শায়খ সৈয়দ আহমদ রহ. : সাধারণের বেশে অসাধারণ এক মানুষ
আমার আববার নাম সৈয়দ আহমদ চাঁন মিয়া। লোকে তাঁকে ‘চাঁন মিয়া সাব’ নামেই বেশি জানে। তাঁর বাবার নাম সৈয়দ আব্দুল খালেক। দাদা হাফিজ সৈয়দ আব্দুল হাকীম রহ.। জন্মস্থান হবিগঞ্জ জিলার চুনারুঘাট থানাধীন চানভাঙ্গা।
তাঁর দাদা সৈয়দ আব্দুল হাকীম রহ. ছিলেন হযরত শাহজালাল (রহ.) এর জিহাদী কাফেলার সাথী হবিগঞ্জ (তৎকালীন তরফ রাজ্য) বিজেতা বাগদাদ থেকে আগত সায়্যিদ নাসীরুদ্দীন সিপাহ্সালার-(রহ.)-এর বংশধর। সৈয়দ আব্দুল হাকীম রহ. ছিলেন অত্যন্ত খোদাভীরু মুত্তাকী বুযুর্গ। পড়াশোনা করেছেন আসামের এক মাদরাসায়। মানুষ তাঁকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করত।
জন্ম ও ইনতিকাল
আনুমানিক ১৯২৩ খৃষ্টাব্দের দিকে একবার শাইখুল ইসলাম হযরত মাদানী রহ. সিলেট থেকে বানিয়াচং যাওয়ার পথে আমাদের বাড়িতে আসেন। তখন আববা মাতৃগর্ভে। দাদাজী আব্দুল খালেক (রহ.) হযরতের কাছে আশু সন্তানের কল্যাণের জন্য দু‘আ চেয়েছিলেন। এর কিছুদিন পরই আববার জন্ম। হয়তো এ দু‘আই ক্রমান্বয়ে আমাদের জন্য ছায়াদার মহীরূহের রূপ পরিগ্রহ করেছিল। অতঃপর প্রায় দীর্ঘ ৮৭ বছর জীবন পার করে বিগত ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১২ খৃষ্টাব্দে তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন।
শিক্ষা-দীক্ষা
প্রাথমিক শিক্ষা বাবার কাছে সম্পন্ন করেন। এরপর বাবার কাছে স্বপ্নের দারুল উলূম দেওবন্দ গমনের বাসনা ব্যক্ত করেন। কিন্তু বাবা ছিলেন সংসারত্যাগী। তাই তাঁর আশা পূর্ণ হয়নি। বরং উল্টো পড়াশোনা বন্ধ করে তখনি তাঁকে সংসার চালানোর দায়ভার সামলাতে হয়েছিল।
মূলত আববার শিক্ষা-দীক্ষা ছিল অপ্রাতিষ্ঠানিক। হযরত মাদানী রহ. ও তাঁর হাতে গড়া একদল শিষ্য ও ছাত্রবৃন্দ ছিলেন তাঁর শিক্ষক। এভাবেই তাঁর জীবন সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে।
হযরত মাদানীর একাধিক শাগরিদ ও খলীফা উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও তাঁকে দীর্ঘ দিন গবিগঞ্জ দ্বীনী শিক্ষাবোর্ড-এর সহ-সভাপতি হিসেবে রাখা হয়।
১৯৪৮ খৃ. রমযান মাসে তিনি পশ্চিমবঙ্গের কাসার গমন করেন এবং হযরত মাদানীর হাতে বায়াত গ্রহণ করেন। ১৯৫৭ সালে হযরত মাদানী রহ.-এর জীবনের শেষ সফরে পশ্চিমবঙ্গের বাশকান্দিতে হযরতের একান্ত সান্নিধ্যে রমযান অতিবাহিত করেন।
হযরত মাদানীর সাথে আববার সারা জীবনের এই অবিচ্ছিন্ন যোগসূত্র তাঁর জীবনে এত গভীরভাবে রেখাপাত করেছে যা কখনোই মুছে যাবার ছিল না। ‘হুব্ ফিল্লাহ’-মাদানী প্রেমের অতুলনীয় দৃষ্টান্ত অন্যান্য আশিকানে মাদানীর মত তাঁর মাঝেও ছিল পূর্ণ মাত্রায়। জীবনের শেষ দিকেও ‘মদনী ছাব’ কথাটা তাঁর মুখে উচ্চারিত হলেই চোখ দুটো অশ্রুসজল হয়ে উঠত।
শাইখুল ইসলাম হযরত মাদানী রহ.-এর ইনতিকালের পর তাঁর প্রবীণ খলীফা হযরত শায়খে বাঘা, হযরত শায়খে মোগলাবাজারী, হযরত শায়খে ফুলবাড়ী, হযরত শায়খে রায়পুরী, হযরত শায়খে বরুণী, হযরত শায়খে ধুলিয়া প্রমুখের সান্নিধ্য গ্রহণ করেন। কিছুদিন পর ইলম ও প্রজ্ঞায়, কর্ম ও কীর্তিতে শ্রেষ্ঠতম খলীফা হযরত বদরুল আলম শায়খে মোগলাবাজারী রহ.-এর হাতে বায়াত গ্রহণ করেন।
