খৃষ্টধর্ম না পৌলবাদ-৩
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
মানুষ যাতে তাঁকে নিয়ে বাড়াবাড়ির স্বীকার না হয় সেজন্য তিনি নিজেও নিজের প্রকৃত অবস্থা স্পষ্ট করে দিয়েছেন। ইন্জীলের পাঠক ইন্জীলের পাতায়-পাতায় দেখতে পাবে কিভাবে তিনি বারবার মনুষ্যপুত্র-মনুষ্যপুত্র বলে নিজের পরিচয় তুলে ধরেছেন ( দেখুন মথি ৯ : ৬; ১০ : ২৩; ১১ : ১৯; ১২ : ৩২, ৪০; ১৩ : ৪০, ৪১; ১৬ : ১৩, ২৭, ২৮; ১৭ : ৯, ১২; ১৯ : ২৮; ২০ : ১৮, ২৮; ২৪ : ৩০, ৩১, ৩৩, ৩৭, ৩৯ অন্যান্য, মার্ক ২ : ১০, ২৮; ৮ : ৩১, ৩৮; ৯ : ৯, ১২, ৩১ অন্যান্য।)
এমনিভাবে তিনি নিজের সম্পর্কে বলেছেন যে, তিনি আল্লাহর প্রেরিত নবী ( মথি ১০ : ৪০, ৪১; ১৩ : ৫৭; মার্ক ৬ : ৪; লূক ১৩ : ৩৩; ৪ : ৪৩, ৪৪)। তিনি আল্লাহর গোলাম (ইউহোন্না ১৩ : ১৬), আল্লাহর গোলাম হিসেবে তাঁরই ইবাদতকারী। (ইউহোন্না ৪ : ১২), তিনি নিজের থেকে কিছু করার ক্ষমতা রাখেন না, বরং তিনি আল্লাহর আজ্ঞাবহ ও তাঁর ইচ্ছা পালনকারী মাত্র (ইউহোন্না ৫ : ১৯, ৩০, ৩৬; ৭ : ১৬, ১৭; ৪ : ৩৪) এবং আল্লাহ তা’আলাকে সন্তুষ্ট করাই তার পরম লক্ষ্য (ইউহোন্না ৮ : ২৮, ২৯)
মোটকথা ইনজীলের-পাঠকমাত্রই সমগ্র ইন্জীলে হযরত ঈসা মসীহ (আ)-এর মনুষ্যসত্তাই দেখতে পাবে। তিনি নবীরূপে দায়িত্ব পালনকালে মানুষের সামনে এই বাস্তবতাই তুলে ধরেছেন যে, অন্যান্য মানুষের মত তিনি একজন মানুষই, যাকে আল্লাহ তা’আলা আর সব নবী-রাসূলের মত মানুষের হিদায়াতের জন্য পাঠিয়েছেন। কোথাও তিনি এমন আভাসমাত্র দেননি যে, তিনি আল্লাহর ত্রিসত্তার একজন, এবং সে হিসেবে তিনি স্বয়ং খোদা, যে মানবদেহে আত্মপ্রকাশ করেছে।
হযরত মসীহ (আ)-এর শিষ্যগণও তাঁর শিক্ষা অনুযায়ী তাকে একজন মানুষ ও আল্লাহর বান্দাই মনে করতেন, যেমন প্রধান শিষ্য পিতর তাঁর এগারজন সংগীর মধ্যে দাঁড়িয়ে ইহুদীদের বলেছিলেন, ইসরাঈলের মানুষেরা, আমি যা বলছি শুনে রাখ, নাজারাথের যীশু এমন একজন মানুষ ছিলেন, যাঁর পরিচয় পরমেশ্বর তোমাদের সামনে তুলে ধরেছিলেন ... (মঙ্গলবার্তা [ইন্জীলের বাংলা অনুবাদ] কলিকাতা ১৯৮৫ খৃ. প্রেরিত ২ : ২২-খৃস্টবাদবিকৃতি পৃ. ৫১-এর বরাতে)।
পিতর তার আরেক ভাষণে বলেন, আমাদের পূর্বপুরুষদের আল্লাহ এই কাজের দ্বারা নিজের গোলাম ঈসার মহিমা প্রকাশ করেছেন (প্রেরিত ৩ : ১৩)।
