খৃষ্টধর্ম না পৌলবাদ
এক. ‘ইনজীল’ : ‘ইনজীল’ শব্দটি শুনলেই মনে হয়, এটি সেই আসমানী কিতাবের নাম, যা বনী ইসরাঈলের শেষনবী হযরত ঈসা মসীহ আলায়হিস সালামের উপর নাযিল হয়েছিল। এরকম মনে হওয়াই স্বাভাবিক, যেহেতু তাঁর প্রতি অবতীর্ণ কিতাবেরই নাম ছিল ইনজীল। কিন্তু আফসোস, বনী ইসরাঈল তথা হযরত ঈসা (আ)-এর উম্মত তাদের সে পবিত্র কিতাবখানির হেফাজত করেনি, ফলে কালের গর্ভে তা এমনভাবেই হারিয়ে গেছে যে, কোথাও তার নিশানাটুকু পর্যন্ত অবশিষ্ট নেই।
এখন খৃষ্টানদের হাতে ‘ইনজীল’ নামে যে গ্রন্থ আছে, তা মূলত হযরত ঈসা (আ)-এর জীবনী। মথি, মার্ক, লূক ও ইওহোন্না-এই চার ব্যক্তি সম্পর্কে কথিত যে, তারা প্রত্যেকে আলাদাভাবে হযরত ঈসা (আ)-এর জীবনী সংকলন করেছেন। প্রত্যেকের সংকলনই ‘ইনজীল’ নামে পরিচিত। খৃষ্টসম্প্রদায় চারও ইনজীলকে আসমানী কিতাবের মর্যাদা দিয়েছে ফলে সবগুলি একত্রে একই ভলিউমে মূদ্রিত হয়ে থাকে। সুতরাং এখন ইনজীল শরীফ বললে এই চারও ‘ইনজীলে’র সমষ্টিকেই বুঝতে হবে।
দুই. উপরে বর্ণিত চারখানি গ্রন্থ ছাড়াও প্রচলিত ইনজীলে আরও ২৩খানি পুস্তিকা সংযুক্ত আছে। মোট এ সাতাশখানির সমষ্টিকে ইনজীল বলা হয়ে থাকে। শেষোক্ত পুস্তিকাসমূহের প্রথমটি হল পৌলের শিষ্য ‘লূক’-এর লেখা হযরত ঈসা (আ)-এর হাওয়ারীগণ (যারা তৎকর্তৃক দাওয়াতী কাজের জন্য প্রেরিত ছিলেন) এবং সেন্ট পৌলের প্রচারকার্যের বিবরণী। এটির নাম ‘প্রেরিত’। তারপর তেরখানি সেন্ট পৌলের লেখা বিভিন্ন স্থান ও লোকের উদ্দেশে লেখা চিঠি। উনিশ নম্বরে ‘ইবরানী’ নামক লেখাটির লেখক অজ্ঞাতনামা জনৈক ব্যক্তি। তারপর একটি চিঠি ইয়াকূবের, দুটি পিতরের, তিনটি ইওহোন্নার ও একটি এহুদার বলে কথিত। সবশেষে ‘প্রকাশিত কালাম’-এর লেখকও ইওহোন্না।
তো এসব চিঠিপত্র কিভাবে ইনজীলের অংশরূপে আসমানী কিতাবের মর্যাদা পেল তা বোধগম্য নয়। যদিও প্রথম চারখানিও আসমানী কিতাব নয় কিছুতেই।
তেইশখানি পুস্তকের সমষ্টি যে আসমানী কিতাব সেই ধারণা সৃষ্টির জন্য কুরআন মজীদের অনুকরণে এক বাক্য বা একাধিক বাক্যকে ‘আয়াত’ নামে অভিহিত করা হয়েছে। আর অধিকাংশ পুস্তকে আছে একাধিক অধ্যায়।
