দরসে তাওহীদ-২
তাওহীদের বিষয়ে আরেকটি মৌলিক কথা বুঝে নেওয়া দরকার। মক্কার মুশরিকরাও একটা পর্যায় পর্যন্ত আল্লাহ তাআলাকে এক মানত। কিন্তু কুরআন মজীদের ঘোষণা অনুযায়ী তা যথেষ্ট নয়। যেমন শুধু এটুকু মানা যে, আসমান-যমীন ও বিশ্বজগতের স্রষ্টা শুধু একজন। জগতের একাংশ একজনের সৃষ্টি, অন্য অংশ আরেক জনের এমন নয়। কুরআন মজীদের পাতায় পাতায় আছে, এটুকু একত্বের বিশ্বাস আরবের মুশরিকদেরও ছিল।
কুরআন মজীদের বিভিন্ন জায়গায় এ কথা আছে যে, মুশরিকদের যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, কে এই বিশ্বজগত ও আসমান-যমীনের স্রষ্টা, তারা বলবে, ‘আল্লাহ’।
ولئن سألتهم من خلق السموات والارض وسخر الشمس والقمر ليقولن الله.
সূরা আনকাবূত (২৯) : ৬১
বরং তারা এটাও মানত যে, এই জগতের নিয়ন্ত্রকও একমাত্র আল্লাহ। রিযিক ও জীবিকা তিনিই দান করেন, জীবন ও মৃত্যু তাঁরই আদেশে হয়। সূরায়ে ইউনুসে বলা হয়েছে
قل من يرزقكم من السماء والارض ام من يملك السمع والابصار ومن يخرج الحىّ من الميت ويخرج الميت من الحىّ ومن يدبر الامر فسيقولون الله.
(হে নবী! আপনি এই মুশরিকদের) জিজ্ঞাসা করুন, ‘কে আকাশ ও ভূমি হতে জীবিকা দান করেন, কিংবা কে মালিক শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তির, কে জীবিতকে বের করেন মৃত হতে আর মৃতকে জীবিত হতে, এবং কে নিয়ন্ত্রণ করেন (বিশ্বজগতের) সকল বিষয়, তারা বলবে, (এই সবকিছু করেন এক) আল্লাহ। বলুন তবু তোমরা সাবধান হচ্ছো না?-সূরা ইউনুস (১০) : ৩১
তো এটুকু একত্ব আরবের মুশরিকরাও মানত। তাহলে চিন্তা করা দরকার, তাদের শিরক আসলে কী ছিল। এ তো জানা কথা যে, তারা ছিল পৌত্তলিক জাতি এবং অসংখ্য দেব-দেবীতে বিশ্বাসী
কুরআন মজীদ থেকেই জানা যায়, এই সকল দেব-দেবী সম্পর্কে তারা মনে করত, এরা যদিও সেই শক্তিমান আল্লাহরই সৃষ্টি, কিন্তু আল্লাহর সাথে তাদের আছে এমন বিশেষ সম্পর্ক, যে, তারা কাউকে কিছু দিতে চাইলে দিতে পারে, কারো কাছ থেকে কিছু হরণ করতে চাইলে করতে পারে। তারা সম্পদ, সন্তান ও সুস্থতা দিতে পারে, আবার নিঃস্ব, অসহায় ও পথের ভিখারীও বানাতে পারে।
তাই এদেরকে রাজিখুশি করার জন্য তারা এদের উপাসনা করত, এদের নামে মান্নত-নযর মানত, নৈবেদ্য নিবেদন করত, মূর্তির চারপাশে প্রদক্ষিণ করত এবং নিজেদের হাজত ও জরুরত তাদের কাছে পেশ করত। তাদের এই সংস্কার ও রীতি-নীতিকেই কুরআন শিরক আখ্যা দিয়েছে। পৌত্তলিক সমাজ ও সম্প্রদায়ে সাধারণত এই শিরকই প্রচলিত ছিল। এমন মুশরিক বোধহয় খুব বেশি ছিল না, যারা মনে করত, এই বিশ্বজগতের সৃজন ও নিয়ন্ত্রণে আল্লাহর কোনো শরীক আছে। আমাদের জানামতে কোনো মুশরিক সম্প্রদায় নিজেদের উপাস্যদের আল্লাহর সমকক্ষ মনে করেনি। আরবের মুশরিকদের বিষয়ে তো কুরআন-হাদীসে এ কথা পরিষ্কার আছে। কুরআন মজীদেই কয়েক জায়গায় আছে, নৌপথের ভ্রমণে তারা যখন বিপদের মুখোমুখি হত এবং উত্তাল তরঙ্গে প্রাণের আশঙ্কা দেখা দিত তখন তারা সব দেব-দেবীকে ভুলে যেত এবং শুধু এক আল্লাহকেই ডাকত। যেমন সূরা বনী ইসরাঈলে বলা হয়েছে-
واذا مسكم الضر في البحر ضل من تدعون الا اياه.
