প্র চা র ণা : সালিশী রায়েও ফতোয়ার রঙ
কয়েকটি পত্রিকায় প্রথম কিংবা শেষ পাতায় গুরুত্ব দিয়ে একটি খবর ছাপা হয়েছে গত ২৬ মে মঙ্গলবার। খবরটির একটি শিরোনাম হচ্ছে : ফতোয়াবাজদের দোররায় ক্ষতবিক্ষত রহিমা এখন ঢাকা মেডিকেলে। সুচিকিৎসার জন্য প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ।’ বাসস পরিবেশিত খবরে জানা গেল, দাউদকান্দির রহিমা আক্তারকে ২২ মে ৩৯টি দোররা মারা হয়। এতে এসে মারাত্মক আহত হলে তাকে গৌরীপুর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এ খবর পত্রিকায় প্রকাশিত হলে তা প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টিতে পড়ে। এরপর তার নির্দেশে আহত রহিমাকে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি করানো হয়।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের দু’জন কর্মকর্তা গিয়ে তার চিকিৎসার খোঁজখবর নিয়েছেন। রহিমার ৬ বছরের পিতৃপরিচয়হীন ছেলেটিও মায়ের সঙ্গেই হাসপাতালের বেডে আশ্রয় নিয়েছে। কোনো কোনো পত্রিকায় রহিমার ছবিও ছাপা হয়েছে। একটি তথাকথিত ‘ফতোয়াবাজির’ ঘটনা উদঘাটন করতে পারায় এ খবরটি প্রচারে বেশকিছু সংবাদপত্র বাড়তি উৎসাহ দেখিয়েছে।
ঘটনার বিবরণে জানা গেছে, ৭ বছর আগে কুমারী রহিমা গর্ভবতী হয়ে একটি পুত্র সন্তান জন্ম দেয়। এজন্য সে স্থানীয় চুন্নু মিয়ার ছেলে আব্দুল করীমকে দায়ী করে, কিন্তু আবদুল করীমের অস্বীকৃতি বিষয়টিকে দরবার পর্যন্ত গড়িয়ে নিয়ে যায়। একটি সংবাদপত্রে লেখা হয়েছে : ‘অবশেষে গত শুক্রবার নোয়াগাঁও মোল্লাবাড়ি মাদ্রাসা প্রাঙ্গনে দুই থেকে তিনশ লোকের উপস্থিতিতে এক ‘ফতোয়াবৈঠক’ অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকের সভাপতি স্থানীয় বানিয়াপাড়ার মাওলানা আবুল কাশেম ও নৈইয়ারের মাওলানা রুহুল আমীনসহ কয়েকজন ‘আলেমের নির্দেশ’ পেয়ে আবদুল করীম পবিত্র কুরআন শরীফ মাথায় নিয়ে রহিমার সঙ্গে তার মেলামেশার কথা অস্বীকার করে। আবদুল করীমকে আলেমরা নিরপরাধ ঘোষণা করেন। তারা রহিমা আক্তারকে দোষী সাব্যস্ত করে ৩৯টি দোররা মারার হুকুম দেন।’
উপরোক্ত রিপোর্টে ব্যবহৃত শব্দ ‘ফতোয়া বৈঠক’ মাওলানা’ ও ‘আলেমদের নির্দেশ’ কথাগুলো একটি গদের মতো উল্লেখ হয়েছে। গ্রাম্য দরবার ও সালিশ ছাড়া কোনো বৈঠকে দুই-তিনশ লোক হওয়ার কথা নয়। অন্তত ফতোয়া কোনো বৈঠকে দেওয়া হয় কিংবা ‘ফতোয়া বৈঠক’ নামে কোনো বৈঠকের রেওয়াজ এ দেশে আছে বলে আর শোনা যায়নি। গ্রাম্য মাতবরদের মাঝেই কাউকে ‘মাওলানা’ এবং কতকের নির্দেশকে ‘আলেমদের নির্দেশ’ বলে চালিয়ে দেওয়ার প্রবণতাটি এখন বেশি দেখা যাচ্ছে। আর সেখানে মানবাধিকার ও নারী অধিকার নিয়ে কিছু প্রশ্ন তুলতে পারলে তো কথাই নেই। মাওলানা-মৌলবী সাহেবদের জড়িয়ে আলেমসমাজের বিরুদ্ধে বিষোদগারের একটি ছুতা আবিষ্কার হয়ে যায়। ৩১ মে-এর দৈনিক নয়াদিগন্ত এবং ১ জুন দৈনিক ইনকিলাবে এই বিষয়টির উপর একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে পরিষ্কার বলা হয়েছে যে, কোনো আলেম উক্ত সিদ্ধান্ত দেননি এবং দশজন স্থানীয় মাতবর ঐ সিদ্ধান্তের উপর স্বাক্ষর করেছেন। সেখানে কোনো আলেমের স্বাক্ষর নেই।
সমাজে মানবতা বিনাশী ব্যভিচারের পথ বন্ধ হওয়া সুস্থ বিবেকের অধিকারী যে কোনো মানুষই কামনা করেন। এজন্য আইন হাতে তুলে নেওয়া কিংবা এককভাবে কেবল কোনো নারীকেই দোষী সাব্যস্ত করে বিচারিক শাস্তি দিয়ে দেওয়ার পক্ষে কেউ থাকতে পারে না। সেখানে যা ঘটেছে তা ফতোয়ার কারণে ঘটেনি। ঘটেছে স্থানীয় মাদবর-মোড়লসহ প্রভাবশালী লোকজনের সালিশী রায়ের কারণে। এটার উপর ফতোয়ার রঙ চড়িয়ে দিলে ইসলামী অনুশাসনের মাহাত্ম নিয়ে কিছুটা টানা-হেঁচড়া করার সুযোগ বের হয়ে আসে বলেই এক শ্রেণীর সংবাদপত্রের উদ্দেশ্যমূলক ও অতিউৎসাহী আচরণ এ ঘটনাটিকে কেন্দ্র করে প্রকাশ পেয়েছে মনে করলে ভুল হবে না। #