তিন. এ রচনায় যেসব উদ্ধৃতি উল্লেখ করা হয়েছে, তা সরাসরি বাংলাদেশ বাইবেল সোসাইটি, নিউ ইস্কাটন, ঢাকা থেকে প্রকাশিত ‘ইনজীল শরীফ’ থেকে নেওয়া। তাতে পুস্তকের নাম, অধ্যায় নং ও আয়াত নং দিয়ে দেওয়া হয়েছে, যেমন প্রেরিত ২:৩ অর্থাৎ প্রেরিত পুস্তকের দ্বিতীয় অধ্যায়ের ৩নং আয়াত। দু’-একটি উদ্ধৃতি ‘খৃষ্টধর্ম বিকৃতি : তথ্য ও প্রমাণ’-এর বরাতে কলিকাতা থেকে মুদ্রিত ‘মঙ্গলবার্তা’ নামক বাংলা ইনজীল থেকেও নেওয়া হয়েছে।
চার. হাওয়ারী : এ শব্দটি পাঠকের চোখে বারবারই পড়বে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর
সাহাবীদের মত হযরত ঈসা আলাইহিস সালামেরও কতিপয় বিশিষ্ট শীষ্য ছিল। তাঁর বিশিষ্ট শীষ্যদেরকে বলা হয় হাওয়ারী। তাদের সংখ্যা ১২ জন।
পাঁচ. সুসংবাদ : এ রচনার বিভিন্ন উদ্ধৃতিতে ‘সুসংবাদ প্রচার’ কথাটি আসবে। ‘সুসংবাদ’ বলতে ইনজীলকে বোঝায়। ইনজীল অর্থ সুসংবাদ, সুখবর, সুসমাচার। ইংরেজিতে বলে ‘গসপেল’। সুতরাং সুসংবাদ প্রচার বা সুখবরের তবলীগ বলতে ‘ইনজীলের প্রচার’ বোঝানো হয়েছে।
ছয়. যীশু খৃষ্ট : এটি হযরত ঈসা মসীহ আলাইহিস সালাম-এর পরিবর্তিত উচ্চারণ। ‘যীশু’-এর গ্রীক উচ্চারণ জিসাস, হিব্রুতে ‘যেশুয়া’ এবং আরবীতে ঈসা। আর ‘খৃষ্ট’ শব্দটি এসেছে ইংরেজি ও গ্রীক ‘ক্রাইস্ট’ থেকে। ক্রাইস্ট শব্দটি হিব্রু ‘মাসায়া’ বা ‘মোসায়া’-এর তরজমা, যাকে আরবীতে বলে ‘মসীহ’, অর্থাৎ ‘অভিষেকপ্রাপ্ত’ বা ‘পরিব্রাজক’ বা স্পর্শ দ্বারা চিকিৎসাকারী ইত্যাদি। সুতরাং যীশুখৃষ্ট হলেন ঈসা মসীহ, ইংরেজিতে ‘জিসাস ক্রাইস্ট’।
সাত. তরীকা বন্দী : এর অপর নাম ব্যাপটাইজ বা বাপ্তিস্ম (Baplism)। এটা খৃষ্টধর্ম গ্রহণকারীর জন্য অবশ্যপালনীয় প্রথা। এ ছাড়া কেউ খৃষ্টান বলে গণ্য হয় না। যে ব্যক্তি এ ধর্ম গ্রহণ করতে চায়, প্রথমে তাকে এ ধর্মের মৌলিক শিক্ষা লাভ করতে হয়। এটা তার উত্তরণ পর্ব। এ পর্বে তাকে খৃষ্টান বলা হয় না। শিক্ষা সমাপ্তির পর তাকে বিশেষ পদ্ধতিতে নগ্ন অবস্থায় পানিতে নামানো হয়। তারপর জিজ্ঞেস করা হয় সে ‘পিতা, পুত্র ও পাক রূহ-এর প্রতি বিশ্বাস রাখে কি না? তাকে বলতে হয়, হাঁ বিশ্বাস রাখি। তারপর পানি থেকে তুলে তাকে সাদা কাপড় পরিয়ে দেওয়া হয়। এই হচ্ছে তরিকাবন্দী। এর মাধ্যমে সে খৃষ্টধর্মে দীক্ষিত হয়। তাদের বিশ্বাস তরিকাবন্দীর মাধ্যমে খৃষ্টধর্মে দীক্ষিত ব্যক্তি বিগত সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত ও পবিত্র হয়ে যায় (বিস্তারিত দেখুন খৃষ্টধর্মের স্বরূপ, পৃ. ৫৫-৫৬)।
কে এই পৌল?
