দ্বীনী মাদরাসাসমূহের মজলূমানা হালত : তলাবায়ে কেরামের দায়িত্ব
কওমী মাদরাসাগুলো এখন যে নাযুক পরিস্থিতি অতিক্রম করছে তা কারো অজানা নয়। দীর্ঘদিন থেকেই দ্বীনী মাদরাসাগুলো দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বহু ষড়যন্ত্রের শিকার। এখন অবস্থা আরো কঠিন হচ্ছে। এর বাহ্যিক কারণ তো ওই সব জালিমদের অত্যাচার-অজ্ঞতা, কিন্তু প্রশ্ন এই যে, এই জালিমদেরকে আল্লাহ তাআলা কেন মাদরাসাগুলোর দিকে লেলিয়ে দিয়েছেন? এর পিছনে কি কোনো অন্তর্নিহিত কারণও রয়েছে? কুরআন-সুন্নাহয় উল্লেখিত জাযা ও ছাযার ইলাহী নিয়ম সম্পর্কে যাদের সূক্ষ্ম দৃষ্টি রয়েছে এবং বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কেও অবগত তারা অনুধাবন করেন যে, এইসব কেবল ঘটনাচক্রের বিষয় নয়। তদ্রূপ শুধু বাহ্যিক কারণগুলোই একমাত্র কারণ নয়; বরং উদ্ভূত পরিস্থিতির পিছনে একটি বাতেনী বিষয়ও কার্যকর রয়েছে। তা এই যে, আল্লাহ তাআলা যে কওমকে যেসব বৈশিষ্ট্যের দ্বারা ইযযত, সম্মান, প্রভাব ও প্রতিষ্ঠা দান করেন তারা যখন সেসব বিষয়ে উদাসীন ও রিক্তহস্ত হয়ে যায় তখন তাদের প্রভাব ও প্রতিষ্ঠা লুপ্ত হতে থাকে। এই উদাসীনতা যত বেশি হয়, হীনতা ও লাঞ্ছনার আযাবও তত কঠিন হয়ে যায়।
খলীফায়ে রাশিদ হযর উমর রা.-এর বাণী স্মরণ করুন। তিনি বলেছিলেন,
إنا كنا أذل قوم أعزنا الله بالإسلام، فهما نطلب العز بغير ما أعزنا الله به أذلنا الله
এই ইলহামী উক্তির আলোকে চিন্তা করুন : আহলে মাদারিসের প্রভাব ও মর্যাদার মূল বিষয় এই যে, এই মাদরাসাগুলো হচ্ছে ‘রিজালুল্লাহ’ তৈরির কেন্দ্র। রিজালুল্লাহ অর্থ এমন ব্যক্তিত্ব, যারা তাফাক্কুহ ফিদ্দীন, রুসূখ ফিলইলম এবং তাকওয়া ও খোদাভীতির গুণে গুণান্বিত হবেন। যারা নিজেদের কর্ম ও আচরণ এবং ছূরত ও ছীরতের মাধ্যমে ইসলামী আদর্শের প্রতিনিধিত্ব করবেন আর অন্যের জন্য উসওয়ায়ে হাসানা হবেন। যাদের ইখলাস ও লিল্লাহিয়্যাত সকল সন্দেহ-সংশয়ের উর্দ্ধে থাকবে, যারা হবেন মুসলিম উম্মাহর ব্যথায় ব্যথিত এবং উম্মাহর কল্যাণে শরীয়তের বিধান মোতাবেক বিভিন্ন অঙ্গনে নিবেদিত। তাঁদের মধ্যে এমন একটি দল থাকাও অপরিহার্য, যারা যুগের সমস্যা ও চাহিদাগুলো অনুধাবন করেন এবং তার সমাধান প্রদানের যোগ্যতা রাখেন তারা
من لم يعرف أهل زمانه فهو جاهل
এর অন্তর্ভুক্ত হবে না।
এখন আমাদের তালিবে ইলম ভাইদের চিন্তা করা উচিত, তারা এই মানদন্ডে কতটুকু উত্তীর্ণ? কোনো সন্দেহ নেই যে, কওমী মাদরাসাকে দুশমনের হামলা থেকে রক্ষা করার সবচেয়ে বড় উপায় হল, মাদরাসার তলাবা-আসাতিযা এবং প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা, কর্মচারী, সহযোগী, শুভানুধ্যায়ী সবাইকে মাদরাসার আদর্শ ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে সচেতন হতে হবে এবং প্রত্যেককে নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে সেই আদর্শের উপর অবিচল থাকতে হবে। আর এ বিষয়ে তালিবে ইলমদের দায়িত্বই সবচেয়ে বেশি। কেননা, তারাই এই মাদরাসাগুলোর মূল পুঁজি। এজন্য এখন তালিবে ইলম ভাইদের কিছু করণীয় রয়েছে, যে বিষয়ে এখনই তাদের মনোযোগী হওয়া কর্তব্য।
