নির্জনতা : আল্লাহর সাথে সম্পর্ক লাভের অপূর্ব সুযোগ
আমার এক বোন কাতার থাকে। এক বছর আগে তার বিবাহ হয়েছে। তার স্বামী সেখানে ‘আওক্বাফ’ এর ইমাম। সেই সুবাদে তাকেও সেখানে নিয়ে গেছে। মাঝে মাঝে ফোনে কথা হয়। আমরা জিজ্ঞাসা করি, নতুন দেশে তার কেমন লাগে। কিন্তু তার একটাই অভিযোগ, একা একা ভালো লাগে না। স্বামী কর্মব্যস্ততায় সারাদিন বাইরে থাকে। তাই সময় যেন কাটে না, ভালো লাগে না। সবসময় কান্নাকাটি করে। আমার চারপাশের অনেক বান্ধবী, আত্মীয়-স্বজন অনেকে বলে, একা বাসায় থাকি তাই ভালো লাগে না। পড়াশুনা ইবাদত বন্দেগী কিছুতেই মন বসে না। কিন্তু আমরা যদি চিন্তা করি তাহলে এটা আমাদের নিতান্তই ভুল ধারণা। একাকিত্ব ও নির্জনতা যে ইবাদত-বন্দেগী ও আত্মশুদ্ধির অপূর্ব সুযোগ তা আমরা বুঝতে পারছি না। জন সমাগম বা যৌথ পরিবার হলে ঝগড়া বিবাদ ও ফিৎনা ফ্যাসাদ লেগেই থাকে। অহেতুক গল্প গুজব গীবত শেকায়েত হতে থাকে। গ্রাম বাংলার নারীদের মাঝে দেখা যায়, সাধারণ একটা বিষয় নিয়ে হাতাহাতি পর্যন্ত হয়ে যায় এবং একজন আরেকজনের সাথে চিরদিনের জন্য সম্পর্কচ্ছেদ করে। তাই আমরা যারা একাকী বাস করি, সাংসারিক ঝামেলা কম; এ সুযোগে অহেতুক চিন্তা না করে সময়টাকে কাজে লাগাই। অনন্ত জীবনে প্রশান্তিতে থাকার জন্য ইবাদত বন্দেগীতে মশগুল হই। কারণ আমাদের জীবন অতি সংক্ষিপ্ত। এভাবে অযথা চিন্তা আর মন খারাপের মাঝ দিয়ে সময়ের বিরাট একটা অংশ চলে যাচ্ছে।
একটি একটি করে আমাদের জীবনের দিনগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। আর যৌবনকাল তো দেখতে দেখতে ফুরিয়ে যায়। এক কবি এই পরম সত্য তুলে ধরেছেন এভাবে (অর্থ) মানব শিশুর জন্মকালে আযান দেয়া, আর জানাযার নামাযকে মৃত্যু পর্যন্ত বিলম্বিত করা, একথার প্রমাণ যে, তার জীবনকাল অতি সংক্ষিপ্ত। যেমন সংক্ষিপ্ত আযান থেকে নামাযের মধ্যবর্তী সময়।
কিন্তু আফসোস, আজকাল আমরা নারীরা কত দীর্ঘ সময় অলস বসে কাটাই। মানুষের দোষচর্চায় লিপ্ত হয়ে পরি। মনে করি যৌবনকাল আনন্দ ফূর্তির সময়, ভোগ বিলাসের সময়। এ সময় গল্প গুজব না করে বান্ধবীদের সাথে আড্ডায় না মেতে একা একা ঘরে বসে থাকা কি সাজে।
অথচ জীবন তো যৌবনকাল। এ কালটিই অর্জন ও কর্মের সুবর্ণ সময়। এ সময় শক্তি সামর্থ্য থাকে পরিপূর্ণ, মনোবল থাকে সুউচ্চ। আর অসুস্থতা বা দুর্বলতা? তা তো এ বয়সের ধর্মই নয়। প্রসিদ্ধ ইমাম ও তাবেয়ী মুহাম্মাদ ইবনে সীরীন রাহ.-এর বোন হাফসা বিনতে সীরীন রাহ., যিনি ছিলেন এক মহান তাবেয়ীয়্যাহ, তিনি বলেন, হে যুবসম্প্রদায়; যৌবন বাকি থাকতেই তোমরা নিজেদের থেকে কাজ আদায় করে নাও। কেননা, আমি তো শুধু যুবকদেরকেই কর্মমুখর দেখতে পাই।