প্রচলিত খৃষ্টধর্মে হযরত ঈসা মসীহ আলাইহিস সালামের পর সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হলেন পৌল বা সেন্ট পল। তাঁর শিক্ষার উপরই এ ধর্মের সুবিশাল সৌধ স্থাপিত। এর অনুসারীদের কাছে প্রচলিত ইনজীলের বর্ণনা যতটা না, তারচেয়ে অনেক বেশি গুরুত্ব লাভ করেছে পৌলের পত্রাবলি ও তার প্রিয় শিষ্য ও মানসপুত্র লূকের রচনাসমূহ। কি আকীদা-বিশ্বাস, কি আচার-অনুষ্ঠান সব ক্ষেত্রে পৌলের মতামতই চূড়ান্ত কথা। ভক্তিতে তো হযরত মসীহ এবং মসীহই তাদের পরম পূজ্য, কিন্তু ধর্মাচার ও চিন্তা-চেতনায় পৌলই তাদের নির্বিকল্প আদর্শ। তা কে এই আদর্শপুরুষ, যিনি দু হাজার বছর যাবৎ বিশ্বব্যাপী দাপিয়ে বেড়ানো এ জমকালো ধর্মটির একচ্ছত্র শাসক হয়ে আছেন?
যতদূর জানা যায় তিনি এশিয়া মাইনরের লোক। সিলিসিয়া (কিলিকিয়া) জেলার অন্তর্গত তার্ষ বা তারসাস শহরে তার পরিবার বাস করত। তারা ছিল ইহুদীদের দ্বাদশ শাখার অন্যতম বিনয়ামীন গোত্রের লোক এবং ধর্মবিশ্বাসে অত্যন্ত গোঁড়া ও প্রতিক্রিয়াশীল। হযরত মুসা আলাইহিস সালামের শরীআত তথা তাওরাতের বিধিবিধান কঠোরভাবে পালন করত। এ রকম গোঁড়া ইহুদীগণ ফরীশী নামে পরিচিত ছিল।
তাঁর জন্মতারিখ ঠিক জানা যায় না, তবে তিনি হযরত মসীহ (আ)-এর জমানারই লোক। জন্মের পর তার নাম রাখা হয়েছিল শৌল এবং ধর্মান্তরের পূর্ব পর্যন্ত এ নামেই পরিচিত ছিলেন। তাওরাতের বিধান অনুযায়ী আট দিনের দিন তার খৎনা করানো হয়।
শৌল বা পৌলের জীবন বিপরীতমুখী দুই অধ্যায়ে বিভক্ত। প্রথম অধ্যায় পৃথিবীতে হযরত মসীহ (আ)-এর বর্তমান থাকাকালীন আর দ্বিতীয় অধ্যায় তার পরবর্তীকালীন।
তার জীবনের প্রথম অধ্যায়
প্রথম অধ্যায়ে তার ব্যক্তিজীবন সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু জানা যায় না। হ্যাঁ ধর্মাদর্শ সম্পর্কে তার আপন বয়ান দ্বারা প্রকাশ যে, ফরীশী-ঐতিহ্য অনুযায়ী তিনি ইহুদী ধর্মের একজন কঠোর অনুসারী ছিলেন। তিনি বলেন, ছেলেবেলা থেকে অর্থাৎ আমার জীবনের শুরু থেকে আমার নিজের দেশের এবং জেরুজালেমের লোকদের মধ্যে আমি কিভাবে জীবন কাটিয়েছি ইহুদীরা সবাই তা জানে। তারা অনেকদিন ধরেই আমাকে চেনে এবং ইচ্ছা করলে এই সাক্ষ্য দিতে পারে যে, আমাদের ধর্মে ফরীশী নামে যে গোঁড়া দল আছে আমি সেই ফরীশীর জীবনই কাটিয়েছি (প্রেরিত ২৬ : ৪-৫)। এর স্বাভাবিক অর্থ, ইহুদী ধর্ম যেমন কঠোরভাবে পালন করতেন, তেমনি