খৃষ্টধর্ম না পৌলবাদ-২
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
আরবদেশে কেন গিয়েছিলেন
দ্বিতীয় প্রশ্ন ছিল, তিনি দক্ষিণ দামেস্কে আরব এলাকায় কেন গিয়েছিলেন? ইতিপূর্বে পৌলের যে উক্তিসমূহ উদ্ধৃত করা হয়েছে তার ভেতরেই এ প্রশ্নের উত্তর নিহিত রয়েছে। তাঁর কথায় তো স্পষ্ট, ‘খৃষ্টধর্মের পিতৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত হয়ে তিনি এ ধর্মের ভিত রচনা করেছেন।’ বস্ত্তত হাওয়ারীগণ হযরত ঈসা (আ) থেকে শিা পেয়ে যে ধর্ম প্রচার করছিলেন পৌল আদৌ সে ধর্ম গ্রহণে প্রস্ত্তত ছিলেন না। তাঁর লক্ষ ছিল হযরত মসীহ (আ)-এর প্রকৃত দীনের পরিবর্তে একটি নতুন ধর্মের গোড়াপত্তন করা আর সেজন্য হযরত মসীহ (আ)-এর পবিত্র নামকে ব্যবহার করা। এজন্য দরকার ছিল হাওয়ারীদের প্রভাববলয়ের বাইরে এমন কোন নিভৃত পরিবেশে চলে যাওয়ার যেখানে বসে তিনি গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করতে পারবেন এবং খৃষ্টধর্মকে নতুন ছাঁচে ঢেলে সাজাতে সক্ষম হবেন। সেইসাথে নববিন্যস্ত সে ধর্মের প্রচার-প্রসার কল্পে নিজ কর্তব্যকর্মও স্থির করতে পারবেন। বিখ্যাত খৃষ্টান ঐতিহাসিক জেমস ম্যাককিনন তার পান্ডিত্যপূর্ণ রচনা ‘ফ"ম ক্রাইস্ট টু কনস্টান্টাইন’-এর এক স্থানে লেখেন, ‘... তিনি আরবদেশে চলে গেলেন। দৃশ্যত তার উদ্দেশ্য তাবলীগ অপেক্ষাও বেশি ছিল নিজ নতুন বিশ্বাসের অন্তর্নিহিত বিষয়াবলি সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা করা।’ (খৃষ্ঠধর্মের স্বরূপ, পৃ. ১০৪)
এনসাইকোপিডিয়া ব্রিটানিকায় ‘পৌল’-এর নিবন্ধকার আরও স্পষ্ট করে বলেন, ‘শীঘ্রই তাঁর এমন কোন নিরিবিলি ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে চলে যাওয়ার প্রয়োজনবোধ হল, যেখানে তিনি নতুন অবস্থান সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করতে পারবেন। সুতরাং তিনি দামেস্কের দক্ষিণাঞ্চলে চলে গেলেন। তার সামনে এখন সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল শরীয়তের নতুন ব্যাখ্যাদান করা। (খৃষ্টধর্মের স্বরূপ, পৃ. ১০৪)
পৌল বনাম হাওয়ারীগণ
আরব এলাকায় তিন বছর নিভৃত জীবন কাটানোর পর পৌল জেরুজালেম ফিরে আসেন এবং হাওয়ারীদের সাথে মেশার চেষ্টা করেন। হাওয়ারীগণ তাকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। তার কথিত অলৌকিক সাক্ষাতকারের বিষয়ে তাদের মনে যথেষ্ট খটকা ছিল। তিনি যে সাচ্চা ঈসায়ী হয়ে গেছেন এ ব্যাপারেও তারা সন্দিহান ছিলেন। সারা জীবন যে ব্যক্তি হযরত মসীহ ও তাঁর অনুসরণের জানী দুশমন ছিল হঠাৎ করেই সে মসীহের ভক্ত-অনুরক্ত হয়ে একদম তার খাঁটি সেবক ও ধর্মপ্রচারক হয়ে গেল এটা মেনে নেওয়া তাদের পক্ষে খুব সহজও ছিল না। তাদের মনে এই সংশয়ও জেগে থাকবে যে, এটা পুরানো শত্রুর নতুন কোন দূরভিসন্ধি নয় তো? সম্ভবত এ কারণেই তারা তার দাবিতে সন্দিহান হওয়ার সাথে সাথে অন্তরে গভীর শঙ্কাও বোধ করছিলেন।
