বে দ না : হৃদয়ে রক্ত ঝরে
ইসরাঈলী বংশোদ্ভূত এক ইহুদী মার্কিন নাগরিক ভয়ংকর কান্ডটি ঘটিয়েছে। এক বছর অগে সে একটি ফিল্ম বানিয়েছে। ‘ইনোসেন্স অব মুসলিম’ নামের ওই ফিল্মে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে আরো কয়েকজন সাহাবী ও সাহাবিয়ার চরিত্র সে দাঁড় করিয়েছে। পুরো ফিল্মে নবীজীর ব্যক্তিজীবন ও ইসলামের গোটা আদর্শকে ন্যাক্কারজনকভাবে হিংস্র ও অনৈতিক কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করে দেখিয়েছে। বছর খানেক আগের ওই ফিল্মটির খবর কেউ জানতো না। কিন্তু এবারের ৯/১১ বার্ষিকীতে সে ফিল্মের কিছু ট্রেলার (প্রধান প্রধান দৃশ্য) ইন্টারনেটের ইউটিউবে ছেড়ে দেওয়া হয়। এরপরই প্রকাশ পেতে শুরু করে ক্ষুব্ধ মানুষের প্রতিক্রিয়া। মানবতার নবীর চরিত্রে কলঙ্ক লেপন আর ইসলামের চরম অবমাননাকর ওই ফিল্মের কারণে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন আর দ্রোহে ফেটে পড়েন কোটি কোটি মুসলমান।
১১ সেপ্টেম্বর রাতেই লিবিয়ার বেনগাজিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কনসুলেট ভবনে বিক্ষুব্ধ মানুষেরা হামলা চালায়। এতে লিবিয়ায় মার্কিন রাষ্ট্রদূতসহ চারজন নিহত হয়। হামলা চালানো হয় মিসর, তিউনিসিয়া ও ইয়েমেনের মার্কিন দূতাবাসে। ইরান, মরক্কো, সুদান, ফিলিস্তিন, পাকিস্তানসহ দেশে দেশে বিক্ষুব্ধ মুসলমানরা রাস্তায় নেমে আসেন। প্রতিবাদ ও ক্ষোভের এই উত্তাল সাগর রুখে দিতে গেলে দেশে দেশে এ পর্যন্ত প্রায় ৩০ জনের মতো মুসলমান শহীদ হন। বাংলাদেশেও গত ১০ দিন ধরে ঢাকাসহ দেশের প্রায় প্রতিটি উপজেলায় মিছিল-বিক্ষোভ চলছে। হাজার হাজার মুসলমান তাতে অংশ নিচ্ছেন। দেশের প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেত্রী ন্যাক্কারজনক এই ফিল্মের প্রতিবাদ জানান। এরই মধ্যে অপর কয়েকটি দেশের মত বাংলাদেশেও ওই ফিল্মের ট্রেলার সংবলিত ইন্টারনেটে-র সার্চ প্রোগ্রাম-ইউটিউব বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
কিন্তু এতসব কিছুর পরও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ওই শয়তানী ফিল্মটি পুরোপুরি বন্ধ করা এবং ফিল্মের পরিচালককে শাস্তি দেওয়ার ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। মার্কিন প্রশাসনের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে-তাদের দেশের আইন অনুযায়ী এ ক্ষেত্রে কিছু করার নেই। তারা তথাকথিত ‘বাকস্বাধীনতার’ দোহাই দিয়ে বলেছে, ফিল্মটি বন্ধ করা যাবে না। মার্কিনীরা যা করেছে তা হলো তাদের রাষ্ট্রদূত নিহত হওয়া দেশ-লিবিয়ায় যুদ্ধজাহাজ পাঠিয়ে দিয়ে হামলাকারীদের কঠোর বিচারের অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে। এবং দেশে দেশে মার্কিন কূটনীতিকদের নিরাপদে রাখার বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। এরই মধ্যে লস অ্যাঞ্জেলসের একটি এপার্টম্যান্ট থেকে ওই ফিল্মের পরিচালককে ধরে আনার একটি মুখঢাকা ছবি গণমাধ্যমে একবার প্রচার করা হলেও দু’দিন পর জানা গেছে, জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তার পরিবারের লোকদেরও নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। লস অ্যাঞ্জেলসের এক আদালতে ওই ফিল্মে অভিনয় করা এক নারী অভিযোগ করে বলেছে, তার সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে। ফিল্মের বিষয়বস্ত্ত যে এত ভয়ংকর ও বেদনাদায়ক-এটা সে জানতো না। তাই ওই ফিল্ম বাজেয়াপ্ত করা হোক এবং ইউটিউব থেকে তা প্রত্যাহার করতে বাধ্য করার নির্দেশ দেওয়া হোক। কিন্তু আদালত তার আবেদনকে নাকচ করে দিয়ে বলেছে, ইউটিউব থেকে ওই ফিল্ম প্রত্যাহার করতে নির্দেশ দেওয়া হবে না। মূলত ইসলাম ও ইসলামের নবীর প্রতি অবমাননাকর এই ফিল্মের ব্যাপারে ফিল্মের নির্মাতা থেকে নিয়ে মার্কিন প্রশাসন ও বিচারবিভাগের অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি-ই সামনে চলে এসেছে। তারা মুখে সবাই ‘বাকস্বাধীনতা’ ও ‘ভিন্নমত’-এর প্রতি সম্মাননার দোহাই দিচ্ছে। কিন্তু মতলবের গোড়ায় সেই ঘৃণ্য মানসিকতার সবই লালন করছে।
