কাদিয়ানী মতবাদ : নবুওতে মুহাম্মদীর প্রতি এক প্রকাশ্য বিদ্রোহ
কাদিয়ানী সম্প্রদায় শরীয়তের শাখাগত বিষয়ে মতভেদকারী কোনো ‘দল’ নয়। এরা ইহুদি, খৃস্টান ও হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মতোই ইসলাম থেকে সম্পূর্ণ আলাদা একটি ধর্মমতের অনুসারী। তবে পার্থক্য এই যে, অন্য সব ধর্ম নিজস্ব নাম ও পরিচয় ব্যবহার করে, কিন্তু কাদিয়ানী সম্প্রদায় ব্যবহার করে ইসলামের নাম ও পরিচয়। একারণে এই ধর্মমত একদিকে যেমন সম্পূর্ণ পরাশ্রয়ী অন্যদিকে তা সরলপ্রাণ মুসলমানদের জন্য চরম বিভ্রান্তিকর। একারণে মুসলিমজাহানের মনীষী, চিন্তাবিদ ও সর্বস্তরের জনগণের এই দাবি সম্পূর্ণ যৌক্তিক যে, এদের অবশ্যই অমুসলিম পরিচয়ে পরিচিত করতে হবে এবং ইসলামের পরিচয় ও পরিভাষা ব্যবহার থেকে বিরত রাখতে হবে।
ইসলাম তো জগতের অন্যান্য ধর্মের মতো ‘আচার সর্বস্ব’ কোনো সাম্প্রদায়িক পরিচিতি নয়, যেগুলোতে বিশ্বাস ও আদর্শের কোনো গুরুত্ব নেই, যা স্বীকার করলেও ঐ ধর্মের অন্তর্ভুক্ত থাকা যায়, স্বীকার না করলেও। পন্ডিত জওহরলাল নেহরু নাকি একবার তার ধর্ম সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন, ‘এ এক আশ্চর্য ধর্ম, যা কোনো ভাবেই পিছু ছাড়ে না। ভগবানকে মানলেও এ ধর্মে থাকা যায়, না মানলেও থাকা যায়। ধর্ম মেনেও থাকা যায়, না-মেনেও থাকা যায়।’ ইসলাম এ জাতীয় ধর্ম নয়। ইসলাম এক আসমানী আদর্শ। এ আদর্শের প্রতি বিশ্বাসী ও সমর্পিত ব্যক্তিই মুসলিম। কালেমা তাওহীদ বা কালেমা শাহাদাত হচ্ছে এই বিশ্বাস ও সমর্পণের স্বীকারোক্তি। তাওহীদ ও রিসালাতের এই সুস্পষ্ট শিক্ষা মনে প্রাণে স্বীকার করা ছাড়া কেউ মুসলিম হতে পারে না।
এরপর আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত সকল শিক্ষা ও বিশ্বাসকে মানা এবং সেই শিক্ষা ও বিশ্বাসের প্রতি অনুগত থাকাও অপরিহার্য। ইসলামের বিধান ও বিশ্বাসের এই অংশকে পরিভাষায় ‘জরুরিয়াতে দীন’ বলে। যেমন কুরআন মাজীদ আল্লাহর কালাম হওয়া, কিয়ামত ও আখিরাত সত্য ও অনিবার্য হওয়া, পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরয হওয়া ইত্যাদি। জরুরিয়াতে দ্বীনের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অস্বীকার (অপব্যাখ্যার মাধ্যমে) রিসালত অস্বীকারেরই নামান্তর। এ কারণে মুখে কালেমা পাঠ করেও কেউ যদি জরুরিয়াতের দ্বীনের কোনো একটিকেও অস্বীকার করে-সরাসরি অস্বীকার করুক, কিংবা অপব্যাখ্যার মাধ্যমে অস্বীকার করুক-তার মৌখিক কালেমা পাঠ অর্থহীন হয়ে যায়। এ কারণে মুখে কালেমা পাঠকারী কোনো ব্যক্তিও যদি কুরআন আল্লাহর কালাম হওয়া অস্বীকার করে, কিয়ামত ও আখিরাত অস্বীকার করে, পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরয হওয়া অস্বীকার করে তবে সে মুসলিম থাকে না। সরাসরি অস্বীকার করুক কিংবা ‘ব্যাখ্যা’র অন্তরালে করুক। যেমন কেউ বলল, ‘কুরআন যে আল্লাহর কালাম তা মানি, কিন্তু ঐ অর্থে নয়, যে অর্থে সাধারণ মুসলমানেরা মানে। এটা আল্লাহর নাযিলকৃত কালাম নয়; বরং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিজের রচনা। তবে আল্লাহর আদেশে রচনা করেছেন বলে একে আল্লাহর কালাম বলা হয়।’ (নাউযুবিল্লাহ)
