মুহাররম-১৪৩৪   ||   ডিসেম্বর-২০১২

স্ব দে শ : জীবনের মূল্য ও জীবননাশের বিচার

ওয়ারিস রব্বানী

মর্মান্তিক দুটি ঘটনা। একই দিনে এবং প্রায় একই সময়ে ঘটেছে। একটি ঢাকায়, অন্যটি চট্টগ্রামে। সর্বশেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত এতে প্রায় দেড়শ মানুষের মৃত্যু ঘটেছে। আহত হয়েছেন কয়েকশ। এখনও নিখোঁজ আছেন  আরও বহু। ঘটনা দুটি ঘটেছে ২৪ নভেম্বর শনিবার সন্ধ্যার পর পর। চাঁদের হিসাবে আশুরার রাতে। প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেত্রী শোক প্রকাশ করেছেন। এরই মধ্যে মন্ত্রীসভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে ২৭ নভেম্বর মঙ্গলবার রাষ্ট্রীয় শোক পালনের।

বড় ঘটনাটি ঘটে ঢাকায়। ঢাকার অদূরে সাভারের আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুর এলাকায় তোবা গ্রুপের তাজরিন ফ্যাশন লিমিটেড নামের একটি গার্মেন্ট কারখানায় সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় আগুন লাগে। পুলিশের বক্তব্য অনুযায়ী এতে মৃত্যু ঘটে অন্তত ১১৪ জন শ্রমিকের। তবে আহত শ্রমিক, প্রত্যক্ষদর্শী আর সংবাদমাধ্যমের ধারণা অনুযায়ী মৃতের সংখ্যা আরও বেশি। আহত হয়েছেন দুইশ’রও অধিক। আগুন লাগে নিচতলায়। প্রথমে মালিক পক্ষের বক্তব্যে বলা হয়েছিল, আগুনের সূত্রপাত হয় নিচতলার সুতার গোডাউন থেকে। কিন্তু পরে প্রকাশ হয়েছে, জেনারেটর কক্ষ থেকেই আগুনের সূত্রপাত। নিচতলার জেনারেটর কক্ষে আগুন ধরে যাওয়া এবং কক্ষটি সিঁড়ির পাশে থাকায় শ্রমিকরা ওই সিঁড়িটি ব্যবহার করতে পারেননি।

আইন থাকার পরও জরুরি নির্গমণের অন্য কোনো পথ, সিঁড়ি কিংবা বিশেষ ব্যবস্থা ছিল না। ফলে ৮ তলা ভবনের কয়েক হাজার বিপন্ন ও ভীত সন্ত্রস্ত শ্রমিক উপরের দিকে চলে যায়। অনেকে উপর থেকে লাফিয়ে পড়ে। বহু শ্রমিক মাঝের তলাগুলোতে আটকে যায়। এভাবেই হতাহতের সংখ্যা অনেক বেড়ে যায়।

সংবাদ মাধ্যমের কাছে আহত কোনো কোনো শ্রমিক আভিযোগ করেছেন, আগুন লাগার পর পর প্রথম দিকেই একবার জরুরি এলার্ম বেজে উঠেছিল। এতে শ্রমিকরা  ছুটে বের হওয়ার উদ্যোগ নিলে দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা তাদের নিবৃত্ত করেন। তারা শ্রমিকদের জানান, আগুন লাগার মতো কিছু হয়নি। অগ্নি নির্বাপন প্রশিক্ষণের জন্য এই এলার্ম বাজানো হয়েছে। এতে শ্রমিকরা বিভ্রান্ত হন। হতাহতের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার বাহ্যিক একটি কারণ এটিও। ঘটনার পর ওই পুড়ে যাওয়া কারখানা ঘুরে এসে প্রত্যক্ষদর্শীরা গণমাধ্যমকে বলেছেন, কারখানায় তাৎক্ষণিক আগুন নেভানোর যন্ত্রগুলো অক্ষত রয়েছে। দায়িত্বশীলদের কেউ ওগুলো ব্যবহারই করেনি।