১. নিজের মানসিব সম্পর্কে সচেতন হওয়া। তাদের জানতে হবে, তারা কে, তাদের পরিচয় কী? হযরত মাওলানা মনযূর নুমানী রাহ.-এর বয়ান-আপ কোন হেঁয়, ক্যায়া হেঁয়, আপকা মানসিব কিয়া হ্যাঁয়? প্রত্যেক তালিবে ইলমের অবশ্যই অধ্যয়ন করা উচিত এবং সে অনুযায়ী আমল করা উচিত।
২. কওমী মাদরাসার প্রকৃত পরিচয় এবং তার আদর্শ-উদ্দেশ্য গভীরভাবে বোঝার চেষ্টা করা। এ বিষয়ে হযরত মাওলানা আবুল হাসান আলী নদভী রাহ.-এর বক্তৃতা-সংকলন-‘পা জা ছুরাগে যিন্দেগী’ প্রথম সুযোগেই অধ্যয়ন করা উচিত।
৩. তাসহীহে নিয়ত এবং ইখলাস ও ইহতিসাবের বিষয়ে মনোযোগী হওয়া কর্তব্য। মাঝে মাঝে নিজের নিয়ত পরীক্ষা করে দেখা উচিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ইরশাদ স্মৃতিতে রাখুন-
من تعلم علما مما يبتغي به وجه الله لا يتعلمه إلا ليصيب به عرضا من الدنيا لم يجد عرف الجنة.
যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য অর্জনীয় ইলম শুধু এজন্য অর্জন করে যে, এর দ্বারা দুনিয়ায় কিছু বিষয় অর্জন করবে সে জান্নাতের খোশবুও পাবে না। (মুসনাদে আহমদ ২/৩৩৮ হাদীস ৮২৫২; সুনানে আবু দাউদ ২/৫১৫ হাদীস ৩৬৬৪; সুনানে ইবনে মাজাহ পৃ. ২২ হাদীস ২৫২)
৪. নিজেকে রিজালুল্লাহর কাতারে শামিল করার জন্য যে নিমগ্নতা চাই তেমন নিমগ্নতার সঙ্গে মেহনত করা কর্তব্য।
রসমী ‘মাওলানা’ হয়ে সন্তুষ্ট হয়ে যাওয়া এবং এতেই নিজেকে আলিম মনে করতে থাকা দ্বীনী মাদরাসার আদর্শ ও উদ্দেশ্যের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। অথচ এটাই এখন আমাদের সবচেয়ে বড় আল্মিয়া (ট্রাডেজি)।
৫. নিজের আচার-ব্যবহার, আখলাক-চরিত্র ও মনোজগতের পরিশুদ্ধির বিষয়ে যত্নবান হওয়া এবং এ বিষয়ে কোনো রকম উদাসীনতার শিকার না হওয়া। ইলম অত্যন্ত গায়রত ও শরাফত সম্পন্ন, হৃদয়ের পবিত্রতা এবং চরিত্রের সূচিতা ছাড়া ইলম কারো সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে না। ইলমের কিছু বাক্য যে কেউ মুখস্থ করতে পারে, কিন্তু আলেম তো সে-ই, যার মধ্যে তাফাক্কুহ ফিদ্দীন ও রুসূখ ফিলইলম রয়েছে। আর এই দুই বৈশিষ্ট্য হৃদয় ও চরিত্রের পবিত্রতা ছাড়া অর্জন করা কখনো সম্ভব নয়।
৬. প্রত্যেক তালিবে ইলমের অনুধাবন করা উচিত যে, দুশমনদের হামলা থেকে একমাত্র আল্লাহই আমাদের রক্ষা করতে পারেন। এজন্য আল্লাহর সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক দুরসত করা হল আমাদের প্রথম কর্তব্য। তাআল্লুক মাআল্লাহর জন্য যে বিষয়গুলো ফরযের পর্যায়ে সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে-
