মুসলমান যেভাবে জীবনযাপন করবে
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
১১. বেশি বেশি আল্লাহ তাআলার যিকির করব। আল্লাহ তাআলা কুরআন মাজীদে ইরশাদ করেছেন, (তরজমা) হে মুমিনগণ! আল্লাহ তাআলার যিকির বেশি বেশি কর।-সূরা আহযাব (৩৩) : ৪১
হাদীস শরীফে এসেছে, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, সর্বদা তোমার জিহবা যেন আল্লাহর যিকিরে সজীব থাকে।-জামে তিরমিযী, হাদীস : ৩৩৭৫
রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যদি আমি একবার সুবহানাল্লাহ ওয়ালহামদুলিল্লাহ ওয়ালা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবার বলি তাহলে তা আমার নিকট সমস্ত দুনিয়ার চেয়ে প্রিয়।-সহীহ মুসলিম, হাদীস : ২৬৯৫
হে মুসলমানগণ! জীবন ও সময় নষ্ট করা থেকে বিরত থাকুন। সবসময় আল্লাহ তায়ালার ম্মরণে লিপ্ত থাকুন। কোনো মজলিস যেন আল্লাহ তাআলার যিকির ও রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরুদ থেকে খালি না থাকে। আমরা চলা-ফেরা, উঠা-বসা (মোটকথা) সদা সর্বদা আল্লাহ তাআলার যিকিরে লিপ্ত থাকব। বিভিন্ন সময়ের মাসনূন দুআগুলো পড়ব। প্রত্যেক ফরয নামাযের পর ৩৩ বার সুবহানাল্লাহ, ৩৩ বার আলহামদুলিল্লাহ, ৩৪ বার আল্লাহু আকবার পড়ব। শোয়ার সময়ও পড়ব।
১২. মুসলমান একে অপরের সাথে মিল-মহববতের সাথে থাকব। একে অপরের সহানুভূতি, সহযোগিতা ও সেবার সাথে জীবন যাপন করব। ছোটদের স্নেহ করব। বড়দের সম্মান করব।
সাহাবী নুমান ইবনে বাশীর রা. বলেন, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, তোমরা মুমিনদেরকে পরস্পরে মিল-মহববত ও একে অন্যের প্রতি দয়া করার ক্ষেত্রে এক শরীরের ন্যায় দেখবে। তারা এমন একটি শরীরের মতো হবে, যখন তার একটি অঙ্গ কষ্ট পায় তখন সমস্ত শরীর ব্যথিত হয়ে যায়।-সহীহ বুখারী, হাদীস : ৬০১১; মুসলিম, হাদীস : ২৫৮৬
অন্য হাদীসে এসেছে, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, মুসলমানগণ হবে একটি শরীরের মতো, যদি তার মাথায় আঘাত লাগে তাহলে সমস্ত শরীরই আঘাত পায়।-সহীহ মুসলিম, হাদীস : ২৫৮৬
হযরত আবু মুসা আশআরী রা. বলেন, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, এক মুমিন অন্য মুমিনের জন্য দেয়াল স্বরূপ। দেয়ালের অংশগুলো (ইট, পাথর, চুনা ইত্যাদি) একটি অপরটির সাথে মিলে থাকে। অতপর রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক হাতের আঙ্গুলগুলো অন্য হাতের আঙ্গুলের মধ্যে ঢুকিয়ে অবস্থাটা বুঝিয়েছেন।-সহীহ বুখারী, হাদীস : ৬০২৬; মুসলিম, হাদীস : ২৫৮৫
হযরত আনাস রা. বলেন, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি আমার কোনো উম্মতের একটি প্রয়োজন পূর্ণ করল সে আমাকে সন্তুষ্ট করল। আর যে আমাকে সন্তুষ্ট করল সে আল্লাহকে সন্তুষ্ট করল। যে আল্লাহকে সন্তুষ্ট করল আল্লাহ তাআলা তাকে জান্নাত দান করবেন।-শুআবুল ঈমান, বায়হাকী, হাদীস : ৭৬৩৫
আবু হুরায়রা রা. বলেন, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, এক মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই। সে তার উপর জুলুম করতে পারে না। তাকে নিঃসঙ্গ ছেড়ে দিতে পারে না। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সিনার দিকে ইঙ্গিত করে বলেছেন, তাকওয়া এখানে। এভাবে তিনবার বলেছেন। তারপর বলেছেন, মানুষ অপরাধী হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে তার মুসলমান ভাইকে নগণ্য বা তুচ্ছ মনে করবে। মুসলমানের সব কিছুই অন্য মুসলমানের জন্য হারাম : তার সম্পদ (সম্পদ অপহরণ করবে না, খেয়ানত করবে না ও কোনো নাজায়েয পন্থায় তা ভোগ করবে না) তার রক্ত (তাকে অন্যায়ভাবে হত্যা করবে না) তার ইজ্জত (তাকে লাঞ্ছিত করবে না)।-সহীহ মুসলিম
