দরসে তাওহীদ
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ তাআলার নিকট থেকে যে শিক্ষা ও নির্দেশনা নিয়ে এসেছেন তা দুই ভাগে বিভক্ত : এক. যা বিশ্বাস ও আকীদা সংক্রান্ত। দুই. যা কর্ম ও আমল সংক্রান্ত।
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন অনেক সত্য ও বাস্তবতা আমাদেরকে জানিয়েছেন যা আমরা নিজেরা জানতে পারতাম না। এইসব সত্যে বিশ্বাস রাখা অপরিহার্য।
এটি ইসলামের আকীদা-অংশ, যা দ্বীন ইসলামের মূল।
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে অনেক বিধিবিধানও জানিয়েছেন, যেগুলো আমাদের কর্মের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। যেমন এ কাজ কর, এ কাজ করো না। এটি ইসলামের আহকাম-অংশ, যা জীবনের সকল অঙ্গনে পরিব্যাপ্ত। ইবাদত-বন্দেগী, আখলাক-চরিত্র, আদব-কায়েদা, নীতি ও শিষ্টাচার, লেনদেন, দাম্পত্য ও সামাজিকতা, দ্বীনের দাওয়াত ও দ্বীন প্রতিষ্ঠা, সমাজ ও রাষ্ট্র-ব্যবস্থা ইত্যাদি সকল বিষয়ের আহকাম ও বিধান তাতে রয়েছে।
এখানে প্রথম বিষয়টি, অর্থাৎ ঈমান ও আকীদার বিষয়ে কিছু কথা আরজ করছি।
দ্বীন ও শরীয়তের পরিভাষায় ঈমান অর্থ, আল্লাহর রাসূলকে আল্লাহর রাসূল বলে মেনে নিয়ে নিশ্চিত বিশ্বাস করা যে, আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সুপথে পরিচালিত করার জন্য তাঁকে ওহীর মাধ্যমে এমন অনেক বিষয় জানিয়েছেন, যা আমরা পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে জানতে পারতাম না। তাঁর সূত্রে আমরা ঐসব বিষয় জেনেছি। এখন তাঁর সংবাদের উপর আস্থা রেখে ঐ সকল বিষয়কে স্বীকার করে নেওয়াই হচ্ছে ঈমান। সুতরাং কোনো ব্যক্তি শুধু তখনই মুমিন হতে পারে যখন সে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা কিছু উম্মতকে জানিয়েছেন তা সব সত্য বলে স্বীকার করে, কোনো একটিকেও অস্বীকার করে না। সুতরাং কেউ যদি বলে, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আল্লাহর রাসূল বলে মানি। তাওহীদ বিষয়ে এবং আল্লাহর তাআলার সিফাত ও গুণাবলি বিষয়ে তিনি যা কিছু বলেছেন তাও বিশ্বাস করি তবে তাঁর শিক্ষায় কিয়ামত ও জান্নাত-জাহান্নামের যে প্রসঙ্গ তা আমার বুঝে আসে না। তাই তা বিশ্বাস করি না (নাউযুবিল্লাহ!) তাহলে সে মুমিন নয়।
মোটকথা, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর নিকট থেকে যে বিশ্বাস ও আদর্শ নিয়ে এসেছেন তার সবকিছুকে সত্য বলে বিশ্বাস করার নাম ঈমান।
সুতরাং যে সরাসরি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুখ থেকে শোনে তাকে তো প্রতিটি কথাই বিশ্বাস করতে হবে এবং মেনে নিতে হবে। অন্যথায় সে মুমিন থাকবে না। পক্ষান্তরে যারা নবী-যুগের পরে পৃথিবীতে এসেছে তারা যদি এমন কোনো বিষয়কে অস্বীকার করে, যা তাঁর সর্বজনবিদিত শিক্ষা তাহলে সে মুমিন থাকবে না। দ্বীনের এই সর্বজনবিদিত বিষয়সমূহকে পরিভাষায় ‘জরুরিয়াতে দ্বীন’ বলে।
