বাইতুল্লাহর ছায়ায়-২৭
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
হজ্ব থেকে ফারেগ হওয়ার পর সবার অন্তরে আশ্চর্য একটি ভালো লাগার অনুভূতি সৃষ্টি হয়। কত বড় কঠিন দায়িত্ব, আল্লাহর রহমতে কত সহজে আদায় হয়ে গেলো! শোকর ও কৃতজ্ঞতার আবেগ যেন হৃদয় উপচে পড়ে। তোমার শোকর হে আল্লাহ! তোমার শোকর!
এই শোকর ও কৃতজ্ঞতার মান ও পরিমাণ সবার অন্তরে অবশ্য এক নয়; এটা যার অন্তরে যত অধিক ও যত গভীর এই দিনগুলোতে সে তত বেশী বিগলিত ও নিবেদিত হয়, তত বেশী যিকির, ইবাদাত ও তিলাওয়াতে মশগুল হয়। মানুষ যখন ঘরে ফেরার চিন্তায় ব্যস্ত এবং বাজারের কেনাকাটায় ব্যতিব্যস্ত, সে তখন ‘ঘরের’ তাওয়াফে বেতাব, বেকারার!
উর্দূওয়ালারা বড় সুন্দর নাম দিয়েছে, ‘তাওয়াফে শোকরানা’। তো যখনই সুযোগ হয় আল্লাহর বান্দা মাতাফে নেমে আসে, হাজরে আসওয়াদের সমান্তরালে দাঁড়ায় এবং বাইতুল্লাহর নূর ও নূরানিয়াতের সদা বহমান স্রোতে একাকার হয়ে যায়। কে জানে এমন দিন আর কবে আসবে জীবনে! আসবে তো! যদি না আসে! তাই প্রতিটি তাওয়াফ যেন আখেরি তাওয়াফ, এমন- ভাবে চলতে থাকে তাদের আল্লাহর ঘরের প্রদক্ষিণ, চলতেই থাকে। মাঝখানে দু’রাকাত নামায, একটু মুনাজাত, আর প্রাণভরে আবে যমযম। আবার তাওয়াফ, ছালাত, মুনাজাত, আর যমযম। কিসমত যদি আরো খুলে যায় তাহলে হাজরে আসওয়াদের চুম্বন এবং মুলতাযামের আলিঙ্গন!
দুর্বল বান্দা যখন ক্লান্তি বোধ করে তখন হারামের ছায়ায় বসে আল্লাহর ঘর দেখতে থাকে, দেখতেই থাকে। কে জানে, আবার কবে দেখতে পাবো; পাবো তো!?
মৃদুমন্দ বায়ুতে বাইতুল্লাহর গেলাফে তরঙ্গ সৃষ্টি হয়, সে তরঙ্গ যেন চোখের তারা বেয়ে হৃদয়-সরোবরে গিয়ে তরঙ্গ সৃষ্টি করে।
পিপাসা পেয়েছে! এই তো কাছেই আছে আবে যমযম, পান করো, আকণ্ঠ পান করো; দেহের প্রতিটি কোষ যেন যমযমে সুসিক্ত হয়।
বান্দার কখনো ইচ্ছে হয়, আল্লাহর ঘর সামনে রেখে আল্লাহর কালাম তেলাওয়াত করে। বান্দা জানে, দেশে প্রবাসে, পথে প্রান্তরে যেখানেই সে তেলাওয়াত করে, আল্লাহ শোনেন, শুনতে পান। তবু তার ইচ্ছে হয়, আল্লাহর ঘরের সামনে হারামের ছায়ায় বসে তেলাওয়াত করে! আল্লাহকে আল্লাহর কালাম শোনায়! এ তেলাওয়াত যেন ঘরের সামনে নয়, ঘরের মালিকের সামনে!
এভাবে দেখতে দেখতে হজ্ব-পরবর্তী অল্পক’টি দিন-রাত পার হয়ে যায়; আমারও পার হয়ে গেলো, যদিও তেমন করে নয় যেমন করে পার হতে দেখেছি আল্লাহর নেক বান্দাদের; তবু পার হয়ে গেলো।
আগামীকাল আছরের পর মদীনা শরীফের উদ্দেশ্যে আমাদের রওয়ানা হওয়ার কথা। শেষ রাতটি যাপন করলাম হারামের সেই চিরচেনা চিরআপন ভাবগম্ভীর পরিবেশে। প্রশান্তিতে কখনো চোখ লেগে আসে; উৎকণ্ঠায় কখনো চোখ খুলে যায়। একবার ঘড়ী দেখতে যাবো আর আযান শুরু হয়ে গেলো! আমার চোখে ঘুম ছিলো, রাতের চোখে ঘুম ছিলো না। সময়ের গতি একেবারে ‘নির্ঘুম’!
ফজরের জামাত হলো। আজকের জামাতে লক্ষ মুমিনের কাতারে আমিও শামিল ছিলাম। আগামীকাল এখানে ফজরের জামাত হবে। লাখো মুমিনীন, আশেকীন তাতে শামিল হবে; আমি থাকবো না। গত রাতে যাদের জানাযা হলো, হারামের জামাতে তারা শরীক হতেন, আজ ফজরের জামাতে তারা ছিলেন না; আর কখনো তাদের দেখা যাবে না হারামের জামাতে। হে আল্লাহ, আমার যেন ...!
ফজরের পর তাওয়াফ করলাম, বিদায়ের তাওয়াফ নয়। আল্লাহর রহমতে আরো কিছু সময় আছে। এখনো হতে পারে আরো একটা-দু’টো তাওয়াফ।
আকাশ বেশ মেঘাচ্ছন্ন, খুব শীতল বাতাস। তবে যখন তাওয়াফ শুরু করলাম, আরামদায়ক উষ্ণতা বোধ হলো কিছু শরীরের তাপে, কিছু হৃদয়ের উত্তাপে।
যোহরের পর যখন বিদায় তাওয়াফ শুরু করবো, ঝিরঝির বৃষ্টি শুরু হলো। খুশিতে আনন্দে আমারও চোখ ছেপে ‘বৃষ্টি’ নামলো। এতদিন শুধু শুনেছি আল্লাহর ঘরে রহমতের বৃষ্টির কথা; রহমতের বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে আল্লাহর বান্দাদের তাওয়াফ করার কথা। শুনেছি, পড়েছি, আজ নিজের চোখে দেখতে পেলাম রহমতের বৃষ্টি এবং বৃষ্টির রহমত বর্ষিত হওয়ার দৃশ্য। এমন অপার্থিব দৃশ্যের কী বিশেষণ হতে পারে! বলতে ইচ্ছে করে ‘জান্নাতি দৃশ্য’। জান্নাতে তো আহলে জান্নাতের উপর রহমতের বৃষ্টিবর্ষণ হবে। তো সে দৃশ্য হবে আরো সুন্দর, এমন সুন্দর যা কেউ কখনো দেখেনি, শুনেনি, এমনকি কল্পনাও করেনি। আজকের দৃশ্য হয়ত সে দৃশ্যের পূর্বাভাস মাত্র।
ঝিরঝির বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে তাওয়াফ শুরু করলাম। সে তাওয়াফের স্বাদ ও লজ্জত এবং শান্তি ও প্রশান্তি ছিলো অন্য কিছু। আমার জীবনের বৃষ্টিভেজা একমাত্র তাওয়াফ। এখনো যেন তার স্বাদ লেগে আছে সর্বঅঙ্গে, সর্বসত্তায়। কী সকূন ও সাকীনা প্রতি কদমে! কী আশ্বাস ও আশ্বস্তি প্রতি পদক্ষেপে!! উপর থেকে রহমতের ফিরেশতারা যেন ‘গোলাবজল’ ছিটিয়ে দেয়! আহা, এমন তাওয়াফ আবার যদি নছীব হয়!