এ সকল আলেমদের সাথে আববার সম্পর্ক ছিল শেখার জন্যই। তাঁর সাথে সব সময় একটি ছোট সাইজের পকেটবই থাকত। এতে তিনি উলামায়ে কেরাম থেকে শিক্ষণীয় যে কোনো ঘটনা, নসীহত, দুআ-দরূদ, হাদীস, নসীহতমূলক শের-আশ্আর লিখে রাখতেন। কেউ কোন কিতাবের উদ্ধৃতি দিয়ে কিছু বললে কিতাবের নাম ও প্রকাশনাতথ্যসহ সবকিছু লিখে রাখতেন-সংগ্রহ করার উদ্দেশ্যে। এভাবে তাঁর পকেটবইগুলোর মধ্যে এর একটি বিশাল সংগ্রহ জমা হয়ে আছে।
অনেক সময় বিভিন্ন কিতাবের গুরুত্বপূর্ণ অথচ দীর্ঘ বিষয়ও নিজ হাতে লিখে রেখে দিতেন। এক সফরে কোনো এক সাথীর কাছে পেলেন ‘মাকতুবাতে শাইখুল ইসলাম’। কয়েক দিনের মধ্যেই পুরো কিতাবটি নিজের খাতায় স্পষ্টাক্ষরে লিখে নেন। অতঃপর তাঁর স্বভাবসুলভ নিয়মে খাতাটিকে বইয়ের মত মজবুত করে বাঁধাই করেছেন, যাতে মনে হয়- একটি বাঁধাই করা কিতাব। প্রায় চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর পর আজও সেই লেখায় কোনো অস্পষ্টতা পরিলক্ষিত হয় না।
খিলাফত লাভ
শায়েস্তাগঞ্জ থেকে রেঙ্গা প্রায় ১০০ কিলোমিটারের পথ। তাও আবার যোগাযোগ ব্যবস্থার দুর্দিনের কথা। তবু তিনি প্রায় প্রতি সপ্তাহেই রেঙ্গা ছুটে যেতেন শায়খের দরবারে। রমযানে নিয়মিতই সেখানে ই‘তিকাফ করতেন। অল্প কিছুদিন পরই হযরত শায়খে রেঙ্গা তাঁকে বায়াত গ্রহণের উপযুক্ত বিবেচনা করত খিলাফত প্রদান করেন।
সুন্নতের অনুসরণ
সুন্নতের অনুসরণ তাঁর স্বভাবে পরিণত হয়েছিল। শেষ বয়সে স্বাভাবিক চেতনা হারালেও সুন্নতের কথা তাঁর ঠিকই মনে থাকত। জুতা পরার সময় জীবনে কোনদিন বাম পায়ের জুতা আগে পরেছেন বলে দেখিনি। কখনো বাম কাতে শুতে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। সারাক্ষণ মাথায় টুপি থাকত। কখনো টুপি নিয়েই ঘুমিয়ে পড়তেন। কথা-কাজ, চলন-বলন, ইবাদত-বন্দেগী সবকিছুতেই সুন্নত ছিল তাঁর নির্বিকল্প আদর্শ।
সুন্নাতের খেলাফ কোনো কাজ দেখলেই তিনি তা শুধরে দেয়ার চেষ্টা করতেন। শাসনের যোগ্য হলে তাই করতেন। শিশুদেরকে সুন্নতের তালীম দিতেন। বাম হাতে কোনো শিশুকে কিছু খেতে দেখলে ভীষণ রেগে যেতেন।
তাঁর মুখের অতি সহজ সাবলীল দুটি বাক্য আমরা প্রতিনিয়তই শুনতাম- ‘হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন’ ব্যস্। এটিই ছিল তাঁর সবচেয়ে শক্তিশালী ও জোরদার কথা।
একটি দোকান একটি ইতিহাস
কৈশোরে দুনিয়াত্যাগী বাবার সংসারের হাল ধরতে সামান্য পুঁজি নিয়ে ব্যবসা শুরু করেন তিনি। জীবনে বহু ধরনের ব্যবসা করেছেন। শেষে প্রায় ৫০ বছর একনাগাড়ে কাপড়ের ব্যবসা করেন। দীর্ঘ জীবনের ব্যবসায় তিনি চোখে পড়ার মতো জাগতিক বড় ধরনের উন্নতি করতে না পারলেও ব্যবসায়ী হিসেবে ব্যাপক খ্যাতি লাভ করেন। কারণ, ব্যবসা তাঁর ইবাদত-বন্দেগীতে, দীনের খেদমতে, দীনের সংগ্রামে, দীনি শিক্ষার প্রচার ও প্রসারে, মানুষের সাহায্য-সহযোগিতা ইত্যাদিতে প্রতিবন্ধক হওয়া দূরের কথা বরং এতে সহায়ক হিসেবেই প্রমাণিত হয়েছে। ব্যবসার সাথে সাথে দীনের খেদমত ও মানবতার সেবার প্রায় সকল ক্ষেত্রেই তাঁর ছিল সমান পদচারণা। সতত ব্যবসায়েও সুন্নতে নববীর যথার্থই অনুসরণ করে গেছেন। কয়েকটি বিষয় এখানে উল্লেখ করা যায়।