আকীদা ও বিশ্বাসগত বিষয়াদি দুই প্রকার : এক. আল্লাহ তাআলার যাত ও সিফাত বিষয়ক ; দুই. আল্লাহর রাসূল, ফিরেশতা, কিয়ামত ইত্যাদি বিষয়ক। আমরা আগে প্রথম বিষয়টি আলোচনা করব। কারণ উদ্দেশ্যের দিক থেকে এটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
***
আকীদার বিষয়ে আলোচনা করতে গেলে শুরুতে যে প্রসঙ্গে অবতারণ সাধারণত করা হয় তা হচ্ছে ‘ওজুদে বারী তাআলা’ অর্থাৎ সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব। এ নিয়ে দীর্ঘ আলোচনার প্রয়োজন নেই। কারণ মানবজাতির ইতিহাস বলে, পৃথিবীর সকল শ্রেণীর মানুষ আল্লাহ তাআলাকে স্বীকার করেছে। অর্থাৎ এটুকু বিশ্বাস সকল যুগের মানুষেরই ছিল যে, ‘এই জগতের একজন স্রষ্টা আছেন, যিনি সর্বশক্তিমান।’ সম্ভবত একারণেই এ বিষয়ে কুরআন-হাদীসে আলাদা জোর দেওয়া হয়নি। কুরআন মজীদে বিভিন্ন কওমের মাঝে নবী রাসূলের আগমন ও তাঁদের দাওয়াতের যে বিবরণ আছে তাতে দেখা যায়, তাওহীদ-কিয়ামত ও অন্যান্য বিষয়ে তো তাঁরা জোরালো দাওয়াত দিয়েছেন, কিন্তু আল্লাহর অস্তিত্বকে স্বীকার করানোর জন্য তাদেরকে বিশেষ জোর দিতে হয়নি। কুরআন মজীদের রীতিও এই যে, তাওহীদ রিসালাত ও অন্যান্য বিষয়ে তো অনেক আয়াত নাযিল হয়েছে কিন্তু ‘আল্লাহ আছেন’-এ কথা স্বীকার করানোর জন্য বেশি কিছু বলার প্রয়োজন বোধ করা হয়নি। কারণ এ তো গোটা মানবজাতির এক সর্বসম্মত বিষয়।
স্রষ্টার অস্তিত্ব মানবের কাছে তেমনিই সহজ-সত্য যেমন তার নিজের অস্তিত্ব। তবে কারো চিন্তা ও স্বভাব সম্পূর্ণ বক্র ও বিকারগ্রস্ত হয়ে গেলে তা ভিন্ন কথা। এ কারণে বর্তমান যুগেও, যাকে নাস্তিক্যবাদের চরম উৎকর্ষর যুগ বলে, এবং পশ্চিমের ঐ সকল দেশেও, যেগুলো নাস্তিক্যবাদের সূতিকাগার বলে পরিচিত, নাস্তিকের সংখ্যা ইশ্বরেবিশ্বাসীদের তুলনায় অতি নগণ্য। এমনকি তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নেও, যাকে নাস্তিকতা ও খোদাদ্রোহিতার কেন্দ্র মনে করা হত, সব সময় নাস্তিকেরাই ছিল সংখ্যালঘু।
যাই হোক, সম্ভবত এ কারণেই বিষয়টিকে লম্বা আলোচনার বিষয় মনে করা হয়নি। তবে এর অর্থ এই নয় যে, কুরআনে পাকে এ বিষয়ে কোনো নির্দেশনাই নেই। এ বিষয়েও চিন্তাশীলদের জন্য যথেষ্ট দিক-নিদের্শনা রয়েছে।
যেমন এক জায়গায় ইরশাদ হয়েছে-
ان الله فالق الحب والنوى، يخرج الحى من الميت ومخرج الميت من الحى، ذلك الله فانى تؤفكون.
(তরজমা) আল্লাহই শস্য বীজ ও আটি অঙ্কুরিত করেন। তিনিই মৃত হতে জীবন্তকে বের করেন এবং তিনিই জীবন্ত হতে মৃতের নির্গতকারী। এই তো আল্লাহ। কাজেই তোমরা কোথায় ফিরে যাও?-সূরা আনআম : ৯৫
অর্থাৎ এ তো মানুষের সাধারণ অভিজ্ঞতা যে, ভূমিতে ফলের অাঁটি, ফসলের বীজ ছড়িয়ে দেয়ার পর মাটির নীচে তা ধীরে ধীরে ফেটে যায়। তা থেকে উদগত অংকুর মাটির বক্ষ বিদীর্ণ করে উপরে মাথা তোলে। মাটির নিচের অন্ধকারে কে এই ফল-ফসলের দানা নিপূণভাবে বিদীর্ণ করেন? কে এই শুষ্ক দানা থেকে সবুজ কোমল কিশলয় উদগত করেন? কার ইশারায় রেশম কোমল কিশলয়টি শক্ত মাটির বুক চিরে মাথা তোলে?