এ ধর্মের বিপরীত যে কোনও ডাক ও প্রচারকেও তিনি কঠোরভাবে প্রতিরোধ করতেন ও তার দমনে জোরালো ভূমিকা রাখতেন। সুতরাং হযরত ঈসা মসীহ (আ) তাওরাতের অনুসারী একজন ইসরাঈলী পয়গম্বর হওয়া সত্ত্বেও প্রথাগত কোন-কোন বিধানে রদবদল করার দরুন আরও অনেক ইহুদীর মত শৌলও তাকে মেনে নিতে পারেননি। মেনে তো নেনইনি উপরন্তু তিনি হয়ে ওঠলেন তার ঘোরতর শত্রু। তাঁর ও তাঁর অনুসারীদের বিরুদ্ধে সম্ভাব্য সবকিছুই করতেন। কিভাবে তাদের মূলোৎপাটন করা যায় এবং চতুর্মুখী জুলুম-নিপীড়নে জীবন অতিষ্ঠ করে তোলা যায় দিবারাত্র কেবল সেই ফন্দীই আঁটতেন। এককথায় তিনি ছিলেন হযরত যিশুখৃষ্ট, খৃষ্টধর্ম ও খৃষ্টসম্প্রদায়ের জানী দুশমন। তার নিজের মুখেই শুনুন, ‘আমি নিজেই বিশ্বাস করতাম, নাসরাতের ঈসার বিরুদ্ধে যা করা যায় তার সবই আমার করা উচিত, আর ঠিক তাই আমি জেরুজালেমে করছিলাম। প্রধান ইমাম (মহাধর্মযাজক)-দের কাছ থেকে ক্ষমতা পেয়ে আমি ঈসায়ী ইমানদার অনেককে জেলে দিতাম এবং তাদের হত্যা করবার সময় তাদের বিরুদ্ধে ভোট দিতাম। তাদের শাস্তি দেবার জন্য আমি এক মজলিসখানা থেকে অন্য মজলিসখানায় যেতাম এবং ঈসার বিরুদ্ধে কথা বলবার জন্য আমি তাদের উপর জোর খাটাতাম।ও তাদের উপর আমার এত রাগ ছিল যে, তাদের উপর জুলুম করবার জন্য আমি বিদেশের শহরগুলোতে পর্যন্ত যেতাম (প্রেরিত ২৬ : ৯-১১)।
আরও বলেন, ঈসার পথে যারা চলত, আমি তাদের জুলুম করে অনেককে হত্যা করতাম আর পুরুষ ও স্ত্রীলোককে ধরে জেলখানায় দিতাম। একথা সত্যি যে, তার সাক্ষী মহাইমাম (প্রধান ধর্মযাজক)ও মহাসভার সকলেই (প্রেরিত ২২ : ৪-৫)।
তাঁর জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়
এভাবেই চলতে থাকে তার জীবনের প্রথম অধ্যায়। হযরত ঈসা (আ)-এর বর্তমানকালে এতে কোন পরিবর্তন আসেনি। তাকে আসমানে তুলে নেওয়ার (এবং পৌলীয় ধারণা অনুযায়ী তাঁকে ক্রুশবিদ্ধ করার) পরও কিছুকাল তার খৃষ্টবিরোধী তৎপরতা অব্যাহত থাকে। এ সময় একদিকে হযরত ঈসা (আ)-এর হাওয়ারী (বিশিষ্ট শিষ্যগণ) প্রাণপনে দাওয়াতী কার্যক্রম চালাতে থাকেন আর অন্য দিকে শৌল ও অন্যান্য বিরুদ্ধবাদীগণও তাদের দমননীতিতে অটল থাকে। কিন্তু সব রকম বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও হাওয়ারীগণ উত্তরোত্তর সফলতা অর্জন করতে থাকেন। তাদের মেহনতের বদৌলতে ইসরাঈলী জাতির মধ্যে খৃষ্টধর্মের ক্রমবিস্তার ঘটতে থাকে। হয়তবা