উ ম্মা হ : ভোটের হিসাবে রক্ত
বারাক ওবামা দ্বিতীয়বারের মতো প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন আমেরিকায়। আমেরিকার মতো দেশে নির্বাচনে আবারো জিতে আসতে তাকে অনেক রকম কৌশল-কসরত করতে হয়েছে। এরকমই একটি কসরতের খবর গত ২৭ নভেম্বরের পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। সেখবরের বিবরণে জানা গেছে, নির্বাচনের আগে ড্রোন হামলাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে চেয়েছিল ওবামা প্রশাসন। নির্বাচনে জেতার বিষয়টি নিশ্চিত করতে আর নির্বাচনী তহবিল সংগ্রহে সুবিধা পেতে বিভিন্ন দেশে (পড়ুন : মুসলিম দেশে) ড্রোন হামলা বাড়িয়ে দিয়েছিল তারা।
নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে প্রকাশিত খবরটি ঢাকার পত্রিকাগুলোতে ছাপা হয় সংবাদসংস্থা রয়টার্স-এর বরাতে। ড্রোন হামলাকে বৈধতা দেওয়া বা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার পরিকল্পনা হাতে নেওয়ার পেছনের কারণ উল্লেখ করেছেন একজন মার্কিন কর্মকর্তা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কর্মকর্তা নিউইয়র্ক টাইমস প্রতিবেদককে বলেন, এক পর্যায়ে নির্বাচনের চাবি আমাদের হাতছাড়া হওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়। এ অবস্থায় ওবামা তার প্রতিপক্ষের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাঠ খালি করে দিতে চাননি।’
আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ইয়েমেনসহ বেশ কটি মুসলিম দেশে গত কয়েক বছর ধরে ড্রোন হামলা চালানো হচ্ছে। এ হামলায় তারা তাদের ভাষায় টার্গেট করছে সন্ত্রাসীদের। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে প্রায় প্রতিটি হামলায় নারী-শিশুসহ নিরীহ মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে। এ হামলাকে নির্বাচনের আগে বৈধতা দেওয়া বা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার উদ্যোগের খবরটি এখানে তুলে ধরার একটি ভিন্ন প্রেক্ষাপট রয়েছে। এ খবরের মাধ্যমে প্রকাশ পেল, আমেরিকায় ভোট পেয়ে জিততে চাইলে এবং আমেরিকানদের কাছ থেকে তহবিল সংগ্রহ করতে চাইলে সন্ত্রাসী দমনের নামে মুসলিম দেশগুলোতে নির্বিচার ড্রোন হামলা চালাতে হয় এবং সেটাকে আরও বাড়িয়ে দিতে হয়। এমনকি অমানবিক ও নির্বিচার এই বোমা হামলাকে বৈধতা দেওয়ার উদ্যোগও নিতে হয়।
ঠিক একই রকম পরিস্থিতি আরও কিছু জায়গায় আরও কিছু ক্ষেত্রে চোখে পড়েছে। এই নভেম্বরে গাজায় ইসরাঈলী হামলার পেছনেও ইসরাঈলে অনুষ্ঠেয় সাধারণ নির্বাচনের হিসাব-নিকাশ গণমাধ্যমে এসেছে। বলা হয়েছে ইসরাঈলের ক্ষমতাসীন দলটি নির্বাচনে জিতে আসার জন্য তার ভোটারদের দৃষ্টি কাড়তে গাজায় হামলা চালিয়েছিল। এতে ফিলিস্তিনী বহু শিশু আগুনে পুড়ে অঙ্গার হয়ে শাহাদাত বরণ করেছে। এ ঘটনাতেও আরব মুসলমানদের হত্যা করে ইসরাঈলীদের নিজ দেশে ভোট পাওয়ার একটি বীভৎস অংক কাজ করেছে। পাশের দেশ মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিমদের কীভাবে হত্যা করা হচ্ছে সেটা সারা পৃথিবী হতবাক হয়ে দেখছে। গত পাঁচ মাসের মধ্যে দু’বার বাড়িঘর জ্বালিয়ে, কুপিয়ে, গুলি করে রোহিঙ্গা নিধনে নেমেছে মিয়ানমারের বৌদ্ধ রাখাইন, গেরুয়া পোশাকধারী বৌদ্ধ ভিক্ষু আর সরকারের নাসাকা বাহিনী। মিয়ানমারের সরকার তো এ নিধন বন্ধে বিশেষ কোনো ভূমিকা রাখেইনি, শান্তি পুরষ্কার বাগানো অং সান সু চি পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়ানোর কোনো গরজ দেখাননি। তাকে বার বার জিজ্ঞাসা করা হলে নেতিবাচক কিছু উক্তি ছাড়া ‘শান্তিকামী’ কোনো বক্তব্য দিতে চাননি। এখানেও কাজ করেছে ভোটের হিসাব। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো পর্যন্ত নির্বাচনী হিসাব কষে রেহিঙ্গাদের পাশে সু চির না দাঁড়ানোর তীব্র সমালোচনা করেছে। কিন্তু মিয়ানমারের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী নাগরিকদের ভোট পেতে রোহিঙ্গা মুসলিমদের প্রতি নির্মমতার পথ সু চিকে বেছেই নিতে হয়েছে। অর্থাৎ মিয়ানমারেও ভোট পেতে হলে মুসলমানদের বিপক্ষে ভূমিকা রাখতে হবে। এছাড়া দু’মাস আগে আমেরিকায় রাসূল ও ইসলাম অবমাননাকারী ছবি ‘ইনোসেন্স অব মুসলিম’ নিয়েও যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনী হিসাবের কথা গণমাধ্যমে এসেছে। বলা হয়েছে, এ ছবির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে ওবামা মার্কিন ইহুদী-খ্রিস্টান নাগরিকদের ভোট হারাবেন আর ব্যবস্থা না নিলে মুসলিম অভিবাসীদের ভোট হারাবেন। বিভিন্ন দেশে খোঁজ নিলে আরও কিছু ঘটনার সঙ্গে এই হিসাব-নিকাশের মিল পাওয়া যায়। তাহলে ব্যাপারটা কী দাঁড়ালো? মুসলিম হত্যা, হত্যায় সহযোগিতা ও সমর্থন এবং ইসলাম অবমাননার সবকটি ক্ষেত্রই কি এখন দেশে দেশে ভোটের হিসাবের বিষয়ে পরিণত হয়েছে? বারাক ওবামা, এহুদ বারাক কিংবা সু চি-এরা কে কোথায় জিতে আসলেন কিংবা হেরে গেলেন তাতে মুসলমানদের কী যায় আসে! কিন্তু দেশে দেশে মুসলমানদের জীবন ও প্রাণকে পরিকল্পনা করে ভোটের খেলার ঘুঁটি বানানোর এই পাশবিক তামাশা তো চলতে পারে না। মুসলিম শাসকদের জন্য এটা লজ্জার কারণ। স্বজাতির রক্ত নিয়ে দেশে দেশে চলা এই নোংরা খেলা বন্ধে যদি তারা কিছু করতেই না পারেন-তাহলে তারা কী করেন! সবাই কি হামিদ কারজায়ীর বেঈমানীর আলখাল্লা গায়ে চড়িয়ে চলতে চান?
এখানে একটি কথা মনে করা খুব প্রাসঙ্গিক। আমরা যারা তর্ক করি-আমেরিকায় বুশ খারাপ না ওবামা খারাপ, মিয়ানমারে সামরিক শাসক খারাপ না সুচি খারাপ-তারা সম্ভবত ভুল তর্ক করি। আসলে নিপীড়ক শাসন ও নিপীড়ক দেশের জনগণই নিপীড়ক। এসব ভোটের হিসাব ও মুসলিম হত্যার পরিকল্পিত পর্ব দেখলে এ ধরনের চিকন তর্কের কোনো সুযোগ থাকে না। মোটা মীমাংসায় চলে যেতেই হয়। দেখা যাচ্ছে, ভোট যাদের হাতে তারাই উৎপীড়ন চায়, তারাই গণহত্যা চায়, তারাই বিতাড়ণ চায়। এই চিত্র ভয়ংকর এবং একই সঙ্গে এই চিত্রটি সরল। দেশে দেশে মুসলমানদের বাঁচাতে হলে এই ভয়ংকর ও সরল চিত্রটি মাথায় নিয়েই বাঁচতে হবে। সুবোধ চিন্তার
নামে বিভ্রান্তিতে পড়লে নিজেরাই ক্ষতিগ্রস্ত হব।
প্রশ্ন উঠতে পারে যে, এসব দেশ কিংবা অপরাপর অমুসলিম প্রধান দেশগুলোতে কি শুভ বুদ্ধিসম্পন্ন কোনো মানুষ নেই? মনে তো হয়-আছে। কিন্তু দেখাই যাচ্ছে যে, তারা হিসাবের মধ্যে পড়েন না। কিংবা ভোটের অংকে তাদের কোনো যোগ-বিয়োগ করার ক্ষমতাই থাকে না।