একবার হাওয়ারীগণ সকলে সম্মিলিতভাবে আল্লাহর কাছে মুনাজাত করেছিলেন-বাস্তবিকই তোমার পবিত্র গোলাম ইয়াসূ, যাকে তুমি মসীহ হিসেবে নিযুক্ত করেছিলেন, তাঁর বিরুদ্ধে বাদশাহ হিরোদ ও পন্তীয় পিলাত এই শহরেই অইহুদীদের সংগে এবং বনী ইসরাঈলের সংগে হাত মিলিয়েছেন (প্রেরিত ৪ : ২৭)।
একবার হাওয়ারী বার্নাবাস বলেছিলেন, আন্তরিক ইচ্ছার সাথে খোদাবন্দের সাথে জড়িয়ে থাক। কেননা তিনি (মসীহ) একজন ভালো লোক ... (প্রেরিত ১১ : ২৩-২৪)।
মোটকথা হযরত মসীহ (আ) নিজেও যেমন নিজেকে একজন মানুষ ও আল্লাহর বান্দা হিসেবে প্রচার করেছিলেন, কখনও নিজেকে ঈশ্বর বা ঈশ্বরের অবতার বলেননি, তেমনি তাঁর হাতেগড়া শিষ্যগণও তার সম্পর্কে সেই একই কথা প্রচার করেছেন। তারাও তাঁকে কখনও ঈশ্বরের অবতার মনে করেননি, একজন মানুষ ও নবীই মনে করেছেন।
পৌলের দৃষ্টিভঙ্গি
খৃষ্টীয় শিক্ষার নামে পৌলই সর্বপ্রথম এই তত্ত্ব হাজির করেছেন যে, হযরত মসীহ মানুষ নয়, বরং ঈশ্বরের অবতার ছিলেন, অর্থাৎ তিনি ছিলেন মানবরূপে ঈশ্বরেরই প্রকাশ।
ফিলিপীয়দের নামে লেখা চিঠিতে তিনি হযরত মসীহ (আ) এর স্বরূপ ব্যাখ্যাপূর্বক ঘোষণা দেন- ঈসা মসীহই প্রভু (ফিলিপীয় ২ : ৬-১১)। কলসীয়দের নামে লেখা চিঠিতে বলেন, এই পুত্রই হলেন অদৃশ্য আল্লাহর হুবহু প্রকাশ। সমস্ত সৃষ্টির আগে তিনিই ছিলেন। সমস্ত সৃষ্টির উপরে তিনিই প্রধান। কারণ আসমান ও যমীনে যা দেখা যায় আর যা দেখা যায় না, সব কিছু তাঁর দ্বারা সৃষ্টি হয়েছে। আসমানে যাদের হাতে রাজত্ব, কর্তৃত্ব, শাসন ও ক্ষমতা রয়েছে তাদের সবাইকে তাঁকে দিয়ে তাঁরই জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে। (কলসীয় ১ : ১৬)
একটু পরে লেখেন, ঈশ্বরত্বের সমস্ত পূর্ণতা মসীহের মধ্যে শরীর হয়ে বাস করছে (কলসীয় ২ : ৯)।
হযরত মাসীহ (আ) সম্পর্কে এই হচ্ছে সেন্ট পৌলের উদ্ভাবিত তত্ত্ব এবং স্পষ্ট পৌত্তলিকতা। তার আগে তাuঁক ঈশ্বরের প্রকাশ ও ঈশ্বরের শরীরী রূপ বলে আর কেউ প্রচার করেনি। সুতরাং প্রচলিত খৃষ্টধর্মে যে হযরত ঈসা (আ)কে ঈশ্বরের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে এবং এটিকে এ ধর্মের বুনিয়াদী বিশ্বাসের স্থান দেওয়া হয়েছে, এটা হযরত মসীহ (আ)-এর শিক্ষা নয়; বরং তাঁর শিক্ষার সম্পূর্ণ বিপরীত মতবাদ। সেন্ট পৌলই এই পৌত্তলিক মতবাদের জন্মদাতা।
‘ইবনুল্লাহ’-এর মর্ম কী?
কোনো ইন্জীল-পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে যে, ইন্জীলের বিভিন্ন স্থানে তো হযরত ঈসা (আ)-কে আল্লাহর পুত্র (ইবনুল্লাহ) বলা হয়েছে। তা অবতারত্বের ধারণাকে সমর্থন করে না কি?
