জুমাদাল উলা ১৪৩০   ||   মে ২০০৯

তাঁরা কি কখনো সত্য বলবেন না

আবদুল্লাহ মালিক

খুব আশ্চর্য লাগল এবং ব্যথিত হলেও নিজেকে খুব কষ্টে সামলে নিলাম। কেননা, আল্লাহ তাআলার ইচ্ছা না হলে তো প্রবন্ধটা আমার চোখেই পড়ত না। তাই কষ্টটাকে সংযত করে কিছু লেখার ইচ্ছা করেছি। তবে নিজের প্রতি এই ভাবনাও উঁকি দিচ্ছিল যে, এই ইবলিসী প্রচেষ্টা নস্যাৎ করার শক্তি কি তোমার মতো ক্ষুদ্র মানুষের আছে? তবে একই সঙ্গে একথাও মনে হল যে, আল্লাহ তাআলার রহমত তো অসীম। আর যারা দ্বীনের শত্রু তারা তো আল্লাহ তাআলারও শত্রু। তাঁদের সাথে যুদ্ধ স্বয়ং আল্লাহ তাআলার! অতএব আমাদের কী চিন্তা? আমরা তো শুধু আমাদের সাধ্যমতো দায়িত্বটুকুই পালন করতে পারি। হয়তো এই সামান্য থেকে সামান্য চেষ্টাই নাজাতের উসিলা হবে।

 

আমি দৈনিক পত্রিকার নিয়মিত পাঠক নই; বরং অনিয়মিত পাঠক বললেও ভুল হবে। হঠাৎ কোনো পত্রিকা হয়তো কখনো দেখি; একটু পড়ি অর্থাৎ কদাচিৎ পাঠক।

 

পাশে ছিল Daily Star সেটি উল্টালাম। ঢুকলাম পত্রিকার মাঝখানে-সম্পাদকীয় পাতায়। সে পাতায়ই শিরোনাম : `The alleged madrasa terrorism linkage’ মাদরাসায় সন্ত্রাস নেপথ্যে। কী বলতে চায়? লেখকের নামটি বড় সুন্দর-নূরুল হুদা। আহা! সত্যিই যদি তিনি নূরুল হুদা হতেন!

 তার লেখার সূচনা হয়েছে কিছু দিন পূর্বে প্রধানমন্ত্রীর সাথে উলামাদের বৈঠক নিয়ে, যেখানে-লেখকের বক্তব্য অনুসারে প্রধানমন্ত্রীর কাছে ধর্মীয় নেতাদের একটি দল কওমী মাদরাসা সংক্রান্ত কিছু মন্তব্যের উপর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। কওমী মাদরাসার বিরুদ্ধে আনীত সাম্প্রতিক অভিযোগকে লেখক খুবই মারাত্মক এবং তার প্রতিক্রিয়া খুব তীব্র বলে আখ্যা দিয়েছেন। এরপর তিনি বলেন,

Under our socio-political circumstances, it is difficult to take a dispassionate look at such a matter because some such efforts have, in the past, been dubbed as motivated. Somehow our tolerance threshold has been lamentably low. However, that should not mean that we have to desist from making enquiry into or studying the dimension of so-called religious extremism and depend upon what academics and security experts abroad have to say.

আমাদের সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এই বিষয়টিকে উদাসীনভাবে গ্রহণ করা কঠিন। কারণ অতীতে এরকম কিছু প্রচেষ্টা উদ্দেশ্য প্রণোদিত বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। কোনো না কোনোভাবে আগে আমাদের জানার আগ্রহ দুঃখজনকভাবে কম ছিল। তার অর্থ এটা নয় যে, আমরা তথাকথিত ধর্মীয় চরমপন্থী বিষয়ক অনুসন্ধান থেকে বিরত থাকব আর প্রাতিষ্ঠানিক বা নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা এ বিষয়ে যা বলেন উপর নির্ভর করে যাব।

আরেকটু অগ্রসর হয়ে বলেছেন :

While incidents of unauthorised firearms haul and seizure of inciting literature from some madrasas should alert all concerned, one should avoid wholesale branding of such religious institutions. One has to bear in mind that the establishment of madrasas by the wealthy ones is still considered an act of piety. There is a danger of hurting the sentiments of many if madrasas are alleged to be fomenting the so-called religious extremism.

যেখানে কিছু মাদরাসা থেকে বেআইনী অস্ত্র ও উত্তেজনাকর লেখা আটক করার মতো কিছু ঘটনা সবাইকে উদ্বিগ্ন করে তোলা উচিত, সেখানে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ঢালাওভাবে বলাটাও কারো পক্ষে আবার সম্ভব হয় না। কারণ এটা মাথায় থাকে যে, ধনীদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত এই মাদরাসাগুলো এখনো ধর্মীয় কাজ বলেই বিবেচিত। তাই  এইসব মাদরাসার বিরুদ্ধে চরমপন্থীরঅভিযোগ আনলে বহু মানুষের মনে আঘাত লাগবে।

আমাদের দুর্ভাগ্য যে, এই ধরনের মানুষগুলো কখনো সত্যকে স্বীকার করে না। গ্রিন ক্রিসেন্ট নামে যে এনজিও প্রতিষ্ঠান থেকে সম্প্রতি অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনা মিডিয়ায় প্রচারিত হয়েছে, একজন সাধারণ মানুষও বোঝেন যে, সেটা কোনো মাদরাসা নয়,  তবুও বারবার মাদরাসা শব্দটাই তারা ব্যবহার করছেন। একটি মিথ্যাকে দশবার বললে সত্যে পরিণত হয়, সম্ভবত এই তত্ত্বেই তারা বিশ্বাসী। আর কওমী মাদরাসার বিরুদ্ধে সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের অপবাদ দেওয়া হলে সেটা কি শুধু বহু মানুষের মনে আঘাত লাগার বিষয়, এতে কি মিথ্যা বলার অন্যায় হয় না? না কি মিথ্যা বলাটা আজকাল কোনো অপরাধই নয়?

