মোবাইল : একটি নিবন্ধ ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা
গত ৫/৩/২০০৯ ঈ. তারিখে পাকিস্তানের জনপ্রিয় দৈনিক জং পত্রিকায় জনাব ফারুক কায়সার সাহেব ‘মোবাইলের ক্ষতিকর ব্যবহার সম্পর্কে ‘মোবাইল মরয’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ লেখেন। তিনি যেভাবে তার অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছেন তা পাঠকবৃন্দের সামনে তুলে ধরছি। তিনি লেখেন :
কেমন হত যদি মোবাইল না থাকত! মোবাইল ফোন ও প্রাইভেট নিউজ চ্যানেলের আগমনের সাথে সাথে আমাদের সুখ-শান্তি ও ধৈর্য্য-স্থৈর্য্যও বিদায় নিয়েছে। আগে উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েরা যেখানে বড়দের সামনে পরস্পরে কথা বলতেও ভয় পেত, বাড়িতে ফোন থাকা সত্ত্বেও ফোনে কথা বলা কিংবা কথা শোনার সাহস করত না, সেখানে সেলুলার ফোনের সুযোগে এখন তারা নিজেদের রুমে বা বাথরুমে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলতেও ইতস্তত বোধ করে না।
মুরুববীদের সামনেই এসএমএস করে, চ্যাটিং করে, প্রেমালাপ করে, ডেটিং-এর জন্য সময় ও স্থান নির্ধারণ করে। এখন স্কুল-কলেজ থেকে শুরু করে মুদি দোকানদার এমনকি ভিক্ষুকদের কাছেও মোবাইল না থাকা পশ্চাৎপদতা বলে মনে করা হয়। মোবাইলের বদৌলতেই হিংসাত্মক ও ধ্বংসাত্মক ঘটনা ঘটানো সহজ হয়ে গেছে। অন্যদিকে নাশকতাকারী ও সন্ত্রাসীদেরকে ধরা কঠিন হয়ে পড়েছে। গ্রাহকের আইডি (পরিচয়পত্র) ছাড়াই লক্ষ লক্ষ মোবাইল সংযোগ দেওয়া হচ্ছে। এগুলোর মাধ্যমে সন্ত্রাসীরা কোথায়, কীভাবে হামলা চালানো যাবে, ডাকাতি ও লুটপাট করা যাবে তার পরিকল্পনা করে। অপরদিকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কোনো পদক্ষেপ নিতে গেলে এই মোবাইলের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করে নিজেদের অবস্থান বদলে ফেলছে এবং পুলিশের ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাচ্ছে। একথা কি সত্যি যে, মোবাইল যদি না থাকত তাহলে আমাদের উন্নতি-অগ্রগতি থেমে যেত? এটা ঠিক যে, মোবাইলের বদৌলতে যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হয়েছে। দূরত্ব কমে গেছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সকল উন্নতি ও সুবিধা উন্নত জাতির জন্য, আমাদের মতো অনুন্নত জাতির জন্য নয়।
টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে মোবাইল সংক্রান্ত বিজ্ঞাপনের এত বেশি ছড়াছড়ি যে, মনে হয় মোবাইল করা আর প্রেম ও রসের আলাপ করা ছাড়া যেন পৃথিবীতে আর কোনো কাজই নেই। গাড়ি চালানোর সময় সামনের কোনো গাড়িকে যদি দেখা যায় যে, রাস্তার মধ্যে একবার এদিক আরেকবার ওদিক করছে তাহলেই বোঝা যায় যে, ড্রাইভারের এক হাত স্টিয়ারিংয়ে আর অন্য হাতে রয়েছে মোবাইল। ইদানীং কল করলে অপর প্রান্ত থেকে গানও শোনা যায়। কোনো কোনো দ্বীনদার লোক রয়েছে যারা গানের বদলে কুরআনের আয়াত ও তেলাওয়াত সেট করেন। এক্ষেত্রে কী হয়? বহু