সফর ১৪৩৪   ||   জানুয়ারি ২০১৩

কুসংস্কারের উপশম কুরআন-সুন্নায়

মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক

এখন হিজরী বর্ষের দ্বিতীয় মাস-সফর মাস চলছে। এ মাসকে আরব জাহেলী যুগে ‘অশুভ’ মনে করা হত। এটা ছিল ঐ সমাজের অসংখ্য কুসংস্কারের একটি। আল্লাহ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দ্ব্যর্থহীনভাবে তা সংশোধন করেছেন-ইরশাদ করেছেন-(অর্থ) রোগ লেগে যাওয়া, কুলক্ষণ, পেঁচা ও সফর-সবের কোনো বাস্তবতা নেই।-সহীহ বুখারী, হাদীস : ৫৭৫৭; সহীহ মুসলিম, হাদীস : ৫৭৪৩

আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অবির্ভাবের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ছিল তাযকিয়া ও পরিশুদ্ধি। আল্লাহর আদেশে তিনি মানবের কর্ম ও চরিত্রের পাশাপাশি তাঁর মন-মানস এবং বিশ্বাস ও চেতনাকে পরিশুদ্ধ, পরিচ্ছন্ন ও নির্মল করেছেন। এবং কিয়ামত পর্যন্ত বিশ্ব মানবতার জন্য ঐ দুই পরশপাথর রেখে গেছেন, যার স্পর্শে মানবের সকল ‘লোহা’ খাটি  ‘সোনায়’ পরিণত হতে পারে। সেই দুই পরশপাথর হচ্ছে-আল কুরআন এবং আসসুন্নাহ।

কুসংস্কার কাকে বলে? কুসংস্কার বলে নিছক ধারণা ও কল্পনা ভিত্তিক প্রমাণহীন বিশ্বাস এবং সেই বিশ্বাস-প্রসূত ভিত্তিহীন প্রথা ও কর্ম। যে হৃদয় ও মস্তিস্ক কুরআন-সুন্নাহর আলো থেকে বঞ্চিত তা-ই নানাবিধ বিভ্রান্তি ও কুসংস্কারের প্রজননক্ষেত্রে পরিণত হয়। একারণে দেখা যায়, পার্থিব শিক্ষা দীক্ষায় অগ্রসর হওয়ার পরও আজব আজব বিভ্রান্তি ও কুসংস্কারে মানুষ লিপ্ত থাকে। এমনকি ঐসবকেই গৌরবের বিষয় মনে করে।

আরব জাহেলিয়াতের মতো এখনও অনেক নারী-পুরুষ কুলক্ষণে বিশ্বাস করে। জপতপ, তন্ত্রমন্ত্রে আস্থা রাখে। জটাধারী ফকিরের   পিছনে পিছনে ঘোরে। মূর্খ বে-শরা লোকদের অশ্লীল কথাবার্তাকে শিল্প-সংস্কৃতি গণ্য করে, এদের ‘জীবন’ ও ‘আদর্শ’ উদঘাটনের পিছনে জাতীয় অর্থ পানির মতো ব্যবহৃত হতে থাকে। সর্বোপরি জগতের সর্ব প্রাচীন ও সর্ব নিকৃষ্ট কুসংস্কার-পৌত্তলিকতা, ও মূর্তিপুজা তো এই বিজ্ঞানের যুগেও বিপুল সংখ্যক মানবের কাছে পরম গ্রহণীয়। ন্যাক্কারজনক বিষয় এই যে, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এই দেশেও একশ্রেণীর ‘মুসলিম’ নামধারী ‘শিক্ষাবীদ’, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী-সাহিত্যিক প্রতিমা পূজা এবং প্রতিমা কেন্দ্রিক সংস্কৃতিতেই শান্তি ও প্রশান্তি খুঁজে বেড়ায়। মুসলিম সমাজে পৌত্তলিকতাপ্রবণ চিন্তা ও মানসিকতা ছড়িয়ে দেওয়াকেই তারা অতি বড় মঙ্গলকার্য জ্ঞান করে।