যখন সমুদ্রে বিপদ তোমাদের স্পর্শ করে তখন তো তিনি ছাড়া অন্যরা, যাদের তোমরা নাম ডেকে থাক অন্তর্হিত হয়ে যায়।-সূরা বনী ইসরাঈল (১৭) : ৬৭
সূরা লুকমানে বলা হয়েছে-
واذا غشيهم موج كالظلل دعوا الله مخلصين له الدين.
অর্থাৎ যখন সমুদ্রের ঢেউ মেঘমালার মতো তাদেরকে আচ্ছন্ন করে তখন তারা একনিষ্ঠ বিশ্বাসে এক আল্লাহকে ডাকতে থাকে। ...-সূরা লুকমান (৩১) : ৩২
মোটকথা, আরবের মুশরিকদের আচরণ ও উচ্চারণ থেকে প্রকাশিত যে, তারা তাদের দেবতাদের আল্লাহর সমান মনে করত না; বরং তাঁর দাস ও সৃষ্টি বলেই মনে করত। তাদের বিশ্বাসেও আল্লাহই সবার উর্দ্ধে ও সবচেয়ে বড়। কিন্তু ইতিপূর্বে যা বলা হয়েছে সেটাই ছিল তাদের শিরক এবং একারণে তারা আল্লাহর কাছে মুশরিক বলে গণ্য।
আরবের মুশরিকদের তালবিয়া
হাদীসের কিতাবে আরবের মুশরিকদের তালবিয়াও উল্লেখ করা হয়েছে, যা তারা হজ্বের মওসুমে পাঠ করত। ঐ তালবিয়ার শেষ শব্দগুলো এই-
إلا شريكا هو لك تملكه وما ملك.
অর্থাৎ তারা বলত, ‘আল্লাহ! আমরা তোমার দরবারে হাজির। তোমার কোনো শরীক নেই, অবশ্য এমন শরীক আছে, যে তোমার দাস, তুমিই তার ও তার মালিকানাধীন সবকিছুর মালিক।
আরবের মুশরিকদের শিরক কী ছিল, যা কুরআন খন্ডন করেছে
আরবের মুশরিকদের শিরক এই ছিল না যে, তারা তাদের উপাস্যদেরকে আল্লাহর মতো সৃষ্টিকর্তা ও রিযিকদাতা মনে করত বা কোনো দিক থেকে আল্লাহর সমকক্ষ মনে করত; তাদের শিরক এই ছিল যে, বিশ্বজগতের সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তা আল্লাহকে মেনেও তারা এই বিশ্বাস পোষণ করত যে, আল্লাহ তাআলার সাথে সম্পর্ক ও নৈকট্যের কারণে এই দেবতাদেরও কিছু কিছু এখতিয়ার আছে এবং তারা চাইলে মানুষের উপকার-অপকার করতে পারে। এই বিশ্বাস থেকেই তারা তাদের উপাসনা করত। অর্থাৎ সিজদা ও তওয়াফ, নযর ও মান্নত, দুআ ও প্রার্থনা ইত্যাদি কাজের মাধ্যমে তাদেরকে রাজিখুশি করার চেষ্টা করত। তাদের এই বিশ্বাস ও কর্মই হল শিরক। আর অধিকাংশ মুশরিক জাতির মাঝে এ শিরকই প্রচলিত ছিল। এ কারণেই কুরআন মজীদে এ শিরকেরই খন্ডন বেশি করা হয়েছে।
এক জায়গায় বলা হয়েছে-
واتخذوا من دونه آلهة لا يخلقون شيئا وهم يخلقون ولا يملكون لانفسهم ضرا ولا نفعا ولا يملكون موتا ولا حيوة ولا نشورا.