১. ঐ সমস্ত গুনাহের কাজ থেকে বেঁচে থাকা যেগুলো আল্লাহর অসন্তুষ্টি ও ক্রোধকে বাড়িয়ে দেয়। সব ধরনের প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য অশ্লীল কাজ এর অন্তর্ভুক্ত। এজন্য যত মুজাহাদা ও কষ্টই হোক না কেন অশ্লীল কাজ থেকে পুরোপুরি বিরত থাকা জরুরি।
২. কুরআন ও হাদীসের আলোকে যে সকল কাজ লা’নতের কারণ বা আযাবের কারণ সেগুলো থেকে বিশেষভাবে বেঁচে থাকতে হবে। যে সকল গুনাহের কারণে পূর্ববর্তী উম্মতের উপর আযাব নাযিল হয়েছে সেগুলো এই পর্যায়ভুক্ত। কুরআন মজীদ তেলাওয়াতের সময় এদিকে লক্ষ রাখা আবশ্যক।
৩. যে সমস্ত আমলের বদৌলতে বিপদ দূর হয় এবং রহমত নাযিল হয় সেসব আমলের যথাসাধ্য ইহতিমাম করা। বিশেষ করে নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী দান-সদকা করা, তা পরিমাণে যত কমই হোক না কেন। তওবা ও ইস্তিগফার করা। প্রতিদিন কমপক্ষে একশ বার কোনো না কোনো কালিমায়ে ইস্তিগফার পড়া উচিত। যদি এক বৈঠকে পড়া সম্ভব না হয় তবুও। তবে দিল থেকে পড়তে হবে। যাতে :
توبہ بر لب سبح بر كف دل پر ازذوق گناہ
معصيت را خندہ مى آيد بر استغفار ما
এর দৃষ্টান্ত না হতে হয়।
সকাল-সন্ধ্যা দিল থেকে সায়্যিদুল ইস্তিগফার পড়া উচিত। বিশেষ করে শোয়ার পূর্বে তওবা ও ইস্তিগফার করে নেওয়া। এছাড়া দিনেরাতে কমপক্ষে একবার সালাতুত তাওবা পড়া উচিত।
৪. অহংকার, আত্মগরিমা ও হিংসার ন্যায় ধ্বংসাত্মক রোগ থেকে নিজেকে পবিত্র করার চেষ্টা করা।
নিজের তা’লীমী মুরববী কিংবা ইসলাহী মুরববীর নিকট থেকে প্রতিকার জেনে সে মোতাবেক আমল করুন।
৫. গীবত ও অন্যান্য যবানী গোনাহ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখা এবং অহেতুক কথাবার্তায় লিপ্ত হয়ে সময় নষ্ট না করা।
৬. কুরআন তেলাওয়াত করা। প্রতিদিন কমপক্ষে ছয় তাসবীহ, ইশরাক, আওয়াবীন ও তাহাজ্জুদের নামায পড়ুন। অন্তত বিতরের পূর্বে দুই চার রাকাত নামায কিয়ামুল লাইলের নিয়তে পড়ার ইহতিমাম করুন।
৭. ইসলামের আদাবে যিন্দেগী মুতালাআ করে তার উপর আমল করার চেষ্টা করুন।
৮. তালিবে ইলমের আসল কাজই হল, একাগ্রচিত্তে মুতালাআ করা, তাকরার করা ও তামরীন করা। অর্থাৎ ইসতি’দাদ তৈরি করা, ইসতি’দাদ পরিপক্ক করা, ইলমের ভান্ডার সমৃদ্ধ করা এবং তাফাক্কুহ ও রুসূখ হাসিল করা। তাই ওযীফা ও যিকর, নফল ও সুনানের প্রতি অধিক মনোযোগ দেওয়ার সুযোগ হয় না। কিন্তু ইলমের মধ্যে নূর পয়দা করার জন্য এবং ইলমে কাসবীর সঙ্গে ইলমে ওয়াহবীর যোগসূত্র স্থাপনের জন্য যেহেতু এছাড়া আর কোনো পথ নেই তাই তালেবে ইলম ভাইদের জন্য কয়েকটি হেদায়েত।
একটি হেদায়েত হল,
أخلص دينك يكفك العمل القليل
এর পথ অবলম্বন করা। ইখলাসে দ্বীনের জন্য নিয়ত সহীহ করার পাশাপাশি ইহসান, ইহতিসাব এবং সকল কাজ সুন্নত তরীকায় করা জরুরি।
দ্বিতীয় হেদায়েত হচ্ছে,
اتق المحارم تكن أعبد الناس
এর মূলনীতির উপর আমল করা।