অচিরেই গোটা ইহুদী সম্প্রদায় এ নতুন ধর্মকে বরণ করে নিত। এহেন বাতাবরণে খৃষ্টীয় মঞ্চের এক মহানায়করূপে ঘটে শৌলের রূপান্তরিত আবির্ভাব, যাকে এক অন্তর্ঘাতমূলক ঘটনাই বলা চলে। অর্থাৎ যখন বিরুদ্ধ প্রচার-প্রচারণায় কাজ হল না, দমন-নিপীড়ন ও সম্মুখসমরেও জেতা যাচ্ছিল না, তখন তিনি বন্ধুত্বের ছদ্মাবরণে ও ঈসায়ী লেবাস পরে ঈসায়ী ধর্মকে ধূলিসাৎ করার মিশনে অবতীর্ণ হলেন। লক্ষ্য ছিল-খৃষ্টধর্মের খোলনলচে পাল্টে হযরত খৃষ্ট (আ)-এর নামে নতুন এক ধর্মের প্রবর্তন করা এবং ইহুদী ও অইহুদী উভয়ের মধ্যে তার বিস্তার ঘটিয়ে সর্বজনীন ধর্মগুরুরূপে নিজের আসন পাকাপোক্ত করা।
সুতরাং হাওয়ারীগণের সাফল্য লাভের সেই সন্ধিক্ষণে মহাশত্রু শৌল আচমকাই তার ধর্মান্তরের ঘোষণা দেন এবং নিজেকে খৃষ্টের একজন নিবেদিত সেবকরূপে পেশ করেন। অদৃষ্টপূর্ব এ পরিবর্তন কিভাবে ঘটল তার বিবরণ শৌলের নিজ জবানীতেই শুনুন, ‘একবার প্রধান ইমামদের কাছ থেকে (ঈসার অনুসারী সকল নর-নারীকে বেধে জেরুজালেম নিয়ে আসার) ক্ষমতা ও হুকুম নিয়ে আমি দামেস্কে যাচ্ছিলাম। মহারাজ! (রাজা আগ্রিপ্পকে লক্ষ্য করে) তখন বেলা প্রায় দুপুর, পথের মধ্যে সূর্যের থেকেও উজ্জ্বল একটা আলো আসমান থেকে আমার ও আমার সঙ্গীদের চারদিকে জ্বলতে লাগল। আমরা সবাই মাটিতে পড়ে গেলাম এবং আমি শুনলাম হিব্রু ভাষায় কে যেন আমাকে বলছে, শৌল, শৌল, কেন তুমি আমার উপর জুলুম কর? কাঁটা বসানো লাঠির মুখে লাথি মেরে কি তুমি নিজের ক্ষতি করছ না? তখন আমি বললাম, প্রভু আপনি কে? প্রভু বললেন, আমি ঈসা, যার উপর তুমি জুলুম করছ। এখন ওঠো, তোমার পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াও। সেবাকারী ও সাক্ষী হিসেবে তোমাকে নিযুক্ত করবার জন্য আমি তোমাকে দেখা দিলাম। তুমি আমাকে যেভাবে দেখলে এবং আমি তোমাকে যা দেখাব তা তুমি অন্যদের কাছে বলবে। তোমার নিজের লোকদের ও অইহুদীদের হাত থেকে আমি তোমাদের রক্ষা করব। তাদের চোখ খুলে দেবার জন্য ও অন্ধকার থেকে আলোতে এবং শয়তানের শক্তির হাত থেকে আল্লাহর কাছে ফিরিয়ে আনবার জন্য আমি তোমাকে তাদের কাছে পাঠাচ্ছি; যেন আমার উপর ঈমানের ফলে তারা গুনাহের মাফ পায় এবং যাদের পবিত্র করা হয়েছে তাদের মধ্যে স্থান পায় (প্রেরিত ২৬ : ১২-১৯)।
শৌল এ ঘটনার বিবৃতিদানপূর্বক প্রভু মসীহের উপর ঈমান আনার দাবি করেন। তিনি তার আগের নামও বদলে ফেলেন। নতুন নাম গ্রহণ করেন পৌল।