তাঁর দোকান সবসময়ই আঞ্চলিক উলামায়ে কেরামের অফিসঘর হিসেবে ব্যবহৃত হত। এখানে বসেই হত স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় উলামায়ে কেরামের গুরুত্বপূর্ণ যতসব পরামর্শ। এখানেই হত তাদের পারস্পরিক সাক্ষাত। এখানেই হত তাঁদের অবকাশযাপন, চা-পান চক্র। আশপাশের চা দোকানীরা উৎসব করে চা বিক্রি করত।
একবার প্রচন্ড শীতের মৌসুমে হযরত শায়খে বরুণী রহ. আসলেন তাঁর দোকানে মাঝরাতে। দোকানে আববা ও এক কর্মচারী পৃথক পৃথক বিছানায় শুয়েছিলেন। হযরত আসার পর আববা নিজের বিছানা হযরতকে দিয়ে পিছনে গিয়ে কর্মচারীকে না ডেকে একটি চাদর গায়ে বসে বসে রাত কাটিয়ে দিলেন!
আববাকে স্মৃতিচারণ করতে শুনেছি-ফখরে বাঙ্গাল তাজুল ইসলাম সাহেব রহ. ইনতিকালের কয়েকদিন পূর্বেও আমার দোকানে চা খেয়ে গেছেন। একাশির নির্বাচনের সময় আববাজী ছিলেন খেলাফত আন্দোলনের জিলা আমীর (সভাপতি)। তাঁর দোকানটিই ছিল অফিস। তখন হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)ও এখানে এসেছেন। একবার নামাযের সময় হয়ে গেলে দোকানেই জামাত হল। হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) আববাকে ইমামতির জন্য সামনে পাঠিয়ে দিলেন।
তাঁর ব্যবসায়িক জীবনের একটি বিরল বৈশিষ্ট্য ছিল দীর্ঘ সময়ে ডজন খানেকের বেশি লোক তাঁর দোকানে কাজ করেছে। এদের সকলেই তাঁকে ভালবাসত প্রবলভাবে। তিনি সব সময় তাঁদের দীনি উন্নতির প্রচেষ্টায় লেগে থাকতেন। ফলে দেখা যেত কিছু দিনের ব্যবধানেই নতুন বেনামাযী কর্মচারী নামাযের পূর্ণপাবন্দ হয়ে যেত। মুখে দাঁড়ি, গায়ে পাঞ্জাবি, মাথায় টুপি। দোকানে বসে বসে নিজের কর্মচারীকে; বরং আশপাশের অনেক দোকানমালিক ও কর্মচারীকেও কুরআন শিক্ষা দিতেন। এভাবে তাঁর দোকানটা একটা কুরআন শিক্ষাগার-মক্তবে পরিণত হয়েছিল।
মিস্ওয়াক ও আতর নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অত্যন্ত প্রিয় সুন্নত। তাই সুন্নতী আমলে মানুষের সহযোগিতার লক্ষ্যে তিনি কাপড়ের সাথে অসঙ্গতি সত্ত্বেও এ ব্যবসা ছাড়েননি। ফলে একসময় তাঁর দোকান আতরের জন্য ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করে।
মানুষ বাজারে টাকা ভাংতি করার জন্য নানা পেরেশানিতে ভোগে। আববাজী রহ. যেন টাকা ভাংতি দেওয়াকে নিজের ব্যবসার কাজের একটা অপরিহার্য অংশ মনে করতেন। ভাংতি দেয়ার উদ্দেশ্যেই প্রতিদিন পাঁচশ টাকার ভাংতির জন্য পাঁচটা করে একশ টাকার নোট একত্র করে একটি বান্ডিল বানিয়ে সামনে রেখে দিতেন। যে-ই আসত আপন কর্তব্য আদায়ের মতই ভাংতি দিতে থাকতেন। এজন্য বহু রকম ভোগান্তি ও পেরেশানি হাসিমুখে সয়ে যেতেন।