আর তারা (মুশরিকরা) তাঁর পরিবর্তে এমন কিছু ইলাহ গ্রহণ করেছে, যারা কিছুই সৃষ্টি করে না; বরং তারা নিজেরাই আল্লাহর সৃষ্টি। তারা (অন্যদের বিষয়ে তো বলাইবাহুল্য) নিজেদেরই অপকার বা উপকারের ক্ষমতা রাখে না এবং না (এই দুনিয়ার) জীবন-মৃত্যুর উপর, না (মৃত্যুর পর) পুনুরুত্থানের উপর তাদের কোনো ক্ষমতা আছে। -সূরা ফুরকান (২৫) : ৩
অন্য জায়গায় ইরশাদ হয়েছে-
قل ادعوا الذين زعمتم من دون الله لا يملكون مثقال ذرة فى السموات ولا فى الارض وما لهم فيهما من شرك وما له منهم من ظهير.
(হে নবী! ঐ মুশরিকদের) বলুন, ডাক তাদেরকে, যাদেরকে তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে (মালিক-মোখতার) মনে কর। তারা তো একটি কণারও মালিক নয়, না আসমানের, না যমীনের আর না এতদুভয়ে ওদের কোনো অংশ আছে, আর না ওদের কেউ আল্লাহর সাহায্যকারী ।-সূরা সাবা (৩৪) : ২২
অর্থাৎ আসমান-যমীনের কণা পরিমাণ বস্ত্ততেও তাদের কোনো মালিকানা নেই এবং এর মালিকানায় আললাহর সাথে তাদের কোনো অংশীদারিত্ব নেই। তদ্রূপ তারা অংশীদারিত্ব বিহীন সহযোগীও নয়।
সূরা বনী ইসরাঈলে এক জায়গায় বলা হয়েছে-
قل ادعوا الذين زعمتم من دونه فلا يملكون كشف الضر عنكم لا تحويلا.
অর্থাৎ (হে নবী! ঐ মুশরিকদের) বলুন, ডাক ওদের, যাদের তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে (মালিক-মোখতার ও ইবাদতের উপযুক্ত) মনে করছ। তাদের তো কোনো ক্ষমতাই নেই তোমাদের কষ্ট দূর করার বা পরিবর্তন করার।-সূরা বনী ইসরাঈল (১৭) : ৫৬
সূরা ইউনুসের শেষ রুকুতে অতি গুরুত্বের সাথে বিশদভাবে বলা হয়েছে-
قل يا ايها الناس ان كنتم فى شك من دينى فلا اعبد الذين تعبدون من دون الله ولكن اعبد الله الذى يتوفاكم وامرت ان اكون من المؤمنين، وان اقم وجهك للدين حنيفا ولا تكونن من المشركين، ولا تدع من دون الله ما لا ينفعك ولا يضرك فان فعلت فانك اذا من الظالمين وان يمسسك الله بضر فلا كاشف له الا هو وان يردك بخير فلا راد لفضله يصيب به من يشاء من عباده وهو الغفور الرحيم.
অর্থাৎ (হে নবী! আপনি) বলুন, লোকসকল! যদি আমার দ্বীন সম্পর্কে তোমাদের কোনো সংশয় থাকে তাহলে (সাফ সাফ বলছি শোনো,) আমার দ্বীন এই যে, আল্লাহ ছাড়া যাদের তোমরা উপাসনা কর আমি ওদের উপাসনা করি না (এবং করব না); আমি তো একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করি (এবং করব) যিনি তোমাদের মৃত্যু দিবেন। তাঁরই আদেশ আমার প্রতি, আমি যেন ঈমানদারদের মধ্যে শামিল থাকি। (আরো আদেশ) নিজেকে সব দিক থেকে ফিরিয়ে আল্লাহর আনুগত্য ও উপাসনায় একনিষ্ঠ রাখ, কখনো মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না। আর আল্লাহ ছাড়া ঐসব বস্ত্তকে ডেকো না, যারা না তোমার উপকার করতে পারে, না অপকার। যদি কর (তাদের ডাক) তাহলে তুমি জালিমদের অন্তর্ভুক্ত হবে। আর আল্লাহ তোমাকে কোনো ক্লেশ দিলে তিনি ছাড়া কেউ নেই, যে তা মোচন করে আর তিনি যদি তোমার কোনো মঙ্গল চান তাহলে কেউ নেই যে তাঁর অনুগ্রহ রদ করে। তাঁর বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা তিনি মঙ্গল দান করেন। তিনিই তো ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।-সূরা ইউনুস (১০) : ১০৪-১০৭
