেই একটি পাখি তার বাসায় বাচ্চা ফুটিয়ে রেখেছে। একজন সাহবী ছানা দুটি নিয়ে এল। পাখিটি অস্থির হয়ে ডানা ঝাপটাতে লাগল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন, এটাকে কে এভাবে কষ্ট দিচ্ছে? সেই সাহাবী বললেন, আমি তার ছানা দুটি নিয়ে এসেছি। তিনি ইরশাদ করলেন, জায়গামত রেখে দাও।-সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ২৬৬৮
একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোনো এক আনসারীর বাগানে গেলেন। সেখানে একটি শীর্ণকায় উট নজরে পড়ল। আল্লাহর রাসূলকে দেখে উটটি আওয়াজ করতে লাগল। তিনি কাছে গিয়ে তার গায়ে আদরের সাথে হাত বুলিয়ে দিলেন। এরপর লোকদের কাছ থেকে এর মালিকের খোঁজ নিলেন। জানা গেল উটটি একজন আনসারীর। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লোকটিকে বললেন, এর হক সম্পর্কে তুমি কি আল্লাহকে ভয় কর না?-সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ২২৫৪২
পরিবেশ রক্ষা
বর্তমানে পরিবেশ বিপর্যয় এত ভয়ানক রূপ ধারণ করেছে যে, কোনোভাবেই এই বিপর্যয় ঠেকানো যাচ্ছে না। এর সবচেয়ে বড় কারণ তো এটাই যে, পরিবেশ রক্ষার কুদরতি মাধ্যম বা প্রাকৃতিক উপকরণের অপব্যবহার। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, বৃক্ষ-পরিবেশ বা বন-রক্ষার নির্দিষ্ট বিধি-নিয়ম থাকলেও আজ বনের পর বন উজাড় করে আধুনিক শহর তৈরী করা হচ্ছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও বৃক্ষ লাগিয়েছেন, বৃক্ষরোপনের ফযীলত বর্ণনা করেছেন এবং সাহাবীদেরকে উৎসাহিত করেছেন। তিনি ইরশাদ করেন, ‘‘যে একটি বৃক্ষচারা রোপন করে আল্লাহ তায়ালা তাকে ওই বৃক্ষের ফল পরিমাণ সওয়াব দান করবেন।’’-মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ২৩৫২০
এক জায়গায় তিনি এরকমও ইরশাদ করেন যে, ‘‘যদি কেয়ামত এসে যায় আর কারো হাতে কোনো বৃক্ষের চারা থাকে এবং সে এতোটুকু সময় পায় যে, চারাটি রোপন করতে পারবে, তাহলে যেন সে তা রোপন করে দেয়।’’-মুসনাদে আহমদ, হাদীস : রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক সালমান ফারসী রাযি.কে আযাদ করার সেই ঘটনা, যেখানে ইহুদী মালিকের কাছ থেকে তাকে ক্রয় করা হয়েছিল ইহুদীর বাগানে গাছ লাগিয়ে দেওয়ার শর্তে।
তৎকালীন আরবের লোকদের বদ-অভ্যাস ছিল, তারা রাস্তায় পেশাব-পায়খানা করত। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এটা খুব অপছন্দ করতেন এবং নিষেধ করতেন। এই বিষয়ে অসংখ্য হাদীস রয়েছে। এমনিভাবে নোংড়া ও অপরিচ্ছন্নতা থেকে বাঁচানোর জন্য তিনি পরিষ্কার পানিতে পেশাব-পায়খানা করতে নিষেধ করেছেন।
তাঁর মজলিসে সুগন্ধি জ্বালানো হতো এবং তাতে কখনো কখনো কর্পূরও দেওয়া হত।
শিল্প-সংস্কৃতি
