দরসে তাওহীদ-৩
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
তাওহীদ ও শিরকের বিষয়ে দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন
এখানে আরো দুটি বিষয় আছে, যা বুঝে নেওয়া জরুরি। এক. ‘ইবাদত’ কাকে বলে, যা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারোর জন্য করা হলে শিরক হয়। দুই. পার্থিব জীবনযাত্রায় অনেক উপায় উপকরণের প্রয়োজন হয়। আমরা সেগুলোর সাহায্য নিয়ে থাকি। যেমন পানি দ্বারা তৃষ্ণা নিবারণ করি, অগ্নি ও সূর্য থেকে তাপ ও আলো গ্রহণ করি, অসুস্থ হলে ঔষধ ব্যবহার করি। তেমনি অনেক ক্ষেত্রে আমাদেরই মতো অনেক মানুষের সহযোগিতা গ্রহণ করি। যেমন অসুস্থতায় চিকিৎসকের, মামলা-মোকদ্দমায় আইনজীবীর এবং বিভিন্ন কাজকর্মে শ্রমিক-কর্মচারীর সহযোগিতা নিয়ে থাকি। এভাবে দরিদ্র ও প্রয়োজনগ্রস্ত মানুষ সম্পদশালী ও ক্ষমতাশীলদের শরণাপন্ন হয়। এসব কর্মের ব্যাখ্যা কী এবং এগুলো শিরক নয় কেন। প্রথমে দ্বিতীয় বিষয়টি আলোচনা করা যাক।
উপায়-উপকরণের ব্যবহার শিরক নয় কেন আল্লাহ তাআলা এই জগতের সকল বস্ত্ত সৃষ্টি করেছেন এবং তাতে বিভিন্ন গুণ ও ধর্ম দান করেছেন। যেমন পানিতে তৃষ্ণা মেটানোর, অগ্নি ও সূর্যে তাপ ও আলো, ঔষধে নিরাময় ইত্যাদি। গুণ ও বৈশিষ্ট্য আল্লাহরই দান এবং আল্লাহর হুকুমেই তা কাজ করে। এই সকল গুণ ও বৈশিষ্ট্যের ক্ষেত্রে এসব বস্ত্তর নিজস্ব কোনো ক্ষমতা নেই। আল্লাহ তাআলাই এগুলোকে আমাদের সেবায় নিয়োজিত করেছেন। তাই এসব বস্ত্তর সেবা গ্রহণ শিরক নয়। এ ঠিক মানব সেবকের সেবা গ্রহণ এবং গৃহপালিত পশু-পাখীর দ্বারা নিজেদের প্রয়োজন পূরণ করার মতোই ব্যাপার। তেমনি যে বান্দাদের আল্লাহ তাআলা এমন কোনো যোগ্যতা দান করেছেন, যার দ্বারা তারা অন্যদের সেবা ও সাহায্য করতে পারেন, যেমন হাকীম, ডাক্তার, আইনজীবী ইত্যাদি, তাদের সম্পর্কেও সকলেই বোঝে, এদের কোনো অলৌকিক ক্ষমতা নেই এবং নিজ ইচ্ছা ও ইখতিয়ারে কিছুই তারা করতে পারে না। এরাও আমাদেরই মতো আল্লাহর মুখাপেক্ষী। তাদের বিশিষ্টতা এইখানে যে, এই উপায়-উপকরণের জগতে তাদের সহযোগিতা নেওয়া যায়-এই যোগ্যতা আল্লাহ তাদের দান করেছেন। তবে ফলাফল তা-ই হবে যা আল্লাহ ইচ্ছা করেন। এদিক থেকে তাদের সহযোগিতা গ্রহণে শিরকের কিছু নেই।
তো শিরক তখনই হয় যখন কাউকে আল্লাহ তাআলার এই উপকরণ ব্যবস্থার উর্ধ্বে নিজ ইচ্ছা ও ইখতিয়ারে অলৌকিকভাবে কর্ম-সম্পাদনের ক্ষমতাশালী মনে করা হয় আর তাকে রাজি খুশি করার জন্য তার উপাসনা করা হয়।
ইবাদত কাকে বলে
দ্বিতীয় প্রশ্ন ছিল ইবাদত সম্পর্কে। ‘ইবাদত’ দ্বীন ও শরীয়তের একটি বিশেষ পরিভাষা। কাউকে অলৌকিকভাবে হাজতপূরণকারী এবং ইষ্ট-অনিষ্টের ক্ষমতাশালী মনে করে তাকে রাজি-খুশি করার জন্য এবং তার নৈকট্য অর্জনের জন্য যে ভক্তি ও উপাসনামূলক কাজ করা হয় তাকে দ্বীনের পরিভাষায় ‘ইবাদত’ বলে। যেমন সিজদা করা, তওয়াফ করা, নযর ও মান্নত করা, কোরবানী করা, কারো নামের অযীফা পাঠ করা ইত্যাদি। এসব কাজ একমাত্র আল্লাহরই প্রাপ্য।
