কাদিয়ানী সম্প্রদায় ও জাতীয় দৈনিকের বিজ্ঞাপন : একটি পর্যালোচনা
আকীদায়ে খতমে নবুওতের অর্থ, হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ তাআলার সর্বশেষ নবী ও রাসূল। তাঁর পরে কোনো নবী বা রাসূল আসা সম্ভবই নয়। কারণ আল্লাহ তাআলা নবুওত ও রিসালাতের ধারাবাহিকতা তাঁর মাধ্যমে সমাপ্ত করেছেন এবং কুরআন মাজীদে তাঁকে ‘খাতামুন নাবিয়্যীন’ বলে ঘোষণা করেছেন। সুতরাং তিনিই শেষ নবী এবং তাঁর শরীয়তই শেষ শরীয়ত। কিয়ামত পর্যন্ত বর্ণ, গোত্র, ভাষা ও ভূখন্ড নির্বিশেষে প্রত্যেক মানব-সন্তানের জন্য তাঁর আদর্শই শিরোধার্য এবং তাঁর প্রতি ঈমান ও আনুগত্য অপরিহার্য। ইসলামে খতমে নবুওতের আকীদা ঐরকমই অকাট্য, সুস্পষ্ট ও সর্বজনবিদিত যেমন নবুওতের আকীদা। অর্থাৎ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবী হওয়া এবং আখেরী নবী হওয়া দু’টো আকীদাই সমান অকাট্য। এটি দ্বীন ইসলামের মুতাওতির বিষয়াদির অন্যতম। কুরআন মাজীদেও এর স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা বিদ্যমান।
আল্লাহর শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খতমে নবুওতের আকীদা সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছেন । শুধু তাই নয় অনেক হাদীসে এই ভবিষ্যদ্বাণীও করে গেছেন যে, কিয়ামতের আগ পর্যন্ত অনেক মিথ্যা নবুওতের দাবিদার আবির্ভূত হবে, যারা হবে চরম মিথ্যুক ও প্রতারক। সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিমের হাদীসে আছে, প্রায় ত্রিশজন চরম মিথ্যাবাদী প্রতারকের আবির্ভাব না ঘটা পর্যন্ত কিয়ামত কায়েম হবে না। এদের প্রত্যেকেই দাবি করবে, সে আল্লাহর রাসূল।
لا تقوم الساعة حتى تقوم دجالون كذابون قريبا من ثلاثين كلهم يزعم أنه رسول الله.
-সহীহ মুসলিম, কিতাবুল ফিতান ৮৪; সহীহ বুখারী, কিতাবুল ফিতান, হাদীস : ৭১২১
আরো ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আমার উম্মতের মাঝে ত্রিশজন চরম মিথ্যুকের আবির্ভাব ঘটবে, যাদের প্রত্যেকে দাবি করবে, সে নবী। অথচ আমি খাতামুননাবিয়্যীন, আমার পরে কোনো নবী নেই।’
أنه سيكون في أمتي كذابون ثلاثون كلهم يزعم أنه نبي وأنا خاتم النبيين.
সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ৪২৪৯; জামে তিরমিযী, হাদীস : ২২১৯
নবুওতের মিথ্যা দাবিদারদের সম্পর্কে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন যে, তারা হবে ‘কাযযাব’ চরম মিথ্যাবাদী এবং ‘দাজ্জাল’ মহা প্রতারক। মিথ্যাচার ও প্রতারণার মাধ্যমে এরা মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করবে। ওদের জাল থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায়, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খতমে নবুওতের সুস্পষ্ট আকীদার উপর অটল অবিচল থাকা। এ বিষয়ে কোনো ব্যাখ্যা-তাবীলের শিকার না হওয়া।
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘খাতামুন নাবিয়ীন’-এর অর্থও পরিষ্কার ভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন। আর তা হচ্ছে ‘তিনি শেষ নবী, তার পরে কোনো নবী নেই।’ ‘আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে সত্য হয়েছে। পরবর্তীতে মিথ্যা নবুওতের বহু দাবিদারের আবির্ভাব ঘটেছে। আর এদের প্রধান বৈশিষ্ট্যই মিথ্যাচার ও প্রবঞ্চনা।
গোলাম আহমদ কাদিয়ানীরও শুধু দাবিসমূহের বিষয়েও যার সামান্য ধারণা আছে তার কাছেও স্পষ্ট তার এই বৈশিষ্ট্যটি। পরবর্তীতে কাদিয়ানী সম্প্রদায়ও তাদের ধর্মমত প্রচারের ক্ষেত্রে একই পদ্ধতি অনুসরণ করেছে। প্রতারণা ও সত্য-গোপনই তাদের প্রধান কৌশল।
সম্প্রতি একাধিক দৈনিকে তাদের যে পাতাব্যাপি বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়েছে তাতেও এই উপসর্গ পূর্ণমাত্রায় বিদ্যমান। কোনো সরলপ্রাণ মুসলমানের যদি গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর দাবিসমূহ ও কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে পূর্বঅবগতি না থাকে, শুধু এ বিজ্ঞাপনের কথাগুলোই হয় এ সম্প্রদায় সম্পর্কে তার প্রথম জানাশোনা তাহলে তার প্রতারিত হওয়ার প্রবল আশঙ্কা আছে। এখানে শুধু কয়েকটি বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
মির্জা কাদিয়ানীর নবুওত দাবি সম্পূর্ণ গোপন করা হয়েছে
এক.
