উ ম্মা হ : গুয়ানতানামো, সাবেরি আর সোয়াত কোথায় আমেরিকা কী করছে?
বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট জনাব বারাক হোসেন ওবামা নির্বাচনের আগে ঘোষণা করেছিলেন তিনি বিজয়ী হলে গুয়ানতানামো কারাগার বন্ধ করে দেবেন। ‘সন্ত্রাসের অভিযোগে’ ধৃত মুসলমানদের ওপর অমানবিক অত্যাচার চালিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার ধারা থামিয়ে দেবেন। সর্বোপরি মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করবেন। বিজয়ের পর চারটি মাস অতিবাহিত হওয়া সত্ত্বেও এ ক্ষেত্রে তার প্রতিশ্রুতি পূরণের কোনো নজির দেখা যায়নি। তার কথাবার্তায় পূর্বসূরী নির্লজ্জ ব্যক্তিটির পরিবর্তে কিছু ‘সৌজন্য’ ও ‘কূটনৈতিক আবরণের’ নমুনা পাওয়া গেলেও বাস্তবে কোনো নতুন উদ্যোগের আলামত লক্ষ করার সুযোগ পাওয়া যায়নি। উপরন্তু গুয়ানতানামোতে বন্দীদের ওপর অমানবিক নির্যাতনের ব্যাপারে সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে ডোনাল্ড রামসফেল্ডসহ যারা অনুমোদন দিয়েছিলেন তাদেরকে কোনো শাস্তি না দেওয়ার ঘোষণা তিনি দিয়েছেন এই মধ্য এপ্রিলে। এসব অত্যাচারমূলক জিজ্ঞাসাবাদ-কলা-কৌশল বন্ধের মৌখিক উদ্যোগ-ইশারার কথা ব্যক্ত হলেও এর সঙ্গে জড়িতদের বিষয়ে কোনো শাস্তিমূলক উদ্যোগের কথা জানানো হয়নি।
নাইন ইলেভেনের পর আফগানিস্তান-ইরাক, পাকিস্তান এবং অপরাপর দেশ থেকে মার্কিন আগ্রাসনবিরোধী মুসলমানদের ধরে নিয়ে কিউবার গুয়ানতানামো দ্বীপে অবস্থিত কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। বিনা বিচারে তাদের আটকে রাখা হয়। পানিতে চুবিয়ে রাখা, কুকুর লেলিয়ে দেওয়া, উলঙ্গ করে রাখা, ইলেক্ট্রনিক শক দেওয়া, ধর্মীয় অবমাননা করাসহ বিভিন্নভাবে সেই মুসলিম বন্দীদের ওপর যে সব অত্যাচার চালানো হতো মার্কিন নিয়ন্ত্রণাধীন মানবাধিকার সংগঠনগুলোই সেগুলোকে অমানবিক ও বর্বরোচিত বলে আখ্যায়িত করে আসছিল। মার্কিনীদের স্বার্থ আর নিষ্ঠুরতার পক্ষে ঐক্যের জোর এতটাই যে, একজন ওবামার প্রতিশ্রুতির মূল্য সেখানে ‘কিছুই না’ বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। অথচ বিপরীত একটি নমুনা দেখুন। গত এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে মার্কিন নাগরিক রোখসানা সাবেরি নামের একজনকে ইরানের একটি আদালত সে দেশের কারাগারে নিক্ষেপ করেছে। সাংবাদিক পরিচয়ে ইরানে এসে ওই মহিলা গোয়েন্দাবৃত্তিতে নিয়োজিত ছিল বলে আদালতের কাছে প্রমাণিত হওয়ায় আদালাত তাকে শাস্তি দিয়েছে। এতেই আমেরিকার প্রতিক্রিয়া হয়েছে মারাত্মক। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, সাবেরিকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে এবং ইরানের প্রেসিডেন্ট সাবেরির পক্ষে আত্মপক্ষ সমর্থন ও সব আইনী পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ দিতে ইরানের ওই আদালতের প্রতি আহবান জানিয়েছেন। এখনো জিজ্ঞাসাবাদের নামে তার ওপর কোনো অত্যাচার চালানো হয়নি। সাবেরির পিতা তার সন্তানের সঙ্গে দেখা করে সাংবাদিকদের বলেছেন, তার মেয়ে ভালো আছে। তারপরও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট জনাব বারাক ওবামা তার দেশের একজন নাগরিককে গ্রেফতার করায় দুঃখপ্রকাশ করেছেন। বলা হচ্ছে, টানাপোড়েন চলতে থাকা ইরানের সঙ্গে এ কারণে মার্কিনীদের সম্পর্ক আরো খারাপ হতে পারে।
