যিলহজ্ব ১৪৩৩   ||   নভেম্বর ২০১২

কোরবানীর সময়সীমা : একটি প্রশ্ন ও তার উত্তর

মাওলানা মুহাম্মাদ যাকারিয়া আব্দুল্লাহ


প্রশ্ন : আমরা জানি, কোরবানী তিন দিন করা যায় : ১০, ১১ ১২ যিলহজ্ব্। কিন্তু একটি বইয়ে দেখলাম, কোরবানীর সময় চারদিন : ১০ যিলহজ্ব, এরপর আরো তিন দিন। বইয়ে এটাকেই সঠিক বলা হয়েছে এবং জুবাইর ইবনে মুতয়িম রা.-এর সূত্রে একটি হাদীসের উদ্ধৃতিও দেওয়া হয়েছে। আর তিন দিনের কথাটাকে বলা হয়েছে ভিত্তিহীন।

বইয়ের আলোচনা পড়ে সংশয়ে পড়ে গেছি। সঠিক সমাধান জানতে চাই।

. আযাদ

উত্তরা, ঢাকা

উত্তর : কোরবানীর সময় তিন দিন : ১০, ১১ ১২ জিলহজ্ব। এটি সহীহমারফূ হুকমীহাদীসে স্পষ্টভাবে আছে, যা আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহর একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকার। তদ্রূপ সাধারণ মারফূ হাদীস দ্বারাও তা প্রমাণিত।

সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিমসহ হাদীসের প্রসিদ্ধ কিতাবসমূহে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিখ্যাত হাদীস বিভিন্ন সাহাবীর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, যাতে তিন রাতের পর ঘরে কোরবানীর গোশত রাখা নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল দরিদ্র মানুষের সহায়তা। কারণ বছর ঈদুল আযহার সময় আশপাশ থেকে অনেক দরিদ্র মানুষ সমবেত হয়েছিলেন। সহীহ বুখারীতে হাদীসের পাঠ এই-

من ضحى منكم فلا يصبحن بعد ثالثة وبقي في بيته منه شيء.

  -সহীহ বুখারী, কিতাবুল আযাহী, বাব : ১৬, হাদীস : ৫৫৬৯

সহীহ মুসলিমে হযরত জাবির রা.-এর সূত্রে বর্ণিত হাদীসের পাঠ এই-

كنا لا نأكل من لحوم بدننا فوق ثلاث مني، فارخص لنا رسول الله صلى الله عليه وسلم فقال : كلوا وتزودوا ...

-সহীহ মুসলিম, কিতাবুল আযাহী, হাদীস ৫০৬৭

হাদীস থেকে বোঝা যায়, শরীয়তের দৃষ্টিতে কুরবানীর সময় তিন দিন। তবে এই সময়ের পরও কোরবানীর গোশত সংরক্ষণের যে সাধারণ বৈধতা ছিল একটি বিশেষ সামাজিক প্রয়োজনে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা রহিত করে দিয়েছিলেন পরে আবার তার অবকাশ প্রদান করেন। অবকাশের। হাদীসগুলোতে কোথাও একথা নেই যে, তিনি কোরবানীর গোশত সংরক্ষণের অবকাশ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চতুর্থ দিনও কোরবানী করার অনুমতি দিয়েছেন।

قال الإمام أبو بكر الرازي الجصاص : فدلت هذه الأخبار على أن جواز الأضحية مقصور على هذه الأيام، لأنه إذا كان منهيا عن تبقية اللحم أكثر من ثلاث والذبح لا محالة قبل ذلك علمنا أن الذبح مقصور على ثلاث.

وقد روي في بعض ألفاظ حديث علي رضي ا لله عنه أن رسول الله صلى الله عليه وسلم نهى أن يبقى عندكم من نسككم شيء بعد الثلاث، فهو على الحي والمذبوح جميعا، لأن اللفظ يتناولهما. انتهى

وقال الإمام ابن قدامة الحنبلي في المغني : ولنا أن النبي صلى الله عليه وسلم نهى عن ادخار لحوم الأضاحي فوق ثلاث، ولا يجوز الذبح في وقت لا يجوز ادخارالأضحية إليه. انتهى