তিনি প্রশ্ন করেছেন, এই মাদরাসাগুলোর দ্বারা এ পর্যন্ত কী উপকার হয়েছে?

এর উত্তর মাদরাসা ওয়ালাদের দিতে হবে না। এর উত্তর দিবেন এ দেশের লক্ষ-কোটি ইসলামপ্রিয় মানুষ। তাঁরা এই সব প্রতিষ্ঠানকে প্রয়োজনীয় বলেই মনে করেন। কিন্তু ইসলামের সঙ্গে যাদের কোনো ধরনের সম্পর্ক নেই, জীবনের কোনো ক্ষেত্রেই যারা ইসলাম মোতাবেক চলেন না এবং চলার প্রয়োজনও বোধ করেন না তারা কীভাবে ইসলামের ও ইসলামী প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন ও উপকারিতা অনুধাবন করবেন। তিনি যদি প্রশ্ন করতেন, এ দেশে এত হাজার হাজার মসজিদ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার দ্বারা দেশের কী উপকার হচ্ছে তাহলেও তো অবাক হওয়ার কিছু ছিল না। তিনি প্রশ্ন করেছেন,

Was moral rearmament or spiritual renaissance the predominant factor behind unusual growth of religious institutions? However, doubts creep in as we do not see any corresponding rise in public or private morality.

নৈতিকভাবে শোভিত হওয়া বা আত্মিক রেনেসাঁই কি এই সব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের অস্বাভাবিক বৃদ্ধির প্রধান উদ্দেশ্য ছিল কিন্তু  সন্দেহ উঁকি দেয় যখন আমরা দেখি যে, এইসব প্রতিষ্ঠান দ্বারা সমষ্টিগত বা ব্যক্তিগত নৈতিকতার কোনো উন্নতি নেই।

লেখক অজান্তেই একটা সত্য কথা বলেছেন। তিনি যে অঙ্গনে বিচরণ করেন এবং তাঁর অভিজ্ঞতার পরিধি যতটুকু সে হিসেবে এই কথাটা সত্য। কিন্তু এর দায় তো মাদরাসা ও ইসলামী শিক্ষার নয়। আপনারা নিজেদের অঙ্গনে ইসলামকে বিসর্জন দিয়েছেন বলেই তো দুর্নীতি, মিথ্যাচার আর অশ্লীলতার সয়লাবে ডুবে গেছেন। কিন্তু এখনও যারা ইসলামের সঙ্গে নিজেদেরকে যুক্ত রেখেছেন, তারা এখনও অনেক বেশি নৈতিকতার অধিকারী। এখনকার অনেক লেখক-কলামিস্টেরই একটা প্রবণতা হল তারা নিজেদের অজ্ঞতাকে অন্যের উপর চাপিয়ে দেন। যেমন এই নিবন্ধেই বলা হয়েছে,

The suspicion is that while the establishment, the civil society and other activists have remained in the dark

মাদরাসায় কী হচ্ছে এ সম্পর্কে সাধারণ জনগণ অন্ধকারে। সত্যিই কি সাধারণ জনগণ অন্ধকারে? তারা তো বিভিন্নভাবে এই মাদরাসাগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত। অন্ধকারে তো তারাই রয়েছেন যাদের কোনো সম্পর্ক মাদরাসার সঙ্গে নেই। সবশেষে একটা অভিযোগ উল্লেখ না করলেই নয়। তিনি বলেন,

There is a fear that with the large increase of madrasas there is a new generation of men being inculcated with misogynist values that have reinforced negative perceptions of women.

আশংকা আছে যে, মাদরাসার সংখ্যা ব্যাপক হলে এমন একটি নতুন প্রজন্ম তৈরি হবে যারা মহিলা বিদ্বেষী হবে।

এখানে প্রথম প্রশ্ন এই যে, নারী-বিদ্বেষের সংজ্ঞা তাদের কাছে কী? নারীকে ভোগ্যপণ্য মনে না করা এবং নারী বিষয়ে পাশ্চাত্যের সীমাহীন চাতুরিপূর্ণ সংস্কৃতি অনুসরণ না করাই কি নারী-বিদ্বেষ? অথচ এটা তো মর্মান্তিক বাস্তবতা যে, পাশ্চাত্য সভ্যতাই নারীকে সবচেয়ে বেশি লাঞ্ছিত করেছে। আজ আমরা যে পত্রিকার পাতা খুললেই ধর্ষণ, এসিড সন্ত্রাস ও নারী নির্যাতনের মর্মান্তিক চিত্র দেখতে পাই এগুলো কি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পাশ্চাত্য সংস্কৃতিরই বিষফল নয়? তাহলে এই সব বুদ্ধিজীবী কি নিজেদের সংস্কৃতির দায় ইসলামী শিক্ষার উপর আরোপ করে দায়মুক্ত হতে চান? তারা মিথ্যা প্রোপাগান্ডার মাধ্যমে ইসলাম-ফোবিয়া তৈরি করতে আগ্রহী, এদের কথাই তা প্রমাণ করে।

নিবন্ধকার লিখেছেন, বাংলাদেশ দরিদ্র দেশ। এদেশের সংবিধান উদার। সাধারণ মানুষ কল্পনাও করতে পারে না যে, ধর্মীয় বিশ্বাস ও চেতনা কত বেশি কঠোর।

আল্লাহ তাআলা এদের অজ্ঞতা, বক্রতা ও অনিষ্ট থেকে আমাদের ঈমানকে হেফাযত করুন। আমীন। #

 

 

advertisement