রহমত যখন নেমে আসে এভাবেই নেমে আসে! আজ আসওয়াদেরও চুম্বন-স্পর্শ লাভ হলো, আল্লাহর কোন বান্দাকে কষ্ট না দিয়ে। মুলতাযামেও বুক লাগাবার তাওফীক হলো। ঘরের দুয়ার ভেজা, আমারও বুক ভেজা এবং চোখ ভেজা। মুলতাযামে বুক লাগিয়ে ভিজলাম, কাঁদলাম, চাইলাম এবং যদি বলি, কিছু পেলাম! দুয়ারে দাঁড়িয়ে ভিজতে থাকা ভিখারীকে তো তাঁর বান্দারাও ফিরিয়ে দেয় না! বুকটা তখন ভরে উঠলো আশায়, ভরসায়, আশ্বাসে ও বিশ্বাসে। তাই প্রাণভরে চাইলাম নিজের জন্য, মা-বাবার জন্য, পরিবার পরিজনের জন্য, দেশ ও সমাজের জন্য এবং সমগ্র মুসলিম উম্মাহর জন্য।
আল্লাহর ঘরের ছাদ থেকে রহমতের ধারা নেমে আসছে মীযাবে রহমত বেয়ে। নীচে অভূতপূর্ব দৃশ্য। বড় মধুর প্রতিযোগিতা। আমাদের পক্ষে দূর থেকে শুধু দেখা আর আফসোস করাই সম্ভব; কাছে যাওয়ার কথা কল্পনা করাও কঠিন। কিন্তু আল্লাহ তাঁর কমযোর বান্দাকেও মাহরূম করলেন না। হাতীমে দাখেল হওয়ার যে পথটি সেখানে এসে দেখি মীযাবে রহমতের পানি স্রোতের মত বের হয়ে আসছে। আশ্চর্য রকম শীতল পানি। অাঁজলা ভরে সে পানিই মাথায় দিলাম। সর্বাঙ্গ যেন শীতল হয়ে গেলো।
এই সফরে প্রথমবার যখন আল্লাহর ঘরের দীদার হলো তখন যেমন পিপাসা ছিলো, আজ বিদায়ের মুহূর্তে সেই পিপাসা যেন আরো তীব্র হলো। প্রতিদিনের এত দীদার, এত যমযম তবে কিসের জন্য! তাহলে কি পিপাসা নিবারণের জন্য নয়, আরো পিপাসা নিয়ে যাওয়ার জন্য! হয়ত!
ঝিরঝির বৃষ্টিতে ভিজে শেষবারের মত আল্লাহর ঘর দেখছি, আর কাঁদছি। আল্লাহর ঘরের সামনে বৃষ্টির পানি আর চোখের পানি আজ একাকার হলো। কষ্টের মধ্যেও ভিতরে যেন একটু খুশির ছোঁয়া লাগলো। এই বৃষ্টিতে আজ আল্লাহর ঘর ভিজেছে, আমিও ভিজেছি। আজ বিদায়ের বিষণ্ণ মুহূর্তে ঘরের গেলাফের সঙ্গে এই যে একটু ‘বৃষ্টি-বন্ধন’ অবশ্যই তা এক ‘মিষ্টি অর্জন’। এই সুখের স্মৃতিটুকু বুকে ধারণ করে বিদায় গ্রহণের তো কিছু না কিছু আনন্দ আছে!
দাও হে আল্লাহ আরো বৃষ্টি দাও! আরো ভিজিয়ে দাও, তোমার ঘরকে, তোমার বান্দাকে।
বান্দার মিনতির লাজ আল্লাহ যেন রক্ষা করলেন, শুরু হলো মোষলধারে বৃষ্টি। কত ভাষায়, কত গানে কবিতায় বৃষ্টিতে ভেজার আনন্দের কথা কত কবি কতভাবে লিখেছেন, ঘর ও ঘরের তাওয়াফীর এই যে একসঙ্গে ভেজার আনন্দ, এর কি কোন তুলনা আছে, কোন উপমা আছে! জান্নাতে যদি বৃষ্টি হয়, আর সেই বৃষ্টিতে যদি ভেজা যায়, তাহলেই শুধু আমি খুঁজে পাবো আজকের এই বৃষ্টিতে ভেজার আনন্দের উপমা।
ইচ্ছে হয়, অনন্তকাল যেন বৃষ্টি হয়, আর এভাবে দাঁড়িয়ে থাকি আল্লাহর ঘরের সামনে, এভাবে ভিজতে থাকি আল্লাহর ঘরের সঙ্গে!
কিন্তু হলো না। আরো বৃষ্টি হলো, অনেক বৃষ্টি হলো, অনেক্ষণ ধরে বৃষ্টি হলো, কিন্তু আমার আর ভেজা হলো না! বুকের ভেতরে ধুক করে যেন একটি শব্দ বেজে উঠলো, ‘বিদায়’! সময় হয়ে গেছে; বিদায় হাতছানি দিয়েছে! আর বিদায়ের হাতছানি কে কবে এড়াতে পেরেছে! বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে আল্লাহর ঘর দেখে দেখে শেষবারের মত যমযম পান করে নিলাম। ভিতর থেকে কান্নাগুলো যেন হু হু করে বের হয়ে এলো।
হে আল্লাহর ঘর, আবার যেন আসা হয়, আবার যেন দেখা হয়, আবার যেন ‘বৃষ্টি’ হয়!
