মক্কা-মদীনার গ্রন্থাগার : ইতিহাস ও পরিচিতি-৩
আলমাকতাবাতুল ‘আম্মাহ
মদীনা মুনাওয়ারা
জাতিকে অধ্যয়ন-অনুরাগী করে তুলতে সাধারণ গ্রন্থাগারের ভূমিকা অনস্বীকার্য। যুগ যুগ ধরে সরকারী-বেসরকারী উদ্যোগে বিভিন্ন দেশে সাধারণ গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং জনগণকে অধ্যয়নমুখী করতে সহযোগিতা করেছে। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়ন সাধনে সহায়তা করেছে। সমসাময়িক ও প্রয়োজনীয় বিষয়ে যথাযথ তথ্য সরবরাহ করেছে। সর্বোপরি জনসাধারণের সার্বিক উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছে।
মদীনা মুনাওয়ারা ইসলামের প্রথম রাজধানী। তাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সময় থেকেই মদীনার সাধারণ জনগণসহ বিভিন্ন দেশ থেকে তালিবুল ইলমরা আসতেন ইলম অন্বেষণের জন্য। সেই থেকেই মদীনায় আস্তে আস্তে গড়ে ওঠে অসংখ্য গ্রন্থাগার, যার কিছু নাম ও পরিচিতি ‘‘মক্কা-মদীনার গ্রন্থাগার : ইতিহাস ও পরিচিতি’’-২ এ উল্লেখ করা হয়েছে। সেই সূত্র ধরেই প্রতিষ্ঠিত হয় আলমাকতাবাতুল ‘আম্মাহ মদীনা মুনাওয়ারা (অর্থাৎ সাধারণ গ্রন্থাগার, মদীনা মুনাওয়ারা)। সাধারণ গ্রন্থাগার যেহেতু জনগণের বিদ্যালয়, তাই এ দৃষ্টিকোণ থেকে আলমাকতাবাতুল ‘আম্মাহ মদীনা মুনাওয়ারা সফলতার সাথে জনগণের মাঝে জ্ঞান বিজ্ঞান সহ যাবতীয় সামাজিক সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে ভূমিকা রেখে চলেছে।
প্রতিষ্ঠা : আলমাকতাবাতুল ‘আম্মাহ মদীনা মুনাওয়ারা ১৩৮৯হিজরীতে প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠার সময় থেকে গ্রন্থাগারটি সউদী সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত ছিল। তবে ১৪২৭হিজরীতে এই গ্রন্থাগারটিকে তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রনালয়ের অধীনে নিয়ে যাওয়া হয়। বর্তমানে এই মন্ত্রণালয়ের অধীনেই তা পরিচালিত হচ্ছে।
অবস্থান : প্রতিষ্ঠা থেকে গ্রন্থাগারটি মসজিদে নববীর দক্ষিণ পশ্চিমে ‘‘হাইউল বাহার’’ নামক এলাকায় অবস্থিত ছিল। বর্তমানে তা মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘‘বাওয়াবা রায়িসিয়্যাহ’’ বা প্রধান ফটক এর সামনে অবস্থিত। মসজিদে কিবলাতাইন থেকে মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে আসতে ডানদিকে চোখে পড়ে মনোরম স্থাপত্য শৈলীতে নির্মিত গ্রন্থাগার ভবনটি। দেখামাত্রই যে কারো চোখ জুড়িয়ে যাবে। ভবনের সামনে উপরে সোনালী প্লেটে লেখা ‘‘আল-মাকতাবা-আল ‘আম্মাহ বি মিনতাকিল মাদীনা আল-মুনাওয়ারাহ’’ অর্থাৎ মদীনা মুনাওয়ারা সাধারণ গ্রন্থাগার।
