প্র যু ক্তি : নেতিবাচকতা থেকে বাঁচতে হবে
তথ্য ও যোগযোগের কলা-কৌশল ও প্রযুক্তি এখন বেশ উন্নত। কথাটা খুব বড় করে উচ্চারণও করা হয়। মুখভরা-পেটভরা একটা অভিব্যক্তি নিয়ে তথ্যপ্রযুক্তির আবেদন-অবদান তুলে ধরা হয়। কিন্তু উন্নত এ প্রযুক্তির বাছ-বিচারহীন ব্যবহার যে সমাজে কত বড় অন্ধকার নিয়ে আসছে- সে দিকটির প্রতি সহসাই কারো চোখ যেতে চায় না। যারা সচেতন, তারা আঙুল তুলে বিষয়টা দেখাতে চান। তাদের কথা লোকে শুনতে চায় না। সেসব কথায় সেকেলে পিছুটানের গন্ধ পেয়ে নাক কুঁচকে থাকেন। তথ্য-প্রযুক্তির অবাধ ব্যবহারের পক্ষে অনঢ় অবস্থান ধরে রাখেন। অথচ এসব উন্নাসিকতা ও অনঢ় অবস্থানের বিরুদ্ধে মারাত্মক পিলে চমকানো একটি চিত্র তুলে ধরা হয়েছে গত ৩১ জুলাই প্রকাশিত ঢাকার একটি প্রসিদ্ধ দৈনিক পত্রিকার ৯-এর পাতায়। বিষয়টি খোলাসা করেই বলা যাক।
আট কলাম জুড়ে ছাপা হওয়া প্রতিবেদনটির শিরোনাম দেয়া হয়েছে-‘শাস্তি না হওয়ায় বাড়ছে যৌন অপরাধ।’ শিরোনামে বিষয়টি পুরোপুরি পরিষ্কার হয়নি। আসলে সব বয়সীদের প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে এতে শুধু শিশু-কিশোরদের বিভিন্ন যৌন অপরাধ, যৌন দুর্ঘটনা ও বিশৃঙ্খলার বিষয় এবং তার কার্যকারণ ও অশুভ ফলাফল তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনটির কয়েকটি প্যারা আমরা দেখতে পারি। ‘... একজন স্কুলছাত্রী জানায়, কিছু দিন আগে পর্যন্ত কার্টুন দেখা ছাড়া তার অবসর কাটানোর উপায় ছিল না। সম্প্রতি সে তার বন্ধুদের কাছ থেকে পর্নোগ্রাফি সম্পর্কে জানতে পেরেছে। তার কিছু বন্ধু ব্লু-টুথ ব্যবহার করে তাকে কিছু ভিডিওচিত্র দেখিয়েছে। অপর এক ছাত্র জানায়, তারা বন্ধুদের কাছ থেকে পর্নোসাইটের খোঁজ পায় এবং ডিভিডি বিনিময় করে।’
‘... কিছু ছাত্রছাত্রী বলেছে, তারা ইন্টারনেটের মাধ্যমে পর্নোছবির খোঁজ করে এবং পর্নো ওয়েবসাইটগুলোতে যায়। এদের অনেকে সাইবার ক্যাফেতে গিয়ে পেনড্রাইভে ছবি নিয়ে এসে বাসায় লুকিয়ে কম্পিউটারে দেখে।’
‘... ঢাকার বেশ কিছু জায়গায় প্রকাশ্যে সিডি-ডিভিডি বিক্রেতারা অপ্রাপ্তবয়স্কদের কাছেও পর্নো সিডি ও ডিভিডি বিক্রি করে। বিভিন্ন সিনেমা হলের সামনে শিশুদের দিয়ে এসব সামগ্রী বিক্রি করানো হচ্ছে।’
প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা হয়েছে, গত বছরের নভেম্বরে একটি এনজিও ‘প্রযুক্তি’ শিরোনামে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ওই গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পর্নোগ্রাফি দেখার কারণে শিশুরা পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে পারে না, যৌন সহিংসতার প্রতি আকৃষ্ট হয়, অশ্লীলতার চর্চা বেড়ে যায়; এতে মা-বাবাকে অসম্মান করতে শেখে, সামাজিক মূল্যবোধ নষ্ট হয়ে যায়, মনে ধর্ষণের ইচ্ছা জাগিয়ে তোলে।
