যিলহজ্ব ১৪৩৩   ||   নভেম্বর ২০১২

স্ব দে শ : কাদম্বরি মরিয়া প্রমাণ করিল

আবু তাশরীফ

গল্পের নাম : জীবিত ও মৃত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ছোটগল্প। কল্পিত এ গল্পে কাদম্বরি নামে একটি নারী চরিত্র রয়েছে। কাদম্বরিকে মৃত ভেবে শ্মশানে পোড়াতে নিয়ে গিয়ে ফেলে আসা হয়। জীবিত কাদম্বরি ফিরে এলে পরিবারের লোকেরা তাকে মেনে নিতে পারে না। ভুত মনে করে তাড়িয়ে দিতে চায়। আতঙ্কিত হয়। মনের দুঃখে কাদম্বরি পরে আত্মহত্যা করে। তখন সবাই বুঝতে পারে যে, আগে সে মরেনি, এবারই সে মরলো। গল্পের উপসংহারে তাই এরকম একটি বাক্য লেখা হয়েছে : কাদম্বরি মরিয়া প্রমাণ করিল, সে মরে নাই।

বাক্যটি এ দেশের গণমাধ্যম, রাজনীতি ও মেঠো বক্তব্যে নানা সময় উদ্ধৃত হয়। রামুর ঘটনার পর বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া, বিশ্লেষণ ও বক্তব্যে আমাদেরও কাদম্বরি মরা-না মরার গল্পটি খুব মনে পড়ছে। কেন মনে পড়ছে সে কথাটি বলেই ফেলি।

এক বৌদ্ধ তরুণ পবিত্র কুরআন অবমাননা করেছে। এ রকম একটি প্রমাণ পাওয়ার পর কক্সবাজার -রামুর  মুসলমানদের একটি অংশ ক্ষুদ্ধ ও উত্তেজিত হয়ে উঠে।

এরপর ২৯ সেপ্টেম্বর মধ্যরাতে স্থানীয় বৌদ্ধবিহারে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে। অবশ্য ঘটনার পেছনে কারা ছিল, সংশ্লিষ্টতা কাদের ছিল-এ নিয়ে শুরু থেকেই শুরু হয় বিতর্ক। পরিষ্কার কোনো তথ্য এখনও পর্যন্ত উঠে আসেনি। অবশ্য কোনো বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ওই ঘটনায় নিহত বা আহত না হলেও বেশ কয়েকটি বসতবাড়ি পুড়ে যায়। এর পর থেকে শুরু হয় গণগ্রেফতার, অপরাধী বানানোর দলীয় অভিযোগ আর প্রতিক্রিয়া ও নিন্দাবাদের মহাযজ্ঞ। মানববন্ধন, গোলটেবিল আর শোক মিছিলে ঢাকা শহরও ব্যস্ত হয়ে উঠে। এ পর্যায়ে দেশের সেকুলার সুশীল ব্যক্তি, মহল ও গণমাধ্যম একধাপ এগিয়ে গিয়ে আবেগের চূড়ান্ত ভাষাও প্রয়োগ করতে শুরু করে। এতে নিজেদের দীর্ঘকালের বক্তব্য ও অবস্থানের বিরুদ্ধে অনেক সত্যকথাও তাদের মুখ ও কলম থেকে বেরিয়ে আসতে থাকে। রাজনীতিক, বুদ্ধিজীবি ও সাংবাদিক-কলামিস্টদের অনেকেই এ সারিতে রয়েছেন। তাদের কেউ কেউ অকপটে বলেছেন, বাইরের দেশগুলোতে আগে মাথা উঁচু করে চলতাম। এ ঘটনার পর মাথা হেঁট হয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ বলেছেন, রামুতে যে ঘটনা ঘটলো, তাতে আমরা আর মুখ দেখাতে পারব না।

কেউ কেউ বলেছেন, কয়েকশ বছরের মধ্যে এরকম ঘটনা এ দেশে ঘটেনি। এ ঘটনার মধ্য দিয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট হল।

সংবাদপত্রের পাতায় তাদের এসব বক্তব্য পড়ে আমরা অবাক হয়েছি। কারণ, এই শ্রেণীর লোকেরাই গত পয়ত্রিশ বছর ধরে এদেশে সাম্প্রদায়িকতা হচ্ছে বলে বিস্তর অভিযোগ করে আসছেন। বার বার বলেছেন আর তারস্বরে চিৎকার করেছেন যে, এখানে সাম্প্রদায়িক ঘটনা ঘটছে, এখানে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি হচ্ছে, এখানে সাম্প্রদায়িক শক্তি ভয়ংকর মারমার কাটকাট রূপ নিয়ে বিরাজ করছে। তাহলে রামুর ঘটনায় (যেখানে একজন বৌদ্ধও নিহত বা আহত হয়নি) তাদের মাথা হেঁট হল কিভাবে? মুখ লুকাতে হচ্ছে কেন?  এ ঘটনার আগে তারা মাথা উঁচু করে কীভাবে চলতেন?

আসল সত্যকথাটা নিজেদের বক্তব্যে পরোক্ষভাবে তারা স্বীকারই করলেন যে, এতদিন এ দেশে উল্লেখযোগ্য কোনো সাম্প্রদায়িক ঘটনা ঘটেনি। এ দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বরাবরের মতো অক্ষুণ্ণ ও অমলিনই ছিল এবং এখনও আছে। রামুর ঘটনাটাই ছিল ব্যতিক্রম। আমরা অবশ্যই মনে করি রামুর ঘটনা নিন্দনীয় ও শাস্তিযোগ্য। এর সঙ্গে আমরা এটাও মনে করিয়ে দিতে চাই যে, এ জাতীয় ঘটনার প্রথম উস্কানি ও উস্কানিদাতার ব্যাপারে চোখবন্ধ রেখে পরে সার্চলাইট নিয়ে সদলবলে ঝাঁপিয়ে পড়া কোনো বুদ্ধিমত্তাপূর্ণ ও ন্যায়ানুগ তৎপরতা নয়।

হায়রে রামু! কাদম্বরির মতো সে-ও কিছু সময়ের জন্য কিছু এলাকায় জ্বলিয়া প্রমাণ করিল আগে কোনো মন্দিরে আগুন জ্বলে নাই। সে জানিয়ে দিল এ দেশ একটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিরই দেশ।

সুশীল বুদ্ধিজীবীরাও মুখ ফসকে সেটা স্বীকার করেছেন। রামুর ঘটনার এত তীব্র প্রতিক্রিয়া তারা না জানালে এ সত্যকথাটার প্রতি তাদের স্বীকৃতি আদায় করার কোনো উপায়ই হয়তো থাকতো না।

আমরা তাদের স্বীকার-অস্বীকারের খেলার মধ্যেই দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলতে চাই, কুরআন অবমাননা, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অবমাননা ও ইসলাম অবমাননার কোনো ঔদ্ধত্যপূর্ণ উস্কানি দেখতে চাই না এবং রামুর ঘটনারও কোনো পুণরাবৃত্তি হোক-তা চাইতে পারি না। আমরা মিয়ানমারের রক্তলোভী বৌদ্ধ কিংবা আসামের হিংস্র হিন্দুদের মতো হতে পারব না। সম্প্রীতি আমাদের বৈশিষ্ট্য। এ সম্প্রীতি নিয়েই আমরা থাকতে চাই। দয়া করে থাকতে দিন। 

 

 

advertisement