তৃতীয় হেদায়েত হচ্ছে, ঐ সমস্ত আমলের দিকে অধিক মনোযোগ দেওয়া যেগুলোতে সওয়াব ও ফায়দা অধিক কিন্তু আমল করা এতই সহজ যে, না তাতে অতিরিক্ত কষ্ট করতে হয়, আর না অধিক সময় ব্যয় করতে হয়। এ ধরনের আমলের জন্য উস্তাযে মুহতারাম হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ তকী উছমানী দামাত বারাকাতুহুম-এর ‘আসান নেকিয়াঁ’ মুতালাআ করা যেতে পারে।
এ ধরনের সহজ আমলের মধ্যে দুআয়ে মাসনূনগুলো বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তদ্রূপ অধিকহারে সালাম দেওয়া (ইফশাউস সালাম) যা শুধু সহজই নয়; বরং গুরুত্বপূর্ণ একটি সুন্নতও বটে, কিন্তু এটি আজকাল মাদরাসাগুলো থেকে বিদায় নিতে শুরু করেছে। সেই সাথে যে কাজই করি না কেন তা সুন্নত তরীকায় করা। এটি এমন একটি আমল, যার জন্য সাধারণত অতিরিক্ত কোনো সময় ব্যয় হয় না। একটু খেয়াল করলেই হয়। এভাবে চিন্তা করলে আরো অনেক আমল পাওয়া যাবে।
৯. প্রত্যেক তালিবে ইলমের একথা বোঝা দরকার যে,
انا نحن نزلنا الذكر وانا له لحافظون
আল্লাহ তাআলা ‘আয্যিকর্’-এর হেফাযতের দায়িত্ব নিয়েছেন। এজন্য যদি আমরা ‘আয্যিকর্’ ওয়ালা যিন্দেগী গ্রহণ করি, সে অনুযায়ী নিজের জীবনকে সজ্জিত করি এবং সঠিক অর্থে ‘হামিলীনে যিকর’ অন্য শব্দে ‘হামিলীনে ইলমে ওহী’ হই, তাহলে ‘আয্যিকর্’-এর হেফাযতের সাথে সাথে আমাদেরও হেফাযত হয়ে যাবে।
মনে রাখবেন, প্রত্যেক পড়নেওয়ালা ‘হামিলে ইলম’ হতে পারে না। ‘হামিলে ইলম’ শুধু সে-ই, যে ইলমের হুকুক ও আদাব পুরোপুরি আদায় করে।
১০. দুশমনদের থেকে নিজেদের এবং দ্বীনী মাদারিস ও মারাকিযের হেফাযতের জন্য এ সংক্রান্ত মা’ছূর ও মুজাররাব দুআ ও আমলের বিশেষ ইহতিমাম করা। যেমন-
حَسْبُنَا اللهُ وَنِعْمَ الْوَكِيْلُ
لا حَوْلَ وَلا قُوَّةَ إِلا بِاللهِ، لا مَلْجَأَ وَلا مَنْجَأَ مِنَ اللهِ إِلا إِلَيْهِ.
إِنَّا كَفَيْنَاكَ الْمُسْتَهْزِئِيْنَ.
ইত্যাদি। প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে যদি ইজতিমায়ী দুআর ব্যবস্থা থাকে তাহলে তাতে ইহতিমামের সাথে শরিক হওয়া। নতুবা ব্যক্তিগতভাবে সুযোগ অনুযায়ী আমল ও দুআর চেষ্টা করা।
সর্বশেষ একটি কথা মনে রাখুন, আপনি যদি সত্যিকারের আলেম হন তাহলে আপনাকে দেখে দুশমনদের ক্রোধ প্রজ্জলিত হবে, কিন্তু সেই ক্রোধ হবে তাদের জন্যই আযাবের কারণ।
ليغيظ بهم الكفار
আর যদি আপনি ইলমের লেবাসধারী কোনো আলেম হন তাহলেও আপনাকে দেখে তাদের ক্রোধ পয়দা হবে (কেননা এই নাম ও সূরতের সাথেই তাদের দুশমনী রয়েছে) কিন্তু তাদের এই ক্রোধ তখন আপনার জন্য আযাবের কারণ হবে
لينزعن الله من صدور عدوكم المهابة منكم
আল্লাহ তাআলা আমাকে এবং সকল তালিবে ইলম ভাইকে সহীহ অর্থে তালেবে ইলম বানিয়ে দিন। এমন তালিবে ইলম বানিয়ে দিন যার অস্তিত্বই হবে দ্বীনী মাদরাসা ও মারকাযসমূহের হেফাযতের অসীলা।
وصلى الله تعلى وسلم سيدنا ومولانا محمد وعلى آله وصحبه أجمعين، والحمد لله رب العالمين.