তো এসকল আয়াতে এবং এমন আরো অনেক আয়াতে আরব-মুশরিকদের ঐ শিরক খন্ডন করা হয়েছে যা তারা লালন করত। তাদের মূর্তি ও দেব-দেবীর সম্পর্কে তাদের বিশ্বাস ছিল এরা আল্লাহর সৃষ্টি ও দাস হলেও আল্লাহর সাথে এদের আছে বিশেষ সম্পর্ক এবং সৃষ্টিজগতে তাদের আছে বিশেষ ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব। সুতরাং তারা আমাদের দুঃখ-কষ্ট দূর করতে পারে, আমাদেরকে সন্তান-সন্তুতি দান করতে পারে এবং সম্পদ ও সম্মানের অধিকারী করতে পারে। এই বিশ্বাসের কারণে তারা নিজেদের প্রয়োজন তাদের কাছে প্রার্থনা করত এবং তাদেরকে রাজিখুশি করার জন্য তাদের উপাসনায় লিপ্ত হত। অর্থাৎ যেভাবে আল্লাহকে রাজি করার জন্য এবং তাঁর সামনে নিজের অক্ষমতা প্রকাশ করা জন্য তাঁর ইবাদত করা হয় তারা ঐ সকল বাতিল মাবূদের বেলায় তা করত। কুরআন পাক তাদের বিশ্বাসকেও শিরক ঘোষণা করেছে, তাদের প্রার্থনা ও শরণকেও। আর তাদেরকে তাওহীদের দিকে ডেকে বলেছে, আল্লাহ ছাড়া কাউকে উপকার-অপকারের মালিক-মোখতার মনে করো না। ইবাদত ও ইসতিআনাত তথা শরণ ও উপাসনায় আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করো না।
ঐ মুশরিকদের উপাস্য কী ছিল
এখানে একথাও বুঝে নেওয়া দরকার যে, ঐ সকল মুশরিক যাদেরকে হাজত পূরণ ও বিপদাপদ থেকে মুক্তি দানের ক্ষমতাশীল মনে করত এবং যাদের উপাসনায় লিপ্ত হত ও প্রার্থনা করত তাদের পরিচয় কী।
অনেকের ধারণা, মুশরিকদের ঐ সকল শিরকী বিশ্বাস ও আচরণ মাটি-পাথরের মূর্তির সাথেই জড়িত ছিল। সব মুশরিকের ক্ষেত্রে একথা সত্য নয়। পাথরের মূর্তি তাদের অনেকেরই প্রকৃত উপাস্য ছিল না; তারা মূলত এ সকল শিরকী বিশ্বাস ও কর্ম কিছু মহাত্ম ও আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে লালন করত, আর পাথরের মূর্তিগুলোকে তাদের স্মারক মনে করত। কুরআন মজীদে সূরা নূহ-এ নূহ আ.-এর কওমের কিছু মূর্তির নাম উল্লেখ করা হয়েছে- ওয়াদ্দা, ছুয়া’, ইয়াগূছ, ইয়ায়ূক ও নাছ্র। আর এদের পরিচয় সম্পর্কে রেওয়ায়েত এসেছে যে, এগুলো মূলত ঐ সম্প্রদায়ের কিছু বুযুর্গ ও আল্লাহওয়ালার নাম, যারা বাস্তবিকই আল্লাহওয়ালা বুযুর্গ ছিলেন। তাদের মৃত্যুর কিছুকাল পর ভক্তরা তাদের ভাস্কর্য নির্মাণ করল এবং তাতে ভক্তি-শ্রদ্ধা নিবেদন করল। পরের প্রজন্মগুলোকে শয়তান এদের উপাসনায় লিপ্ত করল। তদ্রূপ আরবের মুশরিকেরা যেসব মূর্তির পুজা করত সেগুলোকেও মনে করা হত কিছু আধ্যত্মিক ব্যক্তিত্বের ভাস্কর্য ও স্মৃতিচিহ্ন। মূলত উপাসনা করা হত ঐসব ব্যক্তিত্বের, এবং তাদেরকে মনে করা হত হাজত পূরণকারী ও বালা-মুসীবত থেকে উদ্ধারকারী। যেমন হিন্দুরা কৃষ্ণ বা রামের মূর্তির পুজা করে থাকে। এখানে মাটির মূর্তির পুজা-অর্চনা উদ্দেশ্য থাকে না, উদ্দেশ্য থাকে কৃষ্ণ বা রামচন্দ্রের পুজা। আর তার মূর্তিকে গ্রহণ করে তার প্রতি ধ্যান ও মনোনিবেশ এবং তার পুজা-অর্চনার মাধ্যম হিসেবে। সে হিসেবেই এ মূর্তিরও সম্মান করা হয়।