***
মেঘাচ্ছন্ন আকাশ এবং মেঘাচ্ছন্ন হৃদয় সঙ্গে করে প্রিয় নবীর প্রিয় শহর মদীনার পথে রওয়ানা হলাম। মু‘আল্লিমের দফতরের সামনে বাসের ভেতরেই বসিয়ে রাখা হলো দুই ঘণ্টার বেশী সময়। ধৈর্যের মাঝারি আকারের একটা পরীক্ষা হয়ে গেলো।
আল্লাহ জানেন, কে উত্তীর্ণ হলো, কে হলো না। ভরসা শুধু এই যে, তার মাগফেরাতের দুয়ার উন্মুক্ত সবার জন্য। আমার শুধু মনে হলো, আল্লাহর ঘরের সঙ্গে আদবের খেলাফ যা কিছু হয়েছে তা থেকে পাকছাফ করে আল্লাহ আমাদের বের করতে চেয়েছেন; তাই গায়ব থেকে তিনি তারবিয়াতের এই ব্যবস্থা করেছেন। শোকর আলহামদু লিল্লাহ। কত নাফরমানি হয়, আদবের কত খেলাফ হয়, তবু বান্দাকে তিনি মুহববত করেন এবং সামান্য সামান্য কষ্ট দিয়ে বান্দাকে পাকছাফ করেন।
আছরের নামাযের জন্য দয়া করে নামতে দেয়া হলো এবং কয়েক ফোঁটা পানির অযু দিয়ে নামায আদায় করা হলো।
গাড়ী রওয়ানা হলো। পথের ঘটনা আছে অনেক, দুর্ঘটনাও আছে দু’একটি। শিক্ষারও বিষয় আছে কিছু কিছু। থাক। পথে শেষ রাতের আকাশে চাঁদ দেখেছি। দেখেছি চাঁদের বিষণ্ণ জোসনা! সেই চাঁদের কথা এবং তার বিষণ্ণ জোসনার কথাও থাক। এত কথা লেখার, এত কথা পড়ার উদ্দেশ্য কী? আমি লিখবো কেন? আমার পাঠক পড়বে কেন? কল্যাণ লাভের জন্যই তো! কল্যাণের উপকরণ আলহামদু লিল্লাহ আশা করি যথেষ্ট হয়েছে। এখন প্রয়োজন শুধু সামান্য কিছু অর্জন। দু‘আ করি, আল্লাহ যেন কবুল করেন লেখক-পাঠক উভয়কে?
অর্ধেকের কিছু বেশী পথ যাওয়ার পর একদল বানরের সঙ্গে দেখা হলো। দেখা হলো, ঠিক নয়; চলন্ত গাড়ী থেকে শুধু আমি দেখলাম, ওরা আমাকে দেখতে পায়নি।
বলার মত বিষয় হলো, জীবনে এই প্রথম বানরের প্রতি মনে মায়া জাগলো। হোক না বানর, তবু তো মদীনার কত কাছে থাকে। ইমাম ছাহেব বললেন, সুযোগ পেলে এরা নাকি গাড়ীর উপর এবং মানুষের উপর হামলা করে। মন কিন্তু কথাটা মেনে নিতে চাইলো না। এখানকার বানর অবশ্যই অন্যরকম বানর হবে। একবার ইচ্ছে হলো, গাড়ী থামাতে বলি, বানরগুলোর কাছে গিয়ে সবাইকে দেখাই, মদীনার পড়শী বানর কত শরীফ বানর। দেখো তো, কত শারাফাতের সঙ্গে আমার হাত থেকে কলাটা নিলো, খোসাটা আমার দিকে ছুঁড়ে পর্যন্ত মারলো না!
আমার ইচ্ছের কথা শুনে ইমাম ছাহেব শুধু হাসলেন। হয়ত ভাবলেন, পাগল!
মদীনার খুব কাছে, এত কাছে যে, মসজিদুন্-নবীর আলোকিত মিনারগুলো দেখা যায়, এখানে হলো মাওকিফুল হিজরাহ। এখানে বাস থামে এবং মদীনার মুসাফিরদের খুব ইকরামের সঙ্গে মেহমানদারি করা হয়। সেই নূরের যামানা থেকে মেহমানদারি তো মদীনার বাসিন্দাদের স্বভাব ও ফিতরত। এখনো তার ছাপ আছে তাদের মধ্যে। আমাদের বাসে পানি ও খাবারের প্যাকেট নিয়ে যিনি উঠলেন, তিনি হাসিমুখে এমন সুন্দর করে সালাম দিলেন যে, আমাদের সব কান্তি দূর হয়ে গেলো। এই মধুর হাসি, এই সুন্দর সালাম আমাদের অন্তরে আশ্বাসের শীতল পরশ বুলিয়ে দিলো। যেন বলা হলো, এসো এসো নবীর মদীনায় এসো। নবীর মদীনা তোমাদের বরণ করে নেবে, তোমাদের ‘অাঁচল’ পূর্ণ করে দেবে।
দূর থেকে মদীনার শেষ রাতের আলো দেখছি আর দুরূদ পড়ছি। মসজিদুন্-নবীর নূরানী মিনার দেখছি আর ‘বালাগাল উলা’-এর শারাবান তাহূরা পান করছি। নিয়মের দাবীতে জিসিম এখানে পড়ে থাকলেও মন যে ছুটে ছুটে যায় ঐ যে সবুজ গম্বুজ দেখা যায় ঐ মোকামে!
ত্রিশ মিনিট হলো, একঘণ্টা হলো, দেড় ঘণ্টা এবং দু’ঘণ্টা, কিন্তু গাড়ীর চালকের খোঁজ নেই। আমাদের পাসপোর্ট তারই যিম্মায় এবং সেগুলো নিয়ে নির্ধারিত কাউন্টারে তারই যাওয়ার কথা। কত বাস এলো এবং যথারীতি রওয়ানা হয়ে গেলো। আমরা বসে আছি তো বসেই আছি। শুধু বসে থাকা অবশ্য নয়; বসে আছি, আলোকিত মিনার দেখছি আর দুরূদ পড়ছি-
صلى الله على محمد، صلى الله عليه وسلم
দেশ ও জাতি হিসাবে আমাদের রক্তে ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার উপাদান যে পরিমাণ আছে, তার চেয়ে অনেক বেশী ধৈর্যের পরিচয় ইতিমধ্যেই দেয়া হয়ে গেছে, সুতরাং আর কত! যবান এমনই সংযম হারালো যে, আল্লাহ পানাহ! কিন্তু গালমন্দ যতই হচ্ছে তাতে নিখোঁজ চালকের হদীস তো আর মিলছে না। এতক্ষণে একজন বুদ্ধির কথা বললেন, নেমে দেখা দরকার ঘটনা কী! ঘটনা হলো, চালক বেচারা বিশ্রামাগারে গভীর ঘুমে অচেতন। কাজটা হয়ত অন্যায়, কিন্তু ঘুমের প্রয়োজনটাও সত্য। তার চেয়ে বড় কথা, যদি পর্দার আড়ালের সত্য এই হয় যে, করুণা করে যিনি এই পবিত্র শহরের এত কাছে এনেছেন, তিনি আমাদের গাফলত ও দিলের ‘মুর্দেগি’ দেখে নাখোশ হয়েছেন।
তারপরো মুহববত করে আমাদের তারবিয়াতের ইন্তিযাম করেছেন। চালকের গাফলত হচ্ছে উপলক্ষ, আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে আমাদের গাফলত দূর করা। হাকীকত তো এই যে, নবীর শহরে আসার পথেও এমন গাফলত যাদের, তাদের তো চিরকালের জন্য মাহরূম হওয়ার কথা। তার পরিবর্তে যদি কিছু সময়ের ‘তারবিয়াতি বিলম্ব’ হয় তাহলে তো অন্যের প্রতি অসন্তুষ্টির পরিবর্তে সর্তক হওয়া এবং ইসতিগফার করাই কর্তব্য। মোটামুটি একথাগুলো ইমাম সাহেব সবাইকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন। ফলে চালকের প্রতি ক্রোধের কিছুটা উপশম হলো এবং অল্পের উপর দিয়ে, অর্থাৎ দু’চারটে বাংলা ‘মিষ্টি’ শব্দের উপর দিয়েই বিষয়টা পার হয়ে গেলো।
আবার দেখতে পেলাম ‘মাদানী আখলাক’! সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ঘটনা জেনে এমন পেরেশান হলেন যেন তার নিজের অপরাধ! চালককে অতি মৃদু তিরস্কার করলেন, আর আমাদের ইমাম ছাহেবের কাছে, বলতে সঙ্কোচ হয়, বারবার ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। তারপর নিজের তত্ত্ববাধানে খুব সংক্ষেপে আনুষ্ঠানিকতা সেরে আমাদের রওয়ানা করিয়ে দিলেন। দেখলাম আর মনে মনে কামনা করলাম; আমাদের শরীরে মাটি যে ভূখন্ডেরই হোক, আখলাক যেন হয় মদীনার, মদীনাতুন্-নবীর! হে আল্লাহ, যে দেশ, যে মাটি, যে বাতাস, যে পানি তুমি আমাদের জন্য নির্ধারণ করেছো তাতে আমরা খুশী! শুধু এই মিনতি, তোমার পেয়ারা হাবীবকে যারা একদিন
طلع البدر علينا ... أيها المبعوث فينا ...
