নেক কাজে সহযোগিতা
দাম্পত্য ও সামাজিক জীবনে পরস্পর সহযোগিতা অতি গুরুত্বপূর্ণ। তবে তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হল সহযোগিতার ক্ষেত্র সঠিক হওয়া। কুরআন মজীদে এ বিষয়টি স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। তরজমা : ‘আর তোমরা সৎকাজ ও আল্লাহভীতিতে পরস্পরের সহযোগিতা কর। পাপকাজ ও সীমালঙ্ঘনে একে অন্যের সহযোগিতা করো না।’-সূরা মাইদা : ২
বিভিন্ন সামাজিক কাজকর্মে অংশগ্রহণ, সহযোগিতা, সমর্থন ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রেই এই মূলনীতি অনুসরণীয়। ইসলামের দৃষ্টিতে কোন কাজগুলো সৎ কাজও আল্লাহ-ভীতি আর কোনগুলো পাপকাজ ও সীমালঙ্ঘন তা কম বেশি সবারই জানা আছে। অস্পষ্ট ও জটিল বিষয়ে হক্কানী উলামায়ে কেরামের সহযোগিতা নেওয়া যায়।
এখানে লক্ষ্যণীয় বিষয় এই যে, সাহায্য-সহযোগিতার ক্ষেত্রে স্বজনপ্রিয়তা, আঞ্চলিকতা, গোত্রপ্রীতি কিংবা এ জাতীয় অন্য কোনো প্রেরণায় দুর্বল না হয়ে দৃঢ়ভাবে ন্যায় অবলম্বন করাই হল উপরোক্ত নীতির মূলকথা। উল্লেখিত আয়াতের শানে নুযুল তা আরো জোরালোভাবে উপস্থিত করে। আল্লামা শাববীর আহমদ উসমানী রাহ. লেখেন, ‘যুলকা’দাহ মাসে প্রায় দেড় হাজার সাহাবীসহ প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উমরা আদায়ের উদ্দেশ্যে মদীনা শরীফ হতে রওয়ানা দেন। তাঁরা হুদাইবিয়া পর্যন্ত পৌঁছুলে মুশরিকরা তাদেরকে বাধা দেয়। তাঁরা ইহরামের অবস্থা, পবিত্র কা’বার মর্যাদা, পবিত্র মাস, কুরবানীর পশু ও তার বিশেষ চিহ্ন (কিলাদা) কোনো কিছুর প্রতিই ভ্রূক্ষেপ করেনি। আল্লাহ তাআলার নিদর্শনাবলির এ অবমাননা ও দ্বীনী কার্য সম্পাদনে বাধা দানের কারণে এরূপ যালিম ও বর্বর সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে মুসলিমগণ যে পরিমাণই ক্ষোভ ও উত্তেজনা প্রদর্শন করত তা ন্যায়সঙ্গত ছিল এবং প্রতিশোধ স্পৃহায় উত্তাপিত হয়ে যে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণের অবকাশ ছিল। কিন্তু ইসলামের ভালবাসা ও শত্রুতা উভয়ই ন্যায়-নিক্তিতে পরিমিত। কুরআন মজীদ এরূপ যালিম ও স্বেচ্ছাচারী সম্প্রদায়ের মুকাবিলার ক্ষেত্রেও নিজ আবেগ-উত্তেজনা সংযত রাখতে নির্দেশ দিয়েছে। ভালবাসা ও শত্রুতার আতিশয্যে মানুষ সাধারণত সীমালঙ্ঘন করে বসে। তাই বলা হয়েছে, শত্রুতা যতই প্রচন্ডতর হোক তার কারণে তোমরা যেন সীমা লঙ্ঘন না করে ফেল এবং ন্যায়-নীতি বিসর্জন না দাও।’’-তাফসীরে উছমানী, অনুদিত ১/৪৮৭-৪৮৮
নেক কাজে অংশগ্রহণকারীদের প্রাপ্তি সম্পর্কে কিছু ধারণা নিম্নোক্ত হাদীসগুলো থেকে করা যায়।
