জুমাদাল উলা ১৪৩৪   ||   মার্চ ২০১৩

সাম্প্রতিক পরিস্থিতি : ঈমান রক্ষার কুরআনী উপায়

আমাদের পরম সৌভাগ্য, আমরা মুসলিম। আমাদের রব আল্লাহ। তিনি ছাড়া আমাদের কোনো রব নেই, আর কোনো রবের প্রয়োজনও নেই। আমাদের নবী হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তিনিই শেষ নবী, তাঁর পরে কোনো নবী নেই, কোনো নবুওয়তের আর প্রয়োজনও নেই। আমাদের দীন ইসলাম। ইসলাম ছাড়া আমাদের আর কোনো দ্বীন নেই। আর কোনো দ্বীনের প্রয়োজনও নেই। এই আমাদের বিশ্বাস, আমাদের পরিচয়। এ ছাড়া আর কোনো পরিচয়ের আমাদের প্রয়োজন নেই। আমাদের মাঝে আছে আল্লাহর সর্বশেষ ওহী- কুরআন ও সুন্নাহ, যা কিয়ামত পর্যন্ত সকল মুমিনের পথের দিশারী। সমস্যায়-সংকটে বান্দা যখন আল্লাহর বিধান অন্বেষণ করবে, সর্বাবস্থায় যা তার প্রথম কর্তব্য, অবশ্যই কুরআন ও সুন্নাহয় সে তা খুঁজে পাবে। আল্লাহ তাঁর পাক কালাম নাযিলই করেছেন বান্দাকে সরল পথ দেখাবার জন্য এবং অন্ধকার থেকে আলোতে আনবার জন্য। আলো ও অাঁধার পৃথিবীতে ছিল, আছে এবং থাকবে। মানুষ যখন আলোর প্রত্যাশী হয় এবং আল্লাহর সামনে সমর্পিত হয়, তিনি তাকে আলো দান করেন। পক্ষান্তরে কেউ যখন আধার অন্বেষণ করে আর আসমানী আলোর প্রতি বিমুখতা প্রদর্শন করে তখন আল্লাহ তাকে অন্ধকারে নিক্ষেপ করেন। এ-ই তাঁর সুন্নত, এই তাঁর শাশ্বত নিয়ম। এই আলোকিত ও অাঁধারজীবী মানুষের বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা করে খলীফায়ে রাশেদ হযরত আলী ইবনে আবী তালেব রা. বলেন, মানুষ তিন প্রকারের : এক. আলিমে রাববানী, যিনি প্রজ্ঞার সাথে মানুষের মাঝে ইলম বিতরণ করেন। দুই. মুতাআল্লিম, যিনি কুরআন ও সুন্নাহর ইলম অন্বেষণ করেন। এই দুই শ্রেণীই হচ্ছে মুক্তির পথের পথিক। পক্ষান্তরে তৃতীয় দলটি হচ্ছে ঐ নির্বোধ ও হীন মানুষের, যাদের কাছে গ্রহণ-বর্জনের কোনো মানদন্ড নেই- না জ্ঞানের আলো, না জ্ঞানীর অনুসরণ। ফলে সকল ভ্রষ্ট-আহবানে এরা সাড়া দেয় এবং অজ্ঞতা ও ভ্রষ্টতায় নিপতিত হয়। মুসলিমসমাজে এ শ্রেণীর মানুষের উপস্থিতি খুবই দুর্ভাগ্যজনক। এ তো হতে পারে অমুসলিম-সমাজে, যাদের কাছে নেই ওহীর আলো। মুসলিমসমাজের কোনো ক্ষুদ্র অংশেরই তো গড্ডলিকা প্রবাহে ভেসে যাওয়ার কথা নয়। তবুও কিছু মানুষ ভেসে যায় এবং ভেসে যাবে, যারা মুসলিমসমাজে জন্মগ্রহণ করেও ইসলামকে হৃদয়ে ধারণ করে না, কিংবা কুরআন-সুন্নাহর আলো দ্বারা উপকৃত হয় না। কিছু মানুষ তো শিরক ও কুফরের স্রোতেও ভেসে যায় এবং ভেসে যাবে। যারা মুশরিক-মুনাফিকের অন্ধ অনুসারী, কুরআন-সুন্নাহয় যা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ। বিখ্যাত ফকীহ সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বলেছেন, ‘তোমরা কেউ কারো এমন অন্ধ অনুসারী হয়ো না যে, সে ঈমানে থাকলে তুমিও ঈমানে, সে কুফরে গেলে তুমিও কুফরে!’ ভক্তি-শ্রদ্ধা, অনুসরণ-অনুকরণ সব কিছুরই নীতি ও বিধান আছে, মাত্রা ও ক্ষেত্র আছে। এই নীতিজ্ঞান ও মাত্রাজ্ঞানের অভাব মানুষকে জাহিল ও অজ্ঞ করে এবং এই নীতি ও বিধান লঙ্ঘনই মানুষকে অনাচারে লিপ্ত করে। শিরক ও কুফরের ক্ষেত্রে তো পিতামাতার অনুসরণও বৈধ নয়। কারণ সন্তানের উপর পিতামাতার যে হক্ব তার চেয়েও বেশি হক্ব বান্দার উপর আল্লাহর। পিতামাতা সন্তানের পৃথিবীতে আগমন ও বেঁচে থাকার উপায়। পক্ষান্তরে আল্লাহ তার স্রষ্টা ও পালনকর্তা। একই কথা উস্তাদ-শিক্ষক, মুরশিদ-মুরবিব, নেতা-পরিচালক, গোত্র-সমাজ, ভাষা ও ভূখন্ড সকল ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। এরা সবাই শ্রদ্ধা ও ভালবাসার পাত্র, কিন্তু দ্বীন ও ঈমানের অধিক নয়। বিরুদ্ধে তো নয়ই; বরং এই সকল শ্রদ্ধা নিয়ন্ত্রিত দ্বীনেরই নীতি ও বিধান দ্বারা। সুতরাং কারো দ্বারা যদি দ্বীনের অবমাননা হয়, সে যে-ই হোক, তার সাথে কোনো মুমিনের বন্ধুত্ব থাকতে পারে না। কারণ দ্বীনের অবমাননা ব্যক্তির কুফর ও মুনাফেকী প্রকাশ করে। কাফির ও মুনাফিক কি কখনো কোনো মুমিনের বন্ধু হতে পারে? কোথাও যদি আল্লাহর আয়াত ও বিধানের অবমাননা হতে থাকে তখন তো ঐ জায়গায় শারীরিক উপস্থিতিও বৈধ নয়। মুশরিক-মুনাফিকের এহেন অপকর্মের সময় মুমিনদের করণীয় সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন- وَقَدْ نَزَّلَ عَلَيْكُمْ فِي الْكِتَابِ أَنْ إِذَا سَمِعْتُمْ آَيَاتِ اللَّهِ يُكْفَرُ بِهَا وَيُسْتَهْزَأُ بِهَا فَلَا تَقْعُدُوا مَعَهُمْ حَتَّى يَخُوضُوا فِي حَدِيثٍ غَيْرِهِ إِنَّكُمْ إِذًا مِثْلُهُمْ إِنَّ اللَّهَ جَامِعُ الْمُنَافِقِينَ وَالْكَافِرِينَ فِي جَهَنَّمَ جَمِيعًا (তরজমা) তোমাদের উপর তো কিতাবে এই বিধান নাযিল হয়েছিল যে, যখন তোমরা শুনবে আল্লাহর আয়াতসমূহ অস্বীকার করা হচ্ছে এবং সেগুলোর সাথে বিদ্রূপ করা হচ্ছে তখন ঐসব লোকের সাথে বসবে না, যে পর্যন্ত না তারা অন্য কথায় লিপ্ত হয়। নতুবা তোমরাও তাদেরই মতো (মুনাফিক গণ্য) হবে। আর নিশ্চয়ই আল্লাহ মুনাফিক ও কাফিরদের জাহান্নামে একত্র করবেন।-সূরা নিসা (৪) : ১৪০ সূরা নিসার এই আয়াতটি মাদানী। অর্থাৎ হিজরতের পরে নাযিল হয়েছে। এ আয়াতে পূর্বের যে আয়াতের উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে, মুফাসসিরগণ বলেন, তা হচ্ছে সূরা আনআমের আয়াত, যা নাযিল হয়েছিল হিজরতের আগে- لِكُلِّ نَبَإٍ مُسْتَقَرٌّ وَسَوْفَ تَعْلَمُونَ (তরজমা) আর যখন আপনি ঐসকল লোককে দেখবেন যারা আমার আয়াতসমূহে লিপ্ত হয় (অর্থাৎ অস্বীকার ও বিদ্রূপ করে) তখন তাদের সঙ্গ ত্যাগ করুন, যে পর্যন্ত না তারা অন্য প্রসঙ্গে লিপ্ত হয়। আর শয়তান যদি আপনাকে ভুলিয়ে দেয় তাহলে স্মরণ হওয়ার পর ঐ জালিমদের সাথে আর বসবেন না।