অথচ এটাই হচ্ছে কাদিয়ানী ধর্মবিশ্বাসের প্রধান ও মৌলিক বিষয়। সরাসরি মির্জার লিখিত বইপত্র থেকে কিছু কিছু উদ্ধৃতি তুলে দিচ্ছি। যে কেউ ঐ বইগুলো খুলে দেখতে পারেন। নিজের কাছে না থাকলে আমাদের কাছে এসেও দেখে যেতে পারেন।
মির্জার অধিকাংশ বইপত্র উর্দুতে লেখা। কিছু বই হিন্দুস্তানী আরবীতে। উদ্ধৃতিগুলোর সরল বাংলা অনুবাদ উপস্থাপিত হচ্ছে।
* ‘...সত্য খোদা তিনি যিনি কাদিয়ানে তার রাসূল পাঠিয়েছেন।’-দাফিউল বালা পৃ. ১১-রূহানী খাযাইন খন্ড ১৮, পৃ. ২৩১
* ‘আমি ঐ খোদার কসম খেয়ে বলছি, যার হাতে আমার প্রাণ, তিনি আমাকে পাঠিয়েছেন এবং তিনিই আমার নাম রেখেছেন নবী।’-তাতিম্মা হাকীকাতুল ওয়াহী পৃ. ৬৮-রূহানী খাযাইন খ. ২২, পৃ. ৫০৩
* ‘ইতিমধ্যে আমি যখন প্রায় দেড়শ ভবিষ্যদ্বাণী খোদার নিকট থেকে পেয়ে তা স্বচক্ষে বাস্তবায়িত হতে দেখলাম তখন নিজের সম্পর্কে নবী-রাসূল নাম কীভাবে অস্বীকার করতে পারি। আর যখন খোদা তাআলা আমার এই নাম রেখেছেন তখন কীভাবে আমি তা অস্বীকার করি কিংবা তিনি ছাড়া অন্য কাউকে ভয় করি।’-এক গলতী কা ইযালা-রূহানী খাযাইন খ. ১৮; পৃ. ২১০
* ‘কিছুদিন হল, জনৈক ব্যক্তির উপর এক বিরোধীর পক্ষ হতে এই প্রশ্ন উঠল যে, যার কাছে তুমি বাইয়াত হয়েছ সে তো নবী ও রাসূল হওয়ার দাবি করে! এর উত্তর সরাসরি না-সূচক দেওয়া হয়েছে। অথচ এমন উত্তর সঠিক নয়। সত্য এই যে, খোদা তাআলার ঐ পাক ওয়াহী, যা আমার উপর নাযিল হয়েছে তাতে এমন শব্দ- ‘রাসূল’, ‘মুরসাল’ নবী, বিদ্যমান রয়েছে। একবার নয়, বরং শত শত বার।-এক গল্তী কা ইযালা পৃ. ১- রূহানী খাযাইন খ. ১৮; পৃ. ২০৬
মির্জা কাদিয়ানী জীবনের শেষ পর্যন্ত নবুওতের দাবির উপরই ছিল এবং এ দাবির উপরই তার মৃত্যু হয়েছে। মির্জার ঐ পত্রটির সংশ্লিষ্ট অংশ এখানে উদ্ধৃত করা হল যা ঠিক তার মৃত্যুর দিন ‘আখবারে আম’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। ঐ পত্রে তার স্পষ্ট বক্তব্য-‘আমি খোদার আদেশ অনুযায়ী নবী। আমি যদি তা অস্বীকার করি তাহলে আমার পাপ হবে। আর খোদা যখন আমার নাম নবী রাখে, তখন আমি কীভাবে তা অস্বীকার করতে পারি? আমি এই দুনিয়া থেকে চলে যাওয়া পর্যন্ত এরই উপর আছি।-আখবারে আম ২৬ মে ১৯০৮-হাকীকাতুন নুবুওয়াহ, মির্জা মাহমূদ পৃ. ২৭১; মুবাহাছা রাওয়ালপিন্ডি পৃ. ১৩৬-কাদিয়ানী ফিৎনা আওর মিল্লাতে ইসলামিয়া কা মাওকিফ, পৃ. ২২ এই চিঠি ২৩ মে ১৯০৮ সালে লেখা হয় এবং ২৬ মে আখবারে আমে প্রকাশিত হয়। একই দিন মির্জারও মৃত্যু হয়।
মির্জার নবুওত-দাবির বিষয়ে কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের ছল-চাতুরী
দুই.