না, তা সমর্থন করে না। কেননা ইন্জীলের নির্ভরযোগ্যতা প্রশ্নসাপেক্ষ হওয়া সত্ত্বেও যদি আমরা হযরত ঈসা মসীহ (আ) সম্পর্কে ‘ইবনুল্লাহ’ বা ‘আল্লাহর পুত্র’ শব্দের ব্যবহারকে বিশুদ্ধ ধরে নেই, তবু এর দ্বারা ‘পুত্র’-এর সাধারণ অর্থ গ্রহণের কোনো সুযোগ নেই। কারণ তিনি তো নিজেকে বারবার মনুষ্যপুত্রও বলেছেন। সাধারণ অর্থে একই ব্যক্তি আল্লাহর পুত্র হবেন এবং মানুষেরও পুত্র হবেন এটা কি করে সম্ভব? এ রকম স্ববিরোধী কথা একজন নবী কখনও নিজের সম্পর্কে বলতে পারেন না। এ স্ববিরোধিতা থেকে বাঁচার উপায় হল, ‘মনুষ্যপুত্র’-কে সাধারণ পুত্র মর্মে গ্রহণ করা আর আল্লাহর পুত্রকে প্রতীকী ও রূপক অর্থে গ্রহণ করা।
সে হিসেবে ‘পুত্র’-এর এক অর্থ হতে পারে ‘প্রিয়পাত্র’, যেমন খৃষ্টান ও ইহুদীরা নিজেদের সম্পর্কে বলে থাকে ‘আমরা আল্লাহর পুত্র’। কুরআন মাজীদের ইরশাদ-
وَقَالَتِ الْيَهُودُ وَالنَّصَارَى نَحْنُ أَبْنَاءُ اللَّهِ
‘ইহুদী ও খৃষ্টানগণ বলে, ‘আমরা আল্লাহর পুত্র’ (মায়িদা ১৮)।
এতে পুত্র মানে প্রিয়পাত্র ও ঘনিষ্ঠ। বস্ত্তত হযরত ঈসা (আ)-ও নিজেকে আল্লাহর পুত্র বলেছেন এ অর্থেই।
এর অর্থ ‘ধার্মিক লোক’-ও হতে পারে এবং ইন্জীল দ্বারাই তো প্রমাণিত হয়, যেমন মার্কের ইন্জীলে আছে, ‘যে সেনাপতি ঈসার সামনে দাঁড়িয়েছিল সে ঈসাকে এভাবে মারা যেতে দেখে বলল, সত্যিই ইনি ‘ইবনুল্লাহ’ (আল্লাহর পুত্র) ছিলেন’ (মার্ক ১৫ : ৩৯), অথচ এই একই উক্তি লূকের বর্ণনায় যেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, সেখানে ‘আল্লাহর পুত্রের’ স্থানে ‘ধার্মিক লোক’ বলা হয়েছে (লূক ২৩ : ৪৭)।
লূকের বর্ণনাটি ভুল না হয়ে থাকলে বলতে হবে তিনি ‘আল্লাহর পুত্র’-এর রূপক অর্থ করেছেন ‘ধার্মিক লোক’।
বিখ্যাত জর্মন চিন্তাবিদ প্রফেসর হার্নেক এর আরেকটি অর্থ করেছেন, যা খুবই যুক্তিযুক্ত। তিনি বলেন, হযরত মসীহ (আ) নিজেকে কেন ‘ঈশ্বর-পুত্র’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন, তা তিনি নিজেই স্পষ্ট করে দিয়েছেন। তাঁর সে বক্তব্যটি মথির ইন্জীলে বিবৃত হয়েছে। তিনি বলেন, পিতা ছাড়া পুত্রকে কেউ জানে না এবং পুত্র ছাড়া পিতাকে কেউ জানে না। আর পুত্র যার কাছে পিতাকে প্রকাশ করতে ইচ্ছা করেন, সে-ই তাকে জানে (মথি ১১ : ২৭)।