(টীকা : উল্লেখ্য, অভিধানে ইবাদতের আরেক অর্থ, আনুগত্য ও ফরমাবরদারি। এই দুই অর্থের মাঝে স্পষ্ট ও সর্বজনবোধ্য পার্থক্য এই যে, ‘পারিভাষিক’ ইবাদত আল্লাহ ছাড়া আর কারোর জন্য হতে পারে না। এই ‘ইবাদত’ আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্য করা সরাসরি শিরক এবং সবচেয়ে বড় শিরক। পক্ষান্তরে আনুগত্য ও ফরমাবরদারি মাখলুকেরও হতে পারে। বরং কিছু আনুগত্যের আদেশ তো স্বয়ং আল্লাহ তাআলাই করেছেন। যেমন নবী-রাসূলগণের আনুগত্য, উলুল আমর (তথা দায়িত্বশীল ও ফকীহ মুজতাহিদগণের) আনুগত্য, পিতামাতার আনুগত্য, স্বামীর আনুগত্য ইত্যাদি। তো যারা ইবাদতের এই দুই অর্থের মাঝে -উপাসনা ও আনুগত্য- পার্থক্য করে না; বরং দু’টোকে একাকার করে ফেলে তারা দ্বীনের ব্যাখ্যায় মারাত্মক ভ্রান্তির শিকার হয়। এর দ্বারা তো তাওহীদ ও শিরকের অর্থই বদলে যায়।)
তো যে কেউ আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো সাথে এই সব উপাসনামূলক আচরণ করবে সে নিঃসন্দেহে মুশরিক। আর ইতিপূর্বে বিশদভাবে বলা হয়েছে যে, অধিকাংশ মুশরিকের শিরক এটাই ছিল। তারা আল্লাহ ছাড়া আরো কিছু সত্তাকে ইষ্ট-অনিষ্টের মালিক-মোখতার মনে করেছিল এবং তাদেরকে রাজি খুশি করার জন্য ভক্তি ও উপাসনা নিবেদন করেছিল। এই শিরক হল ঐ ‘জুলমে আযীম’ চরম অবিচার, যা থেকে তওবা ছাড়া মৃত্যুবরণ করলে কোনো ক্ষমা নেই।
ছোট ছোট কিছু শিরক
এ পর্যন্ত আমরা বড় শিরকের আলোচনা করেছি, যার সম্পর্কে কুরআন মাজীদে ঘোষণা করা হয়েছে যে, আল্লাহর কাছে এই অপরাধের কোনো ক্ষমা নেই।
যারা এই শিরকের হালতে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছে বা নিবে, তারা ঐরকম চিরজাহান্নামী হবে, যেমন আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে অস্বীকারকারী সম্প্রদায়। এই বড় শিরক ছাড়াও আরো কিছু বিষয়কে ‘শিরক’ বলা হয়েছে, যেগুলো ঐ পর্যায়ের প্রকৃত শিরক নয়, তবে ঐ শিরকের কিছু বর্ণ-গন্ধ তাতে রয়েছে; কিংবা তা থেকে প্রকৃত শিরকে লিপ্ত হওয়ার আশংকা রয়েছে। যেমন কিছু হাদীসে গায়রুল্লাহর নামে কসম করাকে শিরক বলা হয়েছে, তন্ত্র-মন্ত্র জাতীয় বিষয়কে শিরক বলা হয়েছে, রিয়া ও লোক দেখানো ইবাদত-বন্দেগীকে শিরক বলা হয়েছে, এখানে প্রকৃত শিরক উদ্দেশ্য নয়। এগুলো প্রথমোক্ত শিরক থেকে নীচের স্তরের। একারণেই আলিমগণের একটি পরিভাষা শিরকুন দুনা শিরকিন, যার অর্থ, কিছু শিরক আছে, যা বড় ও প্রকৃত শিরকের চেয়ে নীচের, এমনকি আল্লাহর নৈকট্যপ্রাপ্ত বান্দারা, যারা পূর্ণাঙ্গ তাওহীদের অধিকারী, তাঁরা তো দুনিয়া ও দুনিয়ার চীজ-আসবাবের ভালবাসাকেও ‘শিরক’ বলে থাকেন। তাঁদের নিকটে সম্পদের ভালবাসা শিরক, পদ ও পদবীর প্রতি আকর্ষণ শিরক, স্ত্রী-সন্তানের ঐ ভালোবাসা যা আল্লাহ ও বান্দার মাঝে কিছুমাত্র অন্তরায় হয় এবং আল্লাহর স্মরণ থেকে সামান্যতম গাফিল হওয়ার কারণ হয়। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, তাঁরা ঐসকল বিষয়কে মূর্তিপূজার মতো শিরক মনে করেন; বরং এর অর্থ, ঐসকল বিষয়ও তাওহীদের সর্বোচ্চ দাবি ও কাঙ্খিত ও পূর্ণতার পরিপন্থী।