পৌলের শিষ্য লূকের লেখায়ও বিষয়টা স্পষ্ট। তিনি লেখেন, ‘পৌল জেরুজালেম এসে উম্মতদের সাথে যোগ দিতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু তারা তাকে ভয় করতে লাগল। তারা বিশ্বাস করতে পারল না যে, পৌল সত্যিই একজন উম্মত হয়েছেন’ (প্রেরিত ৯ : ২৬)।
কিন্তু পৌল প্রখর বুদ্ধিমান ছিলেন। পরিস্থিতি কিভাবে অনুকূলে আনতে হয় তার কলাকৌশল তার ভালোই রপ্ত ছিল। এজন্য যেখানে যে বেশ ধরার প্রয়োজন হত ও যেখানে যে ছল কার্যকর মনে হত তা অবলম্বন করতে কুণ্ঠাবোধ করতেন না। তিনি নিজেই বলেন, ‘যদিও আমি কারও গোলাম নই তবুও আমি নিজেকে সকলের গোলাম করেছি, যেন অনেককে মসীহের জন্য জয় করতে পারি। ইহুদীদের জয় করবার জন্য আমি ইহুদীদের কাছে ইহুদীদের মত হয়েছি। যদিও আমি মুসার শরীয়তের অধীনে নই তবুও যারা শরীয়তের অধীনে আছে তাদের জয় করবার জন্য আমি তাদের মত হয়েছি। আমার শরীয়তের বাইরে যারা আছে তাদের জয় করবার জন্য আমি শরীয়তের বাইরে থাকা লোকের মত হয়েছি। ... ঈমানে যারা দুর্বল তাদের কাছে আমি সেই রকম লোকের মতই হয়েছি, যেন মসীহের জন্য তাদের সম্পূর্ণরূপে জয় করতে পারি (১ করিন্থীয় ৯ : ১৯-২২)।
বলাবাহুল্য কোন আদর্শবাদী সাচ্চা লোক কখনও এ রকম বহুরূপী তকমা ধারণ করতে পারে না। কিন্তু পৌল এভাবে যেখানে যেমন সেখানে তেমন নীতির অনুসারী হয়ে নিজ লক্ষপানে এগুতে থেকেছেন। হাওয়ারীদের কাছেও তিনি নিজেকে তাদেরই মত একজন হিসেবে প্রমাণ করার চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। পরিশেষে শিষ্য লূকের বর্ণনা অনুযায়ী সর্বপ্রথম হাওয়ারী বার্ণাবাস তাকে স্বীকার করে নেন এবং তিনিই উদ্যোগী হয়ে অন্যান্য হাওয়ারীদের কাছে তার অনুকূলে সাফাই দান করেন। এভাবে পর্যায়ক্রমে তিনি ঈসা (আ)-এর শিষ্য ও উম্মতদের সঙ্গে মিশে যেতে সক্ষম হন। কিছুকাল হাওয়ারীদের সঙ্গে মিলেমিশেই তিনি খৃষ্টধর্মের প্রচারকার্যে মশগুল থাকেন। কিন্তু তাদের সে মিলমিশ বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। কেননা তার লক্ষই যেহেতু ছিল খৃষ্টধর্মের লেবাসে নতুন এক ধর্মের প্রতিষ্ঠাদান করা, তাই ধীরে ধীরে তিনি সে পথেই এগুতে থাকেন। তিনি মানুষের সামনে একেকবার খৃষ্টধর্মের একেক তত্ত্ব হাজির করতে থাকেন। কখনও ত্রিত্ববাদের তত্ত্ব, কখনও মসীহের