মুহাররম-১৪৩৪   ||   ডিসেম্বর-২০১২

জী ব ন : হুশ আসুক আমাদের

আবু তাশরীফ

একজন মানুষের একটি মৃত্যুর ঘটনা। ঘটনাটি বেদনাদায়ক। বেদনাদায়ক দু’দিক থেকেই। বাহ্যিক পরিণতির দিক থেকেও, ঘটনাকালীন অবস্থার দিক থেকেও। ঘটনাটি ঘটেছে সিলেটের দক্ষিণ সুরমার শিববাড়ি এলাকায়। ৫ নভেম্বর সোমবার বিকালের ওই ঘটনায় ট্রেনে কাটা পড়ে মারা যান ত্রিশ বছর বয়সী এক যুবক। পরদিন একটি জাতীয় দৈনিকের ৪-এর পাতায় খবরটি ছাপা হয়। শিরোনাম ছিল-‘মুঠোফোনে গান শোনার সময় ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যু।’

ঘটনার বিবরণে জানা যায়, নিহত ব্যক্তি রেললাইনে বসে ইয়ারফোনে গান শুনছিলেন। পেছন দিক থেকে ঢাকা থেকে সিলেটগামী একটি ট্রেন আসছিল। কয়েকবার হর্নও বাজানো হয়েছিল। কানে ইয়ারফোন থাকায় শুনতে পাননি। এর মধ্যে ট্রেনে কাটা পড়ে মারা যান তিনি। জিআরপি থানার উপপরিদর্শক জানান, ঘটনাস্থল থেকে মরদেহ উদ্ধার করার সময় তার কানে ইয়ারফোন বাঁধা পাওয়া গেছে। তার ব্যবহৃত মুঠোফোন থেকে পরিচয় নিশ্চিত হয়ে পরিবারের সদস্যদের খবর দেওয়া হয়।

ঘটনাটি নিশ্চয়ই একটি দুর্ঘটনা। আকষ্মিক মৃত্যুর ঘটনা। এ দুর্ঘটনায় যিনি চলে গেছেন তিনি তো চলেই গেছেন। তার স্বজন-পরিজনরাও দুঃখে-শোকে কাতর হয়েছেন। কিন্তু বাহ্যিক বিবেচনায় এ দুর্ঘটনার জন্য দায়ী করা যাবে কাকে? ট্রেনের লাইনে বসে ইয়ারফোনে গান শোনা আর হর্ন বাজানো হলেও সে কারণেই শুনতে না পাওয়ার দায়টা কার ওপর বর্তাবে? আহা! মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে গভীর মগ্নতার সঙ্গে গান শুনতে থাকার এ অবস্থাটাই বা কে প্রত্যাশা করতে পারে! এ তো দুর্ঘটনার মধ্যে আরেক ‘দুর্ঘটনা’। এ জন্যই ঘটনাটি বেদনাদায়ক অনেক বেশি। একই সঙ্গে এতে রয়েছে শিক্ষাগ্রহণ ও সতর্কতার বহু উপাদান। আল্লাহ তাআলা শেষ সময়ে আমাদের প্রত্যেককে হেফাযত করুন-রহম করুন।

মোবাইল ফোনের অপব্যবহার আর সব রকম প্রযুক্তির ভুল ব্যবহারের বিষয়ে ঘটনাটি অনেক বড় সতর্কতার বার্তা দেয় আমাদের। তাৎক্ষণিক যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে যে মোবাইল ফোন পুরোপুরি কল্যাণকর একটি উপকরণ হিসেবে গণ্য হওয়ার কথা ছিল, ভেবে দেখা দরকার, উপকরণটির অপকার এখন কত মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছেছে। সাধারণ ও স্বল্প মূল্যের একেকটি মোবাইলফোনের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে হরেক রকম ‘বিনোদন সুবিধা’। ‘দেখা-শোনার’ জগত সেখানে অবারিত। ভালো-মন্দ, সিদ্ধ-নিষিদ্ধ কোনো বাছবিচার নেই। আর এতেই মজে থাকছে তরুন-তরুনী, যুবক-যুবতীরা। এই মজে থাকার প্রতিযোগিতায় কোনো স্তর ও শ্রেণীর বিভক্তি নেই। ভালোর তুলনায় মন্দের মাদকতাই টানছে বেশি মানুষকে। কঠিন ও দুরূহ পাপের বিষয়গুলোকেও সহজলভ্য ও স্বাভাবিক করে তোলা হয়েছে এতে। এরই বিষফল কখনো কখনো আঁতকে ওঠার মতো বেদনাদায়ক ঘটনারও জন্ম দিচ্ছে।

গত কুরবানীর ঈদের দিনের অভিজ্ঞতা। গ্রামের মেঠোপথে মোটরসাইকেলে যাচ্ছি। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে মাঝপথ ধরে ধীরলয়ে এঁকে বেঁকে বাইসাইকেল চালিয়ে যাচ্ছে এক বিশোর্ধ্ব গ্রাম্য যুবক। বার বার হর্ন দিলেও বাইসাইকেল আরোহীর মধ্যে কোনো ভাবান্তর ঘটছে না। কাছে গিয়ে দেখা গেল, ওই বেচারার কানে ইয়ারফোন লাগানো। পকেটে তার মোবাইল ফোন। বেচারার কী দোষ! সে তো হর্ন শুনতেই পায়নি। অপ্রশস্ত গ্রাম্য পথে রাজকীয় চালে গান শুনতে শুনতে চলছে। পেছনে দ্রুতগতির মোটর সাইকেল এসে দুর্ঘটনা ঘটিয়ে দিলেও কিছু করার নেই-তার ভাবখানা ছিল এমনই।

মোবাইল ফোনের আরেক সংযুক্তি ইন্টারনেট। দুনিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ ও ‘তথ্যের আলো’ আহরণের শ্লোগান এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। নানা আয়োজন করে এটাকে সহজ ও জনপ্রিয় করেও তোলা  হচ্ছে। কিন্তু অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত ও বখে যাওয়া তারুণ্য এ সহজ মাধ্যমে কী এমন ‘তথ্য’ সংগ্রহে সময় ও টাকা খরচ করছে-এ বিষয়টিও ভেবে দেখা দরকার। দেশজুড়েই এখন এই অবস্থা। শহর আর গ্রাম নেই। নতুন উপকরণ, নতুন বিনোদন, নতুন আয়োজন। অদ্ভূৎ মাদকতার মধ্যেই কাটছে সময়। চরিত্রে নেমে আসছে ‘আলোহীন’ সন্ধ্যা। আর ধুপ করেই জীবনের সূর্য ডুবে যাচ্ছে হঠাৎ। তখন কোনো আক্ষেপ আর হা-হুতাশ কোনো কাজেই আসছে না।

আল্লাহ! আমাদের হুশ দাও। 

 

 

advertisement