কোনো কোনো মনীষী তাঁর শাগরিদদেরকে উপদেশ দিয়ে বলতেন, তোমরা যখন দরস থেকে বের হবে তখন একাকী বাড়ী অভিমুখে চলবে, কেননা একাকী হলে হয়ত তোমাদের কেউ তেলাওয়াত করতে করতে বাড়ী যাবে আবার কেউ ভালো কোনো ভাবনায় সময়টাকে পার করবে। কিন্তু কয়েকজন একত্রে থাকলে কথাবার্তা বলতে বলতেই সময়টা চলে যাবে।-কীমাতুয যামান ইনদাল উলামা
ইমাম আবুল কাসেম ইবনে আসাকির রা. বিশ বছর বয়সে হাদীস শ্রবণ ও সংগ্রহ শুরু করেন এবং বহু দেশের বহু শায়েখ থেকে হাদীস সংগ্রহ করেন। তাঁর উসতায-সংখ্যা (অর্থাৎ যাদের থেকে তিনি হাদীস শ্রবণ করেছেন) প্রায় চৌদ্দশ। তাদের মাঝে রয়েছেন তেরশ জন পুরুষ এবং আশির কিছু বেশী নারী।-কীমাতুয যামান ইনদাল উলামা
অতীতে মহামনীষীদের মাঝে যেমন পুরুষ ছিল, তেমনি নারীদের সংখ্যাও কম ছিল না। তারা সময়কে কাজে লাগিয়েছেন দ্বীনী কাজে। নির্জনতাকে কাটিয়েছেন ইবাদত-বন্দেগীতে । তাই ইতিহাসের পাতায় তারা স্মরণীয় হয়ে আছেন। আজো মানুষ তাদেরকে শ্রদ্ধাভরে ম্মরণ করে। ‘আ’লামুন নিসা] (নারী মনীষী) নামে কিতাব লেখা হয়েছে, যার পৃষ্ঠা সংখ্যা হাজারের উর্ধ্বে।
আজ আমরা নারীরা দুর্বলতা, নির্জনতা, একাকিত্ব বিভিন্ন অজুহাত খাড়া করে সময়কে নষ্ট করছি। মহামূল্যবান জীবন বরবাদ করছি। তাই সময় থাকতে এখনি আমরা সতর্ক হই। নিঃসঙ্গ জীবনে বিষন্ন না হয়ে আমাদের অনেক কাজ আছে, যা দ্বারা সময়কে কাজে লাগিয়ে একাকিত্ব দুর করতে পারি এবং অখিরাতের পাথেয় সংগ্রহ করতে পারি। যেমন প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত ফরজের পাশাপাশি কিছু নফল আদায় করা। আর এ নফল নামাজকে নিজের জীবনে অপরিহার্য করে নেওয়া।
কিছুক্ষণ পবিত্র কুরআন তেলাওয়াত করা, এমন যেন না হয় আমার একটা দিন পার হয়ে গেল, কিন্তু তেলাওয়াত হল না। সর্বদা জিকিরের হালতে থাকা। চলাফেরায় সাংসারিক কাজ কর্মে। আর এটা এমন এক আমল যার জন্য নির্ধারিত কোনো জায়গা বা সময়ের প্রয়োজন হয় না এবং জিকিরের মাধ্যমেই আত্মার প্রশান্তি আসে, মনের অশান্তি দূর হয়। কুরআন ও হাদীসে এর অসংখ্য বর্ণনা রয়েছে।
কিছু সময় মুনাজাতে মকবুল বা আলহিজবুল আ’যম পাঠ করা। দ্বীনী কিতাবাদি পাঠ করা, আল্লাহর সৃষ্টিকূল নিয়ে কিছু সময় চিন্তা করা, ছোট
সন্তানাদি থাকলে তাদেরকে দ্বীনী তালিম দেওয়া। কোরআন শিক্ষা দেওয়া। তাদের সামনে আল্লাহর বড়ত্ব ও মহত্বের আলোচনা করা।
আরো হিম্মত হলে কমপক্ষে কুরআন-হাদীসের অর্থ বুঝে আসে এ পর্যায়ের দ্বীনী তালীম অর্জন করা। পারলে নারীদের দ্বীনী সচেতনতা তৈরির লক্ষ্যে কলমের মাধ্যমে চেষ্টা করা।
রাতে শোয়ার আগে নিজের আমলের মুহাসাবা করা। গুনাহ হয়ে গেলে ইসতিগফার করা এবং ভবিষ্যত জীবনে যেন গুনাহ না হয় সেজন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করা। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে নির্জনতাকে কাজে লাগিয়ে সময়ের হেফাযত করার তাওফীক দান করুন। আমীন। ষ