অবতারত্বের তত্ত্ব। কখনও তাদেরকে প্রায়শ্চিত্ত্বের দর্শন শেখান, কখনও ‘প্রভুর নৈশভোজ’-এর বটিকা পান করান। এভাবে তার একেকটি নতুন তত্ত্ব সামনে আসে, আর হাওয়ারীদের মনে খটকা সৃষ্টি হতে থাকে। পরিশেষে হাওয়ারীদের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, পৌলের উদ্দেশ্য মোটেই হযরত মসীহের প্রকৃত ধর্মের প্রচার ও প্রতিষ্ঠা নয়; বরং সেই মোড়কে তিনি অন্য কিছু প্রতিষ্ঠিত করতে চাচ্ছেন। ফলে তাঁরা তার থেকে সম্পূর্ণরূপে মুখ ফিরিয়ে নেন এবং তাঁর থেকে আলাদা হয়ে আসল খৃষ্টধর্মের প্রচারকার্যে আত্মনিয়োগ করেন। কিন্তু' ততদিনে পৌলেরও বিপুল ভক্ত-অনুরক্ত জুটে গেছে এবং ঈসায়ী জামাতের মধ্যে তার প্রভাব-প্রতিপত্তি আর সকলকে ছাপিয়ে গেছে। ফলে তিনিও তাদেরকে উপেক্ষা করে আপন চিন্তা-চেতনার প্রচারে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। এভাবে খৃষ্টধর্ম স্বতন্ত্র দুই দৃষ্টিভঙ্গিতে বিভক্ত হয়ে ভিন্ন দুই স্রোতে প্রবাহিত হতে থাকে। একটি আসল খৃষ্টধর্ম, যার নেতৃত্বে থাকেন হাওয়ারীগণ আর একটি রূপান্তরিত খৃষ্টধর্ম, যার একচ্ছত্র নেতৃত্ব দান করেন সেন্ট পল। কালক্রমে রূপান্তরিত খৃষ্টধর্মের প্রচারণার ডামাডোলে আসল খৃষ্টধর্ম লোপাট হয়ে যায়। এখন বিশ্বব্যাপী যে খৃষ্টধর্ম চলছে তা হযরত মসীহ (আ)-এর রেখে যাওয়া হাওয়ারীদের প্রচারিত খৃষ্টধর্ম নয়; বরং পৌলের চিন্তা-চেতনায় গড়ে ওঠা এক স্বতন্ত্র ধর্ম, যার জন্য পৌলবাদ নামই বেশি সংগত। (কালক্রমে কিভাবে আসল খৃষ্টধর্মের স্থলে পৌলবাদ স্বীকৃতি লাভ করল সুদীর্ঘ সেই ইতিহাস জানার জন্য দেখুন খৃষ্টধর্মের স্বরূপ, পৃ. ১০৭-১৩৯; খৃষ্টবাদ বিকৃতি : তথ্য ও প্রমাণ, পৃ. ১২৩-১৫৭)
খৃষ্টধর্ম না পৌলবাদ
আমরা সামনের আলোচনায় খৃষ্টধর্মের ‘আকীদা-বিশ্বাস ও ‘ইবাদত-বন্দেগীর বর্তমান রূপ, হযরত ঈসা মসীহ (আ)-এর শিক্ষা ও পৌলের চিন্তা-ভাবনা পাশাপাশি উল্লেখ করব, যা দ্বারা পাঠকমাত্রই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারবেন যে, বর্তমান খৃষ্টধর্ম আসলেই হযরত ঈসা (আ)-এর রেখে যাওয়া দীন, না পৌলের উদ্ভাবিত এক স্বতন্ত্র ধর্ম, যার উপর হযরত ঈসা (আ)-এর তকমা আঁটা হয়েছে মাত্র।
খৃষ্টধর্মের ‘আকীদা-বিশ্বাসসমূহের মধ্যে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ত্রিত্ববাদ, খৃষ্টের অবতারত্ব ও পাপমোচন। এর যে কোন একটি অবিশ্বাস করলে ভ্যাটিকান কর্তৃপক্ষের কাছে সে আর যাই হোক না কেন একজন ক্যাথলিক খৃষ্টান হিসেবে কিছুতেই স্বীকার্য নয়; বরং সে একজন অখৃষ্টান বেদীনরূপেই প্রত্যাখ্যাত হবে। অথচ হযরত ঈসা (আ)-এর শিক্ষা ও পৌলের দর্শন পাশাপাশি রেখে বিচার করলে দিবালোকের মত স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, এর কোনওটিই হযরত ঈসা (আ)-এর শিক্ষা নয়; সম্পূর্ণই পৌলের মস্তিষ্কপ্রসূত মতবাদ, যা খৃষ্টসম্প্রদায় অন্ধভাবে গ্রহণ করে নিয়েছে।