সম্প্রতি বৃটিশ প্রিন্স উইলিয়াম ও তার স্ত্রী কেটের আপত্তিকর কিছু ছবি ফ্রান্সের এক ম্যাগাজিনে প্রকাশ করা নিয়ে হৈ চৈ হয়। এতে মামলাও করা হয়। মামলায় মাগাজিন কর্তৃপক্ষকে দোষী সাব্যস্ত করে রায় দেওয়া হয়। ওই ছবি প্রত্যাহার করে নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়। পশ্চিমা সমাজ ও গণমাধ্যমের কাউকে ওই ঘটনায় গণমাধ্যম ও বাকস্বাধীনতার দোহাই দিয়ে ছবিগুলো প্রদর্শণের পক্ষে মত দিতে দেখা যায়নি। অথচ ‘ইনোসেন্স অব মুসলিম’ নামের চূড়ান্ত মিথ্যাচারিতাপূর্ণ ও অবমাননাকর জঘন্য ছবিটির ব্যাপারে তারা ‘বাকস্বাধীনতা’ রক্ষায় মরিয়া হয়ে উঠেছে।
একই ঘটনা তারা সালমান রুশদির ‘স্যাটানিক ভার্সেস’ প্রকাশের সময়ও ঘটিয়েছিল। গোটা পৃথিবী প্রতিবাদ জানালেও তারা ওই বইটি নিষিদ্ধ কিংবা প্রত্যাহার করে নিতে রাজি হয়নি। মানবতার নবী মহানবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, ইসলামের আদর্শ ও কুরআনে কারীমের বিষয়ে বিশ্বমোড়ল খ্রিস্টান-ইহুদী চক্র বরাবরই একরকম সুরে কথা বলে থাকে। একই অবস্থান থেকে কাজ করে থাকে। এসব ক্ষেত্রে শেষ পর্যন্ত এটাই প্রতীয়মান হয় যে, এই সব ন্যাক্কারজনক ঘটনার মূল নায়ক ওই সব দেশের কর্ণধার, বিচার বিভাগ, গণমাধ্যম, সুশীল শ্রেণী আর মূল ধারার নাগরিকদের চিন্তা ও সিদ্ধান্ত সব সমশ্রেণীর। এদের জন্য প্রতিবাদ, যুক্তি, জবাব কিংবা তর্ক কোনো সমাধান হয় না। তারা সমাধানের একটা ভাষাই বুঝে, অন্যগুলো তারা বুঝতে চায় না।
পাকিস্তানের বর্তমান রেলমন্ত্রী ওই ফিল্মের নির্মাতার মাথার মূল্য ঘোষণা করেছেন, এক লাখ মার্কিন ডলার। এ ঘোষণা নিয়ে ওই দেশের সরকারে বসে থাকা দুর্বলচিত্ত ও দুর্নীতিগ্রস্ত কর্তারা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেও ওই মন্ত্রী বলেছেন, এ ধরনের ঘোষণা প্রচলিত আইনে অপরাধ সাব্যস্ত হতে পারে-এটা আমি জানি। তারপরও এ অপরাধ করতে আমি প্রস্ত্তত। কারণ, আমি ইসলাম ও ইসলামের নবীর অবমাননার কষ্ট সহ্য করতে পারছি না।
আমরা মনে করি না, ওই মন্ত্রী কোনো ভুল কথা বলেছেন। একজন মুসলমানের ন্যূনতম আবেগের স্তর এরকম হতে বাধ্য। আমরা তার আবেগকে সম্মান জানাই। এবং পশ্চিমা কর্তা ও দেশে দেশে তাদের তাবেদার অনুকর্তাদের বলি, ওই মন্ত্রীর ঘোষণা এবং এ জাতীয় আরও ঘোষণাকে ‘বাকস্বাধীনতা’ হিসেবে গ্রহণ করুন। একে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা ‘বাকস্বাধীনতা’ হরণেরই নিকৃষ্ট নজির হয়ে দাঁড়াবে।
দুনিয়ার দেশে দেশে প্রগতিশীল সাংবাদিক হিসেবে পরিচিত পাকিস্তানের হামিদ মীরের একটি উক্তি তুলে ধরা দরকার মনে করি। তিনি বলেছেন, উসামা বিন লাদেনের কর্মকান্ডকে যদি সন্ত্রাস হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়-তাহলে এ ফিল্মটি হচ্ছে তার চেয়ে হাজার গুণ বড় সন্ত্রাস। উসামার হাতে হয়তো কিছু লোকের মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু এ ফিল্মটি শত কোটি মুসলমানের হৃদয়ে রক্ত ঝরিয়ে চলেছে। আর নেতৃত্ব দিচ্ছে আমেরিকা। সুতরাং আমেরিকা শত কোটি মানুষের হৃদয়ে রক্ত ঝরানোর মতো একটি মহা সন্ত্রাসে পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে।’
আমাদের মনে হয়েছে, হামিদ মীর কথাটা যথার্থ বলেছেন।