কওমী মাদরাসা-প্রসঙ্গ : এই গৃহেরও একজন কর্তা আছেন
কওমী মাদরাসার বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন অপপ্রচার এবং এই সব প্রতিষ্ঠান ও এর ছাত্র-শিক্ষকদের ব্যাপারে দায়িত্বহীন সমালোচনা একশ্রেণীর সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীর চিরাচরিত অভ্যাস। দুঃজনকভাবে কোনো কোনো দায়িত্বশীল ব্যক্তির দ্বারাও এই ধরনের কাজকর্ম সংঘটিত হয়ে যায়। বর্তমান সরকারের আইনমন্ত্রীর বহুল সমালোচিত উক্তিটি এর একটি সাম্প্রতিক দৃষ্টান্ত। অবশ্য পরে প্রতিবাদের মুখে তিনি ‘ব্যাখ্যা’ প্রদান করতে চেয়েছেন এবং প্রধানমন্ত্রীও তার মন্তব্যে উষ্মা প্রকাশ করেছেন এবং মৃদু ভৎর্সনা করেছেন। পরিস্থিতি শান্ত করার জন্য কওমী মাদরাসার প্রতিনিধিত্বশীল আলিমদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকও হয়েছে। আমরা আশা করতে চাই, কওমী মাদরাসার বিরুদ্ধে সব ধরনের হয়রানি বন্ধ করা হবে।
কওমী মাদরাসাগুলোর বিরুদ্ধে এ ধরনের বিষোদগারের কারণ কী? ইসলাম-বিদ্বেষ, না কি ইসলামী শিক্ষা ও আদর্শের সঠিক উপস্থাপনার প্রতি অসহিষ্ণুতা? নাকি কওমী মাদরাসার লক্ষ্য উদ্দেশ্য, ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং এর কর্ম ও অবদান সম্পর্কে অজ্ঞতাই এসবের কারণ? যদি-আল্লাহ না করুন-কারণ প্রথম দু’টোর কোনো একটি হয় তাহলে বিশেষ কিছু বলার নেই। কেননা ইসলামের সঙ্গেই যাদের বিদ্বেষ তারা যে ইসলামের সকল বিষয়েই বিদ্বেষ আচরণ করবে তা তো বলাই বাহুল্য। তদ্রূপ প্রতিযুগের মুলহিদ ও মুতাজাদ্দিদ শ্রেণীরও (যারা ইসলামের অত্যন্ত মারাত্মক বর্ণচোরা শত্রু) আহলে হক ও আহলে ইস্তিকামাতের প্রতি বিদ্বেষ অত্যন্ত প্রাচীন। তবে কারণ যদি তৃতীয় বিষয়টি হয় তাহলে কওমী মাদরাসার পরিচয়-লক্ষ্য কর্ম পদ্ধতি এবং ইতিহাস-ঐতিহ্য-অবদান সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনার মাধ্যমে তাদের অজ্ঞতা দূর করা প্রয়োজন। তদ্রূপ দ্বীন, ইলমে দ্বীন ও আলিম-উলামার সঙ্গে মহববত পোষণকারী সহজ-সরল জনগণকে বিভ্রান্তি থেকে রক্ষা করার জন্য দ্বীনী মাদরাসা বিশেষত কওমী মাদরাসা সম্পর্কে প্রচারিত অভিযোগগুলোর স্বরূপ উন্মোচন করারও প্রয়োজন রয়েছে। এ প্রসঙ্গে আলিমরা লিখছেন, এই পত্রিকাতেই এ বিষয়ে লেখা আসবে ইনশাআল্লাহ।
প্রধানমন্ত্রীর ওই বৈঠকের কিছু বিষয় পাঠকবৃন্দের সামনে পেশ করছি, যা দৈনিক পত্র-পত্রিকার রিপোর্টে না আসলেও নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে।
১. প্রধানমন্ত্রী বৈঠকের শুরুতেই বলেছেন যে, ‘আমার বিশ্বাস, ক্ষমতা আল্লাহ তাআলাই দান করেন এবং আল্লাহ তাআলাই মানুষকে ক্ষমতাহীন করেন।’
এই আকীদা পুরোপুরি তাওহীদের আকীদা। কুরআন মজীদে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন-(তরজমা) বল, হে আল্লাহ, সারাজাহানের অধিপতি! তুমি যাকে ইচ্ছা রাজত্ব দান কর আর যার কাছ থেকে ইচ্ছা রাজত্ব ছিনিয়ে নাও এবং যাকে ইচ্ছা সম্মান দান কর আর যাকে ইচ্ছা অপমানে পতিত কর। তোমারই হাতে রয়েছে যাবতীয় কল্যাণ। নিশ্চয়ই তুমি সর্ববিষয়ে ক্ষমতাশীল। তুমি রাতকে প্রবেশ করাও দিনে আর দিনকে রাতে এবং তুমি জীবিতকে বের মৃত থেকে আর মৃতকে জীবিত থেকে এবং তুমি যাকে ইচ্ছা হিসাব ... রিযিক প্রদান কর।-সূরা আল ইমরান : ২৬-২৭।
সত্যসত্যই যদি কোনো দেশের নেতৃত্ব এই বিশ্বাস পোষণ করে এবং তা তার উচ্চারণ ও আচরণকেও নিয়ন্ত্রণ করে তবে তো তার পক্ষে ইনসাফ-পরিপন্থী কোনো কিছু করা, ইসলামী বিধানের পরিপন্থী কোনো কিছু করা অসম্ভব। আর সেক্ষেত্রে তার নেতৃত্ব ধ্বংস হওয়াও অসম্ভব। হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে-‘আসলিম তাস্লাম’ ইসলাম গ্রহণ কর নিরাপত্তা লাভ করবে।