বলে বরণ করেছে তাদের কণ্ঠের সেই মধু এবং তাদের চরিত্রের সেই মাধুর্য আমাদেরও দান করো, আমীন।
***
ভোরের আযান হলো। সেই আযানের সুমধুর ধ্বনি আমাদের পর্যন্ত এসে পৌঁছলো। কিছুক্ষণের মধ্যে আমরা নবীর মদীনায় দাখেল হলাম। ভাবের ঘোরে আচ্ছন্ন মন যেন খোশখবরি দিলো ‘এসো সফলতার দিকে, এসো সফলতার দিকে, আজকের আযানের এ আহবান তোমার জন্য, হে মুসাফির, তোমার জন্য।
এবার আমাদের মদীনার বাসস্থান হলো কেবলার দিকে এক কিলোমিটারেরও বেশী দূরে। সুতরাং ফজর ঘরেই পড়তে হলো।
শিকদার সাহেব, আমার প্রতি কেন এত দয়া করলেন জানি না, বললেন, আপনার কাছে একটি আব্দার আছে, শোনবার আগেই বলুন, মঞ্জুর করলাম।
বললাম। তিনি বললেন, সালাম পেশ করার জন্য আমাকে আপনার সঙ্গে নিয়ে যাবেন। আবারও বুকের ভিতরে কেমন একটি শীতল স্পর্শ অনুভব করলাম, যেন আশ্বাস পেলাম, ‘যাও, সঙ্গে নিয়ে যাও, এই ‘মাযূর’ মানুষটির উছিলায় তোমারও সালামের নাযরানা কবুল হতে পারে।’
বাবুস-সালামের সামনে এসে দাঁড়ালাম এবং বিশ্বাস হলো, আমি সত্য আশ্বাস লাভ করেছি। কখনো যা দেখিনি, শুনিনি, তাই আজ দেখলাম এবং শুনলাম। শিকদার সাহেব দেখি থরথর করে কাঁপছেন। আশঙ্কা হলো, অসুস্থতার প্রকোপ। না, ভুলটা ভাঙ্গলো যখন তিনি বললেন, হুযূর, আপনি যান, আমার সাহস হয় না। সারা জীবন কী করছি, কী মুখ লইয়া যামু!
অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলাম, তাকিয়েই থাকলাম। আহা, এমন করে যদি ভাবতে পারতাম, জীবনে একবার, অন্তত একবার! সত্যি তো! এত দিন কী করেছি, আজ কোন মুখে গিয়ে দাঁড়াই!
হঠাৎ ভিতর থেকে এই আয়াতের উদ্ভাস ঘটলো-
ولو انهم اذ ظلموا انفسهم جاؤوك فاستغفروا الله واستغفر لهم الرسول لوجدوا الله توابا رحيما.
নিজেদের উপর অবিচার করার পর যদি তারা আপনার কাছে আসে, অনন্তর আল্লাহর কাছে ইসতিগফার করে, আর রাসূল তাদের জন্য ইসতিগফার করেন তাহলে অবশ্যই আল্লাহকে তারা পাবে তাওবা কবুলকারী, পরম দয়ালুরূপে।
এই আয়াতের আশ্বাসে শিকদার সাহেবও শান্ত হলেন আমিও শান্তি পেলাম এবং পরম নির্ভরতার সঙ্গে ‘শান্তির রাজতোরণ’ অতিক্রম করে অগ্রসর হলাম।
মাযুর মানুষটিকে সবাই ইকরাম করলো, আমিও সেই ইকরামের ভাগ পেলাম। শিকদার সাহেব অঝোরে কাঁদলেন; অঝোরে, তবে নিঃশব্দে! এমন কোমল স্নিগ্ধ অথচ ঝরঝর কান্না আর কখনো দেখেছি, মনে পড়ে না। সেই কান্না আমাকেও স্পর্শ করলো। এমন কান্না আমিও বহুদিন কাঁদিনি, কাঁদতে পারিনি। কবে কোথায় যেন পড়েছি-
فيهج لي البكا بكاها
(একটি কবুতরকে কাঁদতে দেখে আমারও কান্না পেলো, তার কান্নায় আমার কান্না উদ্বেলিত হলো। এই কান্না ঐ কান্নার কাছে চিরঋণী)
তখন বুঝতে পারিনি, আমি এক ‘ভোরের প্রদীপ’-এর আলো সঙ্গে করে সালামের নাযরানা পেশ করেছি! আর মাত্র দু’মাস প্রজ্বলিত থাকবে এ জীবন-প্রদীপ, এই জীবন্ত প্রদীপ! আফসোস, কত মানুষ তার জানাযায় শরীক হলো, আমার নছীবে হলো না।
***
মদীনার প্রতিটি দিন ছিলো আলোকিত, প্রতিটি রাত ছিলো আলোঝলমল। সূর্য তো আলো বিতরণে কৃপণতা করে না, চাঁদেরও নেই জোসনা ঢেলে দিতে কার্পণ্য, আলোর বাতায়ন কেউ যদি বন্ধ না করে। মদীনায় সূর্যের আলোতে চাঁদের জোসনায় সণাত হওয়ার সৌভাগ্য কতটুকু হয়েছে তা জানি না, তবে মসজিদে নববীতে এবার একজন আলোকিত ও জোসনাস্নিগ্ধ মানুষের সান্নিধ্য পেয়েছি প্রতিদিন ভোরে ও সন্ধ্যায়। হযরত হাফেজ্জী হুযূর রহ যেখানে বসতেন তার থেকে একটু দূরে, পশ্চিম দিকে তিনি বসতেন। যন্ত্রচালিত হুইল চেয়ার নিজেই চালিয়ে আসতেন। মানুষের চেহারাও হয় এত ঝলমলে! দিনে যেন আলো ঠিকরে বের হয়, রাতে যেন জোসনা ঝরে পড়ে! হয়ত আলোর মাটি, কিংবা মাটির আলো দিয়ে তার সৃষ্টি! শুনেছি এমন মাটিও আছে যা আলো ছড়ায়। হয়ত তিনি তেমন কোন মাটি দিয়ে তৈরী।