এভাবে কিয়ামত ও আখিরাত সম্পর্কে বলল, কিয়ামত মানি, কিন্তু ঐ অর্থে নয়, যে অর্থে মুসলমানরা মানে। কিয়ামত অর্থ, পুরানো যুগের সমাপ্তি ও নতুন যুগের সূচনা। (নাউযুবিল্লাহ)
তেমনি পাঁচ ওয়াক্ত নামায সম্পর্কে বলল, ‘পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরয তা মানি, কিন্তু নামায অর্থ তা নয় যা মুসলমানেরা মনে করে, নামায অর্থ ধ্যান।’ (নাউযুবিল্লাহ)
তো এজাতীয় ‘ব্যাখ্যার’ অর্থ দ্বীনের ঐসকল বিধানকে অস্বীকার করা। এ কারণে এ ব্যক্তিও মুসলিম নয়।
দ্বীন ও ঈমানের এই গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি পরিষ্কার হয়ে থাকলে এর আলোকে কাদিয়ানী মতবাদ সম্পর্কে চিন্তা করুন। হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল-এ বিশ্বাস যেমন অকাট্য ও অপরিহার্য তেমনি তিনি শেষ নবী, তাঁর পরে কিয়ামত পর্যন্ত আর কোনো নবী নেই-এ বিশ্বাসও অপরিহার্য এবং অকাট্য। এটিও কুরআন-সুন্নাহর মুতাওয়াতির আকীদা এবং জরুরিয়াতে দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত। এ কারণে এ আকীদার অস্বীকারও নিঃসন্দেহে কুফর। সরাসরি অস্বীকার করা হোক কিংবা অপব্যাখ্যার অন্তরালে করা হোক।
কাদিয়ানী সম্প্রদায় খতমে নবুওতের অকাট্য ও সুস্পষ্ট আকীদাকে শুধু অস্বীকারই করে না, গোলাম আহমদ কাদিয়ানীকে ‘নবী’ বলেও বিশ্বাস করে। (নাউযুবিল্লাহ) একারণে তারা নিজেদের পরিচয়ও দেয় ‘আহমদিয়া’ বলে। বলাবাহুল্য, এই এক কুফরই এদের কাফির হওয়ার জন্য যথেষ্ট। অন্যান্য কুফরীর কথা না-ই বলা হল। একারণে মুসলিম উম্মাহর সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত এই যে, কাদিয়ানী মতবাদ সম্পূর্ণ কুফরী মতবাদ এবং এই মতবাদে বিশ্বাসীরা নিঃসন্দেহে অমুসলিম, কাফির।
খতমে নবুওতের মতো অকাট্য আকীদা অস্বীকার করার পর, নবুওতে মুহাম্মাদীর সমান্তরালে নতুন ‘নবুওতে’ বিশ্বাসের পরও যারা এদের অমুসলিম পরিচয়ে সংশয় পোষণ করেন তারা হয় যিন্দীক-বেদীন কিংবা জাহিল-মূর্খ। এদেরও কর্তব্য নতুন করে আল্লাহর শেষ রাসূলের উপর ঈমানকে নবায়ন করা।
মুসলিম উম্মাহর নানাবিধ দুর্বলতার সুযোগে সমাজের বর্ণচোরা মুলহিদ শ্রেণী এতই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে যে, ‘জাতীয় দৈনিকে একের পর এক ক্রোড়পত্র প্রকাশ করছে, যাতে আগাগোড়া ব্যবহৃত হচ্ছে ইসলামের কালেমা এবং বিশেষ ইসলামী পরিভাষাসমূহ!