এর দ্বারা স্পষ্ট হয়, নিজের সম্পর্কে ‘ঈশ্বর-পুত্র’ হওয়ার যে ধারণা হযরত মসীহের ছিল তা এ বিষয়ের এক বাস্তব অভিব্যক্তি ছাড়া আর কিছুই নয় যে, তিনি আল্লাহকে পিতা অর্থাৎ নিজের পিতা সম্পর্কে যেভাবে জানা সম্ভব সেইভাবে জানতেন। সুতরাং ‘পুত্র’ শব্দটিকে যদি বিশুদ্ধ ধরে নেওয়া হয়, তবে তার মানে আল্লাহর পরিচয় ছাড়া আর কিছুই নয়। অর্থাৎ হযরত মসীহের দাবি হল, তিনি আল্লাহকে এভাবে জানতেন যেমনটা তার আগে কেউ জানত না। আর এ হিসেবেই তিনি নিজেকে ‘আল্লাহর পুত্র’ বলতেন (বিস্তারিত দ্র. খৃষ্টধর্মের স্বরূপ, পৃ. ৮০-৮২)।
‘পুত্র’-এর এক অর্থ আজ্ঞাবহ ও অনুগতও হতে পারে আর যার আনুগত্য করা হয় তাকে বলা হয় পিতা। ইন্জীলে সেই অর্থে আল্লাহকে পিতা বলা হয়েছে। যেমন, ঈসা (আ) ইহুদীদের বলেছিলেন,
আপনাদের পিতা যা করে আপনারা তাই করছেন। তারা ঈসাকে বললেন, আমরা তো জারজ নই। আমাদের একজনই পিতা আছেন। সেই পিতা হলেন আল্লাহ। ঈসা তাদের বললেন, সত্যিই যদি আল্লাহ আপনাদের পিতা হতেন, তবে আপনারা আমাকে মহববত করতেন। কারণ আমি আল্লাহর কাছ থেকে এসেছি ...। ইবলিসই আপনাদের পিতা আর আপনারা তারই সন্তান; সেজন্য আপনারা তার ইচ্ছা পূরণ করতে চান’ (ইউহোন্না ৮ : ৪১-৪৪)।
বস্ত্তত প্রিয়পাত্র, অনুগত, অনুসারী ইত্যাদি অর্থে ‘ইব্ন’ ও ‘পুত্র’ শব্দের ব্যবহার সব ভাষাতেই আছে এবং এটা বহুল প্রচলিত। কাজেই হযরত ঈসা (আ) নিজেকে আল্লাহর পুত্র যদি বলেও থাকেন, তবে তার দ্বারা প্রকৃত পুত্র বা শারীরিকভাবে জন্মদাতার সন্তান বোঝানো উদ্দেশ্য হবে না; বরং প্রিয়পাত্র ও আজ্ঞাবহ ইত্যাদি বোঝানোই উদ্দেশ্য হবে। যেমন গুরু তার শিষ্যকে পুত্র বলে, নেতা তার অনুসারীকে পুত্র বলে এবং ভক্ত নিজেকে তার আদর্শপুরুষের পুত্র বলে। ঠিক পিতা বলেও রূপকার্থে নেতা, গুরুজন, আদর্শব্যক্তি, মনিব ইত্যাদি বোঝায়। এ হিসেবেই ‘আল্লাহ’ সম্পর্কে ‘পিতা’ এবং বান্দা সম্পর্কে ‘পুত্র’ শব্দের ব্যবহার তাওরাত ও ইন্জীলে ব্যাপকভাবে পরিলক্ষিত হয়। সুতরাং ইবনুল্লাহ বা ‘আল্লাহর পুত্র’ শব্দবন্ধ দ্বারা হযরত ঈসা (আ)-এর অবতারত্ব বা ঈশ্বরত্ব প্রমাণের কোনো সুযোগ নেই। একই কথা ‘পিতা’ শব্দের ক্ষেত্রেও। অর্থাৎ হযরত মসীহ (আ) আল্লাহকে পিতা বলেছেন বলে তিনি যে আল্লাহর অবতার বা তার শারীরিক প্রকাশ, এটা প্রমাণেরও অবকাশ নেই।
পাক রূহ (রূহূল-কুদ্স)
রূহূল-কুদ্স বা পাক-রূহ (ঐড়ষু ংঢ়ৎরঃ) দ্বারা বোঝানো হয় পিতা ও পুত্রের জীবন ও ভালোবাসার গুণকে। অর্থাৎ এ গুণের মাধ্যমে পিতা পুত্রকে এবং পুত্র পিতাকে ভালোবাসে। এগুণটি ‘কালাম’ গুণের মত বস্ত্তগতভাবে বিদ্যমান এবং পিতা-পুত্রের মত নিত্য ও চিরন্তন। এ কারণেই তা স্বতন্ত্র একক সত্তা (চবৎংড়হ)-এর মর্যাদা রাখে (খৃষ্টধর্মের স্বরূপ, পৃ. ২২)