এখানে এ বিষয়টি মনে রাখা দরকার যে, মির্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী নিজের সম্পর্কে অসংখ্য দাবি করেছে। মুজাদ্দিদ, মুহাদ্দাস, (ইলহামপ্রাপ্ত) মসীহ, মাহদী ইত্যাদি দাবির ধারাবাহিকতায় সবশেষে নবুওতের দাবিতে উপনীত হয়েছে। তার রচনাবলিতে সব ধরনের কথাই আছে। প্রথম দিকে সে নবুওত দাবিকে অস্বীকার করত এমনকি একে কুফর বলেও আখ্যায়িত করত। এজন্য মির্জার অনুসারীরা অনেক সময় সাধারণ মুসলমানদের বিভ্রান্ত করার জন্য তার ঐ সময়ের বক্তব্য উদ্ধৃত করে থাকে, যাতে সে সরাসরি নবুওত দাবিকে কুফর বলেছে। কিন্তু তাদের এই প্রতারণা স্পষ্ট হবে যদি স্বয়ং মির্জার বক্তব্য সামনে থাকে।
জনৈক প্রশ্নকারী মির্জাকে প্রশ্ন করেছিল যে, ‘আপনার বক্তব্যের মাঝে তো বৈপরীত্য দেখা যায়। কোথাও নিজেকে ‘নবী নয়’ বলেন, আবার কোথাও ‘সকল বৈশিষ্ট্যে-মসীহের চেয়ে শ্রেষ্ঠ’ ঘোষণা করেন।’ এর জবাবে এই বৈপরীত্যপূর্ণ দাবিসমূহের ‘তাৎপর্য’ ব্যাখ্যা করে মির্জা বলে-‘শোন, এই বৈপরীত্যের ধরন এমনই যেমন বারাহীনে আহমদিয়ায় লিখেছিলাম, মসীহ ইবনে মারইয়াম আসমান থেকে অবতরণ করবেন। কিন্তু পরে লিখেছি, ঐ মাসীহ আমি নিজেই।
এই বৈপরীত্যের কারণ এটাই ছিল যে, যদিও খোদা তাআলা বারাহীনে আহমদিয়ায় আমার নাম রেখেছেন ঈসা এবং একথাও বলেছেন যে, তোমার আসার সংবাদ খোদা ও রাসূল দিয়েছেন, কিন্তু যেহেতু একদল মুসলমানের দৃঢ় বিশ্বাস এবং আমারও বিশ্বাস ছিল যে, হযরত ঈসা আসমানের উপর থেকে অবতরণ করবেন, একারণে আমি খোদার ওহীর বাহ্যিক অর্থ গ্রহণ করতে চাইনি; বরং এর ব্যাখ্যা করেছি এবং সাধারণ মুসলমানের বিশ্বাস যা ছিল আমি নিজের বিশ্বাসও তা-ই রেখেছি। এবং একেই বারাহীনে আহমদিয়ায় প্রচার করেছি। কিন্তু পরে এ বিষয়ে বৃষ্টির মতো ওহী এল যে, ঐ প্রতিশ্রুত মাসীহ, যার আসার কথা ছিল, সে তো তুমিই। এরই সাথে শত শত নিদর্শন প্রকাশিত হল এবং আসমান যমীন আমাকে সত্য বলার জন্য দাড়িয়ে গেল। আর খোদার চমকাতে থাকা নিদর্শনসমূহ আমাকে বাধ্য করে এদিকে নিয়ে এল যে, আখেরী যমানায় যে মাসীহের আসার কথা সে তো আমিই। নতুবা আমার বিশ্বাস তো তা-ই ছিল যা বারাহীনে আহমদিয়ায় লিখেছি।
‘‘তদ্রূপ প্রথম দিকে আমি এ আকীদাই পোষণ করতাম যে, মাসীহের সাথে আমার কী তুলনা? তিনি তো নবী এবং খোদার অন্যতম নৈকট্যপ্রাপ্ত ব্যক্তি। আমার মর্যাদার কোনো কিছু প্রকাশ পেলেও আমি তাকে আমার বিচ্ছিন্ন মর্যাদাই মনে করতাম, কিন্তু পরে যখন খোদা তাআলার ওহী আমার উপর বৃষ্টির মতো বর্ষিত হল তখন তা আমাকে এই আকীদার উপর থাকতে দিল না এবং পরিষ্কারভাবে আমাকে ‘নবী’ খেতাব দেওয়া হল, কিন্তু এভাবে যে, একদিক থেকে নবী আরেকদিক থেকে উম্মতী...
আমি এই পাক ওহীর উপর সেভাবেই ঈমান আনি যেভাবে ইতিপূর্বে আমার উপর হওয়া খোদার ওহীসমূহের উপর ঈমান আনি। ... আমি তো খোদা তাআলার ওহীরই অনুসারী। যতক্ষণ আমার তা জানা হয়নি আমি ঐ কথা বলেছি যা প্রথম দিকে বলেছিলাম আর যখন ঐ বিষয়ের ইলম হল তখন তার বিপরীত বললাম।’’-হাকীকাতুল ওয়াহী ১৪৮-১৫০-রূহানী খাযাইন খ. ২২; পৃ. ১৫২-১৫৪
মির্জার জ্যেষ্ঠপুত্র মির্জা বশীরুদ্দীন মাহমূদের বক্তব্য
‘‘সারকথা এই যে, হযরত মাসীহে মাওউদ (প্রতিশ্রুত মাসীহ) প্রথম দিকে যেহেতু নবীর সংজ্ঞা এই মনে করতেন যে, নবী সে-ই যে নতুন শরীয়ত আনে কিংবা কিছু বিধান রহিত করে কিংবা যে মাধ্যম ছাড়া সরাসরি নবী, একারণে নবীর সকল বৈশিষ্ট্য তার মাঝে বিদ্যমান থাকার পরও ‘নবী’ নাম গ্রহণ করতে অস্বীকার করতেন। যদিও তিনি ঐ সকল বৈশিষ্ট্যের দাবি করতেন, যা থাকলে কেউ নবী হয়ে যায়।
‘‘কিন্তু যেহেতু তিনি ঐসকল বৈশিষ্ট্যকে নবীর বৈশিষ্ট্য মনে করতেন না; বরং ‘মুহাদ্দাস’ (ইলহামপ্রাপ্ত)-এর বৈশিষ্ট্য মনে করতেন এজন্য তিনি নিজেকে ‘মুহাদ্দাস’ বলতেন। তার জানা ছিল না যে, আমার দাবির অবস্থা তো এই যে, তা নবীরা ছাড়া অন্যদের মধ্যে পাওয়া যায় না, অথচ আমি নবী হওয়া অস্বীকার করছি! কিন্তু যখন তিনি জানতে পারলেন, দাবির যে বিবরণ তিনি প্রথম থেকে দিয়ে আসছেন তা তো ‘মুহাদ্দাস’-এর বৈশিষ্ট্য নয়, নবুওতের বৈশিষ্ট্য, তখন নবী হওয়ার কথা ঘোষণা করলেন।’’-হাকীকাতুন নুবুওয়াহ-কাদিয়ানিয়্যত : তাহলীল আওর তাজযিয়ে, হযরত মাওলানা সাইয়িদ আবুল হাসান আলী নদভী পৃ. ৭৭
মির্জা কাদিয়ানী ও তার পুত্রের বক্তব্য এতই স্পষ্ট যে, কোনো ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের প্রয়োজন নেই। এ ধরনের সুস্পষ্ট ব্যাখ্যার উপস্থিতিতে কেউ যদি মির্জার ঐ সময়ের বক্তব্য উপস্থিত করে যখন সে তার নবী-দাবি অস্বীকার করত তাহলে তা হবে ঐ প্রতারণারই দৃষ্টান্ত, যা এই ধর্মমতের মূল উপাদান।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে মির্জা কাদিয়ানীর ভক্তিমূলক বক্তব্যসমূহের স্বরূপ
তিন.