আবু সাইদ ও আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘‘যদি কোনো মুমিনকে হত্যা করার ব্যাপারে আসমান-যমীনের সকলেই শরীক থাকে তবুও আল্লাহ তাআলা সবাইকে উল্টো করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন।-জামে তিরমিযী, হাদীস : ১৩৯৮
আবু বাকরা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যদি কোনো মুসলমান অন্য মুসলমানের বিরুদ্ধে তলোয়ার নিয়ে দাঁড়িয়ে যায় তাহলে তারা উভয়ই জাহান্নামী হবে। এক সাহাবী জিজ্ঞাসা করলেন, আল্লাহর রাসূল! হত্যাকারী জাহান্নামী হবে এটাতো বুঝতে পারলাম (অর্থাৎ হত্যা করার কারণে) কিন্তু যাকে হত্যা করা হয়েছে সে কেন জাহান্নামী হবে? রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, সে-ও অন্যজনকে হত্যা করতে উদ্যত হয়েছিল (এজন্য জাহান্নামী হবে)।-সহীহ বুখারী, হাদীস : ৬৮৭৫; সহীহ মুসলিম, হাদীস : ২৮৮৮
অর্থাৎ দু’জনই হত্যা করার ইচ্ছায় বের হয়েছিল। একজনের সুযোগ হয়েছে সে হত্যা করতে পেরেছে। অন্যজন নিহত হয়েছে। যে নিহত হয়েছে সে তার নিয়তের কারণে জাহান্নামে যাবে। কারণ, সে অজ্ঞতা ও সম্প্রদায়িকতার কারণে হত্যা করার ইচ্ছা করেছিল, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নয়।
১৩. পুরুষ ও মহিলা এমন পোশাক পরিধান করবে যা তাদের জন্য অনুমোদিত। পুরোপুরি সতর ঢেকে থাকে এমন পোশাক হতে হবে। পুরুষ টাখনুর উপরে কাপড় পরিধান করবে। জামা-পায়জামা বা লুঙ্গি যাই পরিধান করুক তা টাখনুর উপর রাখতে হবে। টাখনুর নিচে যেতে পারবে না।
মহিলাগণ মোটা বা এমন পোশাক পরিধান করবে যা দিয়ে শরীর দেখা যায় না। বেগানা পুরুষের সাথে পর্দা করবে। যথাসম্ভব ঘরের ভেতরে থাকবে। কোনো প্রয়োজনে ঘর থেকে বের হতে হলে পর্দা করে (বোরকা পরিধান করে) বের হবে। এমন বোরকা পরিধান করবে যার দ্বারা পুরোপুরি পর্দা রক্ষা হয়।
১৪. বান্দার (মানুষের) হক আদায় করবে। গভীরভাবে চিন্তা করবে যে, তোমার নিকট কারো কোনো পাওনা আছে কি না। যেমন-কারো করয অনাদায় রয়ে গেছে, কারো কোনো খেয়ানত (সম্পদ নষ্ট) করা হয়েছে বা কারো কোনো বস্ত্ত বিনা অনুমতিতে নেওয়া হয়েছে, তার জানা থাকুক বা না থাকুক, নিজে নিজেই তা পরিশোধ করে দিবে।
কারো গীবত করা হয়েছে বা শোনা হয়েছে অথবা কারো উপর অপবাদ দেওয়া হয়েছে, সে তা জেনে থাকলে তার কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। জেনে না থাকলে আল্লাহ তাআলার কাছে তার জন্য বেশি বেশি ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকবে, যতক্ষণ পর্যন্ত নিশ্চিত না হওয়া যায় যে তার হক আদায় হয়ে গেছে।
বান্দার হকের বিষয়টি খুবই কঠিন। (দুনিয়াতে পরিশোধ না করলে) কিয়ামত দিবসে পাওনাদারকে নিজের নেকী দিয়ে দিতে হবে। যদি নেকী দিয়েও পূর্ণ হক আদায় না হয় তাহলে অবশিষ্ট হকের জন্য পাওনাদারের গুনাহ নিয়ে নিতে হবে। অতএব এ কারণে জাহান্নামেও যেতে হবে।
ভাই! চিন্তা করা প্রয়োজন। যারা নিজেদের মা, ভাই-বোনদেরকে মীরাস থেকে বঞ্চিত করে তাদের খুব ভালোভাবে অনুধাবন করা উচিত।