তো কুরআন মজীদ বলছে, এই সব কিছু আল্লাহর ইশারায় হয়।
এরপর বলা হয়েছে, তোমরা আরো দেখছ, একটি প্রাণহীন বস্ত্ত থেকে প্রাণবান বস্ত্ত সৃষ্টি হচ্ছে। ডিম থেকে বের হয়ে আসছে কাকলীমুখর পাখি, এরপর তা উড়ে যাচ্ছে আকাশের শূন্যতায়। পক্ষান্তরে এই পাখী বাচ্চা প্রসব না করে নিষ্প্রাণ ডিম পারছে। এরপর নিষ্প্রাণ থেকে ঘটছে প্রাণের উন্মেষ। তো মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের এই অভিজ্ঞতাগুলো তুলে ধরে কুরআন মজীদ বলছে, এই সবই তো আল্লাহর কুদরতের কারিশমা। যারা খোদায়ী কুদরতের এই ‘জীবন্ত’ নিদর্শনগুলো দেখার পরও আল্লাহর পরিচয় পায় না নিশ্চয়ই তাদের চোখের দৃষ্টিতে পর্দা পড়েছে এবং তাদের অন্তর্দৃষ্টির মৃত্যু ঘটেছে!
অন্য জায়গায় ইরশাদ হয়েছে-
وفى الارض آيات للموقنين، وفى انفسكم افلا تبصرون.
আর ভূমিতে ছড়িয়ে আছে বিশ্বাসীদের জন্য অনেক নিদর্শন এবং তোমাদের সত্তার মাঝেও। তবু তোমরা দেখ না!-সূরা যারিয়াত : ২০-২১
অর্থাৎ মানুষ যদি চোখ মেলে তাকায় তাহলে দেখতে পাবে, তার চারপাশের ভূমিতে আমার অস্তিত্বের ও সৃজনক্ষমতার কত নিদর্শন ছড়িয়ে আছে। তার নিজের সত্তার মাঝেও আছে আমার কত নিদর্শন! মানুষ কেন চিন্তা করে না যে, মাতৃগর্ভে তার এই সুন্দর রূপ, সুন্দর অবয়ব কে তৈরি করেছেন? কে তাকে দান করেছেন দৃষ্টিশক্তি, শ্রবণশক্তি? কে তাকে দিয়েছেন আস্বাদনের জন্য জিহবা ও ঘ্রাণ শোঁকার জন্য নাক? মায়ের বুকে কে তার জন্য দুধের নহর জারি করেছেন? কে দিয়েছেন তার মুখের ভাষা? কার হাতে তার জীবন ও মরণ? মানুষ যদি কান পেতে শোনার চেষ্টা করে তাহলে নিজ সত্তার গভীর থেকে উত্থিত এই ধ্বনি সে শুনতে পাবে যে, এইসব কিছু এক মহাশক্তিমান পরম করুণাময়ের দান। আর তিনিই আল্লাহ।
এ কারণে রাসূলগণ পরম বিস্ময়ের সাথে বলেছেন-
افى الله شك فاطر السموات والارض
আল্লাহ সম্পর্কে সংশয়, যিনি সৃষ্টিকর্তা আসমান-যমীনের?!
সত্যিই তো, যে এই আদিগন্ত ভূমি ও তাতে ছড়িয়ে থাকা বিচিত্র জগৎ প্রত্যক্ষ করে, মাথার উপরের নীল আসমান ও তারকারাজি প্রত্যক্ষ করে সে কীভাবে সন্দেহ করে এই যমীন-আসমানের সৃষ্টিকর্তা সম্পর্কে?