এই সকল অনাচার ও কুসংস্কারের সুরক্ষায় তারা ব্যবহার করে উদারতা, আসাম্প্রদায়িকতা, পরমতসহিষ্ণুতার মতো শব্দাবলি। অথচ দেশে দেশে চরম সাম্প্রদায়িক পৌত্তলিক জনগোষ্ঠীর মুসলিম নিধনের সময় এই সকল শব্দ উচ্চারিত হয়।

মুসলিম কখনো আদর্শত্যাগী অর্থে ‘উদার’ হতে পারে না। ধর্মত্যাগী অর্থে ‘অসাম্প্রদায়িক’ হতে পারে না এবং ইসলাম, কুরআন, ইসলামের নবী এবং মুসলিম ভাইবোনের জান-মাল ইজ্জত-আব্রুর বিষয়ে নির্জীব ও নিস্পৃহ অর্থে ‘পরমতসহিষ্ণু’ হতে পারে না। মুসলিম যে উদারতা, অসাম্প্রদায়িকতা ও পরমতসহিষ্ণুতায় বিশ্বাসী তা সত্যিকার অর্থেই উদারতা, অসাম্প্রদায়িকতা এবং পরমতসহিষ্ণুতা। এর নানান উজ্জ্বল দৃষ্টান্তে মুসলিম জাতির ইতিহাস-গগণ আলোকিত।

কুরআন-সুন্নাহর আলোক বঞ্চিত মানব-সমাজে আশ্লীলতা অভিহিত হয় ‘বিনোদন’ নামে। অনাচার অভিহিত হয় ‘তারুণ্যের ধর্ম’ নামে। আর নারীর রূপ-যৌবন বাজারজাত হয় ‘নারীমুক্তির’ নামে। সর্বোপরি চিন্তা-চেতনায় এই বিকৃতিকেই মনে করা হয় শিল্প ও প্রগতি। এই বিকৃতির পৃষ্ঠপোষকতার জন্য যে শ্রেণীটি আছে তারা ‘প্রগতিশীল’ নামে পরিচিত।

আলোকিত ধর্ম-ইসলামের প্রধান শিক্ষা ঈমান। ঈমানের বিপরীত হচ্ছে কুফর। ঈমান হচ্ছে আলো আর কুফর হচ্ছে অন্ধকার। সুতরাং কুফরের অন্ধকার থেকে মুক্তি পেতে হলে ঈমানের দিকে আসতে হবে।

ঈমানের অন্যতম প্রধান বিষয় ‘তাওহীদ’। তাওহীদের বিপরীত বিষয়টি শিরক। তাওহীদ হচ্ছে আলো আর শিরক হচ্ছে অন্ধকার। সুতরাং অন্ধকার থেকে মুক্তি পেতে হলে তাওহীদের আলোই গ্রহণ করতে হবে।

ইসলামের আরেক প্রধান শিক্ষা ‘সুন্নাহ’। সুন্নাহ হচ্ছে বিদআ’র বিপরীত। সুন্নাহ হচ্ছে আলো আর বিদআ হচ্ছে অন্ধকার। সুতরাং বিদআর অন্ধকার থেকে মুক্তি পেতে হলে সুন্নাহর দিকে আসতে হবে।

ইসলামের অন্যতম প্রধান শিক্ষা ‘আদাবে হাসান’ অর্থাৎ সুরুচি ও সুনীতি। এর বিপরীতে আছে ‘ফাওয়াহিশ’ অর্থাৎ অনাচার ও অশ্লীলতা। ‘আদাবে হাসান’ হচ্ছে আলো আর ‘ফাওয়াহিশ’ হচ্ছে অন্ধকার। সুতরাং ‘ফাওয়াহিশে’র অন্ধকার থেকে মুক্তি পেতে হলে ‘আদাবে হাসানে’র দিকেই আসতে হবে।

মানবজাতির সর্ববিধ অন্ধকার থেকে মুক্ত করার জন্যই কুরআনের আগমন। মহান আল্লাহ কত দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন-(তরজমা) এটি সেই কিতাব যা আমি তোমার প্রতি নাযিল করেছি যেন তুমি মানুষকে বের করে আন অনেক অন্ধকার থেকে এক আলোর দিকে।-সূরা ইবরাহীম (১৪) : ০১

আলোর স্রষ্টা মহান আল্লাহ যেন আমাদের সকল অন্ধকার থেকে মুক্তি দান করেন-এই প্রার্থনা। 

 

 

 

advertisement