নতুন যুগের নতুন প্রতিমা
তাওহীদ ও শিরকের প্রসঙ্গে আরো একটি বিষয় আলোচনার দাবি রাখে। তা এই যে, বর্তমান যুগে পশ্চিমের চিন্তাধারা অনেক মানুষকেই সনাতন শিরকের বিষয়ে বিমুখ করেছে। কারণ ঐ শিরকের ভিত্তি যে অজ্ঞতা ও কুসংস্কার তা অতি স্পষ্ট। একারণে পড়া লেখা জানা ব্যক্তিমাত্রই, যদি তার মধ্যে কিছু চেতনা ও বিচার-বোধও থাকে, প্রতিমাপূজা, বৃক্ষ ও লতাপাতার পূজা, নদ-নদীর পূজা এবং জন্তু-জানোয়ারের পূজাকে চরম নির্বুদ্ধিতাই মনে করে। যদিও প্রথা ও প্রচলনের কারণে কিংবা নিজের ‘জাতীয় সংস্কৃতি’র অংশ মনে করে সে-ও ঐ সকল পূজা-অর্চনায় লিপ্ত হয়, কিন্তু মন থেকে কখনোই এসব বিষয়ে শ্রদ্ধা পোষণ করতে পারে না। কিন্তু এখন পশ্চিমা চিন্তাধারার প্রভাবে ঐ সকল প্রচীন প্রতিমার স্থলে কিছু নতুন ‘প্রতিমা’র আবির্ভাব ঘটেছে এবং বিশ্বব্যাপী তার সংক্রমণ ঘটেছে। এই সকল নতুন প্রতিমার ‘পূজা-অর্চনা’ই এখন জোরেসোরে হচ্ছে। ঐ সকল প্রতিমা হচ্ছে- ‘জাতি’, ভুখন্ড, জাতীয় স্বার্থ, দেশীয় স্বার্থ, উদর, সম্পদ, (যৌনতা), ক্ষমতা ইত্যাদি।
দেশ ও দেশবাসীর প্রতি ভালবাসা ও বিশ্বস্ততা মোটেই নিন্দনীয় নয়, বরং তা স্বভাবের এক সাধারণ প্রেরণা। একটা পর্যায় পর্যন্ত তা কাম্যও বটে। তেমনি দেশীয় ও জাতীয় স্বার্থ রক্ষার চেষ্টা, সম্পদ উপার্জনের চিন্তা, শান্তি ও সম্মানের সাথে জীবনযাপনের আকাঙ্খা, এসব বিষয়ে যদি হালাল-হারামের সীমা এবং অন্যের হকের সীমানা লঙ্ঘন না করা হয় তাহলে কখনো তা নিন্দিত নয়। তেমনি কোনো কল্যাণ-উদ্দেশ্যে, যেমন সৃষ্টির সেবা, ন্যায় ও সুবিচার প্রতিষ্ঠা, ইত্যাদির জন্য রাষ্ট্র-ক্ষমতা অর্জনের
চিন্তা ও তৎপরতাও কখনো ভুল নয়। নবীগণ কখনো এসব কাজে বাধা দেননি; বরং এসব ক্ষেত্রেও বিধান দান করেছেন।
কিন্তু এ যুগে এইসকল বিষয় স্বস্ব গন্ডি অতিক্রম করে এত উপরে উঠে গেছে যে, তা এক ধরনের মা’বুদ ও তাগূতের স্তরে উপনীত হয়েছে। এখন তো দেশ ও জাতির ‘স্বার্থ’রক্ষার জন্য সব কিছুই বৈধ, তা যতই অন্যায় ও গর্হিত হোক না কেন। এটি এখন নীতি ও বিশ্বাসে পরিণত হয়েছে। তেমন সম্পদ ও ক্ষমতার আকাঙ্খা ও তৎপরতাকেও আল্লাহর বিধান থেকে মুক্ত-স্বাধীন ধরে নেওয়া হয়েছে, যেন সম্পদ এক দেবতা, যেকোনোভাবে তার ‘নৈকট্য’ অর্জনই পরম আরাধ্য। আর ক্ষমতা এক দেবী, যে কোনো মূল্যে তার আশীর্বাদ লাভই জীবনের পরম লক্ষ্য। সুতরাং এদের পদপ্রান্তে ধর্ম ও নৈতিকতার সকল বিধানই জলাঞ্জলি দেওয়া যায়!