নতুন ধর্মশিক্ষায় তার কর্মপন্থা
নিজ ধর্মমত ও দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের পর নতুন ধর্মের শিক্ষা ও দীক্ষা গ্রহণের জন্য সাধারণত যা করা হয়ে থাকে, পৌল কিন্তু তা করলেন না। আশা তো এ রকমই হওয়ার কথা যে, তিনি খৃষ্টধর্মের শিক্ষাগ্রহণের জন্য এ ধর্মের যারা সর্বাপেক্ষা বড় আলেম, হযরত মসীহ (আ)-এর সরাসরি হাতেগড়া সেই হাওয়ারী ও শিষ্যবর্গের কাছে ছুটে যাবেন এবং তাদের কাছ থেকে এ ধর্ম সম্পর্কে সুস্পষ্ট ও পূর্ণাঙ্গ শিক্ষাগ্রহণ করবেন। তিনি কিন্তু সে রকম কিছুই করলেন না। কারও সঙ্গে এ বিষয়ে পরামর্শ পর্যন্ত করলেন না; বরং তিনি হাওয়ারীদের প্রভাববলয়ের বাইরে দক্ষিণ দামেস্কে চলে গেলেন এবং সেখানে টানা তিন বছর নিভৃত জীবন যাপন করলেন। গালাতীয়দের কাছে লেখা চিঠিতে তিনি বলেন, ...‘আল্লাহ যখন তাঁর ইচ্ছা অনুসারে তাঁর পুত্রকে আমার কাছে প্রকাশ করলেন তখন আমি কোন লোকের সঙ্গে পরামর্শ করিনি। এমনকি যারা আমার সঙ্গে সাহাবী হয়েছিলেন আমি জেরুজালেমে তাদের কাছেও যাইনি। আমি তখন আরব দেশে চলে গিয়েছিলাম’। (গালাতীয় ১:১৬-১৭)।
তার এই ব্যতিক্রমী কর্মপন্থার রহস্য কী? সে রহস্য উন্মোচনের জন্য পৌলের নিম্নোক্ত উক্তিসমূহ লক্ষণীয়,
* আল্লাহ আমার জন্মের সময় থেকেই আমাকে নিযুক্ত করে রেখেছিলেন এবং তারই রহমতে সাহাবী হওয়ার জন্য আমাকে ডেকেছিলেন (গালাতীয় ১ : ১৫)।
* আমি যে সুসংবাদ তবলীগ করছি তা কোন মানুষের বানানো কথা নয়। আমি কোন মানুষের কাছ থেকে তা পাইনি বা কেউ আমাকে তা শেখায়নি; বরং ঈসা মসীহ নিজেই আমার কাছে তা প্রকাশ করেছিলেন (গালাতীয় ১ : ১১-১২)।
* জামাতের গণ্যমান্য লোকেরা সুসংবাদ বিষয়ে নতুন কোন কিছুই আমাকে জানাননি। আসলে তারা যাই হোক না কেন তাতে আমার কিছু যায় আসে না (গালাতীয় ২ : ৬)।
* আমি কি স্বাধীন নই? আমি কি সাহাবী নই? আমাদের হযরত ঈসাকে কি আমি দেখিনি? প্রভুর জন্য আমি যে কাজ করেছি তোমরা কি তারই ফল নও? (১-করিন্থীয় ৯ : ১)।
* মসীহের বিষয়ে শিক্ষা দেওয়ার লোক হয়ত তোমাদের হাজার হাজার থাকতে পারে, কিন্তু পিতা তোমাদের অনেক নেই। আমিই সুসংবাদের মধ্য দিয়ে ঈসায়ী জীবনে তোমাদের পিতা হয়েছি (১ করিন্থীয় ৪ : ১৫)।
* আমার তো মনে হয় না আমি কোন দিক দিয়ে ঐসব বিশেষ সাহাবীদের চেয়ে পিছনে পড়ে আছি। যদিও আমি খুব ভালো করে কথা বলতে পারি না, তবুও আমার যথেষ্ট জ্ঞান আছে (১ করিন্থীয় ১১ : ৫, ৬)।