১৫. হালাল উপার্জন করবে, হালাল খাবে। নিজের উপার্জন-ব্যবস্থা হালাল কিনা তা বিজ্ঞ আলেমদের থেকে জেনে নিবে। সুদী কারবার ও ঘুষ নেওয়া থেকে অবশ্যই বিরত থাকবে।
১৬. অন্তর ও শরীরের অন্য অঙ্গগুলোকে গুনাহ থেকে বিরত রাখবে। যেমন-অন্তরকে সমস্ত শিরকী ও কুফরী বিশ্বাস, রিয়া (লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে আমল করা), কারো সাথে অযথা দুশমনি রাখা, অহংকার, হিংসা-বিদ্বেষ, ধোকা দেওয়া ইত্যাদি থেকে বিরত রাখবে।
হাতকে হারাম উপার্জন করা, পরিমাপে কম দেওয়া, চুরি করা, খেয়ানত করা, ডাকাতি করা থেকে বিরত রাখবে।
পা’কে গুনাহের দিকে যাওয়া থেকে বিরত রাখবে।
চোখকে ভিন্ন মহিলা ও গুনাহের বিষয়ের দিকে তাকানো থেকে বিরত রাখবে। লজ্জাস্থানকে গুনাহ থেকে বিরত রাখবে।
কানকে গান-বাদ্য, গীবত ও সমস্ত খারাপ বিষয় শ্রবণ করা থেকে বিরত রাখবে। জিহবাকে গীবত করা, কাউকে অপবাদ দেওয়া, অযথা দোষারোপ করা, মিথ্যাবলা, গালি-গালাজ করা, মিথ্যা কসম খাওয়া, অনর্থক কথা-বার্তা বলা থেকে বিরত রাখবে।
উদর হারাম খাওয়া থেকে বিরত রাখবে। মোটকথা সমস্ত শরীরকে সর্বপ্রকার গুনাহ থেকে বিরত রাখবে।
১৭. সর্বক্ষেত্রে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসরণ করবে। লেবাস-পোশাক চুল, দাড়ির ক্ষেত্রেও রাসূলের তরিকা অবলম্বন করবে। ভালভাবে বুঝে নাও, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দাড়ি মোবারক ঘন ছিল এবং বুক বরাবর লম্বা ছিল। অমুসলিমদের কালচার অবলম্বন
করবে না।
১৮. নিজের সন্তানদেরকে কুরআন মাজীদ মুখস্ত করাবে। দ্বীনী জ্ঞান শিক্ষা দিবে, হাদীস, তাফসীর, ফিক্হ ও ফাতাওয়ার শিক্ষক বানাবে। কাফের, ফাসেকদের সংস্রব ও তাদের কালচার অবলম্বন করা থেকে সন্তানদেরকে বিরত রাখবে। যখন সন্তান (বালেগ) প্রাপ্তবয়স্ক হবে তখন তাকে বিয়ে করাবে। বিয়ের অনুষ্ঠান রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নত মোতাবেক করবে। লোক দেখানো ও দুনিয়াদারদের মতো করবে না। ছেলে-মেয়ের জন্য দ্বীনদার স্বামী-স্ত্রী তালাশ করবে।
১৯. হক্কানী আলেম ও বুযুর্গদের মজলিসে শরীক হবে। সন্তাদেরকেও সেখানে নিয়ে যাবে। পরহেযগার ও মুত্তাকী লোকদের সাথে সম্পর্ক রাখবে। তাদের সংস্রব অবলম্বন করবে। হক্কানী আলেমদের রচনাবলী পড়াবে। যেন দুনিয়ার মহববত কম হয় এবং আখেরাতের মহববত বেশি হয়। সুন্নাতের অনুসারী মোত্তাকী বুযুর্গের হাতে বাইআত হবে। বাইআত শুধু নামের জন্য নয়। বরং বুযুর্গের দিক-নির্দেশনার উপর আমল করে অত্মশুদ্ধি ও বেশি বেশি যিকির করার জন্য।
২০. সমস্ত গুনাহর জন্য একনিষ্ঠতার সাথে তাওবা করবে। এরপর যখনই কোনো গুনাহ হয়ে যাবে সঙ্গে সঙ্গে তাওবা করে ফেলবে। নিম্নের
ইস্তেগফারটি বেশী বেশী পড়বে-
أسْتَغْفِرُ اللهَ الَّذِيْ لَا اِلَهَ إِلَّا هُوَ الْحَيُّ الْقَيُّوْمُ وَأَتُوْبُ إَلَيْهِ.
ঘুমানোর পূর্বেও ইস্তেগফারটি তিনবার পড়বে।
মুসলমানদের কাজই হল, সদা-সর্বদা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করা। কুরআন মাজীদে আল্লাহ তাআলা তাঁর ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অনুগত বান্দাদের জন্য সফলতার কথা বলেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেছেন, (তরজমা) যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করবে এবং আল্লাহকে ভয় করবে তারাই সফল হবে।-সূরা নূর : ৫২ ষ
অনুবাদ : মুহাম্মাদ নূরুদ্দীন