খোঁজ নিয়ে জানা গেলো, তিনি মদীনার বাসিন্দা এবং নবী-পরিবারের সন্তান। অতিশয়োক্তি মনে না করা হলে বলি, তাঁর সঙ্গে যখনই মুছাফাহা করেছি, মনে হয়েছে, আমার হাত কেমন যেন আলো-মাখা হয়ে গেছে।
একদিন তিনি بني বলে ডাক দিলেন। এমন আদরমাখা ডাক আসলে এমন মুখ থেকেই আসতে পারে। দৌড়ে গেলাম, মনে হলো কিছু বলতে চাইলেন, কিন্তু বললেন না। অনেক্ষণ বসে থাকলাম যতটা সান্নিধ্য গ্রহণ করে বসা যায়। একসময় হাতটা আলতো করে মাথায় রাখলেন। মনে হলো....।
জীবনে প্রথম যেদিন মদীনায় হাযিরা হলো সেদিনের সেই প্রথম অবলোকনের, প্রথম সন্নিধ্যের পুলক শিহরণের তো আসলেই কোন তুলনা নেই। এখন সেই তীব্রতা নেই, তবে সেই স্নিগ্ধতাটুকু আল্লাহর শোকর এখনো আছে। এটা আসলে হযরত হাফেজ্জী হুযূর রহ-এর ফয়য ও ফয়যান ছাড়া আর কিছু নয়। এই মসজিদে নববীতেই একদিন হযরতের খিদমতে আরয করেছিলাম, আমাকে এমন কোন আমল বলে দিন যাতে যিন্দেগি ভর মদীনার মুহববত কলবের মধ্যে তাযা থাকে।
তিনি বললেন, হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু দু‘আ করতেন, আল্লাহর রাস্তায় শহীদ হওয়ার জন্য এবং আল্লাহর হাবীবের শহরে মওত হাছেল হওয়ার জন্য, তুমিও সেই দু‘আ করো, আর বেশী বেশী দুরূদ ‘ভেজো’।
***
খাদেমুল হারামাইন শরীফাইনকে আল্লাহ উত্তম জাযা দান করুন। মসজিদে নববীর মূল অংশটি তিনি সারা রাত খোলা রাখার ব্যবস্থা করেছেন। সেখানে এখন সারা রাত আশেকীনের হুজূম ও সমাগম। কেউ তেলাওয়াত করে, কেউ যিয়ারাতে গিয়ে সালামের নাযরানা পেশ করে। কেউ একটু পিছিয়ে এসে নামায পড়ে, তেলাওয়াত করে। রাত একটার পরে জান্নাতের বাগিচা খুলে যায়, কিছুক্ষণ সেখানে অবস্থান করো, দু’রাকত নফল পড়ো, সুযোগ হলে একটু তিলাওয়াত করো, ঐ সময় সুযোগ অবশ্য হয়।
তারপর আছহাবে ছোফ্ফার মাকামে হাযির হও। তখন অবারিত সুযোগ। অনেক্ষণ বসা যায়। কখনো অনেকক্ষণ বসে থাকি, কখনো অজানা একটা ভীতি ও উৎকণ্ঠা তাড়া দেয়। উঠে চলে আসি।
আগে জানতাম না, এবার জানলাম, আছহাবে ছোফ্ফা থেকে হুজরা শরীফের দিকে একটু এগিয়ে গেলে পেয়ারা হাবীব ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ঠিক কদম মোবারকের নীচে বসা যায়। আমি জানতাম, এ অংশটি ঘেরাও করে বন্ধ রাখা হয়েছে। সালাম পেশ করার দিক থেকে বন্ধ দেখে হয়ত এমন ধারণা হয়েছে। কিন্তু বাবে জিবরীলের দিক দিয়ে খোলা।
প্রতি রাত্রে আল্লাহ মেহেরবান তাঁর পেয়ারা হাবীবের পাক কদমের সান্নিধ্যে এনেছেন। এবারের মদীনা শরীফের সফরে এ অনেক বড় এক সৌভাগ্য, যা জীবনের প্রথম সফরে হযরত হাফেজ্জী হুযূর (রহ) এর ওছিলায় অর্জিত হয়েছিলো, তারপর এই প্রথম। উর্দূ কবিতাটি মনে ছিলো এখন মনে পড়ছে না, না‘তের কিতাবটি কাছে ছিলো এখন দেখছি না, কবি বলছেন, ‘হে পেয়ারা হাবীব, আপনার মে‘রাজ ছিলো আসমানের উচ্চতাকে ছাড়িয়ে ছিদরাতুল মুনতাহায়; উম্মতের মে‘রাজ আপনার পাক কদমের শীতল ছায়ায়।’
কবি ও কবিতাকে সবসময় আমার বড্ড ভয়! কারণ সীমা ও সীমারেখা সম্পর্কে কবি অনেক সময় অসতর্ক হয়ে পড়ে। না‘তের কবিতায় শুধু নিবেদন যথেষ্ট নয়, অর্পণ ও সমর্পণও অপরিহার্য। নিবেদন হলো কবির নিজস্ব বিষয়, অর্পণ হলো যার জন্য কবিতা তাঁর বিষয়, আর সমর্পণ হলো যার উদ্দেশ্যে কবিতা তাঁর বিষয়। কবিতায় কবি তার মনের ভাব ও আবেগ নিবেদন করে এবং কবিতাটি প্রিয়তমের সমীপে অর্পণ করে, আর নিজেকে সমর্পণ করে পরম সত্তার উদ্দেশ্যে। তখনই তা হয় আদর্শ কবিতা, আদর্শ না‘ত।
উপরের কবিতা-পঙক্তিটির নিবেদন যেমন সুন্দর, হয়ত অর্পণ ও সমর্পণও তেমনি সুন্দর! কিন্তু এমন করে বলতে, এমন করে ভাবতে আমার কেন যেন ভয় করে। মন বলে, পেয়ারা হাবীবের পাক কদমের ছায়ায় কিছুক্ষণ শুধু বসে থাকো, কিছু বলো না, কিছু ভেবো না!