-শরহু মুখতাসারিত তহাবী, জাসসাস /৩৩২-৩৩৩; আলমুগনী, ইবনে কুদামা ১৩/৩৮৭

সাহাবায়ে কেরামও সুস্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, কোরবানীর সময় তিন দিন বলাবাহুল্য, এটা তাঁরা আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ থেকেই গ্রহণ করেছেন। কারণ ইবাদতের সময়সীমা তো নিছক যুক্তি-বুদ্ধির দ্বারা নির্ধারিত হতে পারে না। তাই ধরনের বর্ণনাকে পরিভাষায়মারফূ হুকমীবলে, যা মারফূ হাদীসেরই একটি প্রকার।

সাহাবায়ে কেরামের বক্তব্য

. হযরত আনাস রা. বলেন, ‘যবেহ (কোরবানী) করা যায় ঈদের (দিনের) পর আর দুই দিন।

الذبح بعد العيد يومان

এই বর্ণনার সনদ সহীহ। দেখুন : আহকামুল কুরআন, তহাবী, /২০৬; আসসুনানুল কুবরা, বাইহাকী /২৯৭; আলমুহাল্লা, ইবনে হাযম /৪৯৯

. হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা. বলেন, ‘ঈদুল আযহার (দিনের) পর আযহা (কুরবানী) দুই দিন।

الأضحى يومان بعد يوم الأضحى.

এই বর্ণনার সনদ সহীহ, বরং আসাহহুল আসানীদ (শ্রেষ্ঠ সনদ)-এর অন্যতম। দেখুন : আল মুয়াত্তা, ইমাম মালিক باب الضحية عما في بطن المرأة، وذكر أيام الأضحى   হাদীস : ২০৩৮

. আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস রা. বলেন, ‘আযহা (কোরবানী) তিন দিন।অন্য বর্ণনায় আছে, ‘কোরবানী করা যায় ইয়াওমুন নহর (কোরবানীর দিন)-এর পর আরও দুই দিন।

الأضحى ثلاثة أيام، وفي لفظ : النحر يومان بعد يوم النحر، وأفضلها يوم النحر.

বর্ণনা বিভিন্ন সনদে বর্ণিত হয়েছে। ইবনুত তুরকুমানী রাহ. তহাবীর সনদকেজাইয়েদবলেছেন। দেখুন : আহকামুল কুরআন তহাবী আল জাওহারুন নাকী, (সুনানে কুবরা বাইহাকীর সাথে মুদ্রিত) /২৯৬

. আবু হুরায়রা রা. বলেন, ‘আযহা (কোরবানী) হচ্ছে তিন দিন।

الأضحى ثلاثة أيام

-আলমুহাল্লা, ইবনে হাযম-ইলাউস সুনান ১২/২৩২-১৩৩

. আলী ইবনে আবী তালিব রা. থেকে বর্ণিত, ‘কোরবানী তিন দিন।

النحر ثلاثة أيام، وفي لفظ النحر ثلاثة أيام أفضلها أولها.

-আলমুয়াত্তা, ইমাম মালিক, প্রাগুক্ত  ; আহকামুল কুরআন, তহাবী /২০৫; লাউস সুনান ১২/২৩২

. ওমর ইবনুল খাত্তাব রা. থেকে বর্ণিত, ‘কোরবানী শুধু এই তিন দিনই করা যায়।

إنما النحر في هذه الثلاثة الأيام

-আলমুহাল্লা, ইবনে হাযম-ইলাউস সুনান ১২/২৩২

সাহাবায়ে কেরামের এই সিদ্ধান্ত সম্পর্কে ইমাম তহাবী রাহ. মূলনীতি উল্লেখ করেছেন, যার ভিত্তিতে পরিষ্কার প্রতীয়মান হয় যে, বিষয়টি তাঁরা আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকেই গ্রহণ করেছেন এবং যে কারণে এই বর্ণনাগুলোমারফু হুকমী পর্যায়ভুক্ত হয়। দ্র. আহকামুল কুরআন, তহাবী /২০৮

একই কথা অতি সহজ সংক্ষেপে বলেছেন ইমাম আবু বকর রাযী আলজাসসাস রাহ. তাঁর আলোচনায় মূল পাঠ উদ্ধৃত করা হল।

فإن مقادير الأوقات التي تتعلق بها صحة الفروض لا تعلم من طريق المقاييس، وإنما طريقها التوقيف أو الاتفاق. وقد حصل الاتفاق والسنة في الثلاث. فأثبتناها ولم نثبت ما فوقها، لعدم الدلالة عليه. انتهى