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী মিথ্যা নবুওত দাবিদারদের প্রধান বৈশিষ্ট্য প্রতারণা ও মিথ্যাচার। এরই একটি উদাহরণ এই যে, এরা নিজেদেরকে মুসলমান বলে প্রকাশ করে এবং ইসলামের কালেমা পাঠ করে, এমনকি নিজেদেরকে আখেরী নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ‘অনুসারী’ বলেও দাবি করে।
তারীখে তবারীতে কুখ্যাত মিথ্যুক মুসায়লামাতুল কাযযাব সম্পর্কেও এ তথ্য আছে যে, সে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামে আযান দিত এবং ঐ আযানে এই সাক্ষ্য থাকত যে, হযরত মুহাম্মাদ সা. আল্লাহর রাসূল। তার মুয়াযযিনের নাম ছিল আব্দুল্লাহ ইবনে নাওয়াহা। আর ইকামত দিত হুজাইর ইবনে উমাইর। দ্র. তারীখে তবারী ৩/২৪৪
বিজ্ঞাপনে মির্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর ‘ইযালায়ে আওহাম’ থেকে (প্রথম খন্ড, পৃ. : ১৩৭-১৩৮) একটি উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে। উদ্ধৃতিটি হুবহু তুলে দিচ্ছি :
আমাদের ধর্ম বিশ্বাসের সারাংশ ও সারমর্ম হলো : ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’। এ পার্থিব জীবনে আমরা যা বিশ্বাস করি এবং আল্লাহ তা’লার কৃপায় ও তাঁরই প্রদত্ত তৌফিকে যা নিয়ে আমরা এ নশ্বর পৃথিবী ত্যাগ করবো তা হলো, আমাদের সম্মানিত নেতা হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) হলেন, ‘খাতামান নাবীঈন’ ও ‘খায়রুল মুরসালীন’-যাঁর মাধ্যমে ধর্ম পূর্ণতাপ্রাপ্ত হয়েছে এবং যে নেয়ামত দ্বারা সত্যপথ অবলম্বন করে মানুষ আল্লহ্ তা’লা পর্যন্ত পৌঁছুতে পারে তা পরিপূর্ণতা লাভ করেছে। আমরা দৃঢ় প্রত্যয়ের সাথে বিশ্বাস রাখি, কুরআন শরীফ শেষ ঐশী-গ্রন্থ এবং এর শিক্ষা, বিধান, আদেশ ও নিষেধের মাঝে এক বিন্দু বা কণা পরিমাণ সংযোজনও হতে পারে না বিয়োজনও হতে পারে না। এখন আল্লাহর পক্ষ থেকে এমন কোনো ওহী বা ইলহাম হতে পারে না-যা কুরআন শরীফের আদেশাবলীকে সংশোধন বা রহিত কিংবা কোন একটি আদেশকেও পরিবর্তন করতে পারে। কেউ যদি এমন মনে করে তবে আমাদের মতে সে ব্যক্তি বিশ্বাসীদের জামা’ত বহির্ভূত, ধর্মত্যাগী ও কাফির। আমরা আরও বিশ্বাস করি, সিরাতে মুস্তাকীমের উচ্চমার্গে উপনীত হওয়া তো দূরের কথা, কোনো মানুষ আমাদের নবী (সা.)-এর অনুসরণ ছাড়া এর সামান্য পরিমাণও অর্জন করতে পারে না। আমরা আমাদের নবী (সা.)-এর সত্যিকার ও পূর্ণ অনুসরণ ছাড়া কোনো ধরনের আধ্যাত্মিক সম্মান ও উৎকর্ষ কিংবা মর্যাদা ও নৈকট্য লাভ করতে পারি না।’’ (ইযালায়ে আওহাম, প্রথম খন্ড, পৃ. ১৩৭-১৩৮)
মির্যা কাদিয়ানীর রচনাবলি পড়া না থাকলে এবং কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের নিজস্ব পরিভাষা সম্পর্কে অবগত না থাকলে এই উদ্ধৃতি থেকে কারো মনে হতে পারে, মির্জা তো আল্লাহর রাসূলকে মানে, এমনকি তাকে ‘খাতামুন্নাবিয়ীন’ বলেও স্বীকার করে, কুরআনকে শেষ আসমানী গ্রন্থ মানে এবং তাতে কোনো ধরনের সংযোজন-বিয়োজন-পরিবর্তন ও রহিতকরণ হতে পারে না বলেও বিশ্বাস করে, এমনকি এর বিপরীত আকীদা পোষণকারীদের কাফিরও মনে করে। এ-ই যদি হয় তাদের ধর্মবিশ্বাস তাহলে মুসলমানদের ধর্মবিশ্বাসের সাথে তাদের কী পার্থক্য?