একবার এক সংশয়ী ব্যক্তির সঙ্গে আমার আলোচনা হল, যার মাঝে আল্লাহ তাআলার অস্তিত্বের বিষয়ে তর্ক-বিতর্কের প্রবণতা ছিল। আমি পকেট থেকে একটি ভাঁজ করা কাগজ বের করে তার সামনে মেলে ধরলাম এবং বললাম, ‘ধর"ন, আমি দাবি করছি এই কাগজের এই লেখাগুলো কেউ লেখেনি; এমনি এমনি লেখা হয়ে গেছে। আপনি কি আমার সাথে একমত হবেন?’ তিনি বললেন, ‘না, এ তো সম্ভব নয়।’ বললাম, ‘কিংবা এই ঘড়িটি বা বলপেনটি সম্পর্কে যদি বলি, এটি কেউ তৈরি করেনি, স্বয়ংক্রীয়ভাবে তৈরি হয়ে গেছে? কিংবা একটি ছুটন্ত গাড়ি সম্পর্কে যদি বলি, এটি কেউ প্রস্ত্তত করেনি, নিজে নিজেই প্রস্ত্তত হয়েছে এবং নিজে নিজেই চলছে! আপনি কি আমার কথাগুলো বিশ্বাস করবেন?’ তিনি বললেন, ‘এমন হওয়া তো যুক্তিসঙ্গত নয়’। বললাম, ‘এই সামান্য ঘড়ি, বলপেন, মোটরগাড়ির বিষয়ে যা যুক্তিসংগত নয় তা-ই কীভাবে ‘যুক্তিসংগত’ হয়ে যায় এই চন্দ্র-সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্র, জগত-মহাজগত সম্পর্কে? কীভাবে তা যুক্তিসংগত হয় বিচিত্র প্রাণীজগত এবং প্রাণীজগতের বিস্ময় ‘মানুষ’ সম্পর্কে? মানুষের হৃদয় ও মস্তিস্ক, তার দৃষ্টি ও অর্ন্তদৃষ্টি, তাঁর চিন্তা ও বাকশক্তি-এই সব কিছু সম্পর্কে কীভাবে মেনে নি""ছন, এগুলো নিজে নিজেই হয়ে যেতে পারে?!
তাকে আরো বলি, ‘আপনার কাছে এটা যেমন সহজ সত্য যে, এই ঘড়ি, এই বলপেনের নিশ্চয়ই কোনো কারিগর আছে, কাগজের উপর অঙ্কিত এই বর্ণমালার নিশ্চয়ই কোনো লেখক আছে, সড়কে ছুটন্ত ঐ মোটরগাড়ির নিশ্চয়ই কোনো চালক ও প্রস্ততকারক আছে-এর চেয়ে অনেক বড় সহজসত্য এই যে, এই চন্দ্র-সূর্য, নদী-সাগর ও জগত-মহাজগতের এক সর্বশক্তিমান মহা প্রজ্ঞাময় সৃষ্টিকর্তা আছেন।’
তো আমার স্থির বিশ্বাস, বিষয়টি যেহেতু এক ধ্রুবসত্য এবং যে কোনো চিন্তাশীল মানুষের সামনেই তা ধ্রুবতারার মতো উজ্জ্বল তাই কুরআন পাক এ বিষয়ে আলাদা জোর দেয়নি, বরং সামান্য দৃষ্টি আকর্ষণই যথেষ্ট মনে করেছে। আর এটাই স্বাভাবিক। কারণ কোনো সহজ বিষয়কে লম্বা আলোচনার বিষয় বানানো এবং দলীল-আদিল্লার জটিল প্রসঙ্গের আবতারনা করা সাধারণ প্রজ্ঞার পরিপন্থী। এতে একটি সহজ বিষয় শুধু শুধু কঠিন হয়ে য়ায়।
মোটকথা, বিষয়টি মানব-স্বভাবের কাছে বিতর্কের বিষয়ই নয়। এ কারণে কোনো কালেই মানব-সমাজে নাস্তিক্যবাদের খুব বেশি বিস্তার ঘটেনি। বরং অনেক সময় তো বাহ্যত নাস্তিক ব্যক্তিদের হৃদয়ের নিভৃত কোণ থেকে আল্লাহ আল্লাহ ‘ধ্বনি’ শ্রুতিগোচর হয়েছে।