লোক কুরআন তেলাওয়াত শুনে মিথ্যাচার করতে শুরু করে, অবৈধ কারবার নিয়ে আলাপ করে। এসএমএস একটি ব্যবস্থা যার মাধ্যমে বিজ্ঞাপন, রাজনৈতিক আলাপ, সরকার কিংবা নেতৃস্থানীয় কারো বিরুদ্ধে ইংরেজিতে মত বিনিময়সহ বহু কিছু হয়ে থাকে। অভিনেতা-অভিনেত্রীদের অনেকেই মোবাইলকে তাদের উপার্জনের মাধ্যম বানিয়ে নিয়েছে। তাদের অবসর সময় কাটে ফোনে অশ্লীল কথাবার্তা বলে ও ডাউনলোডকৃত অশ্লীল ছবি দেখে। আমার কয়েকজন বন্ধু আছে, যারা কোথাও একত্র হলেই কার কাছে নুতন কী মডেল আছে, তা নিয়ে গল্প শুরু করে। ৯৯ শতাংশ অভিনেতা-অভিনেত্রীর অবস্থা হল তাদের সাথে না কম্পিউটারের কোনো সম্পর্ক আছে আর না ই-মেইলের কোনো প্রয়োজন তাদের পড়ে। আর বাকি এক শতাংশের অর্ধেক এমন যাদের ইন্টারনেট সংযোগ নেই, যদি থাকেও তাহলে নগ্ন ছবি আর অশ্লীল ছায়াছবি দেখার কাজেই তা ব্যবহৃত হয়।
এখন তো উচ্চপদস্থ ও সরকারী লোকদের দুই-তিনটি করে মোবাইল সংযোগ থাকে। একটি সাধারণ মানুষের জন্য, অন্যটি প্রেমিক-প্রেমিকা ও বন্ধু-বান্ধবদের জন্য তৃতীয়টি স্ত্রীর জন্য। ফোনকারীর আইডি দেখে এই সমস্ত বড় লোকেরা বিপদগ্রস্ত ও সমস্যাগ্রস্ত লোকদের কথা শোনে না। কারো কারো ফোনে তো আনসারিং মেশিন লাগানো থাকে। যাতে কথাবার্তা শুনে সে উত্তর তো দেয়ই না, ভুলে কখনও কল রিসিভ করে ফেললে মিথ্যা কথা বলে। যেমন-আমি এখন শহরের বাহিরে আছি। একবার আমি ইসলামাবাদের এক কফিশপে এক মন্ত্রীকে বসা দেখে তাঁকে কল করলাম। মন্ত্রী মহোদয় রিসিভ করে বললেন, আমি এখন করাচিতে আছি। আমি বললাম, ভাগ্যক্রমে আমিও করাচিতে আছি। যদি অনুমতি দেন তাহলে আপনার সাথে একটু দেখা করে নেই। সে বলল, আমি তো সন্ধ্যার ফ্লাইটে ফিরে যাব, আপনি কীভাবে আমার সাথে দেখা করবেন? আমি বললাম, আমি এখনই দেখা করছি। একথা বলেই হাঁটতে হাঁটতে আমি তার টেবিলে পৌছে গেলাম। সে আমাকে দেখে বিব্রত হল। এরপর শুকনো একটি হাসি দিয়ে বলল, দোস্ত! আগে তো মিছেকথা বলে পার পাওয়া যেত এখন আর পার পাওয়া যায় না! আমি মনে মনে বললাম, মন্ত্রী মশাই মিথ্যে বলেছেন এটা কোনো দোষ নয়। ধরা খেয়ে গেলেন কেন এজন্য মোবাইলের দোষ হয়ে গেছে। আমাদের দেশে চোর-গুন্ডা আর ভিক্ষুকরা মোবাইল থেকে যত উপকৃত হতে পেরেছে সম্ভবত আর কেউ ততটা পারেনি। একবার এক ভিক্ষুককে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ইসলামাবাদে তো ভিক্ষা নিষিদ্ধ করা হয়েছে, এখন কী করবে? উত্তরে সে মোবাইল বের করে বলল, এটা যতক্ষণ থাকবে ততক্ষণ কেউ ধরতে পারবে না। কখনও কোনো সেন্ট্রি আমার পিছে লাগলে আমার সাথী আমাকে ফোন করে সতর্ক করে দিবে। সে পৌঁছার আগেই আমি তার আওতার বাইরে চলে যাব। ব্যাংক ডাকাতরাও মোবাইলের বদলে আর্থিকভাবে বড় মাপের লাভ হাতিয়ে নিয়েছে। ব্যাংক থেকে কেউ টাকা নিয়ে বের হওয়ার সময় ডাকাতদের সঙ্গীরা ব্যাংকের ভেতর থেকেই ফোনে জানিয়ে দিচ্ছে অমুক নগদ এত টাকা নিয়ে ব্যাংক থেকে বের হয়েছে। এভাবে বাস ডাকাতদেরকেও তাদের সাথীরা ফোনে জানিয়ে দেয় অমুক অমুক বাসে ...।
