রোযনামচার একটি পুরানো পৃষ্ঠা : শরৎ-সাহিত্যের দু’টি সমালোচনা
কিছুদিন আগে বাইতুল মুকাররমের সামনে থেকে একটি পুরানো বই কিনেছিলাম। বইটির নাম ‘শরৎচন্দ্র’। প্রচ্ছদের উপরের অংশে শরৎচন্দ্রের ছবি, নীচের দিকে লেখা ‘শরৎসাহিত্যের আলোচনা’। বইটি মোট পনেরটি পরিচ্ছদে বিভক্ত। পৃষ্ঠাসংখ্যা ২০৮। শেষ তিন পৃষ্ঠায় একটি সংক্ষিপ্ত নির্ঘণ্ট আছে। বইটির লেখক ড. সুবোধ চন্দ্র সেন।
এবারের পুষ্পে (রবিউল আওয়াল ১৪৩২ হি.) শরৎচন্দ্রের ‘চরিত্রহীন’ উপন্যাসের উপর একটি সমালোচনা প্রকাশিত হয়েছে। সমালোচনাটি পাঠ করার পর ড. সেনের বইটি খুঁজে বের করলাম এবং পাতা উল্টাতে লাগলাম। শরৎচন্দ্রের সাহিত্যকর্মের বিশেষ কিছু দিক নিয়ে বইটিতে আলোচনা করা হয়েছে। সিংহভাগ আলোচনা বিভিন্ন উপন্যাসের চরিত্র-বিশ্লেষণ সংক্রান্ত। এই আলোচনাগুলো নিঃসন্দেহে মূল্যবান, কিন্তু প্রাথমিক পর্যায়ের সাহিত্য চর্চাকারীর এখান থেকে নেওয়ার মতো বিষয় সামান্য। অন্তত আমার তাই মনে হয়েছে। এরপরও ভাষা প্রাঞ্জল হওয়ায় বইটির বেশ কিছু অংশ পড়েছি এবং যে কথাটি পেতে চাইছিলাম তার জন্য শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করেছি।
সমালোচনার সারসংক্ষেপ হচ্ছে, একজন সফল ঔপন্যাসিক তার উপলব্ধিকে ভাষা দিয়েছেন, পাঠকের পাঠ-প্রবণতা পরিতুষ্ট হয়েছে এবং পাঠক আনন্দ লাভ করেছেন। অতপর সমালোচক উপন্যাসের কলকব্জাগুলো খুলে খুলে দেখিয়েছেন। কিন্তু যা খুঁজছিলাম তা পেলাম না।
এক জায়গায় বরং বলা হয়েছে, ‘কিন্তু রিরংসাবিরোধী হইয়াও শরৎচন্দ্র প্রণয়ের গৌরব ঘোষণা করিয়াছেন। শ্রীকান্ত দুঃখ করিয়া বলিয়াছিল যে, বিশ্বের লোক তাহার পরাজয়টাই বড় করিয়া দেখিল। কিন্তু তাহার অম্লানকান্ত বিজয়মাল্য কাহারো চোখে পড়িল না। প্রেমের এই অম্লান দীপ্তি শরৎসাহিত্যে প্রতিভাত হইয়াছে। সুরেশ ও কিরণময়ীর জীবনে প্রকৃত মাধুর্য ছিল খুব কম। কিন্তু তাহাদের জীবনও শরৎচন্দ্র সমবেদনা দিয়া উপলব্ধি করিবার চেষ্টা করিয়াছেন। তিনি দেখাইয়াছেন যে, তাহাদের অপরাধ শুধু বুঝিবার ভুল, পাপ নহে। তিনি তাহাদিগকে পাপী বলিয়া ঘৃণা করেন নাই, ভ্রান্ত বলিয়া করুণা করিয়াছেন। মানুষের অন্তরতম অন্তস্তলে যে আকাঙ্খা নীড় বাঁধিয়াছে তাহাকে অস্বীকার করিবার চেষ্টা মূঢ়তা। শরৎচন্দ্রের রচনায় অশ্লীলতার মূল হইতেছে এইখানে ... মানুষের ভ্রান্তি-দুর্বলতার জন্য তাহার অফুরন্ত দরদ। পৃষ্ঠা : ১৪৮
এদিক থেকে পুষ্প-সম্পাদকের মূল্যায়ন সুসংক্ষিপ্ত ও বাস্তবসম্মত। তিনি লিখেছেন, ‘দীর্ঘ আলোচনার তো অবকাশ নেই, শুধু বলা যায়, বইটিতে চরিত্রহীনতার যথেষ্ট উপাদান রয়েছে এবং চরিত্রহীনতার প্রতি একটি সদয় ও সহনশীল অনুভূতি জাগ্রত করার চেষ্টা করা হয়েছে।’
এই চেষ্টায় যে শরৎ অনেকটাই সফল তার প্রমাণ ড. সেনের বইয়ের পাতায় পাতায় রয়েছে। কিন্তু এ জাতীয় চেষ্টার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কী হতে পারে সে সম্পর্কে ঐ বইয়ে কিছু বলা হয়নি। এই দিকটির মূল্যায়ন ছাড়া সমালোচনা পূর্ণাঙ্গ হয় কি না ভেবে দেখা দরকার।