তবে তাওহীদের বিষয় বহু জাতি পথভ্রষ্ট হয়েছে। একারণে তা ছিল নবীগণের (আলাইহিমুস সালাম) দাওয়াতের অন্যতম প্রধান বিষয়। আর সব শেষে শরীয়তে মুহাম্মাদীতে বিষয়টি এত সুস্পষ্টভাবে আছে যে, কোনো দিক অনালোচিত নেই। তাওহীদ বিষয়ে কুরআন-সুন্নাহর শিক্ষা ভালোভাবে বোঝার জন্য মনে রাখা দরকার যে, তাওহীদ থেকে ঐ ব্যক্তিই বিচ্যুত হয়, যার আল্লাহ তাআলার সিফাত সম্পর্কে সঠিক ধারণা নেই। পক্ষান্তরে যার আল্লাহ তাআলার সিফাত সম্পর্কে সঠিক ইলম আছে সে কখনো তাওহীদ থেকে বিচ্যুত হয় না এবং শিরকে লিপ্ত হয় না। যেমন, যার ইয়াকীন আছে যে, একমাত্র আল্লাহ-তাআলাই সৃষ্টিকর্তা। তিনিই পালনকর্তা ও রিযিকদাতা তিনিই দান করেন সম্পদ ও সন্তান। তাঁরই আদেশে সুস্থতা-অসুস্থতা এবং সচ্ছলতা-অসচ্ছলতা। তাঁরই হাতে সৃষ্টির জীবন ও মরণ। এককথায়, পৃথিবীতে যা কিছু হয় তাঁর আদেশেই হয়। সৃষ্টিকুল তাঁর মুখাপেী, তিনি কারো মুখাপেক্ষী নন। তো আল্লাহ তাআলার এই সিফাত ও গুণাবলির উপর যার ইয়াকীন আছে সে না আল্লাহ ছাড়া কারো ইবাদত করবে, না আল্লাহ ছাড়া কারো কাছে প্রার্থনা করবে। আর না গায়রুল্লাহকে রাজিখুশি করার জন্য মান্নত মানবে।
কুরআন মজীদে বারবার আল্লাহ তাআলার সিফাত সম্পর্কে সচেতন করা হয়েছে এবং তাওহীদের উপলব্ধি জাগ্রত করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলার গুণ ও বৈশিষ্ট্যের সাথে পরিচিত হলে মানুষ উপলব্ধি করবে যে, যাঁর শান এই তিনিই তো ইবাদতের উপযুক্ত।
কুরআন মজীদে কোথাও আল্লাহ তাআলার সিফাত ও গুণাবলীর পর তাওহীদের কথা বলা হয়েছে। কোথাও তাওহীদের কথার পরে দলীল হিসেবে সিফাতের বিবরণ দেওয়া হয়েছে। কুরআন মাজীদের প্রথম সূরা-সূরা ফাতিহায় দেখুন, প্রথমে বান্দার যবানে আল্লাহর সিফাত উচ্চারিত হয়েছে-
الحمد لله رب العلمين، الرحمن الرحيم، مالك يوم الدين.
(তরজমা) সকল প্রশংসা আল্লাহর, যিনি সমগ্র বিশ্বের প্রতিপালক। অসীম দয়াময় পরম দয়ালু। কর্মফল দিবসের মালিক।-সূরা ফাতিহা : ১-৩
এরপর বলানো হয়েছে-
اياك نعبد واياك نستعين
(তরজমা) আমরা তোমারই বন্দেগী করি এবং তোমারই কাছে সাহায্য চাই। অর্থাৎ আল্লাহই যখন আমাদের পরম দয়ালু প্রতিপালক এবং তিনিই যখন আখিরাতের পরম পরাক্রমশালী বিচারক তাহলে কেন আমরা শুধু তাঁরই ইবাদত করব না এবং সকল প্রয়োজনে শুধু তাঁরই কাছে সাহায্য প্রার্থনা করব না? অবশ্যই আমরা একমাত্র আল্লাহরই ইবাদত করব এবং একমাত্র তাঁরই কাছে সাহায্য প্রার্থনা করব।
এবার আয়াতুল কুরসীতে তাওহীদের প্রসঙ্গ দেখুন। এখানে প্রথমে তাওহীদ, এরপর দলীল হিসেবে সিফাতের আলোচনা। ইরশাদ হয়েছে-