যদি কোনো বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী বাংলাদেশের অখন্ডতাকে অস্বীকার করে এবং বাংলাদেশের সীমানার ভিতরে আরেক ‘বাংলাদেশে’র গোড়াপত্তন করে আর ঐ কল্পিত রাষ্ট্রের জন্য বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা ব্যবহার করে, আলাদা নির্বাহী, প্রশাসন ও বিচারবিভাগ ঘোষণা করে তাহলে এই বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিষয়ে দেশপ্রেমিক জনগণ, সেনাবাহিনী ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের অবস্থান কী হবে বা হওয়া উচিৎ? এরপর যদি ঐ বিদ্রোহী গোষ্ঠীর উপর এদেশের কোনো জাতীয় দৈনিকে ক্রোড়পত্র প্রকাশিত হয় এবং তাদের ‘সংস্কৃতি’ ও ‘রাজনৈতিক পরিচিতি’ রক্ষার আবদার জানিয়ে মায়াকান্না করা হয় তাহলে এদের সম্পর্কে দেশপ্রেমিক জনগণের প্রতিক্রিয়া কী হবে? এদের কি রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধে ফাঁসিতে ঝুলানো হবে না? এরা কি চিরদিনের জন্য গাদ্দার ও মুনাফিক বলে চিহ্নিত হবে না?
একই কথা কাদিয়ানী সম্প্রদায় এবং তাদের পৃষ্ঠপোষকদের সম্পর্কেও প্রযোজ্য। এ সম্প্রদায় শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুওতের সমান্তরালে আলাদা নবুওতের মিথ্যা দাবি করেও এবং সে দাবির সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেও নিজেদেরকে মুসলিম উম্মাহর অন্তর্ভুক্ত বলে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। সম্পূর্ণ আলাদা ও বিচ্ছিন্ন ধর্মমতে বিশ্বাসী হয়েও ইসলামের পরিচয় ও পরিভাষা ব্যবহার করে চলেছে। আর মুসলিমসমাজে ঘাপটি মেরে থাকা মুনাফিক শ্রেণী বিভিন্ন ভাবে এদেরকে প্রচারের আলোয় নিয়ে আসছে এবং এদের পক্ষে জনমত সৃষ্টির অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। ইসলামের সর্বজনীনতা ও সর্বকালীনতাকে অস্বীকারকারী এই বিচ্ছিন্নতাবাদী সম্প্রদায় সম্পর্কে এরপরও কি কোনো মুসলিম দ্বিধাগ্রস্ত থাকতে পারে? আর যেসব মুলহিদ-মুনাফিক এই বিচ্ছিন্নতাবাদের সাথে সংহতি প্রকাশ করে তাদের গোত্র-পরিচয় সম্পর্কেও কি কোনো মুমিনের সংশয় থাকতে পারে?
এখন সময়ের দাবি, মসজিদে মসজিদে কাদিয়ানী মতবাদের উপর ব্যাপক আলোচনা শুরু হওয়া। কুরআন-সুন্নাহর আলোকে খতমে নবুওতের অকাট্য আকীদা এবং নবী-যুগ থেকে এ পর্যন্ত নবুওতের মিথ্যা দাবিদারদের ইতিহাস ও পরিণাম সম্পর্কে প্রমাণিক আলোচনা আরম্ভ করা। আমাদের মাসিক ও পাক্ষিক সাময়িকীগুলোতে এবং দৈনিক পত্রিকাগুলোর ইসলামী পাতাগুলোতেও এ বিষয়ে নিয়মিত আয়োজন থাকা উচিত। মনে রাখতে হবে, এই বছরটি ওদের মিথ্যাচারের শতবর্ষ পূর্তির বছর। সুতরাং সারা বছর বিভিন্নভাবে প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে তাদের অপতৎপরতা যে চলতে থাকবে তা বলাই বাহুল্য। গোটা দেশের আলিম-উলামা, ইমাম-খতীব এবং ইসলাম প্রিয় লেখক-সাংবাদিকের এ বিষয়ে একযোগে আলোচনা ও প্রতিরোধ শুরু করা এখন সময়ের দাবি। সকল মুসলিম নিজ নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী যদি এই চরম বিদ্রোহ ও বিচ্ছিন্নতার মোকাবিলা আরম্ভ করেন তাহলে ইনশাআল্লাহ বেদীন-মুনাফিক চক্রের সকল অপতৎপরতা ব্যর্থ হবেই হবে। আল্লাহ আমাদের তাওফীক দান করুন। আমীন। ষ