ত্রিত্ববাদ
প্রচলিত ইনজীল সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞাতব্য
হযরত ঈসা (আ)-এর শিক্ষা সম্পর্কে সর্বাপেক্ষা নির্ভরযোগ্য উৎস হতে পারত তাঁর প্রতি নাযিলকৃত আসমানী কিতাব-‘ইনজীল’। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে, সেই ইনজীলের কোন অস্তিত্ব জগতে নেই। খোদ খৃষ্টানজাতিই জানে না তা কখন কোথায় হারিয়ে গেছে। বর্তমানে ইনজীল বলতে বোঝায় মূলত মথি, মার্ক, লূক ও ইওহোন্না এই চারজনের সংকলিত ঈসা (আ)-এর চারখানি জীবনীগ্রন্থকে। এর সাথে লূকের লেখা ‘প্রেরিত পুস্তক’, পৌলের লেখা চৌদ্দটি চিঠি এবং পিতর ইওহোন্না প্রমুখের লেখা আরও আটটি পত্র ও পুস্তিকাসহ মোট সাতাশটির সমষ্টিকেও ইনজীল বলা হয়ে থাকে। সাধারণত খৃষ্টানগণ ২৭টির সমষ্টিকেই ‘ইনজীল শরীফ’ নামে প্রকাশ ও প্রচার করে থাকেন।
প্রচলিত ‘ইনজীল শরীফে’ সন্নিবেশিত শেষের তেইশটি তো নয়ই, প্রথম চারখানি পুস্তক অর্থাৎ মথি, মার্ক, লূক ও ইওহোন্নার সংকলনও যে আসমানী কিতাব নয়, তার অতি মোটা দাগের আলামত হল, এগুলোতে হযরত ঈসা (আ)-এর গ্রেপ্তার, তাঁকে শূলে চড়ানো ও দাফন করার কাহিনী সবিস্তারে বর্ণিত রয়েছে। তাঁর জীবদ্দশায় অবতীর্ণ কিতাবে তার ‘কথিত’ মৃত্যুকালীন ও মৃত্যুপরবর্তী ঘটনাবলির বিবরণ কিভাবে থাকতে পারে? আবার এ চারখানি গ্রন্থের রচয়িতা ও এর বিশ্বস্ততা সম্পর্কে বিপুল বিতর্ক রয়েছে। অমরেন্দ্রকুমার সেন তার ‘চিরদিনের বাইবেল’ (পৃ. ২২৯)-এ বলেন, নিউ টেস্টামেন্টের চারটি গসপেল বা সুসমাচার পন্ডিত ও গবেষকেরা বিভিন্ন সময় বারবার পড়েছেন। প্রতিটি শব্দ, তার উৎপত্তি, ধাতুগত অর্থ, ব্যাখ্যা সবকিছু খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, গসপেলগুলির মূল লেখকরা যীশুকে ব্যক্তিগতভাবে চিনতেন না বা তার সংস্পর্শে আসেননি। এ সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানতে হলে দেখুন ‘খৃষ্টধর্মের স্বরূপ’ এবং ড. মরিস বুকাইলি রচিত ‘বাইবেল কুরআন ও বিজ্ঞান’।
যদিও মূল আসমানী ইনজীল এখন বিলুপ্ত, তবুও প্রচলিত ‘ইনজীল শরীফ’ নামক তাঁর জীবনীগ্রন্থসমূহের মাধ্যমে তাঁর প্রকৃত শিক্ষা সম্পর্কে কিছুটা আলো পাওয়া যায়। সেই আলোতে একজন সন্ধানীমনস্ক পাঠকের পক্ষে হদীস লাগানো কিছু কঠিন নয় যে, হযরত মসীহের প্রকৃত শিক্ষা কী ছিল আর এখন তার নামে চালানো হচ্ছে কী?