***
প্রিয় মদীনার দিন-রাতের প্রিয় সময়গুলো যেন সাদা সাদা মেঘের আকাশে ডানা মেলে উড়ে যাওয়া এক শুভ্র বলাকা। উড়ে যাচ্ছে, আর ছোট হয়ে আসছে। তুমি তন্ময় হয়ে তাকিয়ে আছো; হঠাৎ সম্বিত ফিরে পেয়ে দেখো, দূর আকাশে মিলিয়ে গেছে তোমার প্রিয় শুভ্র বলাকাটি!
শিকদার সাহেব বলেছিলেন, হুযূর, আটটা দিন আটদিনের মধ্যেই শেষ হয়ে গেলো!
হাসতে গিয়েও চোখে পানি এসে গেলো। মাঝে মধ্যে তিনি এমন করেই কথা বলতেন। ভয়ানক অসুস্থতার মধ্যে আশ্চর্য রকমের প্রাণবন্ত ছিলো তাঁর সবকিছু।
আবার যখন শিকদার সাহেবের কথা এসে গেলো, কোবার যেয়ারাতের কথা একটু বলার লোভ হলো। একদিন ভোরে ইমাম ছাহেব সবার যিয়ারাতের ব্যবস্থা করলেন। তিনি জানেন, আমার ভালো লাগে কোবার মসজিদে এবং শোহাদায়ে অহুদের যিয়ারাতে একা যেতে। যিয়ারতকারীদের সমাগম তো সবসময় একই রকম, তবু পরিচিত কেউ না থাকলে একা হতে সহজ লাগে, অন্তত আমার কাছে। ইমাম ছাহেব বললেন, তুমি তোমার মত করে যাও আমি সবাইকে যিয়ারত করিয়ে আনি।
কিন্তু শিকদার! সবাইকে লুকিয়ে ছলছল চোখে বললেন, হুযূর, হয় আমাদের সঙ্গে চলেন, না হয় আমাকে সঙ্গে নেন। চুপ করে আছি দেখে বললেন, হয়ত এটাই আমার শেষ অনুরোধ।
বললাম, আচ্ছা, আপনাদের সঙ্গেই যাই। তিনি খুশী হলেন, জাযাকাল্লাহ বললেন, আর মৃদু হেসে বললেন, সারা জীবন বলেছি ধন্যবাদ, আর থ্যাঙ্কু। এই সফরে আপনার কাছে শিখেছি, মুসলমান শুধু বলবে, জাযাকাল্লাহ!
শিকদার সাহেবের ‘হয়ত শেষ অনুরোধ’ কথাটা তখন কানে শুনেছি, কিন্তু অন্তরে অনুভব করিনি। এখন বুঝি, পুরো সফরে মাঝে মধ্যেই তার কথা যেন মৃত্যুকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে আসতো, আর তাতে মৃত্যুর ঘ্রাণ থাকতো। কিন্তু তেমন ঘ্রাণশক্তি আমাদের কোথায়!
মদীনা শরীফে আমাদের যেখানে অবস্থান তার সামনে দিয়েই গেছে কোবা সড়ক। গাড়ীতে পাঁচ মিনিটের পথ। কল্পনাও করিনি, এই পাঁচ মিনিটের পথে এবং অহুদের ময়দানে যাওয়া-আসার পথে এমন কষ্ট আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে! বহু খেজুর বাগান রীতিমত আগুন ধরিয়ে জ্বালানো হয়েছে! কিছু কিছু খেজুর-কান্ড এখনো দাঁড়িয়ে আছে আগুনে পোড়ার দাগ নিয়ে। যেন ফরিয়াদ করে বলছে, কেমন সবুজ সজীব বাগান ছিলাম! কোন কার্পণ্য তো করিনি; দু’হাতে খেজুর বিলিয়েছি তোমাদের! তবু আমার গায়ে আগুন দিলো, তবু আমাকে সারখার করে ফেললো!
নিজের অজান্তেই চোখ দু’টো ছলছল করে উঠলো, হায়, মদীনায়ও এমন যামানা এসে গেলো, খেজুরবাগানের চেয়ে অট্টালিকার মূল্য এখন অনেক বেশী। সামনে যারা আসবে তারা তো এ পোড়া বাগানও দেখতে পাবে না, দেখবে গগনচুম্বী নতুন অট্টালিকা। হয়ত দেখে মুগ্ধহবে। জানবে না, এখানে সবুজ বাগান ছিলো, শীতল ছায়া ছিলো, থোকা থোকা খেজুর ছিলো।
***
কোবার মসজিদকে ঘিরে এমন একটি শান্তসমাহিত পরিবেশ বিরাজ করে যা শুধু অনুভব করা যায়, প্রকাশ করা যায় না। কেন আসতেন এখানে আল্লাহর পেয়ারা নবী, কখনো সওয়ারিতে, কখনো পায়ে হেঁটে? কী ছিলো এখানে? যা ছিলো তা কি আছে এখনো? অন্তত তার একটু ছায়া, একটু ছোঁয়া? আল্লাহর পেয়ারা হাবীব যে তাঁর পেয়ারী উম্মতকে বলে গেছেন এখানে আসতে! দু’রাকাত ছালাত পড়তে!! কেন?! এখানে খেজুর গাছের ছায়া এত শীতল কেন! এখানে ঝিরঝির বাতাসে এত শান্তি কেন!! এখানে নামাযে মুনাজাতে কান্না এত উথলে ওঠে কেন!!! হৃদয়ের গভীরে এমন করে সান্ত্বনা আসে কেন!!!
***
প্রিয় পাঠক, এ অনুভূতিগুলো শিকদার সাহেবের! শব্দগুলো কিছু তার, কিছু আমার! তবে কলমের ব্যর্থতা এই যে, তখন তাঁর কণ্ঠস্বরে যে কম্পন ছিলো, চোখের তারায় যে ঝিলিক ছিলো, কলমের কালি তা ধারণ করতে পারেনি।
তবে ঐ জায়গাটি তোমাকে দেখাতে পারি যেখানে দাঁড়িয়ে কথাগুলো তিনি বলেছিলেন। মসজিদের একপাশে কিছু কবর আছে। হায়, কারা এ কবরের বাসিন্দা! কী নেক আমল ছিলো তাঁদের!! হযরত হাফেজ্জী হুযূর রহ. কে দেখেছি, এখানে যিয়ারত করতে, আমিও করি এবং আমার কেন জানি মনে হয়, এটা জান্নাতুল বাকী’-এরই অংশ। কবরগুলো কত আগের কে জানে! আল্লাহর পেয়ারা হাবীব যখন আসতেন তখনো কি ছিলো একটা দু’টো কবর! কোন ছাহাবীর কবর ছাড়া এমন আলোকময়তার অনুভূতি কি হতে পারে?!
দু’রাকাত নামায পড়ে, মুনাজাত করে ছোট্ট কবরস্তানটির পাশে এসে দাঁড়িয়েছি, যিয়ারত করেছি। বুঝতে পারিনি, শিকদার সাহেব কখন পিছনে এসে দাঁড়িয়েছেন! ভিতরের আবেগ মুখাবয়বেও উপচে পড়ছে। এমন উদ্ভাস, এমন আভা ও প্রভা মাঝে মধ্যেই দেখেছি তাঁর অভিব্যক্তিতে। তখন এমন করে কথা বলতেন, যেন আমাদের পরিচিত মানুষটি নন, অন্য জগতের অন্য কেউ! তার শেষ কথাটি এখনো আমার কানে বাজে, তিনি বললেন, ‘যদি কামনা করি, এখানে যাদের কবর, তাদের সঙ্গে যেন আমার হাশর হয়, তাহলে কি ভুল হবে?’