-সূরা আনআম : ৬৭ আল্লাহর রাসূলের মক্কা-জীবনে কুরআনের আয়াত ও বিধান অস্বীকার করত মুশরিকরা আর মাদীনা-জীবনে ইহুদী ও মুনাফিকরা। কাফির ও মুনাফিক গোষ্ঠীর সাথে অন্তরঙ্গতার তো প্রশ্নই আসে না, সামাজিক সাক্ষাত ও মেলামেশার ক্ষেত্রেও উপরের দুই আয়াতে বিধান দেওয়া হয়েছে যে, কখনো তাদের মজলিসে দ্বীন সম্পর্কে কটূক্তি ও সমালোচনা শুরু হলে তৎক্ষণাৎ ঐ মজলিস ত্যাগ করবে। নতুবা তোমরাও তাদেরই মতো মুনাফিক বলে গণ্য হবে। অন্তর থেকে সমর্থন করলে তো প্রকৃত মুনাফিক, আর অন্তর থেকে সমর্থন না করে বিনা ওজরে বসে থাকলে কর্মগত মুনাফিক। এই যদি হয় ঘটনাচক্রে উপস্থিতির বিধান তাহলে ইচ্ছাকৃত গমন ও সংহতি প্রকাশের বিধান কী হতে পারে? কুরআন মজীদের এই নির্দেশ অটল ও শাশ্বত। একটু চিন্তা করলেই বোঝা যায়, এই নির্দেশ একদিকে যেমন নিজের দ্বীন ও ঈমানের জন্য রক্ষাকবচ, অন্যদিকে প্রতিবাদ-প্রতিরোধেরও শক্তিশালী উপায়। আজ যখন ফেসবুক ও ইন্টারনেটে মুশরিক-মুনাফিকদের আসরে ইসলাম সম্পর্কে অশ্রাব্য কটূক্তি ও অশ্লীল মিথ্যাচার হচ্ছে তখন সুশীল ও সত্যনিষ্ঠ মুমিনদের কর্তব্য, ঐসব আসর বর্জন করা। এটা প্রথমত নিজের ঈমান রক্ষার জন্য, দ্বিতীয়ত প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের জন্য। আর তা সুস্থতা ও সুরুচিরও দাবি। কারণ ব্যক্তির উচ্চারণ তো তার রুচি ও চরিত্রেরই প্রতিফলন। শব্দ ও বাক্যের দ্বারা সবার আগে ব্যক্তি উন্মোচিত করে তার নিজের জীবন ও চরিত্রকে। সুতরাং সুস্থ ও সুরুচির অধিকারী কেউ কি অসুস্থ ও চরিত্রহীন কারো সঙ্গ গ্রহণ করতে পারে? এরপর তাদের অপপ্রচারের জবাব-প্রসঙ্গ। এ বিষয়ে প্রথম কথা এই যে, সবার জবাব ও সবকিছুর জবাব একরকম হয় না। যে সত্যি সত্যি জানতে চায় তার যে জবাব প্রাপ্য জানার পরও যে হঠধর্মী করে তারও কি একই জবাব প্রাপ্য? সত্য-সন্ধানীর যে জবাব প্রাপ্য অসত্য মিথ্যাচারীরও কি একই জবাব প্রাপ্য? জালিমের জবাব তো সেটাই যা তাকে জুলুম থেকে নিবৃত্ত করে। এটা শুধু সত্য-ন্যায়ের স্বার্থেই নয়, শুধু সমাজের স্বার্থেও নয়, ঐ দুর্ভাগারও স্বার্থে। তার অপকর্মের ফিরিস্তি দীর্ঘ হতে দেওয়া ঠিক নয়। দেশের দায়িত্বশীলদের বিষয়টি গভীরভাবে উপলব্ধি করা দরকার। দেশের শান্তি-শৃঙ্খলার স্বার্থেই তাদের কর্তব্য, রাসূল অবমাননার বিষয়টা শক্ত হাতে নিয়ন্ত্রণ করা। দ্বিতীয় কথা এই যে, কিছু ইলম আছে যা অর্জন করা ফরজে আইন, অর্থাৎ প্রত্যেক মুসলিমের উপর ফরয। ঐ ফরযে আইন ইলমের একটি প্রকার, ঈমান নষ্টকারী কোনো প্রশ্ন-সংশয় কারো মনে জাগলে এবং ঈমান নষ্টের আশংকা দেখা দিলে সঙ্গে সঙ্গে বিজ্ঞ আলিমের শরণাপন্ন হয়ে তা নিরসনের চেষ্টা করা। উপরে কুরআন মাজীদের যে সুস্পষ্ট বিধান উল্লেখ করা হয়েছে, অর্থাৎ মুশরিক-মুনাফিকের ঈমান-বিধ্বংসী কথাবার্তা থেকে নিজেকে দূরে রাখা, তা লংঘন করার কারণে কিংবা অন্য কোনো কারণে কোনো ঈমানদারের মনে যদি ইসলাম সম্পর্কে, ইসলামের কোনো বিধান সম্পর্কে বা ইসলামের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন-সংশয় জাগে তাহলে তার কর্তব্য, কোনো প্রাজ্ঞ আল্লাহওয়ালার শরণাপন্ন হওয়া। যে ইলমটুকু দ্বারা এ সংশয় দূর হতে পারে তা অন্বেষণ করা ঐ সময় তার উপর ফরয। রোগের অনুভূতি ও উপশমের তীব্র আকাঙ্খা থাকলে মেহেরবান আল্লাহ অবশ্যই তার রোগমুক্তির ব্যবস্থা করবেন। ইনশাআল্লাহ। আখিরাতে কাফির-মুনাফিকদের যেসকল অপকর্মের উপর কঠিন শাস্তির হুঁশিয়ারি শোনানো হয়েছে তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি হচ্ছে, দ্বীনের বিষয়ে কটূক্তি ও সমালোচনাকারীদের সাথে কটূক্তি ও সমালোচনায় লিপ্ত হওয়া। সূরা মুদ্দাচ্ছিরে ইরশাদ হয়েছে, জাহান্নামীদের জিজ্ঞাসা করা হবে, (তরজমা) কী কারণে তোমরা জাহান্নামের অগ্নিতে নিক্ষিপ্ত হয়েছ? তারা বলবে, আমরা তো নামায আদায়কারীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলাম না, মিসকীনদের খানা খাওয়াতাম না, দ্বীনের বিষয়ে (কুফর ও ইসতিহ্যায়) লিপ্ত লোকদের সাথে আমরাও লিপ্ত হয়ে পড়তাম আর হিসাব-দিবসকে অসত্য বলতাম। এ অবস্থায়ই আমাদের কাছে মৃত্যু এসে উপস্থিত হয়েছিল।-সূরা মুদ্দাসসির (৭৪) : ৪২-৪৭ সুতরাং অনুসরণ-অনুকরণ এবং সঙ্গ ও সংশ্রবের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্কতা কাম্য। একজন মুমিন যদি জীবনের সকল ক্ষেত্রে কুরআন-সুন্নাহকেই দিশারী হিসেবে গ্রহণ করেন এবং ঈমানদার ও পরহেযগার ব্যক্তিদের সাহচর্যে থাকেন তাহলে ইনশাআল্লাহ করুণাময় আল্লাহ তাকে সিরাতে মুসতাকীমের উপর রাখবেন এবং সব ধরনের পদস্খলন থেকে রক্ষা করবেন। আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে হেফাযত করুন। আমীন ইয়া রাববাল আলামীন।

ঘোষণা

গত কয়েক সংখ্যা থেকে আলকাউসারের নির্ধারিত কপি শেষ হয়ে যাওয়ার কারণে দ্বিতীয় সংস্করণ ছাপতে হচ্ছে। যার কারণে পাঠকের হাতে পৌঁছতেও কিছুটা বিলম্ব হচ্ছে। এজন্য আমরা দুঃখিত। আমরা পাঠকবৃন্দের দুআ চাই। কেউ যদি কপি বাড়াতে-কমাতে চান তাহলে দয়া করে মাসের বিশ তারিখের মধ্যে সার্কুলেশন বিভাগে যোগাযোগ করার আহবান রইল।-সম্পাদক

 

advertisement