ত্রিত্ববাদ না একত্ববাদ?
আল্লাহ সম্পর্কে হযরত মসীহ (আ)-এর শিক্ষা
আল্লাহ তাআলা সম্পর্কে হযরত মসীহ (আ) যে শিক্ষা দিতেন তা তাওহীদ ও একত্ববাদ ছাড়া কিছুই নয়। অর্থাৎ আল্লাহ এক, চিরঞ্জীব। তাঁর কোন শরীক নেই। কোন কিছুই তার সঙ্গে তুলনীয় নয় এবং তিনি ছাড়া কেউ ইবাদতের উপযুক্ত নয়। প্রচলিত ইনজীলের বিভিন্ন স্থানে এ শিক্ষা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। যেমন একবার এক ইহুদী তাকে জিজ্ঞেস করেছিল, তৌরাত শরীফের মধ্যে সবচেয়ে দরকারী হুকুম কোনটা? জবাবে ঈসা বললেন, সবচেয়ে দরকারী হুকুম হল, বনী ইসরাঈলেরা শোন, আমাদের মাবূদ আল্লাহ এক। তোমরা প্রত্যেকে তোমাদের সমস্ত দিল, সমস্ত প্রাণ, সমস্ত মন এবং সমস্ত শক্তি দিয়ে তোমাদের মাবূদ আল্লাহকে মহববত করবে ...। তখন সেই আলেম বলল, হুজুর খুব ভালো কথা। আপনি সত্য কথাই বলেছেন যে, আল্লাহ এক এবং তিনি ছাড়া কোন মাবূদ নেই ...। ঈসা যখন দেখলেন, সেই আলেমটি খুব বুদ্ধিমানের মত জবাব দিয়েছে তখন তিনি বললেন, আল্লাহর রাজ্য থেকে আপনি বেশি দূরে নন (মার্ক ১৯ : ২৮-৩৪; মথি ২২ : ৩৬)।
ইওহোন্নার ইনজীলে আছে, হযরত মসীহ (আ) আল্লাহ তাআলার কাছে মুনাজাত করতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘তোমাকে অর্থাৎ এক ও সত্য আল্লাহকে আর তুমি যাকে পাঠিয়েছ সেই ঈসা মসীহকে জানতে পারাই সত্য জীবন (ইওহোন্না ১৭ : ৩)।
একজন নেতা ঈসাকে বলেছিল, হুজুর! আপনি একজন ভালো লোক। ঈসা (আ) তাকে বললেন, আমাকে ভালো বলছেন কেন? একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কেউই ভালো নয় (লূক ১৮ : ১৮, ১৯)।
এক যুবক এসে ঈসাকে বলল, হুজুর! অনন্ত জীবন পাবার জন্য আমাকে ভালো কি করতে হবে? ঈসা তাকে বললেন, ভালোর বিষয়ে আমাকে কেন জিজ্ঞেস করছ? ভালো মাত্র একজনই আছেন। যদি তুমি অনন্ত জীবন পেতে চাও তবে তাঁর সব হুকুম পালন কর (মথি ১৯ : ১৬, ১৭)।
এছাড়া আল্লাহর ইচ্ছামত চলতে বলা, আল্লাহর ইবাদতে রত থাকার আদেশ দেওয়া, আল্লাহর শুকরিয়া জানানো, আল্লাহকে সর্বশক্তিমান বলা, আল্লাহকে সর্বজ্ঞ বলে উল্লেখ করা, আল্লাহর রাজ্যে প্রবেশে উৎসাহিত করা, আল্লাহর কালাম প্রচার করা, আল্লাহর নিকট থেকে আসা ও আল্লাহর কাছে ফিরে যাওয়ার কথা বলা, মোটকথা প্রতিটি বিষয়ে আল্লাহকেন্দ্রিকতার যে দৃশ্য গোটা ইনজীলজুড়ে দেখা যায়, তা কি তাওহীদ ও আল্লাহর একত্বই নির্দেশ করে না? সুতরাং এতে কোন সন্দেহ নেই অন্যসব নবী-রাসূলের মত হযরত ঈসা (আ)-ও আল্লাহর তাওহীদ ও একত্বই শিক্ষা দিয়েছিলেন। কুরআন মজীদও তাঁর শিক্ষা সম্পর্কে সেই সাক্ষ্যই প্রদান করে, ইরশাদ-
