আমাদের রাজ্যশাসন-২
মাওলানা আবদুস সালাম কিদওয়ায়ী
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
আল্লাহ তাআলার পয়গাম
তোমরা আগেই জেনেছ যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বদা নেক কাজে সম্পৃক্ত থাকতেন। মক্কার নিকটে একটি পাহাড় ছিল, যার নাম গারে হেরা। নবীজী খাবার-পানীয় নিয়ে সেখানে চলে যেতেন এবং দিনের পর দিন আল্লাহর ইবাদতে মশগুল থাকতেন। এ অবস্থায় একদিন হযরত জিবরীল আ. আল্লাহর পয়গাম নিয়ে এলেন। সেদিন থেকেই কুরআনের আয়াত অবতীর্ণ হতে শুরু করল। কয়েকদিন পর অন্যদেরকেও আল্লাহর পয়গাম শোনানোর আদেশ হল। যারা সবচেয়ে কাছের মানুষ প্রথমে তিনি তাদেরকে আল্লাহর পয়গাম শোনালেন।
হযরত খাদীজা রা. ছিলেন তাঁর স্ত্রী, হযরত আবু বকর রা. ছিলেন তাঁর সারা জীবনের বন্ধু, হযরত আলী রা.ও বাল্যকাল থেকে একসাথে ছিলেন। হযরত যায়েদ রা. ছিলেন তাঁর গোলাম। নবীজীর গোটা জীবন তাদের সামনেই কেটেছে। তাঁরা ভালো করেই জানতেন যে, তিনি কতটা সৎ, সত্যবাদী, পবিত্র ও বিশ্বস্ত। তাই বলার সঙ্গে সঙ্গেই তারা তাঁর দাওয়াত কবুল করেন এবং নবীজীর প্রতি ঈমান আনেন।
প্রথম কয়েক দিন নবীজী গোপনে চুপিসারে দাওয়াতের কাজ করছিলেন। পৃথক পৃথকভাবে মানুষের সাথে দেখা করতেন এবং তাদেরকে আল্লাহর পয়গাম শোনাতেন। এভাবে আরো কিছু মানুষ ইসলাম গ্রহণ করলেন। এখন আল্লাহ তাআলা প্রকাশ্যে দাওয়াতের আদেশ দিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাফা পাহাড়ে সকল মানুষকে একত্র করলেন। সবাই যখন উপস্থিত হল তখন তিনি তাদের উদ্দেশে বললেন, আমি যদি বলি এই পাহাড়ের পিছনে এক বিশাল বাহিনী অপেক্ষা করছে, যারা অতি শীঘ্রই তোমাদের উপর আক্রমণ করবে-তবে কি তোমরা তা বিশ্বাস করবে? সকলেই একবাক্যে বলে উঠল, কেন নয়? চল্লিশ বছরের অধিক সময় ধরে আপনি আমাদের সাথে আছেন। এতদিনে একটি ভুল কথাও আপনার মুখ থেকে বের হয়নি। এরপরও আমরা আপনার কথা কেন বিশ্বাস করব না?
এ কথা শুনে নবীজী বললেন, আচ্ছা তাহলে শোন। আল্লাহ হলেন এক। তিনি আমাকে তাঁর রাসূল বানিয়ে প্রেরণ করেছেন। এ কথা শোনামাত্র সকলেই তাঁকে মন্দ কথা বলতে শুরু করল। একটু আগেও যারা ছিল তাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ, মুহূর্তেই তারা হয়ে গেল বড় নিন্দুক।
এরপর থেকে নবীজী পুরোপুরিভাবে মানুষকে ইসলামের দাওয়াত দিতে লাগলেন এবং আস্তে আস্তে ইসলাম প্রচার হতে লাগল। এটি কুরাইশদের খুবই অপছন্দনীয় ছিল। মানুষ ইসলাম গ্রহণ করুক-এটা তারা কোনোক্রমেই চাইত না।
কারণ এতে একদিকে যেমন তাদের পিতৃপুরুষের ধর্ম বিলুপ্ত হয়ে যাবে অন্যদিকে শত শত বছর ধরে চলে আসা নিজেদের নেতৃত্ব-কর্তৃত্বও হাতছাড়া হয়ে যাবে। তাই প্রথম প্রথম তারা মুখে বিরোধিতা করত। কিন্তু যখন দেখল, এভাবে কাজ হচ্ছে না তখন তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নানাভাবে কষ্ট দিতে শুরু করল। কখনো চলার পথে কাঁটা বিছিয়ে রাখত যেন তা পায়ে বিদ্ধ হয়। কখনোবা নবীজীর শরীর মোবারকে নাপাকি ঢেলে দিত। কখনো আবার গলা চেপে ধরার চেষ্টা করত। মোটকথা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তাঁর কাজ থেকে বিরত রাখার সবধরনের চেষ্টাই তারা করত। কিন্তু এত কিছুর পরও নবীজীর মাঝে এসবের কোনো প্রভাব পড়ত না। তিনি সমানভাবেই নিজের কাজ অব্যাহত রাখলেন। অবশেষে তারা আবু তালেবের নিকট নালিশ করল যে, আপনি তাকে বিরত রাখুন। আবু তালিব নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ডেকে বোঝালেন। দ্বীনের দাওয়াত থেকে বিরত থাকতে অনুরোধ করলেন। কিন্তু নবীজী স্পষ্ট বলে দিলেন, আল্লাহর শপথ! যদি আমার ডান হাতে সূর্য ও বাম হাতে চাঁদ এনে দেওয়া হয় আর বিনিময়ে এ কাজ থেকে বিরত থাকতে বলা হয় তাহলেও তা কখনো হবে না। এ কথা বলতে বলতে নবীজীর চোখ অশ্রুতে ভরে গেল। এ অবস্থা দেখে আবু তালেব বললেন, যাও। তোমার কাজ করতে থাক। যতদিন আমি বেঁচে আছি, তোমার কোনো ক্ষতি হবে না।
এখন কুরাইশরা আরো বেশি কঠোরতা করতে লাগল। তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে সাথে তাঁর সাথী ও মুসলমানদেরকেও নানাভাবে কষ্ট-নির্যাতন করতে লাগল। কাউকে মারধর করত, কারো গায়ে কাঁটা বিদ্ধ করত, কাউকে মাটিতে হেঁচড়াত, কাউকে বেঁধে ঝুলিয়ে রাখত, কাউকে উত্তপ্ত কয়লার উপর শুইয়ে দিত, কাউকে ক্ষত বিক্ষত করে আরবের উত্তপ্ত বালুতে শুইয়ে রাখত এবং শরীরের উপর পাথর রেখে দিত। মোটকথা অত্যাচার-নির্যাতনের কোনো পন্থাই তারা বাদ রাখেনি। কিন্তু আল্লাহর এসব বান্দার ঈমান এত দৃঢ় ও পাক্কা ছিল যে, এত অত্যাচার-নির্যাতন তাদেরকে বিন্দুমাত্র বিচলিত করতে পারেনি। বরং অত্যাচারের পরিমাণ যতই বাড়ত ততই যেন তাদের ঈমান আরো দৃঢ় ও মজবুত হত।
কুরাইশদের অত্যাচার যখন সীমা ছাড়িয়ে গেল এবং শক্তিহীন মুসলমানদের পক্ষে তা অসহনীয় হয়ে উঠল তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ সাথীদেরকে হাবশা চলে যাওয়ার আদেশ করলেন। সেখানকার বাদশা খুবই দয়াপ্রবণ ও নরম প্রকৃতির ছিলেন। ফলে নবীজীর আদেশে তারা হাবশায় রওনা হলেন। কিন্তু মুসলমানরা কোথাও শান্তি ও নিরাপদে থাকুক এটা কুরাইশদের কীভাবে সহ্য হবে? কুরাইশের কিছু লোক দ্রুত হাবশায় গিয়ে পৌঁছল এবং সেখানকার বাদশার সাথে সাক্ষাত করল। তারা বাদশাহ নাজাশীকে বলল, আমাদের কিছু ক্রীতদাস পলায়ন করে এখানে চলে এসেছে। আপনি তাদেরকে ফেরত পাঠিয়ে দিন। নাজাশী মুসলমানদেরকে ডেকে এ সম্পর্কে জানতে চাইলেন। হযরত জাফর রা. পূর্ণ ঘটনা তাকে সবিস্তারে শোনালেন। এতে নাজাশী আশ্বস্ত হয়ে মুসলমানদেরকে নিরাপদে বসবাসের আদেশ দিলেন আর কুরাইশের লোকগুলোকে ফেরত পাঠিয়ে দিলেন।
এদিকে মক্কায় যেসব মুসলমান ছিলেন তাদের প্রতি অত্যাচার আরো বেড়ে গেল। কিন্তু এরপরও কেউ দ্বীন ত্যাগ করেননি। এ অবস্থা দেখে কুরাইশরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর খান্দানকে অবরোধ করে রাখার ফন্দি আঁটল। এ কারণে দুই বছরেরও বেশি সময় তারা কঠোরভাবে অবরুদ্ধ থাকেন। এ সময় তাঁদের সাথে মেলামেশা, বিয়ে-শাদি ইত্যাদি সব ধরনের সম্পর্ক ছিন্ন করা হয়। তাদের খাবার-পানীয়ের সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়। দীর্ঘ দুই-আড়াই বছর পর কিছু নরম মনের মানুষের মধ্যস্থতায় এই অবরোধ প্রত্যাহার করা হয়।
(চলবে ইনশাআল্লাহ)
অনুবাদ : আবদুল্লাহ ফাহাদ