যেমন অনেক মুসলিম নামধারী জাহেল তা’জিয়াতে নৈবেদ্য নিবেদন করে, তাজিয়ার সামনে মাথা ঝোকায়, এমনকি শোনা যায়, নিজেদের মনোবাসনাও তাজিয়াতে লটকে দেয়। এককথায় এর সাথে ঐ সব আচরণ করা হয় যা মূর্তি পুজকরা তাদের মূর্তির সাথে করে থাকে। এই সব তা’জিয়াদার ও তাজিয়া পুজারীরা কি বাঁশ-পাতায় বানানো তাজিয়াকেই গায়বী বা অলৌকিক ক্ষমতার মালিক মনে করে? করে না। তারা সব কিছু করে ইমাম হোসাইন রা.-এর উদ্দেশে। আর তা’জিয়াকে মনে করে তার চিহ্ন ও নিদর্শন। তো এটা পুরাপুরি মূর্তি পুজারীদের মতোই ব্যাপার-স্যাপার। হ্যাঁ, কিছু নির্বোধ এমনও আছে, যারা এই বাশ-কাগজের তাজিয়াকেই সবকিছু মনে করে। এ থেকে বোঝা যায়, আরবের মুশরিকদের মাঝেও এরকম একটি শ্রেণী ছিল, যারা নিজেদের হাতেগড়া পাথরের মূর্তিকেই অলৌকিক বা ঐশ্বরিক ক্ষমতার অধিকারী মনে করত এবং স্বয়ং সেগুলোরই উপাসনা করত। সম্ভবত এদের সম্পর্কেই কুরআন মাজীদে বলা হয়েছে
اتعبدون ما تنحتون
তোমরা ঐসব পাথরের মূর্তির উপাসনা করছ, যেগুলোকে তোমরা নিজেরাই বানিয়েছ?!
তো এ ধরনের আয়াত মূলত ঐ নির্বোধ শ্রেণীর মুশরিকদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, যারা পাথরের মূর্তিকেই সব কারিশমার আধার মনে করে।
আর যেসব মুশরিক এতটা নির্বোধ ছিল না এবং পাথরের মূর্তিগুলোকেই প্রকৃত উপাস্য মনে করত না; কিছু বাস্তব বা কাল্পনিক ব্যক্তিত্বকে ইষ্ট-অনিষ্টের ক্ষমতাশালী মনে করত আর মূর্তিকে মনে করত তাদের নিদর্শন বা আবির্ভাবের স্থল এবং একে মাধ্যম বানিয়ে ঐ সব ব্যক্তিত্বেরই পুজা-অর্চনা করত তাদের সম্পর্কে বলা হয়েছে-
ان الذين تعبدون من دون الله عباد امثالكم
আল্লাহর পরিবর্তে যাদের উপাসনা তোমরা কর তারা তো তোমাদেরই মতো (আল্লাহর) দাস।-সূরা আ’রাফ
অন্য জায়গায় বলা হয়েছে, ওরা তো নিজেরাই আমার মুখোপেক্ষী, আমার করুণার ভিখারী, নিজেদের প্রয়োজনও তারা আমার কাছেই প্রার্থনা করে আর আমার নৈকট্য অন্বেষণে ব্যস্ত থাকে, আমার রহম ও করুনার আশায় উদ্দীপ্ত এবং আমার আযাব ও শাস্তির ভয়ে ভীত কম্পিত থাকে।
আয়াতের আরবী পাঠ এই-
اولئك الذين يدعون يبتغون الى ربهم الوسيلة ايهم اقرب ويرجون رحمته ويخافون عذابه.
তো, এধরনের আয়াতে ঐসব মুশরিকদের শিরক খন্ডন করা হয়েছে, যারা মূর্তিকে প্রকৃত উপাস্য ও হাজত পূরণকারী মনে করত না বরং কিছু আধ্যাত্মিক ব্যক্তি সম্পর্কে তারা এই বিশ্বাস লালন করত। আর মূর্তিগুলোকে মনে করত শুধু তাদের প্রতিনিধি, বা নিদর্শন কিংবা তাদের আবির্ভাবের স্থল। আফসোসের বিষয় এই যে, অনেক মুসলিম নামধারী ত’জিয়া পুজারী ও কবর পুজারীরও এই অবস্থা। তারা বুযুর্গানে দ্বীন সম্পর্কে এ ধরনের বিশ্বাস পোষণ করে। এই বিশ্বাস থেকেই তাদের কবর ও তাজিয়ার সামনে মাথা ঝোকায় এবং তাতে নজর-নিয়ায নিবেদন করে। (ক্রমশ)