ما قلت لهم الا ما امرتنى به ان اعبدوا الله ربى وربكم
‘তুমি আমাকে যে আদেশ করেছ তা ছাড়া আমি তাদেরকে আর কিছুই বলিনি। তা হচ্ছে-তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর, যিনি আমার প্রতিপালক এবং তোমাদেরও প্রতিপালক। (মায়িদা : ১১৭)।
সেন্ট পৌলের দৃষ্টিভঙ্গি
সেন্ট পৌল আল্লাহ তাআলার পাশাপাশি আরও দুটি সত্তার কথা বলেন। মোট এই তিন সত্তার সম্মিলিত রূপকেই তিনি ঈশ্বর বা আল্লাহ বলে মত প্রকাশ করেছেন, যা আজ সারা বিশ্বের খৃষ্টসম্প্রদায়ের বিশ্বাস। পৌলের মতে সেই তিন সত্তার এক সত্তা হচ্ছেন পিতা, আরেক সত্তা পুত্র আর তৃতীয় সত্তা ‘পাক-রূহ’। পিতা হচ্ছেন আল্লাহর মূল সত্তা, যার থেকে পুত্রের প্রকাশ হয়েছে। পুত্র হলেন মসীহ, যিনি মূলে ছিলেন আল্লাহর কালাম গুণ। সেই গুণই ঈসা মসীহের মানব-অসি-ত্বে আত্মপ্রকাশ করেছে আর তাই তিনি আল্লাহর পুত্র। ‘পাক-রূহ’ হল পিতা ও পুত্রের মধ্যে নিহিত জীবন ও ভালোবাসার গুণ। এ গুণের মাধ্যমে পিতা পুত্রকে এবং পুত্র পিতাকে ভালোবাসে। এ গুণটিও কালাম গুণের মত বস্ত্তগত অস্তিত্বের অধিকারী এবং পিতা-পুত্রের মত নিত্য ও চিরন্তন। তো পিতা-পুত্র ও পাক-রূহ-এ তিন মিলেই এক খোদা। একেই বলে ত্রিত্ববাদ।
আমরা উপরে দেখেছি, হযরত ঈসা (আ) এক আল্লাহর কথাই প্রচার করেছেন। তার বিশিষ্ট শিষ্য বা হাওয়ারীগণও জীবনভর এক আল্লাহর দিকেই মানুষকে ডেকেছেন। আল্লাহর তিন সত্তা বা ত্রিত্ববাদের কথা স্পষ্টভাবে তো নয়ই, ইশারা-ইঙ্গিতেও তারা কেউ বলে যাননি। এ শিক্ষা কেবলই পৌলের। সর্বপ্রথম পৌলই বলেছেন, এই পুত্রই হলেন অদৃশ্য আল্লাহর হুবহু প্রকাশ। সমস্ত সৃষ্টির আগে তিনিই ছিলেন। সমস্ত সৃষ্টির উপরে তিনিই প্রধান। কারণ আসমান ও যমীনে যা দেখা যায় আর যা দেখা যায় না সবকিছু তাঁর দ্বারা সৃষ্ট হয়েছে। আসমানে যাদের হাতে রাজত্ব, কর্তৃত্ব, শাসন ও ক্ষমতা রয়েছে তাদের সবাইকে তাঁকে দিয়ে তাঁরই জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে (কলসীয় ১ : ১৬)।
একটু পরে লেখেন, ঈশ্বরত্বের সমস্ত পূর্ণতা মসীহের মধ্যে শরীর হয়ে বাস করছে (কলসীয় ২ : ৯)।
পৌলের এ দর্শনই আরও ব্যাখ্যাত হয়ে বর্ণিত হয়েছে ইওহোন্নার ইনজীলে । তাতে আছে, প্রথমেই কালাম ছিলেন, কালাম আল্লাহর সংগে ছিলেন এবং কালাম নিজেই আল্লাহ ছিলেন (ইওহোন্না ১ : ১)।