ইনজীল শরীফের শেষে যে শব্দার্থ ও টীকা লেখা হয়েছে তাতে ‘পাক-রূহ’-এর পরিচয় দেওয়া হয়েছে নিম্নরূপ, ‘ইন্জীল শরীফে ইনি একজন, যাঁকে ‘পাক-রূহ’ বলা হয়। সেই রূহ কোন প্রভাব, ফেরেশতা অথবা মনের অবস্থা নয়-তিনি নিজে আল্লাহ। তিনি সৃষ্টির কাজে, আল্লাহর কালাম প্রকাশের কাজে এবং ঈমানদারদের পরিচালিত ও শক্তিশালী করার কাজে জড়িত ছিলেন (পৃ. ৩৯৬)
খৃষ্টানদের বিশ্বাস হল, হযরত মাসীহ (আ)-কে যখন তরিকাবন্দী দেওয়া (ব্যাপ্টাইজ করানো) হচ্ছিল তখন এই ‘পাক-রূহ’ কবুতর আকৃতিতে অবতীর্ণ হয়ে তাঁর সত্তায় মিশে গিয়েছিল (দেখুন মথি ৩ : ১৬)। পরবর্তীতে যখন হযরত মসীহ (আ)-কে আকাশে তুলে নেওয়া হয়েছিল তখন পঞ্চাশওমী ঈদের দিন এই পাক-রূহই আগুনের জিহবা আকারে এসে হযরত মসীহ (আ)-এর শিষ্যবর্গের উপর বসেছিল ( প্রেরিত ২ : ১-২২)।
খৃষ্টানদের বিশ্বাস এই পাক-রূহ আল্লাহর ত্রিসত্তার অন্যতম। পিতা (আল্লাহর নিজ সত্তা) ও পুত্র (আল্লাহর কালাম গুণ)-এর মত ‘পাক-রূহ’-ও একজন খোদা। এবং খোদা হিসেবে তিনি সর্বজ্ঞানী, স্বাধীন ও সার্বভৌম ইচ্ছাশক্তির অধিকারী ও স্বাধীন কর্তা, যে কারণে তিনি পূজ্য ও আরাধ্য।
হযরত ঈসা (আ)-এর শিক্ষা
খৃষ্টধর্মে ‘পাক-রূহ’-এর যে ঈশ্বরত্ব ও প্রভূত্বের মর্যাদা উপরে বর্ণিত হল এ সম্পর্কে হযরত ঈসা (আ) থেকে কিন্তু কোনো বক্তব্য পাওয়া যায় না। এমনকি তার হাওয়ারী ও শিষ্যদের থেকেও নয়। হযরত মসীহ (আ)-এর বিভিন্ন বক্তব্যে ‘পাক-রূহ’-এর প্রসংগ এসেছে বটে, কিন্তু তা ঈশ্বর হিসেবে নয়; বরং একজন সাহায্যকারী, পথ-প্রদর্শক ও পরিচালক হিসেবে। অর্থাৎ তিনি বিভিন্ন কাজে হযরত ঈসা (আ)-কে সাহায্য ও পরিচালনা করেছেন ও সংবাদ দিয়েছেন, ব্যস এতটুকুই (দেখুন মথি ২২ : ৪৩; মার্ক ১ : ১২; ১২ : ৩৫; লূক ২ : ২৬; প্রেরিত ১ : ১৫)।
এর বেশি কিছু তাঁর বা হাওয়ারীদের বক্তব্যে পাওয়া যায় না। বস্ত্তত হযরত মসীহ (আ)-এর বক্তব্য থেকে ‘পাক-রূহ’ সম্পর্কে যে ধারণা পাওয়া যায় তা কুরআন মাজীদে প্রদত্ত ধারণার অনুরূপ। অর্থাৎ ‘পাক-রূহ’ বা ‘রূহূল-কুদ্স’ হল হযরত জিবরীল (আ)-এর উপাধি, যিনি ফিরিশতাদের সর্দার। আল্লাহ তা’আলা তাঁর মাধ্যমে যেমন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি ওহী নাযিল করেছেন এবং গুরুত্বপূর্ণ বহু ক্ষেত্রে তাঁকে তার সাহায্যার্থে প্রেরণ করেছেন, তেমনি হযরত মসীহ (আ)-এর সাহায্য-সহযোগিতায়ও বিশেষভাবে তাঁকে নিযুক্ত করেছিলেন, যেমন ইরশাদ হয়েছে,