পুরো প্রতিবেদনে যে বিষয়টি ফুটে ওঠেছে, তা হচ্ছে ভয়ংকর এই অশ্লীলতা ও পর্নোগ্রাফি শিশুদের মাঝে বিস্তৃত হচ্ছে মোবাইলফোন ও কম্পিউটারের সাহায্যে। তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়নের অবাধ জোয়ারেই সর্বনাশটা হচ্ছে। এক্ষেত্রে বাছবিচারের মানসিকতা দৃঢ় না হওয়ায় বর্তমানে প্রধানত শহুরে শিশু দ্বিতীয়ত সারাদেশের শিশু-কিশোর সমাজে ভয়াবহ যৌন বিশৃঙ্খলা তৈরি হচ্ছে। উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, চারিত্রিক পবিত্রতা ও যৌন নৈতিকতা শৈশব-কৈশোরেই ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় বর্তমান জেনারেশনের জীবনের সামগ্রিক আঙ্গনেই নেমে আসছে সর্বনাশা ক্ষয়। প্রতিবেদনে তথ্যপ্রযুক্তির এসব নেতিবাচক প্রভাব থেকে শিশু-কিশোরদের বাঁচাতে প্রথমে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে অভিভাবকদের সার্বক্ষণিক নজরদারির ওপর। তারপর বলা হয়েছে, অশ্লীল সিডি-ডিভিডির ব্যবসায় কিছু নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে হবে।
গবেষণা প্রতিবেদনে শুধু শিশুদের মাঝে অশ্লীলতা ছড়িয়ে পড়ার বিভিন্ন কারণ, কুফল ও সুপারিশ ব্যক্ত হয়েছে। পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টটিতেও তা-ই। তথ্য প্রযুক্তির মধ্য দিয়ে ছড়িয়ে পড়া সামগ্রিক অশ্লীলতা ও তার ভয়াবহ কুফল নিয়ে তাতে কোনো কথাই বলা হয়নি। অশ্লীলতা ও অবক্ষয়ের যে অন্ধকার চারদিক থেকে প্রবাহিত হচ্ছে- সে সম্পর্কে মৌলিকভাবে কোনো উদ্বেগ-আতঙ্কের দেখা তাতে মেলেনি। এ কারণে পত্রিকার রিপোর্টটিতেও মূল ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কিছুই বলা হয়নি। বলতে দ্বিধা নেই, এটাই হচ্ছে এসব নেতিবাচক পরিস্থিতির মূল কারণ। যে কোনো প্রযুক্তির নেতিবাচক ভয়াবহতা সম্পর্কে পূর্ণ সতর্কতা ও বাছাই প্রক্রিয়া সব পর্যায়েই রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে যে কোনো ছাড়-চিন্তা যে কারো জন্যই ভয়ংকর ক্ষতি বয়ে আনতে পারে। অশ্লীলতার কবিরা গুনাহ থেকে সবারই তো বাঁচতে হবে। শিশু-কিশোরদের এ থেকে বাঁচাতে সর্বাত্মক তৎপরতা চালাতে হবে। অবাধ তথ্যপ্রবাহের যুক্তি কিংবা বাছ-বিচারহীনভাবে সবকিছু গ্রহণের উন্মুক্ত আহবানকে কোনোভাবেই গ্রহণ করা উচিত হবে না। যারা বাছ-বিচারহীন গ্রহণের কাজটা এতদিন করেছেন-তারাই এখন মাতম করছেন। পরিস্থিতির ভয়াবহতা দেখে আঁতকে উঠছেন। সুতরাং সময় থাকতে সবারই সাবধান হতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।