একটু পরে আছে, সেই কালামই মানুষ হয়ে জন্মগ্রহণ করলেন এবং শ্রেষ্ঠত্ব ও সততায় পূর্ণ হয়ে আমাদের মধ্যে বাস করলেন এবং পিতার একমাত্র পুত্র হিসেবে তার যে মহিমা সেই মহিমা আমরা দেখেছি (ইওহোন্না ১ : ১৪)।
আর ‘পাক-রূহ’-এর ঈশ্বরত্বও পৌলেরই প্রচার। তিনিই সর্বপ্রথম বলেছেন, জীবনদাতা পাক-রূহের শক্তিই মসীহ ঈসার মধ্য দিয়া আমাকে পাপ ও মৃত্যুর শক্তি মুক্ত করিয়াছে। (রোমীয় ৮:২)
(পাক-রূহ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা সামনে আসছে)।
এভাবে সেন্ট পৌলই ‘পাক-রূহ’কে ঐক ঐশ্বরিক সত্তারূপে উপস্থাপন করেছেন। না হয় হযরত মসীহ (আ) ও শিষ্যদের থেকে এমন কোন বর্ণনা পাওয়া যায় না, যা পাক-রূহের ঈশ্বরত্ব প্রমাণ করে।
সুতরাং প্রমাণ হল ‘পিতা-পুত্র ও পাক-রূহ’ এই তিন ঐশ্বরিক সত্তার সমষ্টিই খোদা’-এ তত্ত্ব সম্পূর্ণরূপে পৌলের আবিষ্কার। তিনিই খৃষ্ট জাতিকে এই ত্রিত্ববাদের গোলক ধাঁধায় নিক্ষেপ করেছেন।
ত্রিত্ববাদের গোলক ধাঁধা
খৃষ্টীয় বিশ্বাস অনুযায়ী পিতা-পুত্র ও পাক-রূহ-এ তিনের প্রত্যেকেই স্বতন্ত্র সত্তার অধিকারী। প্রত্যেকেরই আলাদা
অস্তিত্ব আছে, প্রত্যেকেই আলাদাভাবে কাজ করেন, প্রত্যেকেই অনাদিকাল থেকে আছেন এবং প্রত্যেকেই খোদা।
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, তা হলে খোদা বহু হয়ে গেল না কি? এটা তো স্পষ্ট শিরক। শিরকের এই অভিযোগ থেকে বাঁচার জন্য তারা বলে থাকেন, এ তিনের প্রত্যেকেই খোদা বটে, কিন্তু তাই বলে খোদা তিনজন নন-তিন মিলে একই খোদা-একই আল্লাহ।
কিন্তু এর উপরও আরও জটিল প্রশ্ন ওঠে, তিনজনই যদি স্বতন্ত্র অস্তিত্বমান খোদা হয়ে থাকেন, তবে খোদা তো তিনজনই হলেন, স্বতন্ত্র তিন অস্তিত্ব এক খোদা হয় কি করে। আবার খোদা যদি একজনই হন তবে তার আলাদা তিন
অস্তিত্ব হওয়া কি করে সম্ভব? একই তিন আবার তিনই এক-একি আশ্চর্য গোলক ধাঁধা?
এর উত্তর দিতে গিয়ে খৃস্টান পন্ডিত ও ধর্মগুরুগণ গলদ্ঘর্ম হয়েছেন। তারা
বিভিন্ন রকম কথা বলেছেন। কিন্তু আজও পর্যন্ত তারা এর কোনও যৌক্তিক ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে পারেননি। যিনিই এর কোন ব্যাখ্যা দিতে চেষ্টা করেছেন, তিনিই নতুন করে আরও জটিল প্রশ্নের জন্ম দিয়েছেন। সুতরাং ত্রিত্ববাদের এ বিশ্বাসটি এক দুর্জ্ঞেয় রহস্যই রয়ে গেছে। এভাবে খৃস্টধর্ম তার সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ও সর্বপ্রধান বিশ্বাস নিয়ে এক দুর্ভেদ্য জটাজালে বন্দি হয়ে আছে।
ঈসা মসীহ (‘আ) কি আল্লাহর অবতার?