দান-সদকা সম্পর্কিত একটি হাদীসে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, তরজমা : ‘আমানতদার মুসলিম খাজাঞ্চি যদি মালিকের আদেশ পালন করে অর্থাৎ যা তাকে প্রদান করতে বলা হয়েছে তা পরিপূর্ণভাবে ও সন্তুষ্ট চিত্তে প্রদান করে তবে সেও সদকাকারী হিসেবে গণ্য হবে।’-সহীহ মুসলি ১/৩২৯
অর্থাৎ কোনো ব্যক্তি যখন তার সম্পদ থেকে সদকা করে তখন সে যেমন সদকার ছওয়াব পায় তেমনি এই নেক আমলে যারা তার সহযোগী হয় তারাও বঞ্চিত হয় না। গোটা কাজটি যেহেতু কয়েকজনের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়েছে তাই সবাই এতে শামিল এবং আল্লাহর দরবারে সবাই ‘সদকাকারী’ হিসেবে গণ্য। তবে এর জন্য যে বিষয়গুলো অপরিহার্য তা উপরোক্ত হাদীসে বলে দেওয়া হয়েছে। তা হচ্ছে :
১. মুসলিম হওয়া। কেননা, অমুসলিমের নিয়তের কোনো মূল্য নেই।
২. আমানতদার হওয়া
৩. যা প্রদান করতে বলা হয়েছে তা পূর্ণরূপে প্রদান করা।
৪. সন্তুষ্টচিত্তে প্রদান করা।
প্রসঙ্গত, অনেক সময় দেখা যায়, সম্পদের মালিক দান করতে ইচ্ছুক কিন্তু অধীনস্তদের পক্ষে তা বরদাশ্ত করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। উপরোক্ত হাদীসে এই ব্যধির উপশম রয়েছে। দানকারী যেমন ছওয়াবের আশায় দান করতে চাইছেন তেমনি অধীনস্তও যদি চিন্তা করেন যে, এটা তো আমার জন্যও সুবর্ণ সুযোগ, ইখলাসের সঙ্গে সহযোগিতা করে আমিও এই নেক আমলে শামিল হতে পারি তবে এটা তার কষ্টের বিষয় থাকবে না, আনন্দের বিষয়ে পরিণত হবে।
দ্বিতীয় দৃষ্টান্ত : জিহাদ সংক্রান্ত এক হাদীসে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তরজমা : ‘আল্লাহ তাআলা একটি তীরের বদৌলতে তিন জনকে জান্নাতে দাখিল করবেন : তীরের কারিগরকে, যে তা ছওয়াবের আশায় প্রস্ত্তত করে। তীর নিক্ষেপকারীকে এবং তীর প্রদানকারীকে।’-সুনানে তিরমিযী ১/২৯৩; সুনানে ইবনে মাজাহ পৃ. ২০৭
তৃতীয় দৃষ্টান্ত : গৃহস্থালী বিষয়ক এক হাদীসে আছে, ‘নারী যখন তার গৃহের কিছু খাবার দান করে এবং সে তাতে (সম্পদ) বিনষ্টকারীনী না হয় তবে এর বিনিময়ে সে নিজেও ছওয়াব প্রাপ্ত হয়, কেননা, সে দান করেছে। তার স্বামীও ছওয়াবপ্রাপ্ত হয়। কেননা, সে উপার্জন করেছেন এবং খাজাঞ্চিও ছওয়াব লাভ করে।’-সহীহ মুসলিম ১/৩২৯
মোটকথা, একটি নেক আমল যত জনের মাধ্যমে পূর্ণতায় পৌঁছে সবাই তাতে শরীক এবং সবাই ওই নেক আমলের দ্বারা ছওয়াব লাভ করে। সে অংশগ্রহণ যে পর্যায়েরই হোক না কেন এবং বাহ্য দৃষ্টিতে তা যত সামান্যই হোক না কেন। ইখলাসের সঙ্গে ছওয়াবের আশায় নেক কাজে শামিল হলে অবশ্যই সে এর বিনিময় মহান আল্লাহ রাববুল আলামীনের নিকটে লাভ করবে। আল্লাহ পাক আমাদেরকে তাওফীক দিন। #