গ্রন্থাগারের কার্যসময় : ছুটির দিন ছাড়া গ্রন্থাগারটি সপ্তাহের পাঁচদিন খোলা থাকে এবং প্রতিদিন দু’বেলা (সকাল ৮টা থেকে দুপুর ২টা, বিকাল ৪টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত) পাঠক সেখানে
বই পড়াসহ যাবতীয় সেবা গ্রহণ করতে পারে।
গ্রন্থাগারের বিভাগসমূহ : এ গ্রন্থাগারের অনেকগুলো বিভাগ রয়েছে এবং কর্তৃপক্ষ আরো কিছু নতুন বিভাগ খোলার কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। বর্তমানে যে বিভাগগুলো আছে তা হল :
১। প্রধান অধ্যয়ন-হল : এই হলটি এই গ্রন্থাগারের প্রধান অংশ। অধিকাংশ তথ্যগ্রন্থ ও যাবতীয় বই-পুস্তক এখানেই সাজানো রয়েছে। ইলমী মাছাদির-মারাজি বা তথ্যগ্রন্থের সাথে সাথে জ্ঞান-বিজ্ঞান, সাহিত্য-সংস্কৃতি, খেলা-ধুলাসহ যাবতীয় গ্রন্থের সমাহার এখানে।
২। দুর্লভ কিতাব সংগ্রহশালা : একটি গ্রন্থাগারের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে কিছু দুর্লভ গ্রন্থের সমাহার গড়ে তোলা, যার কারণে সাধারণ পাঠক ঐ গ্রন্থাগারের প্রতি আকর্ষণ বোধ করেন। এর প্রতি লক্ষ্য রেখে আলমাকতাবাতুল ‘আম্মাহ মদীনা মুনাওয়ারা একটি দুর্লভ গ্রন্থ বা নাদির কিতাব-এর সংগ্রহশালা গড়ে তুলেছে। এ বিভাগের কিতাব সাধারণত অন্যান্য নিয়মের বাহিরে থাকে। অর্থাৎ চাইলেই তা মুতালাআ করা যায় না বরং কেটালগ দেখে নিদৃষ্ট কিতাবটির জন্য ‘আমিনুল মাকতাবা’ বা গ্রন্থাগারিক-এর অনুমতি প্রয়োজন হয় । এবং অন্যান্য সাধারণ গ্রন্থ ধার নেয়া গেলেও এই নাদের কিতাবগুলো ধার দেয়া হয় না।
৩। পত্রিকা ও সাময়িকী বিভাগঃ এই বিভাগে প্রতিদিন দুটি ইংরেজী পত্রিকা ও লন্ডন থেকে প্রকাশিত আশ-শারকুল আওসাত, সউদী থেকে প্রকাশিত ৯টি দৈনিক পত্রিকাসহ মোট ১২টি দৈনিক পত্রিকা রাখা হয়। প্রত্যেকে নিজ নিজ অভিরুচি অনুযায়ী পত্রিকা পাঠ করতে পারে। পরবর্তীতে দৈনিকগুলোকে দিন, তারিখ ও বছর হিসেবে সংরক্ষণ করা হয়।
দৈনিক পত্রিকা ছাড়াও সউদীসহ আশেপাশের আরব দেশগুলোর বিভিন্ন সংস্থা, প্রতিষ্ঠানের প্রকাশিত শিক্ষা, সংস্কৃতি ও খেলাধুলা বিষয়ক অসংখ্য পত্রিকা ও সাময়িকীর সমাহার থাকে এই বিভাগে। বিভিন্ন শ্রেণীর পাঠক বিভিন্ন ভাবে এ সমস্ত সাময়িকী থেকে উপকৃত হওয়ার সুযোগ পায়।