* আল্লাহর কাছ থেকে যে বিশেষ রহমত আমি পেয়েছি তার দ্বারাই ওস্তাদ রাজমিস্ত্রির মত আমি ভিত্তি গেঁথেছি আর তার উপরে অন্যেরা দালান তৈরি করেছে (১-করিন্থীয় ৩ : ১০)।
তার এসব কথা আমাদেরকে যে বার্তা দেয় তা নিম্নরূপ,
১. জন্মের আগে থেকেই তিনি আল্লাহ কর্তৃক ঈসা মসীহের সাহাবী ও ধর্মপ্রচারকরূপে মনোনীত।
২. তাঁর প্রচারিত ধর্মাদর্শ মসীহ (আ) স্বয়ং তাকে শিক্ষা দিয়েছিলেন।
৩. যেহেতু স্বয়ং মসীহ কর্তৃক শিক্ষাপ্রাপ্ত, তাই কোন মানুষের কাছ থেকে তার শিক্ষাগ্রহণের কোন প্রয়োজনবোধ হয়নি। হোক সে মানুষ সরাসরি মসীহের শিষ্য ও তাঁর হাতেগড়া।
৪. একই কারণে ঈসায়ী জামাতের কোন লোক তার কাছে ভ্রূক্ষেপযোগ্য ছিল না, তিনি যতই গণ্যমান্য হোন।
৫. হযরত মসীহের বর্তমানকালে ঘোরশত্রু হওয়া সত্ত্বেও (খৃষ্টীয় বিশ্বাস অনুযায়ী) তাঁর মৃত্যুর পর কথিত অলৌকিক সাক্ষাতকারের মাধ্যমে এক লহমায় তিনি কেবল একজন সাহাবীই নয়; বরং জীবদ্দশার সাহাবীগণকে ছাড়িয়ে এ ধর্মের পিতৃত্বের মর্যাদায় পৌঁছে যান।
৬. আল্লাহ ও মসীহের কল্যাণ-করুণায় তিনি দক্ষ রাজমিস্ত্রির মত এ ধর্মের ভিত্তিস্থাপন করেন, যার উপর অন্যেরা ধর্মের দালান গাঁথে।
হাওয়ারীদের থেকে শিক্ষাগ্রহণ না করার কারণ
এর দ্বারা আমরা দুটি জিজ্ঞাসার জবাব পেয়ে যাই। প্রথম জিজ্ঞাসা ছিল তিনি ধর্মান্তরের পর মসীহ (আ)-এর প্রত্যক্ষ শিষ্যদের কাছ থেকে খৃষ্টধর্মের সবক নিলেন না কেন? উত্তর সহজ। যিনি আল্লাহ তাআলা কর্তৃক মনোনীত ও খোদ খৃষ্ট কর্তৃক শিক্ষাপ্রাপ্ত হয়ে এ ধর্মের পিতৃত্বের আসনে পৌঁছে গেছেন এবং জাতির পিতা হিসেবে এ ধর্মের ভিত্তি স্থাপনের গুরু মতলবে আছেন তার তো হাওয়ারীগণসহ অন্য কোন খৃষ্টীয় ধর্মজ্ঞের কাছ থেকে এ ধর্মের সবক নেওয়ার কথা নয় এবং নেওয়া যুক্তিযুক্তও নয়; বরং অন্য সকলেরই কর্তব্য হবে তার থেকে শিক্ষা নিয়ে সে অনুযায়ী নিজেদের ধর্মমতকে পুনর্বিন্যস্ত করা।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কোন নবীর
অন্তর্ধানের পর তার চিরদিনের শত্রু কিংবা পরম মিত্রও যদি তাঁর সঙ্গে অলৌকিক সাক্ষাতকারের দাবিতে এমন কোন শিক্ষা প্রচার করে, যা সেই নবীর নিজের প্রবর্তিত এবং তার হাতে গড়া শিষ্যদের কর্তৃক প্রচারিত শিক্ষার সম্পূর্ণ বিপরীত তবে তা কতটুকু বিশ্বাসযোগ্য এবং এমনটা ঘটা বাস্তবে কতটুকু সম্ভব?