الله لا اله اله هو
আল্লাহ ছাড়া ইবাদতের উপযুক্ত কেউ নেই।
এ হচ্ছে তাওহীদ। এরপর
الحى القيوم
অর্থাৎ তিনি শাশ্বত ও চিরজীবী। প্রকৃত, শাশ্বত ও নিজস্ব জীবন একমাত্র তাঁর। অন্য সবার জীবন ক্ষণস্থায়ী ও আল্লাহ-প্রদত্ত। এবং তিনিই এই গোটা বিশ্বজগতের নিয়ন্ত্রক।
এরপর বলা হয়েছে-
لا تأخذه سنة ولا نوم
না তাঁর তন্দ্রা আসে, না নিদ্রা। অর্থাৎ তিনি সর্বদা সজাগ। নিদ্রা ও তন্দ্রার মতো বিষয়ের তিনি উর্ধ্বে।
له ما فى السموت وما فى الارض
যমীনে-আসমানে যা কিছু আছে সব তাঁরই। তিনিই সব কিছুর মালিক-মোখতার।
من ذا الذى يشفع عنده الا باذنه
কে আছে, যে তাঁর সমীপে তাঁর অনুমতি ছাড়া সুপারিশ করে? কেউ নেই।
يعلم ما بين اديهم وما خلفهم ولا يحيطون بشيئ من علمه الا بما شاء
যা কিছু বান্দাদের সামনে উপস্থিত তা-ও তিনি জানেন, যা উপস্থিত নয় তা-ও জানেন। পক্ষান্তরে তারা আল্লাহ তাআলার অসীম জ্ঞানের একটি জিনিসও পুরাপুরি জানতে পারে না। তবে তিনি যদি তাদেরকে কিছু জানাতে চান শুধু তখনই তারা ঐ বিষয়টি জানতে পারে এবং যতটুকু জানাতে চান শুধু ততটুকুই জানতে পারে।
وسع كرسيه السموت والارض ولا يؤده حفظهما وهو العلى العظيم
তাঁর ‘কুরসী’ আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীময় পরিব্যাপ্ত। এ দুয়ের রক্ষণাবেক্ষণ তাঁকে ক্লান্ত করে না। তিনি মহান, শ্রেষ্ঠ।
তো আয়াতুল কুরসীতে দেখা যাচ্ছে, প্রথমে তাওহীদের কথা। এরপর আল্লাহ তাআলার সিফাতের বিবরণ, যা জানার পর মানুষ নিজেই উপলব্ধি করে যে, একমাত্র তিনিই সত্য ইলাহ। ইবাদত বন্দেগী পাওয়ার হক একমাত্র তাঁরই।
তেমনি সূরায়ে ইখলাসে তাওহীদের বিবরণ দেখুন।
শুরুতে আল্লাহ তাআলার ‘ওহদানিয়াত’- قل هو الله احد
বল ও স্বীকার কর, তিনি আল্লাহ এক, একক।
এরপর তাঁর সিফাতের বিবরণ- الله الصمد لم يلد ولم يولد ولم يكن له كفوا احد
আল্লাহ বে-নিয়াজ। তিনি কারো মুখাপেক্ষী নন। কিন্তু সবাই তাঁর মুখাপেক্ষী। তার কোনো সন্তান নেই, তিনিও কারো সন্তান নন। তার সমকক্ষ কেউ নেই।
এই ছোট ছোট বাক্যে আল্লাহ তাআলার যে শান বয়ান করা হয়েছে তা জানার পর মানুষ উপলব্ধি করে যে, সত্য ইলাহ একমাত্র তিনি। কারণ তিনি কারো মুখাপেক্ষী নন, অথচ সবাই তাঁর মুখাপেক্ষী। আর তাঁর সমকক্ষ কেউ নেই।
তো কুরআন মজীদে তাওহীদের বিবরণ সম্পর্কে একটি মৌলিক কথা আরজ করা হল। এর আলোকে তাওহীদ-প্রসঙ্গ এবং কুরআন মজীদে তাওহীদের বিবরণ বোঝার ক্ষেত্রে সহায়তা পাওয়া যাবে ইনশাআল্লাহ। (ক্রমশ)
ভাষান্তরে : মুহাম্মাদ যাকারিয়া আবদুল্লাহ