সাধারণত অসামর্থবানকে কেউ বাকী দেয় না। তার বাকীর পরিমাণও ছিল বিপুল। আবার গরীব অসহায় শ্রেণীর এমন লোকদেরও বাকী দিতেন, যাদের থেকে পাওনা আদায়ের আশা ক্ষীণ। এর মাঝেই আল্লাহ তা‘আলা তাঁর ব্যবসাকে বরকতময় করে দিয়েছিলেন। অত্যধিক প্রাচুর্য নয়; স্বচ্ছন্দে চলার মত প্রয়োজন মাফিক আয়ের ব্যবস্থা আল্লাহ তাঁকে করে দিয়েছেন সারা জীবন।
লোকে বলে মানুষ চেনার সবচেয়ে কার্যকর মাধ্যম- লেনদেন। আল্লাহ তা‘আলার খাছ মেহেরবানীতে আববাজী রহ.-এর পুরো জীবনটাই ছিল অর্থনৈতিক লেনদেনের। কিন্তু সুদীর্ঘ প্রায় নববই বছরের জীবনে শত্রু-মিত্র নির্বিশেষে কেউ লেনদেন বিষয়ে তাঁর উপর কোনো কালিমা লেপন করা দূরের কথা, সন্দেহ পোষণ করারও কোন সুযোগ পায়নি কোনো দিন।
মানুষ তাঁকে একটি নিরাপদ ব্যাংক মনে করে নগদ অর্থকড়ি ও মূল্যবান কাগজপত্র তাঁর কাছে আমানত রাখত এবং টাকা পয়সা ধার নিত। দোকানে একটি বিশালকায় লোহার সিন্দুক ছিল। সিন্দুক ভর্তি টাকা থাকত। প্রতিদিনের বেচা-কেনার মতই মানুষ টাকা জমা রাখত, আবার কেউ জমা টাকা তুলে নিত। দৈনন্দিন হিসাবের খাতায় বেচা কেনার হিসাবের সাথে আমানত গ্রহণ ও প্রদানের দুটি পৃথক ঘর করা থাকত। মানুষ আমানত রেখে নিরাপত্তা পেত, শান্তি পেত এবং দু‘আ করত প্রাণভরে।
সুপরিচিত ইসলামী রাজনীতিবিদ মাওলানা আব্দুর রব ইউসূফী সাহেব বলেন- ‘স্বাধীনতার আগে আমি তাঁর কাছে কিছু টাকা আমানত রেখেছিলাম। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুদ্রা পরিবর্তন হয় এবং সকলকে পুরাতন টাকা জমা দিয়ে নতুন টাকা নেওয়ার জন্য আহ্বান করা হয়। বিষয়টি আমার জানা ছিল না। অনেকদিন পর তাঁর সাথে দেখা হলে-রসিকতাচ্ছলে আমাকে জিজ্ঞেস করেন-আপনার টাকা কি পরিবর্তন করেছেন? বিষয়টা বুঝতে পেরে আমি হতাশ হই। তখন তিনি হেসে বললেন-চিন্তার কোনো কারণ নাই, আমি আপনার টাকা পরিবর্তন করে রেখেছি। এভাবেই তিনি মানুষের আমানতের হেফাযত করেছেন’।
আববাজী রহ. সমাজের স্বাভাবিক স্রোত থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন হয়ে সক্ষম-অক্ষম সকল শ্রেণীর বিত্তহীন ও বিপদগ্রস্ত মানুষদের কেবল আল্লাহ্র ওয়াস্তে, অব্যাহতভাবে ঋণ দেওয়ার ধারা চালু রাখেন আপন ব্যবসার কাজের মতই।
উলামা-মাশায়েখ, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, আত্মীয়-অনাত্মীয় সকল শ্রেণীর মানুষই তাঁর কাছ থেকে ঋণ নিয়ে উপকৃত হয়েছেন। বিশেষত আলেম-উলামাদের কদর ছিল তাঁর কাছে বেশি। শায়খে বাঘা, শায়খে মোগলাবাজারী, শায়খে বরুণী প্রমুখ মাশায়েখে কেরাম তাঁর কাছে টাকা আমানতও রেখেছেন। তাঁর কাছ থেকে ধারও নিয়েছেন। আববার ইনতিকালের পর খলীফায়ে মাদানী হযরত শায়খ আব্দুল মুমিন সাহেব (দামাত বারাকাতুহু)- এর সাথে দেখা করতে গেলাম। তিনি ভাবাবেগে জড়িয়ে চোখ বন্ধ করে অনেক কথাই বললেন। আর বললেন-‘‘একটা মানুষ চলে গেলেন। ‘সৈয়দ সাহেব’ ছিলেন আমাদের ‘তহ্বিল’। কোন প্রয়োজনে তাঁর কাছে টাকার জন্য গেলে খালি হাতে আসতে হয়নি কখনো। তাঁর কাছে টাকা না থাকলেও শান্তভাবে বলতেন-বসেন, ব্যবস্থা করে দিচ্ছি; আহ্’’!