৪। শিশু পাঠকঃ প্রতিটি দেশের জাতীয় ও সাধারণ গ্রন্থাগারগুলো শিশুদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থাপনা রাখে তাদের গ্রন্থাগারে। আবার কখনো গড়ে তোলে শিশু-গ্রন্থাগার। কারণ সাধারণ পাঠকের মত শিশুর ব্যবস্থা হলে চলে না। তাদের বয়স ও মননের সাথে মিল রেখেই তাদের সামনে তুলে ধরতে হয় জ্ঞান বিজ্ঞানের সকল শাখা। অন্যদের তুলনায় তাদের পরিচর্যা নিতে হয় একটু বেশী। এই শিশুরাই তো আগামীর ধারক বাহক এবং ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে তারাই ভূমিকা রাখবে। এই সমস্ত দিক খেয়াল করে এই গ্রন্থাগারে রাখা হয়েছে শিশুদের জন্য আলাদা পাঠকক্ষ। তৈরী করা হয়েছে তাদের উপযোগী সব বই। রয়েছে অডিও-ভিডিও শিক্ষা মাধ্যম এবং রয়েছে খেলাধুলা ও আনন্দ বিনোদনের মাধ্যমে শিক্ষা দেয়ার ব্যবস্থা। তাই অনেক অবিভাবককেই দেখা যায় প্রতিদিন তাদের সন্তানদের নিয়ে আসেন এবং অধ্যয়ন ও জ্ঞান অর্জনে তাদের আগ্রহী করে তুলেন।
৫। সংস্কৃতি ও বিনোদন কক্ষঃ মূলত এটি একটি অডিটোরিয়াম বা মিলনায়তন। বিভিন্ন উপলক্ষ্যে সভা, সেমিনার ও প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হয় এখানে। অনেক সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী এখানে তাদের সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড পরিচালনা করে। বিভিন্ন ধরনের নাটক ও কৌতুকও মঞ্চস্থ হয় এখানে। তবে সবকিছুই শরিয়তের নীতি ও বিধানের মধ্যে থেকে। আর এই গ্রন্থাগার এ জাতীয় সব কিছুর ব্যবস্থাপনা করে জনগণকে জাগিয়ে তোলার জন্য, অধ্যয়নসহ শিল্প-সাংস্কৃতিক কাজে অগ্রগামী করে তোলার জন্য।
৬। মহিলা পাঠকক্ষঃ এই গ্রন্থাগারটি পূর্বের স্থান ‘‘হাইউল বাহারে’’ যখন ছিল তখন তাদের মহিলা পাঠকক্ষ ছিল। কিন্তু স্থান পরিবর্তনের পর মহিলা পাঠকক্ষের কাজ আরম্ভ করতে একটু দেরি হয়। তাই মহিলা পাঠকক্ষ বর্তমানে নির্মানাধীন।
৭। বাধাই ও ক্যাটালগ বিভাগঃ এই বিভাগ সাধারণ গ্রন্থাগারে আসা নতুন বইগুলোকে তাদের মত করে বাধাই করে এবং ক্যাটালগ তৈরি করে। সাথে সাথে পুরাতন কিতাবগুলোও প্রয়োজনানুসারে বাধাই করে থাকে। এই বিভাগ ক্যাটালগের জন্য লাইব্রেরী ম্যানেজম্যান্টের উপর নির্মিত ‘‘আল-ইয়াসির’’ সফটওয়্যার ব্যবহার করে থাকে।
সেবাসমূহঃ
১। দিকনির্দেশনাঃ গ্রন্থাগারে আগত পাঠক-গবেষকদের কম্পিউটার, টেকনোলজিসহ গ্রন্থাগারের সার্বিক ব্যবস্থাপনা থেকে সহজে উপকৃত হওয়ার জন্য নির্দিষ্ট কিছু লোক সেবা দিয়ে থাকে, কোন্ কিতাব কোথায় আছে তা জানিয়ে থাকে এবং পাঠকদের প্রয়োজনীয় প্রশ্নের উত্তর দিয়ে থাকে।
যে সমস্ত কিতাব ধার দেয়া হয় না সেগুলো দেখা ও পাঠের ব্যবস্থা করা এবং অন্যান্য গ্রন্থ সরবরাহের সেবা দেয় কিছু কর্মী।