বললাম, তাঁর চেয়ে এমন করে বলুন, পেয়ারা হাবীবের ছাহাবা কেরামের সঙ্গে যেন আমার হাশর হয়।
প্রিয় পাঠক, তোমার বিরক্তি না হলে, শিকদার সাহেবের কথা আরেকটু বলি! সেটা অহুদের ময়দানে।
এবার অহুদের ময়দানে যুদ্ধের নকশাটা বড় সুন্দর করে বুঝিয়েছিলেন এক পাকিস্তানী আলেম। তিনি বোঝাচ্ছিলেন তার সঙ্গীদের, আমরাও উপস্থিত ছিলাম। সবকিছু যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছিলো তার বর্ণনায়। বিশেষ করে তিরন্দাযদের অবস্থান এবং একটি ভুলের সুযোগে ‘খালিদ বিন ওয়ালীদ’-এর ঘুরপথে এসে ঝটিকা হামলার চিত্রটি এত সুন্দর করে আগে বুঝিনি। কাছে গিয়ে বলার সুযোগ ছিলো না, দূর থেকেই বললাম, ‘আল্লাহ তোমাকে উত্তম বিনিময় দান করুন।
শিকদার সাহেব এত ভালো উর্দূ বোঝেন জানতাম না। তিনি বললেন, হুযূর, পুরো নকশাটা আমি বুঝতে পেরেছি। কেমন আদর্শ সিপাহসালার ছিলেন আমাদের পেয়ারা হাবীব! যুদ্ধের ‘হৃদপিন্ড’টাই তো ছিলো এখানে, এই তীরন্দাযদের অবস্থানক্ষেত্রে। আর এ জন্যই তিনি বলেছিলেন, আমাদের জয় হোক, বা পরাজয়, তোমরা এখান থেকে সরবে না।
সে যুগে যুদ্ধের ময়দানে সৈন্যবাহিনীর যে বিন্যাস হতো তাতে মধ্যভাগকে বলা হতো কলব বা হৃদপিন্ড। সেনাপতি সাধারণত সেখানেই অবস্থান করে যুদ্ধ পরিচালনা করতেন।
শিকদার সাহেবের তা জানার কথা নয়। কী আশ্চর্য সৃজনশীলতা, তিনি বললেন, ‘যুদ্ধের হৃদপিন্ড’!
ঘটনা এখানে নয়, আরো পরে। টিলার উঁচু স্থনটিতে দাঁড়িয়ে আমরা পাকিস্তানী আলিমের বর্ণনা শুনছিলাম। সেখান থেকে নেমে এসে সাইয়েদুশ্-শুহাদা হযরত হামযা রাদিয়াল্লাহু আনহু এবং তাঁর সঙ্গীদ্বয়ের কবর যিয়ারাত করলাম। তারপর ইমাম ছাহেব শহীদানে অহুদ এবং যুগ যুগের সমস্ত শুহাদায়ে ইসলাম ও মুজাহিদীনে ইসলামের জন্য দু‘আ করলেন, আমরা আমীন, আমীন বললাম।
এদিকে তাকাই, ওদিকে তাকাই; শিকদার সাহেব কোথায়! হঠাৎ দেখি আশ্চর্য দৃশ্য! বেশ কিছু দূরে শিকদার সাহেব খালি হাতে তলোয়ার চালাচ্ছেন। দু’চারজন কৌতূহলী মানুষও দাঁড়িয়ে গেছে। এগিয়ে গেলাম। তিনি একটু লাজিক হেসে বললেন, অহুদের ময়দানে আল্লাহর নবীর সঙ্গে যারা জিহাদ করেছিলেন তাঁদের সঙ্গে একটু সাদৃশ্য অর্জনের চেষ্টা করছিলাম।
শিকদার সাহেব মানুষটি খুব সাধারণ ছিলেন এবং খুব অসাধারণ ছিলেন। আল্লাহ তাকে জান্নাত নছীব করুন। শুহাদায়ের অহুদের সঙ্গে আমাদের সবার হাশর করুন, আমীন।
***
বিদায় সালাম আরয করার সময় হয়ে গেলো। বাবুস্-সালামের সামনে এসে দাঁড়ালাম। সব সময় যা দেখে এসেছি তাই দেখতে পেলাম। কারো চোখে খুশির ঝিলিক, কারো চোখে অশ্রুর ঝিলমিল। কারো মুখাবয়বে মিলনের আনন্দ-আভা, কারো চেহারায় বিদায়ের বিষাদ-ছায়া। এই তো সেদিন আমারো মুখে ছিলো এ আনন্দ-আভা, কিন্তু আজ!
বিষণ্ণ তন্ময়তায় কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম জানি না, একজন বলে উঠলেন, ইমশি ইয়া হাজ্! কী সতেজ কণ্ঠ! বিদায়ের সুর নয়, যেন আনন্দের সানাই! কে ভাই তুমি? কোন সুদূর থেকে এসেছো? তোমার কণ্ঠস্বর এত পরিচিত কেন মনে হলো?! ঠিক যেন পঁচিশ বছর আগের এক যুবকের কণ্ঠস্বর! নিশ্চয় তুমি আজ নওমুসাফির! যেমন ছিলো পঁচিশ বছর আগের সেই যুবক মুসাফির! পেয়ারা নবীর পাক রওযায় প্রথম হাযিরির সেই অভাবিতপূর্ব শিহরণ হৃদয়ের গভীরে মুহূর্তের জন্য যেন জেগে উঠে আবার মিলিয়ে গেলো।
ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম। কত জন যে হাতে মুখে দাড়িতে আতর লাগিয়ে দিলো। এরা কারা! আমার ভাই! কত দেশে, কত ভূখন্ডে, কত ভাষায়, কত বর্ণে ছড়িয়ে আছে আমার ভাই! আমাকে চিনতে পারে, আমি কেন চিনতে পারি না?!