ইবাদত বন্দেগী
নামায ‘চোখের শীতলতা’ হাদীসটির যথার্থতা তাঁকে দেখলে উপলব্ধি করা যেত। যৌবন ও প্রৌঢ়ত্ব ছাড়িয়ে বার্ধক্যে তাঁকে আমি দেখেছি। তখনও নামাযের প্রতি তাঁর আকর্ষণ, নামাযে মনোযোগ ও খুশু-খুযু, সদা নামাযের প্রতি মানুষকে দাওয়াত দেওয়া, নামাযের জন্য পরিবারের শিশু থেকে নিয়ে দোকান কর্মচারীসহ সকল অধীনস্তদের শাসন করা ইত্যাদি দেখে মনে হত নামায তাঁর সবচেয়ে প্রিয় কাজ, সত্যিই নামায তাঁর ‘চোখের শীতলতা’।
জামাতের গুরুত্ব ছিল তাঁর কাছে অত্যধিক। নিয়মিতই বিভিন্ন প্রসঙ্গে তাঁর মুখে বিনা ওজরে জামাতে অনুপস্থিত লোকদের বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দেয়ার সংকল্পের মত কঠোর হুশিয়ারীমূলক হাদীসগুলি শুনতাম।
ইশরাকের নামায, ভরপুর মসজিদে আওয়াবীনের নামায ও শেষ রাতে নির্জনে তাহাজ্জুদের নামায সবগুলোর ধরন-ধারণ ছিল এক ও অভিন্ন। নিয়মিত এবং খুশু-খুযুতে সমৃদ্ধ।
নামাযের মত কুরআন তিলাওয়াতও ছিল তাঁর জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাঁর আবেগপূর্ণ গম্ভীর আওয়াজের তিলাওয়াত, তিলাওয়াতের আদাব, পূর্ণ একাগ্রতা ও মনোযোগিতার যে চিত্র আমার শিশুমনে গেঁথে গেছে এর উপমা আর খুঁজে পাইনি। সকালের ঘুম তার কাছে খুব অপছন্দনীয় ছিল। সকাল বেলা তাঁর এবং সন্তানদের কুরআন তিলাওয়াতে ঘর মুখরিত হয়ে উঠত। দোকানে বসে এত পরিমাণে তিলাওয়াত করতেন যে, দেখলে মনে হত দোকানে তাঁর কাজই ছিল তিলাওয়াত। কুরআন মাজীদের যত্ন ও আদব রক্ষায় ছিলেন খুব সতর্ক।
যখন অসুস্থতা ও দুর্বলতার কারণে দোকানে ও মাদরাসায় যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়, তখন পুরো সময়ই কাটাতেন কেবল কুরআন তিলওয়াতে। কখনো আফসোস করে বলতেন, আর পারি না! আমি একবার পরামর্শ দিলাম- আববা আপনি হেলান দিয়ে বসে বসে তিলাওয়াত করতে পারেন। বিরক্তভরে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন- ‘বাবা কুরআন মাজীদের আদব আছে না’।
রমযান মাস ছিল আববাজীর নামায ও তিলাওয়াতের মাস। শাইখুল ইসলাম হযরত মাদানী রহ.-এর পর শায়খে মোগলাবাজারী রহ. যতদিন হায়াতে ছিলেন, ততদিন রমযানে শায়খের দরবারেই ইতিকাফ করতেন। তারপর নববইয়ের দশকে ফিদায়ে মিল্লাত রহ. ঢাকার চৌধুরীপাড়া মাদরাসায় এলে মেঝো ভাই মাওলানা তানভীর ছিফাতুল্লাহ্ (মুহতামিম জামিয়া হুসাইনিয়া শায়েস্তাগঞ্জ)-কে নিয়ে সেখানে ইতিকাফ করেন। রমযানে প্রায় পুরো রাত ইবাদত-বন্দেগীতেই কাটাতেন। রমযানের শেষ দশক এলে আমাদেরকেও রাত জাগতে বলতেন। নিজের কথা না বলে, মাদানী সাহেব ও অন্যান্য আকাবিরের রমযান যাপনের কথা আমাদের প্রায়ই শুনাতেন। প্রতি বেজোড় রাতেই মুসল্লীদেরকেও উৎসাহ দিতেন রাত জাগার জন্য। সারাদিন তিলাওয়াতের মধ্যেই কাটত। নিয়মিত দোকানে উন্মুক্ত ইফতারের আয়োজন হত।
দু‘আ ছিল তাঁর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য। প্রতি দিন নিয়মিত চার পাঁচ বার লম্বা লম্বা দু‘আ করতেন।