আল্লামা ইকবাল সরলপ্রাণ মুসলিমের জন্যই বলেছিলেন- ‘আমাদের সমাজের সারল্যও দেখ আর শত্রুর নির্লজ্জতাও দেখ।’
মির্জার উপরোক্ত বক্তব্য এবং এ জাতীয় অন্যান্য বক্তব্যের ব্যাখ্যা তার নিজের মুখেই শুনুন।
১. খাতামুননাবিয়্যীন অর্থ
এ প্রসঙ্গে মির্জা কাদিয়ানীর বক্তব্য :
‘...আল্লাহ জাল্লা শানুহু হযরত সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ‘খাতাম ওয়ালা’ বানিয়েছেন, অর্থাৎ গুণ ও বৈশিষ্ট্য প্রবাহিত করার জন্য তাঁকে সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি মোহর দেওয়া হয়েছে, যা আর কোনো নবীকে কক্ষনোই দেওয়া হয়নি। একারণেই তার নাম খাতামুন নাবিয়ীন স্থির হয়েছে। অর্থাৎ তাঁর অনুসরণ নবুওতের গুণসমূহ দান করে আর তার রূহানী তাওয়াজজুহ নবী সৃষ্টি করে। এই পবিত্র শক্তি আর কোনো নবী লাভ করেননি।-হাকীকাতুল ওয়াহী, টীকা : পৃ. ৯৭/১০০; রূহানী খাযাইন : ২২
একজন সাধারণ বোধসম্পন্ন পাঠকও বুঝতে পারছেন, এ হচ্ছে পরম ভক্তির আবরণে ‘খাতামুন নাবিয়ীন’-এর অর্থকেই সম্পূর্ণ বিকৃত করে দেওয়া এবং নতুন নবুওত দাবির পথ থেকে বাধা সরানো। মির্জা কাদিয়ানীর কাছে ‘খাতামুন নাবিয়ীন’ অর্থ, যিনি রূহানী তাওয়াজজুহের মাধ্যমে অন্যকে নবী বানান। অতএব খাতামুন নাবিয়্যীনের পরেও নবী হতে পারে বরং হতেই হবে। (নাউযুবিল্লাহ)। অথচ স্বয়ং আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পরিষ্কার ভাষায় ‘খাতামুন নাবিয়ীন’-এর ব্যাখ্যা করে গেছেন যে, ‘আমার পরে কোনো নবী নেই।’
মির্জা বশীরুদ্দীন মাহমুদের বক্তব্য শুনুন : ‘‘যদি আমার গর্দানের দুই পাশে তলোয়ারও ধরা হয় এবং আমাকে বলা হয় যে, বল, আঁহযরত সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পরে কোনো নবী আসবে না তাহলে আমি বলব, তুমি মিথ্যাবাদী; চরম মিথ্যাবাদী, তাঁর পরে নবী আসতে পারে এবং অবশ্যই আসতে পারে।’’-আনওয়ারে খিলাফত পৃ. ৬৫-কাদিয়ানী ফিৎনা আওর মিল্লাতে ইসলামিয়্যাহ কা মাওকিফ, শায়খুল ইসলাম মাওলানা মুহাম্মাদ তাকী উসমানী পৃ. ৫৩
মির্জা কাদিয়ানীর নিজস্ব পরিভাষার মর্ম উপলব্ধি করে থাকলে এরই আলোকে নবী-প্রশস্তির আবরণযুক্ত বিজ্ঞাপনের এ বাক্যটি পাঠ করুন এবং অর্থ বোঝার চেষ্টা করুন-
‘‘যেকোনো গোষ্ঠির জন্য সাফল্যের সাথে শতবর্ষ অতিক্রম করা একটি গৌরবের বিষয়। এটি যেমন সংগঠনের জন্য গর্বের, তেমনই আধ্যাত্মিক প্রতিষ্ঠানের জন্যও এ এক বিশাল অর্জন। তবে আধ্যাত্মিক প্রতিষ্ঠান তাদের এই সাফল্য উদযাপন করে খোদার দরবারে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ এবং তাঁর কাছে বিনীত সমর্পনের মাধ্যমে। আল্লাহ তা’লা আমাদেরকে যে সাফল্যের সাথে শতবর্ষ অতিক্রমের সৌভাগ্য দান করেছেন এজন্য আমরা তাঁর কাছে চিরকৃতজ্ঞ। আমাদের সমস্ত অর্জন হযরত মুহাম্মা (সা.)-এর কল্যাণ ও বরকতে।
২. যিল্লী ও বুরুযী নবীর অভিনব দর্শন
মির্জা কাদিয়ানী তার নবুওতের দাবিকে মসৃণ করার জন্য এই অভিনব ব্যাখ্যারও আশ্রয় নিয়েছে যে, সে হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এরই বহিঃপ্রকাশ (নাউযুবিল্লাহ)। এই দাবির জন্য ‘যিল্লি নবী’, ‘বুরুযী নবী’র মতো অভিনব পরিভাষার ধোঁয়াশাও সৃষ্টি করেছে। অথচ তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের একজন ছাত্রও বলবে, এ সরাসরি হিন্দুদের অবতারবাদ । ইসলামে এর কোনো স্থান নেই।
মির্জার সুস্পষ্ট বক্তব্য :