যদিও ত্রিত্ববাদের আলোচনায় পুত্রসত্তারূপে মসীহ (আ)-এর বিষয়ে পৌলীয় তত্ত্বের সারকথা এসে গেছে, তারপরও খৃস্টধর্মের যাবতীয় চিন্তা ও কর্ম যেহেতু হযরত মসীহের ব্যক্তিত্বকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়, এবং সেক্ষেত্রে তার ইবনুল্লাহ (আল্লাহর পুত্র) হওয়ার বিষয়টিই সর্বপ্রধান বিশ্বাস ও এ ধর্মের প্রাণবনবস্ত্তরূপে বিবেচিত হয় তাই ত্রিত্ববাদের পরে মসীহের অবতারত্বও একটি স্বতন্ত্র বিশ্বাসের মর্যাদা রাখে। খৃস্টধর্ম তাকে আল্লাহর অবতার মনে করে, অর্থাৎ তাঁর সত্তা অদৃশ্য আল্লাহর বা তাঁর কালাম গুণেরই শরীরীরূপ। তো তাদের এ বিশ্বাসের ভিত্তি কী? হযরত মসীহ (আ) নিজেই কি এরকম বলেছেন, না এটা অন্য কারও প্রচার? আর নিজের সম্পর্কে হযরত মসীহ (আ)-এর শিক্ষাই বা কী ছিল?
হযরত মাসীহ (আ) নিজের দৃষ্টিতে
হযরত ঈসা (আ) ছিলেন আল্লাহ তা’আলার কুদরতের এক জলজ্যান্ত নিদর্শন। আল্লাহ তা’আলাই যে সকল সৃষ্টির স্রষ্টা এবং সৃষ্টিকার্যে তিনি কোনো কিছুর মুখাপেক্ষী নন বিভিন্ন নিদর্শন দ্বারা তিনি তা স্পষ্ট করে দিয়েছেন। দুনিয়ার সাধারণ নিয়ম হচ্ছে পিতামাতার সম্মিলনে সন্তান জন্ম নেয়। এ নিয়ম আল্লাহ তা’আলাই জারি করেছেন। কিন্তু এর অর্থ এমন নয় যে, দুনিয়ায় সন্তানের আগমন পিতামাতার মধ্যস্ততা ছাড়া সম্ভব নয়। আল্লাহ তা’আলা চাইলে নর-নারী ছাড়াও সন্তান সৃষ্টি করতে পরেন, যেমন হযরত আদমকে সৃষ্টি করেছিলেন। কেবল নর থেকেও সৃষ্টি করতে পারেন, যেমন হযরত হাওয়াকে সৃষ্টি করেছিলেন। আবার কেবল নারী থেকেও পারেন। কেবল নারী থেকেও যে সন্তান জন্মাতে পরে তার দৃষ্টান্ত হিসেবেই হযরত ‘ঈসা মসীহ (আ)-এর জন্ম। তিনি বিনা পিতায় সতী-সাধ্বী কুমারী মারয়াম (আ)-এর গর্ভে জন্ম নিয়েছিলেন। কিন্তু যারা আল্লাহ তা’আলার কুদরত ও মতার মহিমা উপলব্ধি করে না, তারা কুদরতের নিদর্শন দ্বারাও বিভ্রান্ত হয়। হযরত মসীহ (আ)-এর ক্ষেত্রে তাই হয়েছে। কেউ তো তার মহিয়সী মায়ের নামে কলঙ্ক রটিয়েছে (নাউযুবিল্লাহ) এবং কেউ তাকে খোদার পুত্র বানিয়ে ছেড়েছে। ষ
(চলবে ইনশাআল্লাহ)