বাড়িতে থাকাকালীন সময়ে শুক্রবার দিন বাদ আছর মোবারক সময় বিবেচনা করে পরিবারের সবাইকে নিয়ে দু‘আ করতেন নিয়মিত। এতে ঘরের ছোট্টমনিরাও অংশগ্রহণ করত প্রবল আগ্রহের সাথে। আববার দু‘আ ও তাঁর কান্না সকলের চোখের পানি ঝরাত। দু‘আ শেষে মনে হত পৃথিবীটা কত সুন্দর নিষ্কণ্টক। তৃপ্তিতে ভরে যেত মন।
চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও ব্যক্তিজীবন
আববাজী রহ.-এর অনুপম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য তাঁকে শিশু থেকে বৃদ্ধ আপন পর সকলের কাছেই পরম প্রিয় করে রেখেছে। লোভ, হিংসা-বিদ্বেষ, স্বার্থপরতার কোন চিহ্নও তাঁর মাঝে ছিল না। তিনি ছিলেন স্বল্পভাষী, সদা সহাস্য-সদালাপী।
তাঁর চরিত্রে বিনয়-নম্রতা, ক্ষমা ও উদারতা দীপ-শিখার মত জ্বল-জ্বল করত। বংশগত আভিজাত্য, আজন্ম ভদ্রতা, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিঃশর্ত অনুকরণের অদম্য স্পৃহা ও উলামায়ে কেরামের সুহ্বত তাঁকে অপরূপ চারিত্রিক রূপশোভা দিয়ে একজন পরিপূর্ণ আদর্শ মানুষরূপে তৈরী করেছিল।
আমার বৃদ্ধ বাবাকে আমি দেখেছি ইবাদত-বন্দেগী ও শত ব্যস্ততার পরও নিজের কোন কাজ অন্যকে দিয়ে করাতেন না। সকালে পরিবারের শিশুদের পড়ানো, তাদের খাওয়ানো, প্রতিদিন গোসল করানো, শুক্রবারে চুল নখ কেটে দেওয়া, নিজের কাপড় চোপর ধোয়া, নিজের ও পরিবারের ছিড়ে যাওয়া কাপড় সেলাই করা, সকলের বই খাতা মলাট করা, বাঁধাই করা, মাদরাসায় পড়ানো, দোকান, মাদরাসা ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের যাবতীয় হিসাব-নিকাশ করা, দৈনিক মাছ-তরকারি কেনাসহ সব কাজ নিত্যদিনই রুটিন মাফিক করতেন।
খাবার ছিল পরিমিত এবং সময়মত। পূর্ণ মনোযোগিতার সাথে খাবার খেতেন সম্পূর্ণ সুন্নত তরীকায়। বসতেন ঠিক মনিবের সামনে গোলামের বসার মতো। সাধারণত তাঁর কোনো খাবারের অংশ মাটিতে পড়ত না। অন্য কারো কিছু পড়ে গেলেও তিনি উঠিয়ে নিজে খেতেন অথবা অন্যকে খাইয়ে দিতেন। খাবার শেষে হাত ধোয়ার আগেই হাত বা প্লেট দেখলে মনে হত খাবার এখনো শুরু হয়নি। অনুরূপ তাঁর হাঁটাও ছিল মাপাঝোকা। সব সময় পথের ডান দিকে চলতেন। চোখ থাকত নিচের দিকে।
দীনি খিদমাত
আববা প্রায় নববই বছরের দীর্ঘ জীবনে বহুমুখী দীনি খিদমাতের সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করে রেখেছিলেন। এতদঞ্চলে যত ধরনের সহীহ দীনি কাজ হয়েছে সবগুলোতেই তাঁর সম্পৃক্তি ছিল আবশ্যিক।
জামিয়া হুসাইনিয়া শায়েস্তাগঞ্জ
শায়েস্তাগঞ্জ সংলগ্ন লস্করপুর ছিল এককালে তরফ রাজ্যের রাজধানী। বর্তমানেও শায়েস্তাগঞ্জ রেলপথ ও সড়কপথে সিলেট বিভাগের প্রবেশপথ। একসময় নৌপথেও এটি একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ এলাকা হিসেবে বিবেচিত হত। কিন্তু গভীর গ্রামে অবস্থিত হাঁসার গাঁও মাদরাসা ছাড়া এর দু’দিক দিয়ে প্রায় ত্রিশ কিলোমিটারব্যাপী কোন কওমী মাদরাসা ছিল না। ফলে শায়েস্তাগঞ্জ পুরান বাজার ও আশপাশের এলাকা মূর্খতার অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল। আশপাশের প্রায় সকল গ্রামই শির্ক-বিদআতে ভরপুর ছিল।