এই দেশ-জাতি, অর্থ ও ক্ষমতা এবং উদর ও যৌনতা হচ্ছে এ যুগের নতুন ‘প্রতিমা’। আর এসবের ‘পূজা-অর্চনা’ই হচ্ছে এ যুগের নতুন ‘শিরক’। তাওহীদের দ্বীন ইসলামে এসবের কোনো স্থান নেই।
সুতরাং নতুন পুরাতন সকল মুশরিককে লক্ষ্য করে আমাদের পুনরায় ঘোষণা করতে হবে তাওহীদের ইমাম সাইয়েদুনা ইবরাহীম আ.-এর বজ্র নির্ঘোষ-
إِنَّا بُرَآَءُ مِنْكُمْ وَمِمَّا تَعْبُدُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ
অর্থাৎ তোমাদের সাথে আর তোমাদের মনগড়া উপাস্য দেবতার সাথে আমাদের কোনোই সম্পর্ক নেই।-সূরা মুমতাহিনা : ৪
এই সকল অনাচারের মূলে রয়েছে প্রবৃত্তির পূজা, অর্থাৎ আল্লাহর বিধানের আনুগত্যের স্থলে মনের চাহিদার অনুগমন-এটাই হচ্ছে সকল শিরক ও অনাচার এবং সকল নাফরমানী ও স্বেচ্ছাচারের জননী। এদিক থেকে যেন সবচেয়ে বড় প্রতিমা মানবের নিজের প্রবৃত্তি।
এ সময়ের কোনো কোনো আল্লাহ-ওয়ালা বুযুর্গকে দেখেছি, কালিমায়ে তাওহীদের ব্যাখ্যায় তারা এবিষয়েই অধিক জোর দিয়েছেন। তাঁদের নিকটে কালিমায়ে তাওহীদ লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ-এর বিশেষ দাবি এই যে, মন যা চায় তা না করা; বরং সকল ক্ষেত্রে আল্লাহর যা হুকুম তাই করা। কুরআন মাজীদের এক জায়গায় নফসের খাহিশকে ‘ইলাহ’ বলা হয়েছে-
أَرَأَيْتَ مَنِ اتَّخَذَ إِلَهَهُ هَوَاهُ
সূরা ফুরকান : ৪৩
এ থেকে বোঝা যায়, যে ব্যক্তি আল্লাহর বিধান থেকে বেপরোয়া হয়ে প্রবৃত্তির আনুগত্য করে সে যেন নিজ প্রবৃত্তির পূজারী। প্রবৃত্তিই তার মাবুদ ও উপাস্য। হাদীসে আছে-
أعدى أعداءك نفسك التي بين جنبيك
তোমার সবচেয়ে বড় শত্রু তোমার ‘নফস’, যা রয়েছে তোমার দুই পাজরের মধ্যে।-ইহইয়াউ উলূমিদ্দীন
সুতরাং ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর মাধ্যমে আমাদেরকে ঐ সকল বিষয় অস্বীকার করতে হবে, যেগুলোতে মাবূদ বা তাগূত হওয়ার কিছুমাত্র বর্ণ-গন্ধও রয়েছে। সকল পর্যায়ের ও সকল ধরনের শিরককে ঘৃণা করতে হবে এবং সেসব থেকে সর্বোতভাবে আত্মরক্ষা করতে হবে। আর সকল দিক থেকে নিজের তাওহীদকে পূর্ণ ও খাঁটি করতে হবে। শিরক যেমন আল্লাহর কাছে চরম ঘৃণিত, তাওহীদ তেমন তাঁর কাছে পরম গ্রহণীয়। বস্ত্তত তাওহীদই গোটা দ্বীন ও ধর্মের প্রাণ। ষ
(চলবে ইনশাআল্লাহ)