পুষ্প-সম্পাদক লিখেছেন, ‘কিন্তু আমার যে ভারি আশঙ্কা, বড় একটা ভুল বার্তাই পাঠক বইটি থেকে গ্রহণ করবে এবং চরিত্রহীনতার প্রতি প্রচ্ছন্ন উৎসাহই লাভ করবে, যা আপনি নিশ্চয়ই কামনা করেন না।’
লেখাটিতে চরিত্রহীন উপন্যাসের একটি অনুচ্ছেদের সাহিত্যগত আলোচনাও করা হয়েছে। ড. সেনও তার বইয়ের এক জায়গায় এই বিষয়ে কিছু আলোকপাত করেছেন। তিনি লেখেন, ‘শরৎচন্দ্রের স্টাইল বা রচনারীতির মাধুর্য উচ্চপ্রশংসা লাভ করিলেও তাহার রচনায় বহু দোষও আছে। ‘কিন্তু’র আতিশয্য, ‘অন্তর্যামী’র ছড়াছড়ি, ‘এমনি হয়’, ‘এমনি বটে’ প্রভৃতির পুনরুক্তি সকলেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করিবে। অবশ্য এইরূপ কোনো শব্দ বা পদের আতিশয্য লেখকের মুদ্রাদোষ। ইহাকে রচনার মৌলিক ত্রুটি মনে করিলে গৌণ লক্ষণকে প্রাধান্য দেওয়া হইবে। (প্রাথমিক পর্যায়ের সাহিত্য চর্চাকারীদের জন্য এই মূল্যায়নের একটা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে, যা তাদের লেখার ভবিষ্যতের জন্য ক্ষতিকর।) শরৎচন্দ্রের রচনার প্রধান গুণ তাহার সুস্পষ্টতা ও বাস্তবপ্রিয়তা। কখনো কখনো তিনি কোনো ভাবকে প্রত্যক্ষ করিতে যাইয়া তাহাকে অতিরিক্ত প্রাধান্য দিয়াছেন। অথবা কোনো চিত্রকে বাস্তব করিতে যাইয়া উদ্ভট করিয়া ফেলিয়াছেন। দৃষ্টান্তস্বরূপ নিম্নলিখিত বাক্যগুলো উল্লেখ করা যাইতে পারে : ‘আমার সমস্ত মন উন্মত্ত উর্ধ্বশ্বাসে তাহার পানে ছুটিয়াছে।’ উর্ধ্বশ্বাসের উন্মত্ততা কষ্টকল্পনা। ...
লেখক এ বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেছেন। (পৃষ্ঠা : ১৮৬-১৯১)
কিন্তু এই দীর্ঘ আলোচনাকে পুষ্পের আলোচনার সাথে মিলিয়ে পাঠ করলে কয়েকটি বিষয় পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে। প্রথম বিষয়টি হচ্ছে পুষ্প-সম্পাদকে ভাষার মাধুর্য। তিনি চরিত্রহীন উপন্যাসের দুটি মারাত্মক ত্রুটির কথা বলেছেন, কিন্তু ভাষার শালীনতা কোথাও এতটুকু ক্ষুণ্ণ হয়নি। আর দ্বিতীয় বিষয়, আলোচনার পূর্ণাঙ্গতা। ড. সেনের আলোচনায় একটি জিনিসের অভাব
অনুভূত হয়, তা হচ্ছে বিকল্প দৃষ্টান্ত। ‘এই বাক্যটি ত্রুটিপূর্ণ’ বললে অর্ধেক বলা হয়। এর সাথে যদি থাকে ‘এই ভাবে বলা যেতে পারে’ তাহলে গোটা বিষয়টি উপলব্ধি করতে এবং গ্রহণ করতে সুবিধা হয়।
এ প্রসঙ্গে আরেকটি
কথাও বলা যায়, তা হচ্ছে সাহিত্য-সমালোচনারও নিশ্চয়ই শাস্ত্রীয় ব্যাকরণ আছে, তবে সাহিত্যচর্চায় সফর যাদের সবেমাত্র শুরু, তাদের জন্য চিন্তার মৌলিক সূত্রগুলো
এখনও বোধ হয় বিন্যস্ত হয়নি। রসিক-সমঝদার তো নিজ গুণে রসের বিচার করেন, কিন্তু বিচারের আইন-কানুনগুলো সাধারণত আলোচনা করেন না। এদিক থেকে ‘এসো কলম মেরামত করি’র বিশিষ্টতা লক্ষণীয়।
১১.২.১১ ঈ.