২। ধার প্রদানঃ পাঠক যেন গ্রন্থাগার থেকে খুব ভালোভাবে উপকৃত হতে পারেন সে জন্য রয়েছে গ্রন্থ ধার দেয়ার ব্যবস্থা। এর জন্য পাঠককে একটি ফরম পূরণ করতে হয়, যার মধ্যে পাঠকের ব্যক্তিগত তথ্যসহ ধার নেয়ার শর্তাবলী ও নিয়মনীতি উল্লেখ করা আছে। এই ফরম পূরণ করার পর ২০ রিয়াল মূল্যে তাকে একটি কার্ড প্রদান করা হবে, যার মেয়াদ ১বছর। আর এই মূল্য ছাত্রের জন্য অর্ধেক। প্রতিটি কিতাব ধার নেয়ার সময় জমানত স্বরূপ ১০০ রিয়াল জমা রাখতে হয়, যা কিতাব ফেরত দেয়ার সময় পাঠককে ফেরত দেয়া হয়। ধার নিয়ে বই ফেরৎ দেয়ার সময় ১৪দিন। প্রয়োজনে সময় শেষ হলে নবায়ন করারও সুবিধা আছে। মূলত এসব নীতি ও শর্ত গ্রন্থাগারের সুবিধার জন্য করা হয়ে থাকে। কারণ অনেক পাঠক মূল্যবান কিতাব ধার নিয়ে তা ফেরত দেয়ার কথা ভুলে যায়। যার কারণে গ্রন্থাগারের অনেক ক্ষতি হয়, সাথে সাথে ক্ষতিগ্রস্ত হয় অসংখ্য পাঠকও।
৩। ফটোকপিঃ পাঠক-গবেষক কখনো কখনো অধ্যয়নের মাঝে প্রয়োজনীয় কোনো অংশ ফটোকপি করতে চান। কখনো সাধারণ বিক্রয়কেন্দ্রগুলোতে গ্রন্থটি না পাওয়া গেলে পুরো গ্রন্থটি ফটোকপি করতে চান। গ্রন্থাগার কর্তৃপক্ষ ভিতরেই ফটোকপির ব্যবস্থা রেখেছেন, যা কখনো বিনামূল্যে আবার কখনো ন্যায্য মূল্যে সরবরাহ করা হয়।
এছাড়াও নিয়মিত পাঠকদেরকে গ্রন্থাগারের গ্রন্থ তালিকাসহ নতুন আসা গ্রন্থ সম্পর্কে অবহিত করা হয় এবং সাধারণ জনগণের মাঝে অধ্যয়ন মুখিতা সৃষ্টির জন্য ব্যাপক প্রচারণা চালানো হয়। সেই প্রেক্ষাপটে মাঝে মাঝে
বিভিন্ন প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করা হয়।
গ্রন্থাগার কর্তৃপক্ষ তাদের সেবাসমূহ আরো ব্যাপক করার জন্য সর্বদা কাজ করে যাচ্ছে। বিশেষত গ্রন্থ সংগ্রহের ব্যাপারে বর্তমানে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।
শেষ কথা : আমাদের দেশে সরকারী বেসরকারী উদ্যোগে প্রত্যেক থানা শহরেই গড়ে উঠেছে সাধারণ পাঠাগার। এতে করে মানুষ বিভিন্ন বিষয় চর্চার সুযোগ পাচ্ছে। কিন্তু ইসলামী সভ্যতা সংস্কৃতি চর্চায় উদ্বুদ্ধ করতে ইলম ও আমল শিক্ষা দেয়ার লক্ষ্যে আমরা কি তৈরী করতে পেরেছি এধরনের সাধারণ গ্রন্থাগার? যেখানে সর্বসাধারণ এবং মুসলিম-অমুসলিম সকলের রুচির প্রতি লক্ষ্য রেখে বই সংগ্রহ করা হবে। সাধারণ মানুষের মাঝে ইসলামী সভ্যতা সংস্কৃতি বিকাশে বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নেয়া হবে, যার মাধ্যমে সকলের কাছে ইসলামের সুমহান বার্তা পৌঁছে যাবে। সকলেই বিভিন্ন ফিতনামুক্ত জীবন যাপন করবে। তালিবুল ইলমসহ ইসলামী সুধীসমাজ এ বিষয়টি নিয়ে একটু ভাববেন এই আমার প্রত্যাশা। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে সকল ধরনের ভালো ও মহৎ কাজে অংশগ্রহণ করার তাওফিক দান করুন। আমীন।