وَآَتَيْنَا عِيسَى ابْنَ مَرْيَمَ الْبَيِّنَاتِ وَأَيَّدْنَاهُ بِرُوحِ الْقُدُسِ
‘আমি ঈসা ইবন মারয়ামকে দিয়েছিলাম সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী এবং তাঁকে সাহায্য করেছিলাম রূহুল-কুদসের মাধ্যমে (বাকারা : ৮৭, ২৫৩)।
কুরআন মাজীদ আরও জানায়, ‘রূহূল-কুদস’ বা ‘পাক-রূহ’ সম্পূর্ণরূপেই আল্লাহ তা’আলার আজ্ঞাবাহী। আল্লাহ তা’আলার হুকুম ছাড়া তিনি কোনো কাজ করেন না (দেখুন মারয়াম : ৬৪; নাবা : ৩৮)। একই কথা আছে ইন্জীলেও। বলা হয়েছে, ‘পাক-রূহ’ আল্লাহর ইচ্ছামতই আল্লাহর বান্দাদের জন্য অনুরোধ করেন’ (রোমীয় ৮ : ২৭)।
বোঝা যাচ্ছে ‘পাক-রূহ’ ঈশ্বর বা ঈশ্বরের ত্রিসত্তার একজন নন।
পাক-রূহ সম্পর্কে পৌল যা বলেন
‘পাক-রূহ’ সম্পর্কে পৌল তাঁর পত্রাবলীতে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন এবং ঈশ্বর হিসেবে তার যে কী শক্তি ও মহিমা তা তার ভক্তদেরকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। যেমন তিনি বলেন, শরীআত মৃত্যু আনে, কিন্তু ‘পাক-রূহ’ জীবন দান করেন ( ২-করিন্থীয় ৩ : ৬)।
করিন্থীয়দের নামে লেখা প্রথম চিঠিতে বলেন, ‘পাক-রূহের অজানা কিছুই নেই। এমনকি তিনি আল্লাহর গভীর বিষয়ও জানেন’ (১-করিন্থীয় ২ : ১০)।
একই চিঠিতে তিনি পাক-রূহের ক্ষমতা ও প্রভুত্ব বোঝাতে গিয়ে বলেন, একই পাক-রূহের দেওয়া বিশেষ দান ভিন্ন-ভিন্ন রকমের। আমরা ভিন্ন-ভিন্ন উপায়ে একই প্রভুর সেবা করি। আমাদের প্রত্যেককে ভিন্ন-ভিন্ন কাজ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু একই আল্লাহ ভিন্ন-ভিন্ন উপায়ে আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে কাজ করে থাকেন। সকলের উপকারের জন্যই এক-এক মানুষের মধ্যে-এক-এক রকম করে ‘পাক-রূহ’ প্রকাশিত হন। কাউকে কাউকে সেই ‘পাক-রূহের’ মধ্য দিয়ে জ্ঞানের কথা বা বুদ্ধির কথা বলতে দেওয়া হয়। অন্য কাউকে- কাউকে সেই একই রূহের দ্বারা বিশ্বাস বা রোগ ভালো করার ক্ষমতা বা অলৌকিক কাজ করবার ক্ষমতা বা নবী হিসেবে আল্লাহর কালাম বলবার ক্ষমতা বা ভালো ও ভুতদের চিনে নেবার ক্ষমতা দেওয়া হয়। এই সমস্ত কাজ সেই একই পাক-রূহ করে থাকেন। তিনি যেভাবে ইচছা করেন সেভাবেই এইসব দান প্রত্যেককে আলাদা করে দেন (১-করিন্থীয় ১২ : ৪-১১)।