অর্থাৎ বিষয়টি দাঁড়াল এই যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট ইচ্ছা করলে পৃথিবীর যে কোনো দেশের (যদি মুসলিম দেশ হয় তাহলে তো কথাই নেই) যে কোনো নাগরিককে দোষ প্রমাণিত না হলেও ধরে নিয়ে যে কোনো দ্বীপের জিন্দানখানায় বন্দী করে বর্বরোচিত আচরণ চালিয়ে যেতে পারবে। তাতে কোথাও কোনো সমস্যা হবে না, কিন্তু তার কোনো নাগরিককে দেশবিরোধী নির্দিষ্ট অপরাধে ধরে জেলে দিলে তাতে আন্তঃরাষ্ট্র সম্পর্কে প্রভাব সৃষ্টি করবে। এক দিকে পৃথিবীর সব দরিদ্র মুসলিম মানুষের মূল্য। আরেকদিকে যে কোনো মার্কিন নাগরিকের মূল্য, যা সবার চেয়েও বেশি। এ ধরনের অসাম্য ও ‘জোর যার ...’ নীতি অনুসরণ করে পৃথিবীতে নতুন উদ্যোগ আর নতুন যুগের সূচনা সম্ভব নয়। মার্কিনীদের নীতি হচ্ছে, অন্য যে কাউকে আমরা অপরাধী বলে সন্দেহ করলেই সে অপরাধী আর আমাদের কেউ অপরাধ করে ধরা পড়লেও তার দিকে কেউ আঙুল উঠাতে পারবে না। এতবড় মানবিক অসাম্য নিয়ে দুনিয়া কি স্থির ও শান্ত থাকতে পারে? অপরদিকে পাকিস্তানে আবারো শরীয়া আইন বাস্তবায়ন-পন্থীদের ব্যাপারে মার্কিনীদের রাগ-ক্ষোভ প্রকাশ্য হয়ে ওঠেছে। সোয়াতে কেন শান্তিচুক্তি করা হল, কেন সেখানে শরীয়া আইন বলবৎ করার সুযোগ দেওয়া হল এ নিয়ে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারী ক্লিনটন প্রকাশ্যে উষ্মা প্রকাশ করেছেন।
গত ২৩ এপ্রিল এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘পরমাণু শক্তিধর পাকিস্তান ক্রমেই বিশ্বের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে।’ তিনি তালেবানদের ব্যাপারে সরকারের নীতিমালার সমালোচনা করে বলেন, চরমপন্থীদের প্রতি সরকারের নমনীয় মনোভাবের কারণে তারা ক্রমেই একটার পর একটা এলাকায় নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারছে। সোয়াতে তালেবানদের সঙ্গে সরকারের চুক্তির বিরোধিতা করার জন্য তিনি পাকিস্তান সরকারের কর্মচারী এবং জনগণের প্রতি আহবান জানান।
মূলত ইসলামাবাদের ১০০ কিলোমিটার দূরত্বের ভেতরে অবস্থিত বুনার জেলায় তালেবানরা তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পরই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এই বক্তব্যটি দিয়েছেন। তার বক্তব্যে মনে হতে পারে-পাকিস্তানের তালেবানরা সোয়াতের পর বুনারে কোনো অমানবিক আইনের প্রতিষ্ঠা করেছেন। কিন্তু বাস্তবে এটাকে সত্য বলে মনে করা যাচ্ছে না। জনগণ তাদের ন্যায়ানুগ শাসনকে অভিনন্দন জানালেও কেবল আমেরিকার ধমকে পাক আর্মির উদ্যোগে তারা শেষ পর্যন্ত বুনার জেলা ত্যাগ করেন। কেবল শরীয়া আইনের বাস্তবায়নকে যারা সন্ত্রাসবাদ বলে অভিহিত করেন তারাই যখন দুনিয়ার নিয়ন্ত্রক শক্তিতে পরিণত হন তখন সত্যকে এভাবেই মিথ্যা দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়।