আশির দশকের শেষের দিকে আববা উক্ত পরিস্থিতি বিবেচনায় তখনি একটি প্রতিষ্ঠান করার পরিকল্পনা নিয়ে বন্ধু-বান্ধব উলামায়ে কেরামদের সাথে মতবিনিময় করতে থাকেন। অবশেষে তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু মাওলানা নূরুল হক ধরমন্ডলী, মাওলানা মুখলিছুর রহমান ও মাওলানা তাফাজ্জুল হক সাহেব প্রমুখের পরামর্শে নিজের যৎসামান্য সামর্থ্য থেকে প্রায় ত্রিশ শতাংশ জমি ওয়াক্ফ করে একটি মাদরাসার সূচনা করেন। সকল উলামায়ে কেরাম তাঁকেই প্রতিষ্ঠাতামুহতামিম হিসেবে দায়িত্বভার চাপিয়ে দেন। এর প্রথম শিক্ষাসচিব ছিলেন তাঁর জামাতা মাওলানা আব্দুল কুদ্দুস সাহেব। মাদরাসার তৃতীয় বৎসরে নায়েবে মুহতামিম হিসেবে যোগ দেন মাওলানা নূরুল ইসলাম ওলীপুরী সাহেব।
সত্যিই এ মাদরাসা এত আলো বিতরণ করেছে যে, কোন বিবাদ-বিসংবাদ ছাড়াই এলাকার সব অন্ধকার দূর হতে শুরু করেছে। বিদআতের প্রভাব দ্রুততার সাথে হ্রাস পাচ্ছে। এক মাদরাসা জন্ম দিয়েছে আরো একাধিক মাদরাসার। আশপাশে সকল গ্রামেই-যেখানে বিদআত ছিল সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে, সেখানে এখন উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আলেম তৈরী হয়েছে। প্রায় সকল মসজিদেই যোগ্য ইমামের ব্যবস্থা হয়েছে। প্রায় প্রত্যেক ঘরেরই কোন না কোন ছেলে মাদরাসায় অন্তত আসা যাওয়া করেছে। অথচ মাদরাসা হওয়ার পূর্বে এ গ্রামে আমার বড় ভাই ছাড়া আলেম-হাফেজ দূরের কথা একজন ক্বারীও ছিলেন না।
আববার দীর্ঘ দিনের লালিত স্বপ্ন বাস্তব হল। খালি মাঠের মাঝখানে একটি অপূর্বসুন্দর ইলমের বাগিচা সুবাস ছড়াতে শুরু করল।
দীর্ঘ একটা সময় পর্যন্ত মাদরাসার কোন বোর্ডিং ছিল না। তাই নবাগত ছাত্র-শিক্ষকদের সকলের খাবারের আলাদা ব্যবস্থা না হওয়া পর্যন্ত আমাদের ঘরেই তাদের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা ছিল। বছরের শুরুতে দশ-পনেরজন ছাত্র এক সাথে আমাদের বাংলাঘরের বারান্দায় কাতার ধরে বসে খানা খেত। আর এ সব রান্না-বাড়া করতেন আমার মহীয়সী মা। খাবার পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব ছিল আমাদের উপর। মনে পড়ে একদিন ডেগভর্তি ডাল পড়ে গিয়ে আমার পুরো পা পুড়ে গিয়েছিল। অনুরূপ মাদরাসার ফান্ডে টাকা থাকুক আর নাই থাকুক মাদরাসার যাবতীয় কার্য নির্বাহ হত আববার ক্ষুদ্র ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকে। নিয়মিত সকল উস্তাদের বেতন পরিশোধ করতেন এভাবেই।
একবার মহাসড়কের কাজে সরকার অনেকের মত আমাদেরও বেশকিছু জমি নিয়ে নেয়। এর বিনিময়ে পাওয়া টাকা দিয়ে কেউ কিনেছে জমি, কেউ করেছে বাড়ি, গাড়ি। আববাকে জিজ্ঞেস করলাম- আপনি টাকা কী করেছেন? উত্তরে বললেন-‘মাদরাসার কিছু জমি কেনা হয়েছে, ঘর বানানো হয়েছে, এতে খরচ হয়ে গেছে!’