এটা সম্ভব হলে যে কোন নবীর নবুওয়াত ও নবুওয়াতী শিক্ষা একদম খেলো হয়ে যায়। এক একজন খেলোয়াড় আসবে আর এইমত দাবি করে সেই নবীর নামে নতুন শিক্ষার প্রচার শুরু করে দেবে আর এভাবে অগণ্য শিক্ষার ডামাডোলে সেই নবীর আসল শিক্ষাই লোপাট হয়ে যাবে। তখন তো নবুওয়াত মানুষের পক্ষে হিদায়াত ও রহমতের বিষয় থাকবে না; বরং মানব-অস্তিত্বের পক্ষেই এক মহামসিবত হয়ে দাঁড়াবে। খোদ খৃষ্টান জাতিকেও তো এজন্য কম যন্ত্রণা পোহাতে হয়নি। হাওয়ারীগণের সঙ্গে দ্বন্দ্ব থেকে শুরু করে পরবর্তী কয়েক শতাব্দীকাল পর্যন্ত এ জাতিকে হযরত ঈসা (আ)-এর মূল শিক্ষা ও পৌলীয় শিক্ষার সংঘর্ষে পেষাই হতে হয়েছে (বিস্তারিত জানার জন্য শায়খুল ইসলাম তাকী উছমানী কৃত ‘খৃষ্টধর্মের স্বরূপ’ বইখানি দেখুন।)
বস্ত্তত হযরত মসীহ (আ)-এর সাথে অলৌকিক সাক্ষাতের মাধ্যমে খৃষ্টধর্মের শিাগ্রহণ ও এ ধর্মের বিশেষ মর্যাদালাভের যে দাবি পৌল করেছেন তা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক ও অবাস্তব। তার এ দাবি মেনে নেওয়ার অর্থ তাকে একজন স্বতন্ত্র নবী ও রাসূলরূপে স্বীকার করে নেওয়া, যার মাধ্যমে হযরত মসীহ (আ)-এর রেখে যাওয়া দীন ও শিক্ষা রহিত হয়ে গেছে। যদি হযরত মসীহ (আ)-এর জীবদ্দশায় প্রচারিত ধর্ম তার পরবর্তীকালে তাঁর নামে প্রচারিত ধর্ম দ্বারা রহিত হয়ে যাওয়ার কথা থাকে, তবে সে সম্পর্কে স্বাভাবিকভাবেই তার ভবিষ্যদ্বাণী করে যাওয়ার কথা ছিল। এই আগাম খবর দিয়ে যাওয়া দরকার ছিল যে, ‘তাঁর পরে ‘পৌল’ নামে এক ‘বৈপ্লবিক রাসূল’-এর আবির্ভাব ঘটবে, তাঁর উম্মত যেন তাঁকে মেনে নেয়। কিন্তু সেরকম কোন সংবাদ তো দূরের কথা, কোন ইশারা-ইংগিত পর্যন্তও যখন তিনি করে যাননি, তখন এ অস্বাভাবিক পৌলীয় দাবিকে মেনে নেওয়ার কোন বৈধতা থাকতে পারে না। (এ সম্পর্কে বিস্তারিত দ্র. খৃষ্টধর্মের স্বরূপ, পৃ. ১০৫; মাওলানা আবদুল মতীন, খৃষ্টধর্ম বিকৃতি : তথ্য ও প্রমাণ, পৃ. ২৫-২৭)
(চলবে ইনশাআল্লাহ)