-শরহু মুখতাসারিত তহাবী /৩৩৩

আরো দেখুন : আহকামুল কুরআন জাসসাস /২৩৪ সূরা হজ্বের আলোচনায়।

বিখ্যাত তাবেয়ী ইমাম ইবরাহীম নাখায়ী রাহ. বলেন, ‘আযহা (কোরবানী) তিন দিন। ইওয়ামুন নাহর তার পর দুই দিন।অন্য বর্ণনায়, ‘আযহা (কোরবানী) তিন দিন : ইয়াওমুন নাহ্র তার পর দুই দিন। আর আইয়ামুত তাশরীক হচ্ছে ইয়াওমুন নাহর-এর পর তিন দিন।

الأضحى ثلاثة أيام : يوم النحر ويومان بعده. رواه الإمام أبو حنيفة في كتاب الآثار رقم ٧٨٦ وقال محمد : وبه نأخذ، وهو قول أبي حنيفة. وفي رواية أبي يوسف عنه زيادة ...وأيام التشريق ثلاثة أيام بعد يوم النحر.

-কিতাবুল আছার, ইমাম আবু হানীফা, (ইমাম মুহাম্মাদ রাহ.-এর বর্ণনা) হাদীস : ৭৮৬; (ইমাম আবু ইউসুফ রাহ.-এর বর্ণনা) হাদীস : ৩০৬

ইমাম আবু হানীফাইমাম মালিক, ইমাম সুফিয়ান ছাওরী, ইমাম আবু ইউসুফ, ইমাম মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান, ইমাম যফর ইবনুল হুযাইল, ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রাহিমুাহুল্লাহ) প্রমুখ বিখ্যাত মুজতাহিদ ইমামগণের  সিদ্ধান্তও তাও। সুতরাং একেভিত্তিহীনবলা চরম মূর্খতা ছাড়া আর কিছুই নয়।

 কোনো কোনো আহলে ইলম কুরবানীর সময় চার দিন হওয়ার কথাও বলেছেন। আতা ইবনে আবী রাবাহ, হাসান বসরী, ওমর ইবনে আব্দুল আযীয (রাহিমাহুমুল্লাহ) থেকে তা বর্ণিত হয়েছে। সেটিও একটি ইজতিহাদী মত। ইমাম শাফেয়ী রাহ. এই মত গ্রহণ করেছেন।

তবে এই দুই মতের কেউই অপর মতকে ভিত্তিহীন বলেননি। শরীয়তের যে বিষয়গুলোতে উভয় দিকে দলীল থাকার কারণে আহলে ইলমের মাঝে ইজতিহাদগত মতভেদ হয়েছে সেসব বিষয়ে একটি মত গ্রহণ করে অন্য মতকে ভিত্তিহীন বলা অপরিপক্কতার পরিচয় বহন করে। এটা সাম্প্রতিক সময়ের শুযুয বিচ্ছিন্নতা, যা সালাফের যুগে ছিল না। উপসর্গের বিষয়ে সতর্কতা কাম্য।

আর কোরবানীর সময় চার দিন হওয়ার বিষয়ে জুবাইর ইবনে মুতইম রা.-এর সূত্রে বর্ণনাকৃত যে রেওয়ায়েতের কথা প্রশ্নে উল্লেখ করা হয়েছে তার সনদমুনকাতি বিচ্ছিন্ন। তাছাড়া বর্ণনার আলোচিত অংশটি অনেক ইমামের মতেমালূলঅর্থাৎ তা হাদীসের শক্তিশালী বর্ণনাগুলোতে পাওয়া যায় না। বিস্তারিত : আহকামুল কুরআন তহাবী /২০৬; আহকামুল কুরআন জাসসাস /২৩৪-২৩৫;আলইসতিযকার ১৫/২০৩-২০৪; আলমুগনী, ইবনে কুদামা ১৩/৩৮৭; আলমাজমূ শরহুল মুহাযযাব /৩৬১; আলজাওরুন নাকী (সুনানে কুবরার সাথে) /২৯৬; নাসবুর রায়াহ /২১২-২১৩; ইলাউস সুনান ১২/২৩১

আশা করি আপনার প্রশ্নের জবাবের জন্য এটুকু আলোচনা যথেষ্ট।

মুহাম্মাদ যাকারিয়া আবদুল্লাহ

 

 

 

advertisement