আজ শিল্প-সংস্কৃতির নামে যে অশ্লীলতা চলছে এবং যত জোরেশোরে চলছে তা কারো অজানা নেই। নগ্নতাকে বলা হচ্ছে সভ্যতা। এর অনিবার্য ফল হিসেবে বর্তমান প্রজন্মের চরিত্র বিনষ্ট হতে চলেছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানুষের এই সৌন্দর্যপ্রিয়তাকে ভালো ও উত্তম বিষয়ের সাথে জুড়ে দিয়েছেন। ইরশাদ করেছেন, ‘‘আল্লাহ সুন্দর, তিনি সৌন্দর্যকে ভালবাসেন।’’-মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ১৭৩৬৯
‘‘তোমরা কুরআনকে সুন্দর আওয়াজে পড়।’’-মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ১৮৪৯৪
তিনি এই শিল্পকলা ব্যবহার করেছেন মানুষের সুস্থ বোধ, সুন্দর রুচি, মানবিকতা ও উত্তম চরিত্র গঠনে উদ্বুদ্ধ করার লক্ষ্যে।
হযরত হাছছান বিন সাবিত রাযি. এই কাজের জন্য নিয়োজিত ছিলেন। তাঁর সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘‘হে আল্লাহ! রুহুল কুদ্স্-এর মাধ্যমে তাকে সাহায্য করুন।’’-মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ২১৯৩৬
কখনো কখনো তিনি বিভিন্ন কবিতার উদ্ধৃতিও দিয়েছেন। ইরশাদ করেন, ‘‘কবিরা যেসব কথা বলেছেন তার মধ্যে সবচেয়ে সত্য কথা হল লাবীদের এই কথা, ‘আল্লাহ ছাড়া সব কিছুই ধ্বংসশীল।’’
-সহীহ বুখারী, হাদীস : ৩৮৪১
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত মুআওওয়ায বিন আফরার কন্যা রবীয়ার বিবাহে তাদের ঘরে গেলেন এবং বরের বিছানায় বসে পড়লেন। তখন আশেপাশে ছোট ছোট মেয়েরা জড় হয়ে দফ বাজিয়ে শুহাদায়ে বদরের উপর গীত গাইতে শুরু করল। হঠাৎ একজন গেয়ে উঠল, (অর্থ) ‘আমাদের মধ্যে আছেন এমন নবী, যিনি জানেন ভবিষ্যতে কী হবে।’
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এসব বাদ দাও, আগে যা বলছিলে তাই বল।-সহীহ বুখারী, হাদীস : ৫১৪৭
শেষ কথা
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অতুলনীয় জীবন-পদ্ধতি ও শিক্ষা দেখতে দেখতেই মানবজাতির রূপ বদলে গিয়েছে। তেইশ বছরের সংক্ষিপ্ত সময়ে আরব ভূখন্ডের মূর্খ, অশিক্ষিত, উসৃঙ্খল, দ্বন্দ্ববাজ এবং নারীদের জ্যান্ত কবর দানকারী মানুষেরা, একটি সুশৃঙ্খল, সুশিক্ষিত, চরিত্রবান, আদর্শবান, শান্তিপ্রিয় এবং মানুষের অধিকার রক্ষাকারী জাতিতে পরিণত হয়েছিল।
আজও প্রয়োজন সেই সীরাতে নববীর বাণীকে ব্যাপকভাবে প্রচার করা। যদি বর্তমান বিশ্ব বাস্তবিক পক্ষেই বস্ত্তগত উন্নয়নের সাথে সাথে চারিত্রিক ও আত্মিক উন্নতি চায় এবং মানুষকে একটি নিরাপদ ও সুন্দর জীবন উপহার দেওয়ার স্বপ্ন দেখে তাহলে অবশ্যই রাসূলের আদর্শকে চোখের মণি বানিয়ে চলতে হবে। কারণ, বর্তমান সমস্যার সমাধান একমাত্র সীরাতে নববীর মধ্যেই রয়েছে।
সীরাত সর্বকালের মানুষের জন্য কল্যাণময় এক আদর্শ। ষ
অনুবাদ : মাসরূর বিন মনযূর