‘‘এবং আঁহযরত সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামের আমি পূর্ণাঙ্গতম প্রকাশস্থল অর্থাৎ জিল্লী বা ছায়ারূপে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং আহমদ।-হাকীকাতুল ওয়াহী (টীকা) পৃ. ৭৩/৭৬-রূহানী খাযাইন ২২
তার পূর্ণ বক্তব্য এই-‘এই ওহীতে খোদা আমার নাম রুসুল (রাসূল শব্দের বহুবচন) রেখেছেন। কারণ- যেমনটা বারাহীনে আহমদিয়ায় লেখা হয়েছে-খোদা তাআলা আমাকে সকল নবীর ‘প্রকাশস্থল’ সাব্যস্ত করেছেন এবং সকল নবীর নাম আমার দিকে সম্বন্ধ করেছেন । আমি আদম, আমি শীছ, আমি নূহ, আমি ইবরাহীম, আমি ইউসুফ, আমি মূসা, আমি দাউদ, আমি ঈসা, এবং আঁহযরত সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামের আমি পূর্ণাঙ্গতম প্রকাশস্থল অর্থাৎ যিল্লীভাবে মুহাম্মাদ সা.ও আহমদ সা.।’
অন্যত্র : ‘‘আয়াত وآخرين منهم لما يلحقوا بهم এর দাবি অনুযায়ী বুরুযী-ভাবে আমিই খাতামুল আম্বিয়া। খোদা আজ থেকে বিশ বছর আগে বারাহীনে আহমদিয়ায় আমার নাম মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও আহমদ রেখেছেন। এবং আমাকে আঁ হযরত সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অযুদ (অস্তিত্ব) সাব্যস্ত করেছেন। সুতরাং এভাবে আঁ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খাতামুন্নাবিয়্যীন হওয়ার মাঝে আমার নবুওতের দ্বারা কোনো কম্পন আসে না। কারণ ছায়া তো কায়া থেকে আলাদা হয় না। আর যেহেতু আমি যিল্লীভাবে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুতরাং খাতামুন নাবিয়ীনের মোহর ভাঙ্গেনি। কারণ মুহাম্মাদ সা.-এর নবুওত মুহাম্মাদ সা. পর্যন্তই সীমাবদ্ধ রইল, অর্থাৎ সর্বাবস্থায় মুহাম্মাদ সা. ই নবী রইলেন, অন্য কেউ নয়। অর্থাৎ আমি যেহেতু বুরুযীভাবে মুহাম্মাদ সা. এবং বুরুযীভাবে নবুওতে মুহাম্মাদীসহ সকল মুহাম্মাদী গুণ ও বৈশিষ্ট্য আমার জিল্লিয়তের আয়নায় প্রতিবিম্বিত তাহলে এখানে আলাদা কোনো ব্যক্তি কোথায়, যে আলাদা নবুওতের দাবি করেছে?’’-এক গালতী কা ইযালা-রূহানী খাযাইন ১৮/২১২
এই বাক্যগুলো উদ্ধৃত করতেও বুক কেঁপে উঠে। তবু তা এজন্যই উদ্ধৃত করতে হচ্ছে যাতে তাদের পরিভাষার অর্থ ও মর্ম পরিষ্কার হয় এবং নবী-ভক্তির অন্তরালে এরা যে খতমে নবুওতের অকাট্য ও সুস্পষ্ট আকীদাকেই অস্বীকার করে তা বুঝতে অসুবিধা না হয়।
‘যিল্লী ও বুরূযী’ শব্দের ধোঁয়াশা সৃষ্টি করে মির্জা কাদিয়ানী যখন ‘নবুওতে মুহাম্মাদী সমেত সকল মুহাম্মাদী গুণ ও বৈশিষ্ট্য’ নিজের মধ্যে টেনে নিল তখন আর খতমে নবুওতকে অস্বীকারের কী বাকী থাকে?
এদের এই ‘ব্যাখ্যা’ উপলব্ধি করে থাকলে এরই আলোকে বিজ্ঞাপনের এই বাক্যটি পড়ুন এবং মর্মোদ্ধারের চেষ্টা করুন
‘রাসূলুল্লাহ সা.-এর আহমদ নামের বিকাশ হিসেবে তিনি এই আধ্যাত্মিক জামাতের নাম ‘আহমদীয়া’ মুসলিম জাম’াত রেখেছেন।’ সরল ভাষায়-মির্জা কাদিয়ানী হচ্ছে আহমদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ছায়া, প্রকাশ, অবতার (নাউযুবিল্লাহ)। আর তার অনুসারী হওয়ার কারণে এরা ‘আহমদিয়া’।
প্রিয় পাঠক, মির্জা কাদিয়ানী ও তার অনুসারীদের বিশ্বাসকে উপরোক্ত সকল ব্যাখ্যা ও পরিভাষার আবরণ সরিয়ে যদি চিন্তা করেন তাহলে আপনার সামনে পরিষ্কার হয়ে যাবে যে, সকল ব্যাখ্যা-অপব্যাখ্যার অন্তরালে এরা ঐ কথাই প্রতিষ্ঠিত করার অপতৎপরতায় লিপ্ত যা আল্লাহর শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দ্ব্যর্থহীন ভাষায় প্রত্যাখ্যান করে গেছেন। তাঁর ঐ একটি বাক্যই এই সকল বিভ্রান্তির জাল ছিন্ন করার জন্য যথেষ্ট।
أنا خاتم النبيين، لا نبي بعدي.