বড় লোকদের মধ্যে পুলিশ অফিসার, আইজি, সচিব, সংবাদপত্র বা চ্যানেলের মালিকদেরও দুটি মোবাইল থাকে। একটি সেক্রেটারির কাছে থাকে, অন্যটি ভি.আই.পি দের জন্য। সাধারণত সেক্রেটারির নম্বর সবাইকে দেওয়া হয়। যদি কোনো সাধারণ লোক কোনো প্রয়োজনে সাহস করে কল করে তখন সেক্রেটারি বলে দেয়, স্যার এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ মিটিংয়ে আছেন। ফলে তারা তাঁদের সাথে কখনই মোবাইলে কথা বলার সুযোগ পায় না।
প্রিয় পাঠক! এভাবেই আমাদের অন্যান্য কর্মকান্ডের মতো মোবাইলও আমাদের দুই নম্বরী সমাজ ব্যবস্থারই প্রতিনিধিত্ব করছে। যেখানে ন্যায়বিচার ও ইনসাফ নেই। যৌনতা ও অশ্লীলতার ছড়াছড়ি, ধোকাবাজি, প্রতারণা, ঘুষ ও মিথ্যার জয়জয়কার। সততা ও সত্যবাদীতার যেখানে কোনোই স্থান নেই, সেই সমাজ যতই উন্নতি করুক, যতই আলীশান ইমারত ও প্লাজা তৈরি করুক, যত মোবাইল কানে লাগিয়ে ঘুরতে থাকুক। একদিন ধ্বংস ও বিপর্যয়ের করাল গ্রাসে পতিত হবে।’
প্রসঙ্গত বলতে হয়, নিবন্ধকার যদিও তার নিজের দেশ সম্পর্কে কথাগুলো বলেছেন কিন্তু সচেতন ব্যক্তি মাত্রই উপলব্ধি করেন যে, বাস্তবতার যে ভয়াবহ রূপ এই নিবন্ধে তুলে ধরা হয়েছে তার সঙ্গে আমাদের দেশের চিত্রের খুব বেশি অমিল নেই। তবে মোবাইল ফোন হচ্ছে যোগাযোগের একটি মাধ্যম মাত্র। এটির ভালো-মন্দ নির্ভর করে ব্যবহারকারীর উপর। প্রযুক্তির এই সুবিধাগুলো গ্রহণ করে আমরা আমাদের জীবনযাত্রাকে সহজ করতে পারি, আমাদের মূল্যবান সময় সাশ্রয় করতে পারি, কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে যে জাতির চারিত্রিক ও আদর্শিক পতন ঘটে সে জাতির কাছে যতই উন্নত উপায় উপকরণ থাকুক না কেন তা তাদের উন্নতি ও সমৃদ্ধির পরিবর্তে অবক্ষয় ও পতনকেই ত্বরান্বিত করে। নিবন্ধকার সত্যিই বলেছেন যে, এগুলো প্রয়োজন উন্নত বিশ্বের, আমাদের মতো অনুন্নত দেশগুলোতে এগুলো বরং বিনোদনের সামগ্রী। এখন আমরা যদি এই পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পেতে চাই, তাহলে আমাদের নৈতিক ও আদর্শিক উন্নতি অপরিহার্য। আর এর জন্য আমাদেরকে ইসলামের পথে ফিরে আসতে হবে। সেজন্য আলেম ও দ্বীনদার শ্রেণীকে দাওয়াতের ময়দানে আরো জোর কদমে এগিয়ে আসতে হবে। সেই সাথে সরকারের পরিচালনায় যারা রয়েছেন তাদের কর্তব্য হল, মোবাইলের এই অপব্যবহার থেকে কীভাবে জাতিকে বাচানো যায়, সে সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা, প্রয়োজনে আইন প্রণয়ন করে তা বাস্তবায়ন করা। যেমন গভীর রাত্রে ফোন কোম্পানিগুলো বিল কমিয়ে দেয়। এর ফলে দেশের যুব সমাজ রাত্রের ঘুম নষ্ট করে কথা বলে, ফলে তাদের শরীর-স্বাস্থ্য নষ্ট হয়, দিনের বেলা কাজের উদ্যম হারিয়ে যায়। তাই আইন করে এ ধরনের ব্যবস্থা বন্ধ করা উচিত। তদ্রূপ মোবাইলের ইন্টারনেটে অশ্লীল ও ক্ষতিকর সাইটগুলো ঢুকতে না দেওয়া, পরিচয় পত্রহীন কোনো সীম যাতে ব্যবহার না হয়, তা নিশ্চিত করা ইত্যাদি। #