যখনই দুনিয়া থেকে চলে যাবার কথা মনে হত, তিনি অসিয়ত করতেন-‘আমার মাদরাসাটা দেখো’। আমাকে কতবার কত করে বলেছেন-‘বাবা আমার মাদরাসার প্রতি খেয়াল রেখো’।
মৃত্যুর প্রস্ত্ততি, ইন্তিকাল ও কাফন-দাফন
আববাজী রহ. সব সময়ই মুত্যুর জন্য প্রস্ত্তত থাকতেন। তাঁর ওয়াজের একটি নিয়মিত বিষয় ছিল-মৃত্যু ও তৎপরবর্তী যিন্দেগী। প্রায় সবসময়ই তাঁর মুখে এ হাদিসটি শোনা যেত- ‘তোমার মরণের পরের জগৎটা হয়ত একটা দোজখের ‘গাড়া’ হইব, না হয় জান্নাতের একটি বাগিচা’।
নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: ‘যে ব্যক্তি রাতে একবার ‘সায়্যিদুল ইসতিগফার’ পড়বে, সে যদি ঐ রাতে মারা যায় তাহলে সে জান্নাতি। আর যে এ দু‘আটি দিনে পড়বে, অতঃপর ঐ দিনে যদি সে মারা যায়, তাহলে সে জান্নাতি’। হয়ত এ আশাতেই আববা সর্বদা এ দু‘আর আমল করতেন।
ইতিমধ্যে আববার শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটে। একদিন আম্মা আমাকে ফোন করে বললেন-‘বাবা এ বছর মাদরাসা থেকে ছুটি নিয়ে বাড়িতে চলে আস। যতদিন তোমার আববা হায়াতে আছেন তাঁর একটু খেদমত কর। তোমার খুব প্রয়োজন’। আম্মার কথায় আমি চিন্তায় পড়ে গেলাম। একদিকে মাদরাসার এত ব্যস্ততা, অপরদিকে আববার অবস্থা, আমি কী করব? আমার উস্তাদ ও মুরববী-যাকে আমি প্রাণাধিক ভালবাসি, হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক ছাহেবকে বিষয়টা জানালাম। ধারণা ছিল হুজুর হয়ত বলবেন, মাদরাসা তো আর বাদ দেওয়া যাবে না। যাওয়া আসা কর, তোমার আম্মাকে বুঝিয়ে বল। কিন্তু আশ্চর্য! আল্লাহ্র ইঙ্গিতে হুজুর আমার কথা শোনামাত্রই বিলম্ব না করে বললেন-‘এখানে ভাবার কি, আপাতত এক সপ্তাহের ছুটি নিয়ে বাড়ি চলে যাও। পরে দেখা যাবে কী হয়’। হুজুরের কথার আওয়াজ ও ভঙ্গিতেই আমার সব দ্বিধাদ্বন্দ্ব দূর হয়ে গেল। আমি সাথে সাথে ছুটি নিয়ে বাড়িতে রওয়ানা করলাম।
যখন বাড়িতে পৌঁছলাম তখন প্রায় সন্ধ্যা নেমে এসেছে। আববার সাথেই প্রথম দেখা হল, মুসাফাহা হল, তাঁর জীবনের শেষ হাসিটাও দেখা হল-যেভাবে তিনি প্রতি সপ্তাহে আমাকে দেখে হাসতেন, এবারও ঠিক তেমনি হাসলেন। তখনো জানা ছিল না এটিই তাঁর এ জীবনের শেষ হাসি! আমাকে সারা জীবন এ হাসির স্মৃতি ধরেই থাকতে হবে!
পরদিন শুক্রবার। আসরের পর তাঁকে সামনে নিয়ে আমরা কেঁদে কেটে দুআ করলাম। রাতভর চারপাশে আমরা দুআ-তিলাওয়াত করছি। তিনি অনুচ্চস্বরে আল্লাহ আল্লাহ যিকির করছেন। এভাবে রাত শেষ হয়ে এল।
আমি বসলাম বাকি সবাই নামায পড়তে গেলেন। দেখতে দেখতে আববার অবস্থার পরিবর্তন হতে লাগল। যিক্রের শব্দ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হতে লাগল। এবং খুব স্বাভাবিক ভাবেই দু’টি বড় নিঃশ্বাস ফেলার মধ্যেই আববার ইহজীবনের অবসান ঘটল। চিরশান্তির আলয়ে (ইনশাআল্লাহ) আড়াল হয়ে গেলেন তিনি।
মুহূর্তেই আববার ইনতিকালের সংবাদ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। আর আববাকে দেখার জন্য আসা মানুষের ভিড় বাড়তে থাকে। জানাযার সময় পার হয়ে যাচ্ছিল তবু দেখতে চাওয়া মানুষের ভিড় সামাল, দেওয়া যাচ্ছিল না। এক হিন্দু ভদ্রলোককে দেখেছি- দুচোখে ঝর ঝর করে পানি ছেড়ে দিল আববার কথা বলে। সবাই আবাক হচ্ছিল এতদিনের অসুস্থতার পরও চেহারার এত ঔজ্জ্বল্য দেখে।
আসরের জামাত শেষে মাদরাসার দক্ষিণস্থ বিশাল ধান ক্ষেতগুলোতে হাজার হাজার মুসল্লীর একটি জামাতে বিকাল ৫ টায় তাঁর জানাযা হয়। নামায শেষে মাদরাসা মসজিদ সংলগ্ন পশ্চিমে তাঁকে দাফন করা হয়। শেষবারের মত দেখে মুখটা ঢেকে দেই।
আল্লাহ্ এই চেহারার ঔজ্জ্বল্য তুমি বাড়িয়ে দাও। তুমি এর দীপ্তি চিরস্থায়ী করে দাও। তুমি তাঁকে আফিয়ত ও প্রশান্তি দান কর। তুমি তাঁর সওয়াল-জওয়াব আসান করে দাও। তাঁর সকল নেক কাজকে তুমি কবুল করে নাও। সব ভুল-ত্রুটি তুমি ক্ষমা করে দাও। আমীন।