‘‘আমি খাতামুন নাবিয়্যীন আমার পরে আর কোনো নবী নেই।’’
এই দ্ব্যর্থহীন ঘোষণায় কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের কল্পিত অবতারবাদের কোনোই অবকাশ নেই। এরপরও কেউ যদি ঐ অবকাশ বের করতে চায় তবে কালিমার প্রথম অংশ لا إله إلا الله আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবূদ নেই-এতেও তো কোনো প্রতারক এমন কিছু মিথ্যা খোদারও অবকাশ বের করতে পারে ‘যে সরাসরি মাবুদ নয়, শুধু ‘আল্লাহ’ নামের বিকাশ, প্রকাশ ও ছায়া’ মাত্র। (নাউযুবিল্লাহ মিন যালিক)
৩. জিহাদের কুরআনী বিধানের বিষয়ে মির্জা কাদিয়ানীর বক্তব্য : ‘‘জিহাদ অর্থাৎ দ্বীনী লড়াইয়ের প্রচন্ডতা খোদা তা’লা ধীরে ধীরে হ্রাস করেছেন। হযরত মূসা আ.-এর সময় এর তীব্রতা এত বেশি ছিল যে, ঈমান আনাও হত্যা থেকে রক্ষা করতে পারত না এবং দুধের শিশুকেও কতল করা হত। এরপর আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সময় শিশু, বৃদ্ধ ও নারীদের হত্যা করা হারাম করা হল, এরপর কোনো কোনো সম্প্রদায়ের জন্য ঈমানের স্থলে শুধু জিযয়া দ্বারা দায়মুক্তি গ্রহণ করা হল। আর প্রতিশ্রুত মসীহের সময় জিহাদের বিধান সম্পূর্ণরূপে স্থগিত করে দেওয়া হয়েছে।- আরবায়ীন ৪ পৃ. ১৫-রূহানী খাযাইন খ. ২৭, পৃ. ৪৪৩
মির্জার এই সুস্পষ্ট বক্তব্যের সাথে বিজ্ঞাপনে উদ্ধৃত বক্তব্যকে মিলিয়ে দেখুন- ‘আমরা দৃঢ় প্রত্যয়ের সাথে ... ধর্মত্যাগী ও কাফির।’
শুধু জিহাদের বিধানকে অস্বীকার করার দ্বারা কুরআন মজীদের কতগুলো আয়াতকে বাতিল করা হল! এরপর খতমে নবুওতের আয়াতসমূহের অপব্যাখ্যা ও বিকৃতি তো দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট।
উল্লেখ্য, মূসা আ.-এর সময় জিহাদে মুমিন ও শিশুদের হত্যা করা হত-একথা যে সম্পূর্ণ অসত্য তা বলার অপেক্ষা রাখে না। মুমিন ও শিশুদের কি মূসা আ. হত্যা করতেন, না ফিরাউন?
বস্ত্তত এই সকল অপব্যাখ্যা হচ্ছে ঐ মিথ্যাচার ও প্রতারণারই বিভিন্ন উদাহরণ, যার ভবিষ্যদ্বাণী আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চৌদ্দশ বছর আগেই করে গেছেন।
মুসলিম উম্মাহ ও কাদিয়ানী সম্প্রদায় এক মিল্লাত নয়
চার.
চিন্তাশীল ব্যক্তিমাত্রই এই বাস্তবতা উপলব্ধি করবেন যে, কোনো নবুওতের দাবিকে স্বীকারকারী ও অস্বীকারকারী দুই দল কখনো এক মিল্লাত হতে পারে না। একদলের উপাধি ‘মুমিন’ অন্য দলের ‘কাফির’।
আল্লাহর সত্য নবী ও রাসূলগণের ক্ষেত্রে যেমন এটা বাস্তব, মিথ্যা নবুওতের দাবিদারদের ক্ষেত্রেও বাস্তব। তবে মিথ্যা নবুওতের দাবিদারদের ক্ষেত্রে মুমিন-কাফির শব্দ থেকে বিপরীত অর্থ গ্রহণ করতে হবে। অর্থাৎ তার দাবি স্বীকারকারী তার ধর্মে ‘মুমিন’ নামে পরিচিত হলেও বাস্তবে সে কাফির। আর তার দাবি অস্বীকারকারী ঐ ধর্মে ‘কাফির’ হলেও বাস্তবে কাফির নয় যদি আল্লাহর শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি ঈমান ও আনুগত্য থাকে। বাস্তবে সে মুমিন।
জাতি ও ধর্মের সুদীর্ঘ ইতিহাসও এই বাস্তবতার সাক্ষী। সুতরাং গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর নবুওতের দাবি স্বীকারকারী কাদিয়ানী সম্প্রদায় এবং অস্বীকারকারী মুসলিম উম্মাহকে এক ধর্ম ও মিল্লাতের অনুসারী মনে করা শুধু কুরআন ও সুন্নাহরই পরিপন্থী নয় কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের আকীদারও বিরোধী।
কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের ধর্মগ্রন্থ থেকেই সুস্পষ্ট যে, একশ কোটি মুসলিম ও কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের ধর্ম ও মিল্লাত এক নয়। মির্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর দাবিসমূহ যারা স্বীকার করে না তারা তাদের ‘কাফির’ ও ইসলামের গন্ডি থেকে খারিজ’ বলেই বিশ্বাস করে। কিছু উদ্ধৃতি লক্ষ করুন : মির্জা কাদিয়ানীর খুতবাতে ইলহামিয়্যাহয় (যার সম্পর্কে তার দাবি, খুৎবাটি আগাগোড়া ‘ইলহামের’ মাধ্যমে নাযিল হয়েছে) সুস্পষ্ট আছে।&
‘এবং শ্রেষ্ঠ রাসূলের আধ্যাত্মিকতা প্রকাশের পূর্ণতা ও নূরের প্রতাপে পৌঁছার জন্য এক ‘প্রকাশস্থল’ গ্রহণ করেছে, যেমনটা খোদা তাআলা তার সুস্পষ্ট কিতাবে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তো আমিই সেই ‘প্রকাশস্থল’। সুতরাং ঈমান আন, কাফিরদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না। ইচ্ছে হলে খোদা তালার এই বাণী পাঠ কর-‘যিনি তার রাসূলকে পাঠিয়েছেন ...’-খুতবাতে ইলহামিয়্যাহ পৃ. ২৬৭; রূহানী খাযাইন ১৬