দুরূদের সুমধুর গুঞ্জনটি শুরুতে ততটা স্পষ্ট হয় না। দূরত্ব যত কমে আসে, যত নিকটবর্তী হই তত যেন স্পষ্ট হয়, তত যেন মধুর করে গুঞ্জরিত হয়। শত সহস্র দুরূদ যেন একত্র হয়ে অভিন্ন এক সত্তা লাভ করেছে! সেই যে পেয়ারা হাবীব বলেছেন, ‘কাজাসাদিন ওয়াহিদিন’, অন্তত নবীর রওযায় দুরূদের মাধ্যমে উম্মত যেন তার সত্যতা প্রমাণ করছে। অভিন্ন দুরূদের এই মর্মবাণী উম্মতকে ধারণ করার তাওফীক দাও হে আল্লাহ! এখানে এই পাক মোকামে এই যে আতরের মাখামাখি, এর সুবাস-সম্প্রীতি সমগ্র উম্মতের মাঝে ছড়িয়ে দাও হে আল্লাহ! আমাদের মুখের কথায় আতরের সুবাস দাও, আমাদের কর্মে চিন্তায় আতরের সুবাস দাও।
একজন আমার কাছে আতর চাইলেন। লজ্জায় পড়ে গেলাম। আমার কাছে আতর ছিলো না। আতর নিতে হয় এবং আতর দিতে হয়, শিক্ষাটা আজ নবীর রওযায় বিদায় সালাম আরযের সময় অর্জন করলাম। আল্লাহর শোকর এ শিক্ষাটা পরে আর ভুলিনি।
আমার ভাইকে আমি আতর দিতে পারিনি। কিন্তু ভাই তো আমি একা নই। তিনচারটি ভাই আতরের শিশি বাড়িয়ে দিলেন; আমার দিকেও।
এখন বুকের সঙ্গে পিঠ এবং পিঠের সঙ্গে বুক যেন একেবারে অভিন্ন!
উম্মতের জন্য গালিচা বিছানো রাজপথটি অনেক দূর পাড়ি দিয়ে খুব কাছে এসে পড়েছি। যত কাছে আসি, বুকের সঙ্গে পিঠ এবং পিঠের সঙ্গে বুকের অভিন্নতা যেন গভীর হয়। সবক’টি হৃদয় যেন এখানে অভিন্ন স্পন্দন লাভ করে। কত ভালো হয়, হৃদয়ের এই অভিন্ন স্পন্দন যদি চিরকাল ধারণ করা যায়; এখানে যেমন তেমনি দেশে দেশে, উম্মতের প্রতিটি জনপদে! হে আল্লাহ, তোমার পেয়ারা হাবীবের রওযায় বিদায়-সালাম আরযকালে এ-ই আমার আকুতি! এ-ই আমার মিনতি!! হে আল্লাহ, ইরাকে, ফিলিস্তিন, আফগানিস্তানে, কাশ্মীরে,
তুর্কিস্তানে আমার ভাইয়ের বুকে যত গুলি বিঁধে আমার বুকেও যেন তার ব্যথা জাগে, আমার হৃদয়েও যেন রক্তক্ষরণ ঘটে।
অনেক কাছে এসে পড়েছি। ঐ যে দেখা যায়,
يا خير من دفنت
এত আলো, এত সুবাস! শুধু কি বাতির আলো! শুধু কি আতরের সুবাস! আলো যেন এখানে আরো আলোকিত! সুবাস যেন এখানে আরো সুবাসিত!!
তোমার পেয়ারা হাবীবের রাওযা থেকে আজ বিদায়কালে হে আল্লাহ, বড় আশা হয়, কিছু আলো, কিছু সুবাস সঙ্গে নেয়ার তাওফীক তুমি দেবে হে আল্লাহ! আমাকে, তোমার প্রতিটি বান্দাকে!
আহ, আমার ভাই আমার কত আপন! সালাম পেশ করার জন্য জায়গা করে দিলেন। এতক্ষণ কান্না আসেনি, এখন বুক ছাপিয়ে কান্না এলো, অশ্রু ঝরলো। বিদায়ের বেদনামিশ্রিত কণ্ঠে সালাম উচ্চারিত হলো-
الصلاة السلام عليك يا رسول الله.
তারপর সালাম হযরত ছিদ্দীকে আকবরকে, তারপর সালাম হযরত ফারূকে আ‘যমকে।
নিয়ত ছিলো, পিছিয়ে এসে কেবলামুখী হয়ে প্রাণভরে মুনাজাত করবো। সুযোগ হলো না। আসকারী কঠোরভাবে সরিয়ে দিলো। মনে কিছুটা কষ্ট হলো। কিন্তু আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্য করেন। বাইরে এসে মুনাজাত করলাম। বুকের সেই ঢেউটা তখন আর ছিলো না। হঠাৎ দেখি, একটু সামনে এক জামাত মুনাজাত করছে, আর জারজার কাঁদছে। সেই মুনাজাতে শামিল হলাম। শুধু কান্না নয়, রোনাযারি এবং আহাযারি!
‘হে আল্লাহ, আমাদের তুমি রক্ষা! তুমি ছাড়া আমাদের কোন সহায় নাই। আমাদের মুসলিম ভায়েরা আমাদের ভুলে গেছে, তুমি আমাদের ভুলে যেয়ো না হে আল্লাহ।
খুনের দরিয়া পার হয়ে তোমার ঘরে, তোমার হাবীবের কাছে এসেছি হে আল্লাহ! সেই জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডেই আবার আমাদের ফিরে যেতে হবে হে আল্লাহ! কারণ আমাদের কোন আশ্রয়ভূমি নাই হে আল্লাহ!
আমাদের ঘরবাড়ী জ্বলে পুড়ে সারখার হয়ে গেছে হে আল্লাহ! বাপ-ভাই, পুত্র-কন্যার লাশ
বে-কাফন, বে-দাফন পড়ে আছে হে আল্লাহ! হিংস্র হায়েনাদের হাতে আমাদের আব্রু-ইজ্জত ভূলুণ্ঠিত হে আল্লাহ! আমাদের ফরিয়াদ, আমাদের আর্তনাদ তুমি ছাড়া কে শোনবে হে আল্লাহ! .....
দিল-জিগর বিদীর্ণকারী এমন মুনাজাত, এমন ফরিয়াদ, এমন আর্তনাদ তাদেরই শুধু হতে পারে খুন-আগুনের তুফান যাদের উপর দিয়ে গেছে।
মযলূম মুসলমানদের জন্য অনেক দু‘আ, অনেক আহাযারি শুনেছি; নিজেও শামেল হয়েছি। কিন্তু আজ শুনেছি খোদ মযলুমানের ফরিয়াদ এবং ক্ষত-বিক্ষত হৃদয়ের আর্তনাদ!
কত আকাঙ্খা ছিলো, ইরাকের কোন মুসলিম ভাইয়ের সঙ্গে যদি দেখা হতো!
ইরাকের প্রকৃত অবস্থা জানার যদি সুযোগ হতো! আজ বিদায় সালামের পর সবুজ গম্বুজের কাছে দেখা হলো
পুরো একটি হজ্ব কাফেলার সঙ্গে। সেখানে যুবক ছিলো, বৃদ্ধ ছিলো, নারী ও পুরুষ ছিলো, কিন্তু একজনকে এমনকি একটি সালাম দেয়ারও সাহস হলো না।
ভিতর থেকে শুধু ধিক্কার আসছিলো নিজের অস্তিত্বের প্রতি, নিজের আমলদারি-দ্বীনদারির প্রতি!
তুমি মাফ করো হে আল্লাহ! তুমি তাওফীক দাও হে আল্লাহ!!
(সমাপ্ত)