কেউ কেউ বলেছেন, তাজরিন গার্মেন্টে আগুন লাগা, এলার্ম বাজা, শ্রমিকদের বের হতে মানা করা এবং জরুরি পরিস্থিতিতে নির্গমণের কোনো ব্যবস্থা না রাখা এবং এতজন শ্রমিকের মৃত্যু হওয়ার পেছনে কোনো রহস্য, ষড়যন্ত্র বা ইচ্ছাকৃত পরিকল্পনা কাজ করেছে। ঘটনার তৃতীয় দিন সোমবার ২০ হাজার টাকার বিনিময়ে অন্য একটি গার্মেন্ট কারখানায় আগুন লাগানোর অভিযোগে দুই তরুন-তরুনীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। স্বেচ্ছায় আগুন লাগানোর অভিযোগে এই দু’জনের গ্রেফতারের বিষয়টিকেও কেউ কেউ ‘সন্দেহজনক’ বলে মনে করছেন। সর্বোপরি মালিক পক্ষের অবহেলা, গাফলতি ও দায়িত্বহীনতার বিষয়টিকে সবাই বড় করে দেখছেন। দোষী ও দায়ী মালিকদের শাস্তি দাবি করছেন তারা।

গার্মেন্ট কারখানায় আগেও আগুন লেগেছে। এতে প্রতিবারই কিছু শ্রমিকের মৃত্যু ঘটেছে। কিন্তু এবারের মতো এত সংখ্যক শ্রমিকের মৃত্যু আগে কখনো ঘটেনি। শ্রমিকদের যথাযথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা না করায় এ পর্যন্ত কোনো মালিকেরই শাস্তি হয়নি। দেশের গণমাধ্যমগুলো এ ঘটনাটির পর মালিকপক্ষের গাফলতি ও দায়িত্বহীনতা নিয়ে চরম ক্ষুদ্ধতা প্রকাশ করেছে। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী পোশাক শিল্প  মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র নেতারা শ্রমমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছেন এবং সংবাদসম্মেলন করে ‘ষড়যন্ত্র’ খতিয়ে দেখার আহবান জানিয়েছেন।

অপরদিকে চট্টগ্রামের বহদ্দারহাটে নির্মাণাধীন একটি ফ্লাইওভারের গার্ডার ভেঙ্গে পড়ায় বহু লোক হতাহত হয়েছেন। এ পর্যন্ত ১৭ জনের লাশ উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। এখানেও নিহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে জানা গেছে। এই ফ্লাইওভারে এর আগেও দুবার দুর্ঘটনা ঘটেছে। এরই মধ্যে এর কাজের মান নিয়ে মানুষের ক্ষোভ ব্যক্ত হয়েছে। ২৪ নভেম্বর রাতের ঘটনার পর ক্ষুদ্ধ জনতা স্থানীয় পুলিশ ফাঁড়ি ও ঠিকাদারের সাইট অফিসে আগুন ধরিয়ে দেয়। পুড়িয়ে দেয় চট্টগ্রামের ২ পুলিশকর্তার গাড়িসহ ১০ টি মোটরসাইকেল। চট্টগ্রামের স্থনীয় নেতা, মন্ত্রী ও সরকারের কর্তারা ঘটনাস্থলে গিয়ে তদন্ত কমিটি গঠনের কথা বলে এসেছেন। ফ্লাইওভার নির্মাণ তদারকি প্রতিষ্ঠান সিডিএর (চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ) চেয়ারম্যান, প্রকল্প কর্মকর্তা ও সরকার দলীয় ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ করে অনেকেই বলেছেন, এ ঘটনার জন্য তারাই দায়ী। তাদের গ্রেফতার করে কঠোর শাস্তি দিতে  হবে।

তবে দুটি মর্মান্তিক ঘটনার পর (এ লেখা তৈরির সময় পর্যন্ত) ৪৮ ঘন্টা পার হয়ে গেলেও দায়ী অথবা সম্ভাব্য দায়ী কোনো প্রভাবশালী ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়নি। ঘটা করে শোকবাণী দেওয়া আর শোকদিবস পালন করা হলেও শতাধিক শ্রমিক ও আমজনতার জীবননাশের ঘটনা দুটি নিয়ে কার্যকর কোনো পদক্ষেপই নেওয়া হচ্ছে না। কয়েকটি তদন্ত কমিটি অবশ্য গঠন করা হয়েছে। জীবনের মূল্য ও জীবননাশের বিচার নিয়ে এ যেন জাতীয় অবহেলার বড় একটি নজিরে পরিণত হতে যাচ্ছে। এ দুটি ঘটনার আরও বড় একটি মর্মান্তিক দিক এটি। 

 

 

advertisement