‘‘হাকীকাতুল ওয়াহী’’তে বলা হয়েছে, ‘কাফির’ শব্দটি মুমিনের বিপরীতে। আর কুফর দুই প্রকারের। (প্রথম) এক এই কুফর যে, কেউ ইসলামকেই অস্বীকার করল এবং হযরত সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে খোদার রাসূল মানল না। (দ্বিতীয়) এই কুফর যেমন প্রতিশ্রুত মাসীহকে মানে না এবং দলীল-প্রমাণ পুরাপুরি উপস্থাপিত হওয়ার পরও তাকে মিথ্যাবাদী মনে করে, যাকে মানার ও সত্য জানার বিষয়ে আল্লাহ ও তার রাসূল তাকীদ করেছেন এবং পূর্ববর্তী নবীদের কিতাবেও তাকীদ পাওয়া যায়। সুতরাং যেহেতু সে খোদা ও রাসূলের ফরমান অস্বীকারকারী তাই কাফির।...-হাকীকাতুল ওয়াহী পৃ. ১৭৯/১৮৫, রূহানী খাযাইন ২২
কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের প্রথম ‘খলীফা’ হাকীম নূরুদ্দীনের ঘোষণা
‘‘রাসূলের প্রতি ঈমান না থাকলে কেউ মুমিন মুসলমান হতে পারে না। আর রাসূলের উপর ঈমান আনার বিষয়ে কোনো ব্যতিক্রম নেই, সে নবী আগে আসুক বা পরে। হিন্দুস্তানে হোক বা অন্য কোনো দেশে। (পড়ুন : সত্য হোক বা মিথ্যা) আল্লাহর পক্ষ হতে আদিষ্ট কাউকে অস্বীকার কুফর হয়ে যায়। আমাদের বিরোধী পক্ষ হযরত মির্জা সাহেব আল্লাহর পক্ষ হতে আদিষ্ট হওয়াকে অস্বীকার করে। তো বল, এই মতভেদ শাখাগত কীভাবে হল?’’-মজমুয়ায়ে ফতোয়ায়ে আহমদিয়া ১/২৭৫-কাদিয়ানী ফিৎনা আওর মিল্লাতে ইসলামিয়্যাহ কা মাওকিফ
দ্বিতীয় ‘খলীফা’ খ্যাত মির্জা মাহমূদ আহমদের ঘোষণা
‘‘আমাদের জন্য ফরয যে, আমরা গায়ের আহমদীকে মুসলমান মনে করব না এবং এদের পিছনে নামায পড়ব না। কারণ আমাদের নিকটে তারা খোদা তালার একজন নবীকে অস্বীকারকারী। এটা ধর্মের বিষয়। এতে কারো নিজের এখতিয়ার নেই যে, কিছু করে।’’-আনওয়ারে খিলাফত পৃ. ৯০, কাদিয়ানী ফিৎনা আওর মিল্লাতে ইসলামিয়্যাহ কা মাওকিফ পৃ. ৪৫
মির্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর মেঝো পুত্র মির্জা বশীর আহমদ এম.এ-এর বক্তব্য
‘‘এমন যে কোনো লোক, যে মুসা আ.কে মানে কিন্তু ঈসা আ.কে মানে না কিংবা ঈসা আ.কে মানে কিন্তু মুহাম্মাদ সা.কে মানে না অথবা মুহাম্মাদ সা.কে মানে কিন্তু প্রতিশ্রুত মাসীহকে মানে না (পড়ুন : মুহাম্মাদ সা.কে মানে কিন্তু মুসায়লামাতুল কাযযাব, আসওয়াদ আনাসী-প্রমুখ মিথ্যা নবুওতের দাবিদারদের মানে না) সে শুধু কাফির নয়, পাক্কা কাফির এবং ইসলামের গন্ডি থেকে খারিজ।’’-কালিমাতুল ফসল পৃ. ১১০-প্রাগুক্ত পৃ. ৪৫
মির্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী বা তার অনুসারীদের কারো লেখায় কোথাও কোথাও বিরোধীদের জন্য ‘মুসলমান’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। এই প্রয়োগের স্বরূপ বর্ণনা করে মালিক মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ কাদিয়ানীর বক্তব্য :
‘‘তিনি তার অস্বীকারকারীদেরকে তাদের বাহ্যিক নামের কারণে ‘মুসলমান’ লিখেছেন। কারণ সাধারণ ব্যবহারের কারণে যখন একটি নাম প্রসিদ্ধ হয়ে যায় তখন তাতে বাস্তবতা বিদ্যমান না থাকলেও তাকে ঐ নামেই
ডাকা হয়।’’-আহমদিয়্যাত কে ইমতিয়াযী-প্রাগুক্ত পৃ. ৪৭
মোটকথা, তাদের ধর্মগ্রন্থসমূহের বিবরণ ও সুস্পষ্ট বক্তব্যের দ্বারা পরিষ্কার যে, কাদিয়ানী সম্প্রদায় মুসলমানদেরকে তাদের মিল্লাতভুক্ত মনে করে না। এটাই তাদের ধর্মবিশ্বাস। তাদের বিশ্বাস ও পরিভাষা অনুধাবন করে থাকলে তাদের প্রতারণা কিছুমাত্র অস্পষ্ট থাকবে না। ইসলাম বলতে তারা কোন্ ধর্মকে নির্দেশ করে, মুমিন-কাফির অর্থ তাদের কাছে কী, খাতামুন্নাবিয়্যীন অর্থ কী, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি ভক্তি ও আনুগত্য প্রকাশের তাৎপর্য কী কিছুই অস্পষ্ট থাকবে না। এই সকল বিষয়ে পাঠক আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুস্পষ্ট বাণী-
كذابون دجالون
‘প্রচন্ড মিথ্যাবাদী, চরম প্রতারক’-এরই সত্যতা ও বাস্তবতা দেখতে পাবেন।
আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলের ঈমানের হেফাযত করুন। আমীন। ষ
(চলবে ইনশাআল্লাহ)