করিন্থীয়দের কাছে লেখা দ্বিতীয় চিঠিতে বলেন, আজও মূসার তৌরাত শরীফ তেলাওয়াত করবার সময় বনী-ইসরাঈলের দিল সেই পর্দায় ঢাকা থাকে। কিন্তু তাদের মধ্যে কেউ যখন প্রভুর দিকে ফেরে তখন সেই পর্দা সরে যায়। এই প্রভুই হলেন ‘পাক-রূহ’ আর যেখানেই প্রভুর রূহ সেখানেই স্বাধীনতা। এজন্য আমরা যারা মসীহের সংগে যুক্ত হয়েছি আমরা সবাই খোলামুখে আয়নায় দেখা ছবির মত করে প্রভুর মহিমা দেখতে দেখতে নিজেরাও মহিমায় বেড়ে উঠে বদলে গিয়ে তাঁরই মত হয়ে যাচ্ছি। প্রভুর অর্থাৎ পাক-রূহের শক্তিতেই এটা হয়
(২ করিন্থীয় ৩ : ১৫-১৮)।
সেন্ট পৌলের এসব উক্তি ‘পাক-রূহ’ সম্পর্কে যে ধারণা দেয়, তা আল্লাহ সম্পর্কিত বিশ্বাসেরই অনুরূপ। অর্থাৎ পাক রূহ সর্বজ্ঞ, তার অজানা কিছুই নেই, তিনি জীবনদাতা, মানুষের যত সব শক্তি ও ক্ষমতা তা তাঁরই দান এবং তিনিই প্রভু হিসেবে মানুষকে তা দিয়ে থাকেন। এভাবে সেন্ট পৌল তার বক্তব্যে মূলত ঈশ্বরের ছবি এঁকেছেন।
সুতরাং পিতা আল্লাহও সর্বশক্তিমান সত্তা, পুত্র মসীহও এক সর্বশক্তিমান সত্তা এবং ‘পাক-রূহ’ এক সর্বশক্তিমান সত্তা। ঈশ্বরের এই পূর্ণাঙ্গ তিন সত্তা তথা ত্রিত্ববাদের জন্মদাতা কেবলই সেন্ট পৌল। না হযরত মসীহ (আ)-এর নিজ বক্তব্যে এর কোনো আভাস আছে, না তাঁর শিষ্যগণ এ তত্ত্বের সাথে পরিচিত ছিলেন, আর না মূল খৃষ্টধর্মে এর কোনো ধারণা ছিল। খৃষ্টধর্মে এই শিরকী ও পৌত্তলিক ভাবনার অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে সেন্ট পৌলই এ ধর্মকে তাওহীদী অবস্থান থেকে বিচ্যুত করেছে আর গরিষ্ঠসংখ্যক খৃষ্টান সেই সত্যচ্যুত ধর্মকেই আসল ধর্ম হিসেবে বরণ করে নিয়েছে। তাদের এ চেতনা কবে জাগবে যে, তারা যাকে খৃষ্টধর্ম বলে বিশ্বাস করছে তা মোটেই হযরত যিশু খৃষ্ট (আ)-এর শিক্ষা নয়; আসলে তারা পৌলবাদের চোরাবালিতেই আটকে গেছে? কুরআন মাজীদও তাদেরকে হুঁশিয়ার করছে,
فَآَمِنُوا بِاللَّهِ وَرُسُلِهِ وَلَا تَقُولُوا ثَلَاثَةٌ انْتَهُوا خَيْرًا لَكُمْ إِنَّمَا اللَّهُ إِلَهٌ وَاحِدٌ سُبْحَانَهُ أَنْ يَكُونَ لَهُ وَلَدٌ لَهُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ وَكَفَى بِاللَّهِ وَكِيلًا
‘তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলগণের প্রতি ঈমান আন এবং বলো না ‘আল্লাহ তিন’। এর থেকে নিবৃত্ত হও। এরই মধ্যে তোমাদের কল্যাণ। আল্লাহ তো একই মাবূদ। তার কোনো পুত্র থাকবে-এর থেকে তিনি সম্পূর্ণ পবিত্র। আকাশমন্ডল ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে তা তাঁরই। সকলের তত্ত্বাবধানের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। (নিসা : ১৭১)।
(চলবে ইনশাআল্লাহ)