ইসলামী বিধানকে সমর্পিত চিত্তে গ্রহণ করার মাঝেই নিজের ও নিজের নেতৃত্বের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা রয়েছে।
২. প্রধানমন্ত্রী কওমী মাদরাসা সম্পর্কে স্বস্তি প্রকাশ করেছেন এবং স্বীকার করেছেন যে, কওমী মাদরাসার উপর আরোপিত জঙ্গিবাদের অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। তবে তিনি একথাও বলেছেন যে, ‘দেখুন একটি বা দুটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে সকল মাদরাসা এবং গোটা মুসলিম উম্মাহর বদনাম করা হচ্ছে। এই দুর্নাম ঘুচানোর পন্থা কী হতে পারে সে বিষয়ে আপনারা আমাকে পরামর্শ দিন।’
আমাদের জানা নেই, এক-দুইটি ঘটনা বলতে তিনি কোন ঘটনাকে বুঝিয়েছেন। আমরা তো কোনো কওমী মাদরাসা সম্পর্কেই সন্ত্রাস বা জঙ্গিবাদের অভিযোগ প্রমাণিত হতে দেখিনি। এ প্রসঙ্গে যত প্রচার-প্রচারণা সবই মিডিয়ার নিজস্ব উৎপাদন। এরপরও যদি কওমী মাদরাসার শত শত বছরের ইতিহাসে প্রধানমন্ত্রী শুধু দু’ একটি ঘটনার সন্ধান পেয়ে থাকেন তাহলে সেটা কি উল্লেখযোগ্য কোনো বিষয়? যদি এই দু’একটি বিচ্ছিন্ন
(ও সন্দেহযুক্ত) ঘটনার ভিত্তিতেই কোনো শ্রেণী সকল কওমী মাদরাসা ও গোটা মুসলিম উম্মাহকে অভিযুক্ত করে বসে তাহলে সরকারের কর্তব্য হয়ে যায় যে, তাদের অন্যায় অপপ্রচার নিয়ন্ত্রণ করা, যেন তারা দলীল প্রমাণ ছাড়া কাউকে অভিযুক্ত করতে না পারে এবং বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনাকে ছুতা বানিয়ে ব্যাপক প্রোপাগান্ডার সাহস না করে।
দ্বিতীয় কর্তব্য এই যে, যখন সরকারের দায়িত্বশীল মহলই এ বিষয়ে সচেতন যে, এগুলো মিথ্যা প্রচারণা তখন তাদের কর্তব্য হল, এইসব প্রোপাগান্ডায় প্রভাবিত না হওয়া এবং এর উপর ভিত্তি করে কওমী মাদরাসা বিরোধী কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ না করা।
৩. মাদরাসার নেসাব-নেযাম (সিলেবাস-ব্যবস্থাপনার) বিষয়টিও আলোচনা এসেছে। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী পরিষ্কার বলেছেন যে, ‘এ বিষয়ে আমাদের কোনো অভিজ্ঞতা নেই। এটা আপনারই নির্ধারণ করবেন।’
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, নিজের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার বাইরে মতামত প্রদান করা কারো পক্ষেই উচিত নয়। এটি একটি সর্বজনস্বীকৃত মূলনীতি এবং সাধারণ ভদ্রতা ও শরাফতেরও দাবি।তাই আমরা আশার করতে চাই, প্রধানমন্ত্রী যা বলেছেন বাস্তবেও তার প্রতিফলন ঘটবে।
কওমী মাদরাসার বিষয়ে কওমী মাদরাসার ব্যক্তিরাই ভালো জানেন। এ বিষয়ে তাঁদের সিদ্ধান্তই হবে সঠিক ও গ্রহণযোগ্য। এতে সরকার বা অন্য কোনো মহলের অযাচিত অনুপ্রবেশ মোটেই কাম্য নয়। উপরোক্ত নীতি অনুসরণ করা হলে, আমরা আশা করি, তা যেমন জনগণের জন্যও কল্যাণকর হবে তেমনি সরকারের জন্যও। পক্ষান্তরে এর বিরোধীতা করে মাদরাসাসমূহের নিজস্ব বিষয়ে নাক গলানোর চেষ্টা করা হলে, কিংবা মিথ্যা প্রোপাগান্ডায় প্রভাবিত হয়ে মাদরাসার বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হলে আমরা খাজা আবদুল মুত্তালিবের মতো শুধু এটুকুই বলব যে, ‘এই গৃহেরও একজন কর্তা আছেন, তিনিই একে রক্ষা করবেন।’
এতে তো কোনো সন্দেহ নেই যে, মসজিদ-মাদরাসাগুলো খানায়ে কাবারই শাখা, খানায়ে কাবার সঙ্গেই এদের সম্পর্ক। এজন্য মসজিদ-মাদরাসার বিষয়ে যে কোনো পদক্ষেপের আগে সূরায়ে ফিল তেলাওয়াত করা উচিত এবং দাম্ভিক আবরাহার পরিণাম ভেবে নেওয়া উচিত। #